কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা ১ম পর্ব;
সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী রহঃ
অনুবাদঃ গোলাম সোবহান সিদ্দিকী।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন বিশ্ব মানবতার মুক্তি-সনদ। মানব জীবনের সকল সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের মুলনীতি এতে নিহিত। সর্বকালের সর্বযুগের শ্রেষ্ঠতম জ্ঞান-ভান্ডার এ মহাগ্রন্থ আরবী ভাষায় অবতীর্ণ। অনেক পারিভাষিক শব্দ ও এতে ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী ভাষার জ্ঞান ছাড়া পারিভাষিক শব্দগুলাের সঠিক তাৎপর্য উপলব্ধি করা কুরআনের শিক্ষা হৃদয়ঙ্গম করার জন্যে একান্ত অপরিহার্য।
কুরআনে ব্যবহৃত পারিভাষিক শব্দগুলাের মধ্যে ইলাহ, রব, দ্বীন ও ইবাদত অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। বর্তমান শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তানায়ক সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (র) 'কুরআন কি চার বুনিয়াদী এসতেলাহ্যাঁয়' নামক গ্রন্থে এ চারটি পরিভাষা নিয়েই জ্ঞানগর্ভ ও বিস্তারিত আলােচনা পেশ করেছেন। গ্রন্থটি তিনি ১৯৪১ সালে উর্দু ভাষার রচনা করেন। এটি ইতিমধ্যেই বিশ্বের প্রধান কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়ে বিভিন্ন ভাষার লােকদের কুরআন মজীদ বােঝা ও হৃদয়ঙ্গম করার পথ সুগম করে দিয়েছে। বাংলা ভাষায় এর অনুবাদ করেছেন সুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক জনাব গােলাম সােবহান সিদ্দিকী। কুরআনকে বােঝার ব্যাপারে বইটি বাংলা ভাষা পাঠক পাঠিকা মহলে এক অমূল্য সম্পদ হিসাবে বিবেচিত হবে বলে আশা করি।
প্রকাশক
বিষয় সূচী
সূচনা
পরিভাষা চতুষ্টয়ের গুরুত্ব
ভুল ধারণার মূল কারণ
ভুল ধারণার ফল
ইলাহ
আভিধানিক তত্ত্ব
ইলাহ সম্পর্কে জাহেলী যুগের ধারণা
ইলাহ বনাম ক্ষমতা
কুরআনের যুক্তি
রব
আভিধানিক তত্ত্ব
কুরআনে রব শব্দের ব্যবহার
রুবুবিয়াত সম্পর্কে পথভ্রষ্ট জাতিসমূহের ভ্রান্ত ধারণা
নূহ (আ)-এর জাতি
আদ জাতি।
সামূদ জাতি
ইবরাহীম (আ)-এর জাতি ও নমরূদ
লূত জাতি
শােয়াইব জাতি
ফিরাউন ও তার জাতি
ইহুদী ও খৃস্টান
আরব মুশরিক সমাজ
কুরআনের দাওয়াত
ইবাদাত
আভিধানিক তত্ত্ব
কুরআনে ইবাদাত শব্দের ব্যবহার
ইবাদাত-দাসত্ব-আনুগত্য অর্থে
ইবাদাত-আনুগত্য অর্থে
ইবাদাত-পূজা অর্থে
ইবাদাত-বন্দেগী-আনুগত্য-পূজা অর্থে
দ্বীন
আভিধানিক তত্ত্ব
কুরআনের দীন শব্দের ব্যবহার
দ্বীন প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থে
দ্বীন তৃতীয় অর্থে
দ্বীন চতুর্থ অর্থে
দ্বীন একটি ব্যাপক পরিভাষা
সুচনা :
:ইলাহ, রব, দ্বীন ও ইবাদত -কুরআনের পরিভাষায় এ চারটি শব্দ মৌলিক গুরুত্বের অধিকারী। কুরআনের সার্বিক দাওয়াত এই যে, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই একক রব ও ইলাহ
; তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই, নেই কোন রব। উলুহিয়্যাত ও রুবুবিয়্যাত -এ কেউ তাঁর শরীক নেই। সুতরাং তাঁকেই তোমাদের ইলাহ ও রব মেনে নাও; তিনি ব্যতীত অন্য সকলের উলুহিয়্যাত - রুবুবিয়্যাতকে অস্বীকার করো। তাঁর ইবাদাত করো, তিনি ছাড়া অপর কারো ইবাদাত করো না। দীনকে একান্তভাবে তাঁর জন্যেই খালেস করো, অন্য সব দীনকে প্রত্যাখান করো।
وَ مَاۤ اَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَّسُوْلٍ اِلَّا نُوْحِیْۤ اِلَیْهِ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنَا فَاعْبُدُوْنِ
আমরা তোমার পূর্বে যে রসূলই পাঠিয়েছি, তাকে ওহী দান করেছি, আমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। সুতরাং আমারই ইবাদাত করো। সূরা আল আম্বিয়াঃ ২৫
وَ مَاۤ اُمِرُوْۤا اِلَّا لِیَعْبُدُوْۤا اِلٰهًا وَّاحِدًاۚ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَؕ سُبْحٰنَهٗ عَمَّا یُشْرِكُوْنَ
এই ইলাহ’র ইবাদাত ব্যতীত তাদেরকে অপর কিছুর হুকুম দেয়া হয় নি, তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। তারা যে শরীক করেছে, তা থেকে তিনি মুক্ত।
সূরা তওবাঃ ৩১
اِنَّ هٰذِهٖۤ اُمَّتُكُمْ اُمَّةً وَّاحِدَةً ﳲ وَّ اَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُوْنِ
নিশ্চয়ই তোমাদের (অর্থাৎ সকল নবীর) এ দল একটি মাত্র দল আর আমি তোমাদের রব। সুতরাং আমার ইবাদাত করো।
সূরা আল-আম্বিয়াঃ- ৯২
قُلْ اَغَیْرَ اللّٰهِ اَبْغِیْ رَبًّا وَّ هُوَ رَبُّ كُلِّ شَیْءٍؕ
বল, আমি কি আল্লাহ ছাড়া অপর কোন রব তালাশ করবো? অথচ তিনিই হচ্ছেন সব কিছুর রব।
সূরা আল-আনআমঃ-১৬৪
فَمَنْ كَانَ یَرْجُوْا لِقَآءَ رَبِّهٖ فَلْیَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَّ لَا یُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهٖۤ اَحَدًا۠
সুতরাং যে ব্যক্তি আপন রব-এর সাক্ষাৎ লাভের আশা পোষণ করে, সে যেন ভাল কাজ করে এবং আপন রব-এর ইবাদাতে অন্য কাউকে শরীক না করে।
সূরা আল - কাহাফঃ ১১০
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِى كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطّٰغُوتَ ۖ
আল্লাহ্ র ইবাদাত করো এবং তাগুত-এর ইবাদাত থেকে বিরত থাকো-এ নির্দেশ দিয়ে আমরা প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে একজন রসূল প্রেরণ করেছি।
সূরা আন্ -নাহালঃ ৩৬
أَفَغَيْرَ دِينِ اللَّهِ يَبْغُونَ وَلَهُۥٓ أَسْلَمَ مَن فِى السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَإِلَيْهِ يُرْجَعُونَ
তবে কি তারা আল্লাহর দীন ব্যতীত অপর কোন দীন তালাশ করে? অথচ আসমান-যমীনে যা কিছু আছে, সব কিছু ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাঁর-ই অনুগত। তাদেরকে তাঁর নিকটেই ফিরে যেতে হবে।
সূরা আলে ইমরানঃ ৮৩
قُلْ إِنِّىٓ أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللَّهَ مُخْلِصًا لَّهُ الدِّينَ
বল, আল্লাহ্ র ইবাদাত করার জন্যে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, একান্তভাবে নিজের দীনকে তাঁরই জন্যে নিবেদিত করো।
সূরা আয-যুমারঃ ১১
إِنَّ اللَّهَ رَبِّى وَرَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ هٰذَا صِرٰطٌ مُّسْتَقِيمٌ
নিশ্চয় আল্লাহ আমার ও রব, তোমাদেরও রব। সুতরাং তোমরা তাঁরই ইবাদাত করো। এটাই সহজ সরল পথ।
সূরা আলে ইমরানঃ ৫১
উদাহরণ স্বরূপ এ কয়টি আয়াত পেশ করা হলো। কুরআন অধ্যয়নকারী প্রত্যেক ব্যক্তি প্রথম দৃষ্টিতেই অনুভব করবে যে, কুরআনের সমগ্র আলোচনাই এ চারটি পরিভাষাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের কোন্দ্রীয় চিন্তাধারা (Central idea) এইঃ
আল্লাহ্ হচ্ছেন রব ও ইলাহ্ ।
আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো রবুবিয়্যাত-উলুহিয়্যাতের অধিকার নেই।
সুতরাং কেবল তাঁরই ইবাদাত করতে হবে।
দীন হবে একনিষ্ঠ ভাবে তাঁরই জন্যে।
পরিভাষা চুতষ্টয়ের গুরুত্ব,
এটা স্পষ্ট যে, কুরআনের শিক্ষা অনুধাবন করার জন্যে পরিভাষা চুতষ্টয়ের সঠিক ও পরিপূর্ণ তাৎপর্য অনুদাবন করা একান্ত অপরিহার্য। ইলাহ শব্দের অর্থ কি, ইবাদাতের সংজ্ঞা কি, দ্বীন কাকে বলে- কোন ব্যক্তি যদি তা না জানে তবে তার কাছে সম্পূর্ণ কোরআনই অর্থহীন হয়ে পড়েবে। সে তাওহীদ জানতে পারবে না, শের্ক বুঝতে পারবে না, ইবাদাতকে একান্তভাবে আল্লাহ্ র জন্যে নিবেদিত করতে পারবে না, দ্বীনকে করতে পারবে না আল্লাহ্ র জন্যে নির্দিষ্ট। অনুরূপভাবে কারো মানসপটে যদি এ পরিভাষাগুলোর তাৎপর্য অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ থাকে, তাবে তার কাছে কুরআনের গোটা শিক্ষাই অস্পষ্ট থাকবে। কুরআনের প্রতি ঈমান রাখা সত্ত্বেও তার আকীদা ও আমল-বিশ্বাস ও কর্ম-উভয়ই থেকে যাবে অসম্পূর্ণ। সে মুখে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই বলবে আর তা সত্ত্বেও অনেককে ইলাহ বানাবে। ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোন রব নেই’ - মুখে এ কথা ঘোষণা করলেও কার্যত অনেকেই তার রব সেজে বসবে। সে একান্ত সদুদ্দেশ্যে বলবে, আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদাত করি না, কিন্তু এতদসত্ত্বেও আরো অনেক মাবুদের ইবাদাতেই সে মশগুল থাকবে। সে একান্ত জোর দিয়ে বলবেঃ আমি আল্লাহর দ্বীনে আছি, ‘অন্য কোনো দীনে আছে’ বলা হলে সে লড়তে উদ্যত হবে কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক দীনের শিকলই তার গলায় ঝুলবে। কোন গায়রুল্লাহ্ র জন্যে তার মুখ থেকে ‘ইলাহ’ ‘রব’ শব্দ তো কোন সময়ই বেরুবে না; কিন্তু যে অর্থের জন্যে এ শব্দগুলি গঠিত, সে প্রেক্ষিতে তার অনেক ইলাহ ও রব থাকবে। আর বেচারা জানতেও পারবে না যে , সে কার্যত আল্লাহ ছাড়াও বহু রব- ইলাহ বানিয়ে রেখেছে। তাকে যদি বলা হয়ঃ তুমি অন্যের ‘ইবাদাত’ করছো, ‘ দ্বীন’-এ শের্ক করছো, তা হলে প্রস্তর নিক্ষেপ করার জন্যে ছুটে আসবে, কিন্তু ইবাদাত ও দীনের তাৎপর্যের বিচারে সে কার্যত অন্যের ইবাদাত করছে, দ্বীন পালন করছে। সে জানতেও পারবে নাঃ আমি যা করছি, আসলে তা অন্যের ইবাদত ভিন্ন কিছুই নয়। যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় পতিত হয়েছে, তাকে গায়রুল্লাহর দ্বীন ব্যতীত আর কিছুই বলা যায় না।
ভুল ধারণার মূল কারণ
. আরবে যখন কুরআন পেশ করা হয়, তখন প্রত্যেকেই জানতো ইলাহ অর্থ কি, রব কাকে বলা হয়। কারণ তাদের কথাবার্তায় এ শব্দদ্বয় পূর্ব হতে প্রচলিত ছিল । তারা জানতো এ শব্দগুলোর অর্থ কি, কি এর তাৎপর্য। তাই তাদের যখন বলা হলো যে, আল্লাহ-ই একক রব ও ইলাহ, উলুহিয়্যাত ও রুবুবিয়্যাতে আদৌ কারো হিসসা নেই, তারা তখন ঠিক ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। স্পষ্টতই তারা বুঝতে পেরেছিল, অন্যের জন্যে কোন্ জিনিসটি নিষেধ করা হচ্ছে আর আল্লাহ্ র জন্যে কোন জিনিসটি করা হচ্ছে নিদিষ্ট। যারা বিরোধিতা করছিল, গায়রুল্লার উলুহিয়্যাত-রুবুবিয়্যাত অস্বীকৃতির আঘাত কোথায় কোথায় লাগে, তা জেনেশুনেই তারা বিরোধিতা করেছিল। এ মতবাদ গ্রহণ করে আমাদেরকে কি বর্জন করতে হবে আর কি গ্রহণ করতে হেব তা জেনেশুনেই তারা ঈমান এনেছিলো। অনুরূপভাবে ইবাদাত ও দ্বীন শব্দও তাদের ভায়ায় প্রচালিত ছিলো পুর্ব হতে। তারা জানতো, আব্দ কাকে বলে, উবদিয়্যাত কোন্ অবস্থার নাম। ইবাদাতের উদ্দেশ্য কোন্ ধরনের আচরণ, দ্বীনের তাৎপর্য কি? তাই তাদের যখন বলা হলো, সকলের ইবাদাত ত্যাগ করে আল্লাহ্ র ইবাদাত করো, সকল দ্বীন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর দীনে দাখিল হও, তখন কুরআনের দাওয়াত বুঝতে তাদের ভুল হয় নি। এ শিক্ষা আমাদের জীবন ব্যবস্থায় কোন্ ধরনের পরিবর্তন চায়, শোনামাত্রই তারা তা বুঝতে পেরেছিলো।
কিন্তু কুরআন অবতীর্ন হওয়ার সাময় এ শব্দগুলোর যে মৌল অর্থ প্রচালিত ছিল, পরবর্তী শতকে ধীরে ধীরে তা পরিবর্তিত হতে তাকে। শেষ পর্যন্ত এক- একটি শব্দ তার সম্পূর্ণ ব্যাপকথা হারিয়ে একান্ত সীমিত বরং অস্পষ্ট অর্থের জন্যে নিদিষ্ট হয়ে পড়ে। এর এক কারণ ছিলো আরবী ভাষার প্রতি সঠিক স্পৃহার অভাব, দ্বিতীয় কারণ ছিলো ইসলামী সমাজে যেসব ব্যক্তির উদ্ভব হয়েছে, তাদের কাছে ইলাহ, রব, দ্বীন, ইবাদাতের সে অর্থ অবশিষ্ট ছিলো না, যা কুরআন নাযিল হওয়ার সময় অমুসলিম সামজে প্রচলিত ছিলো। এ কারণে পরবর্তী কালের অভিধান ও তাফসীর গ্রন্থে অধিকাংশ কোরানিক শব্দের ব্যাখ্যা করা হয়েছে আভিধানিক অথ্যের পরিবর্তে এমন সব অর্থে যা পরবর্তী কালের মুসলমানরা বুঝতো। যেমনঃ
ইলাহ শব্দকে মূর্তি ও দেবতার প্রায় সমার্থক করা হয়েছে। লালন-পালন কর্তা বা পরওয়ারদেগার-এর প্রতিশব্দ করা হয়েছে রবকে, ইবাদাতের অর্থ করা হয়েছে পূজা-উপাসনা, ধর্ম, মযহাব এবং রিলিজিয়ান (Religion) -এর সমার্থজ্ঞাপক শব্দ করা হয়েছে দীনকে। তাগুত- এর তর্জমা করা হয়েছে মূর্তি বা শয়তান।
ফল দাঁড়ালো এই যে, কুরআনের মৌলিক উদ্দেশ্য অনুধাবন করাই লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়লো । কুরআন বলছে, ‘আল্লাহ ছাড়া কাউকে ইলাহ বানাবে না।’ লোকে মনে করছে, আমারা মূর্তি ও দেবতাকে ত্যাগ করেছি। সুতরাং কুরআনের উদ্দেশ্য পূর্ণ করেছি। অথচ ইলাহ এর অর্থ আরও যেসব ব্যাপারে প্রযোজ্য, তারা সে সবকে আঁকড়ে ধরে রয়েছে। গায়রুল্লাহকে যে ইলাহ বানাচ্ছে সে খবরও তাদের নেই। কোরআন বলছেঃ আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে রব স্বীকার করো না। লোকে বলছেঃ আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে আমরা পরওয়ারদেগার বলে স্বীকার করি না; সুতরাং আমাদের তাওহীদ পরিপুর্ণ হয়েছে। অথচ আরো যে সকল অর্থে রব শব্দ ব্যাবহৃত হয়, সে প্রেক্ষিতে অধিকাংশ ব্যক্তিই আল্লাহর পরিবর্ততে অন্যান্যের রুবুবিয়্যাত স্বীকার করে নিয়েছেন। কুরআন বলছেঃ তাগুত-এর ইবাদাত ত্যাগ করে শুধু আল্লাহর ইবাদাত কর। লোকেরা বলছেঃ আমরা মুর্তি পূজা করি না শয়তানের ওপর লানত করি, কেবল আল্লাহকেই সিজদা করি, সুতরাং আমরা কুরআনের এ দাবীও পূর্ণ করেছি। অথচ পাথরের মুর্তি ছাড়া অন্যান্য তাগুতকে তারা আঁকড়ে ধরে আছে, পূজা ব্যতীত অন্যান্য রকমের যাবতীয় ইবাদাত গায়রুল্লার জন্যে নিদিষ্ট করে রেখেছে। দীনের অবস্থাও তাই। আল্লাহর জন্যে দীনকে খালেস করার অর্থ মনে করা হয় শুধু এই যে, মানুষ ‘ইসলাম ধর্ম’ কবুল করবে, হিন্দু বা ইহুদী-খৃস্টান থাকবে না। এ ভিত্তিতে ‘ইসলাম ধর্মের সকল ব্যক্তিই মনে করে আমি দীনকে আল্লাহর জন্যে খালেস করে রেখেছি। অথচ দীন-এর ব্যাপকতর অর্থের দৃষ্টতে এমন ব্যক্তির সংখ্যাই বেশী, যাদের দীন আল্লাহর জন্যে খালেছ নয়।
ভুল ধারণার ফল,
এটা সত্য যে, কেবল এ চারটি মৌলিক পরিভাষার তাৎপর্যে আবরণ পড়ে যাওয়ার কারণে কুরআনের তিন-চুর্থাংশের চেয়েও বেশী শিক্ষা বরং তার সত্যিকার স্পিরিটই দৃষ্টি থেকে প্রচ্ছন্ন হয়ে যায়। ইসলাম কবুল করা সত্ত্বেও মানুষের আকীদা-আমল-বিশ্বাস ও কর্মে যে সকল ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছে, এটা তার অন্যতম প্রধান কারণ। সুতরাং কুরআনুল করীমের মৌলিক শিক্ষা এবং তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা একান্ত জরুরী ।
ইতিপূর্বে অনেক নিবন্ধে আমি এসব শব্দের তাৎপর্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এ যাবৎ আমি যা আলোচনা করেছি, একদিকে তা সকল ভ্রান্ত ধারণা অপনোদনের জন্যে যথেষ্ট নয়, অপরদিকে তা দ্বারা লোকদের পূর্ণ তৃপ্তি হতে পারে না। কারণ অভিধান ও কুরআনের আয়াত উল্লেখ ছাড়া লোকেরা আমার সকল ব্যাখ্যাকেই নিজস্ব মত বলে মনে করে। যারা আমার সাথে একমত নন, আমার মত অন্তত তাদের পরিতৃপ্তির কারণ হতে পারে না। আলোচ্য গ্রন্থে এ চারটি পরিভাষার পরিপূর্ণ অর্থ অত্যন্ত স্পষ্ট করে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। অভিধান ও কুরআনে প্রমাণ পাওয়া যায় না এমন কোন কথাই আমি এ গ্রন্থে বলবো না।
চলবে......!

0 Comments