Recent Tube

কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা ৩য় পর্ব; সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী রহঃ; অনুবাদঃ গোলাম সোবহান সিদ্দিকী। সম্পাদনায় শামীম আজাদ।

কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা ;
সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী রহঃ 

قُلْ أَرَأَيْتُم مَّا تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ أَرُونِي مَاذَا خَلَقُوا مِنَ الْأَرْضِ أَمْ لَهُمْ شِرْكٌ فِي السَّمَاوَاتِ........وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّن يَدْعُو مِن دُونِ اللَّهِ مَن لَّا يَسْتَجِيبُ لَهُ إِلَى يَومِ الْقِيَامَةِ. 

বল, আল্লাহ ব্যতীত যে সব মাবুদকে তোমরা অভাব পূরণের জন্যে ডাক, তাদের অবস্থা সম্পর্কে তোমরা কি কখনো চিন্তা করে দেখেছো? যমীনের কতটুকু অংশ তাদের সৃষ্টি বা আসমানের সৃষ্টিতে তাদের কতটুকু অংশ আছে, আমাকে একটু দেখাওতো!.... যারা আল্লাহকে ছেড়ে এমন সবকে ডাকে, যারা কিয়ামত পর্যন্ত তাদের ডাকে সাড়া দিতে পারে না, তাদের চেয়ে বেশী গোমরাহ আর কে হতে পারে ?১
 সূরা আহকাফঃ ৪-৫

(১)টিকা: (অর্থাৎ তাদের আবেদনের জবাবে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনা। ) 

لَوْ كَانَ فِيهِمَا آلِهَةٌ إِلَّا اللَّهُ لَفَسَدَتَا فَسُبْحَانَ اللَّهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُونَ 
لَا يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ 
আসমান- জমীনে যদি আল্লাহ ছাড়া আরও ইলাহ থাকতো, তবে বিশ্বের ব্যবস্থাপনা ওলট -পালট হয়ে যেতো। সুতরাং আল্লাহ, যিনি আরশ (অর্থাৎ বিশ্বের শাসন-ক্ষমতা) - এর মালিক, তাঁর সম্পর্কে ওরা যা কিছু বলছে, তা থেকে তিনি মুক্ত -পবিত্র । তিনি তাঁর কোন কাজের জন্যে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন; অন্য সকলেই (তাঁর কাছে) জবাবদিহি করতে বাধ্য।

 مَا اتَّخَذَ اللَّهُ مِن وَلَدٍ وَمَا كَانَ مَعَهُ مِنْ إِلَهٍ إِذًا لَّذَهَبَ كُلُّ إِلَهٍ بِمَا خَلَقَ وَلَعَلَا بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ
আল্লাহ কোন পুত্রও গ্রহণ করেন নি, তাঁর সাথে অন্য কোন ইলাহও নেই। যদি এমন হতো, তাহলে সকল ইলাহ তার নিজের সৃষ্ট বস্তু নিয়ে পৃথক হয়ে যেতো, আর একে অন্যের ওপর চড়াও হতো। 
সূরা আল-মুমিনুন -৯১

قُل لَّوْ كَانَ مَعَهُ آلِهَةٌ كَمَا يَقُولُونَ إِذًا لاَّبْتَغَوْاْ إِلَى ذِي الْعَرْشِ سَبِيلاً 
سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يَقُولُونَ عُلُوًّا كَبِيرًا
বল, আল্লাহ্‌র সাথে যদি অন্য ইলাহ হতো, যেমন লোকেরা বলছে, তাহলে তারা আরশ-অধিপতির রাজত্ব দখল করার জন্যে অবশ্যই কৌশল অবলম্বন করতো। তিনি পাক; ওরা যা বলছে, তা থেকে তিনি অনেক উর্ধে। 
সূরা বনী ইসরাইলঃ ৪২-৪৩

এ সকল আয়াতে আদ্যোপান্ত একই কেন্দ্রীয় ধারনা দেখতে পাওয়া যায়। আর তা এইঃ ইলাহিয়াত ও ক্ষমতা অবিচ্ছেদ্যভাব সম্পৃক্ত -ওতপ্রোতভাব জড়তি। স্পিরিট ও তাৎপর্যের দিক থেকে উভয়ই এক জিনিস। যার ক্ষমতা নেই, সে ইলাহ হতে পার না- ইলাহ হওয়া উচিৎ নয় তার। যার ক্ষমতা আছে, কেবল সে-ই ইলাহ হতে পারে- ইলাহ তাঁরই উচতি হওয়া। কারণ ইলাহর নিকট আমাদের যতো প্রকার প্রয়োজন রয়েছে, অন্য কথায়; যে সব প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে কাউকে ইলাহ স্বীকার করার আমাদের প্রয়োজন পড়ে, তার কোন একটি প্রয়োজনও ক্ষমতা ছাড়া পূরণ হতে পারে না। সুতরাং ক্ষমতাবিহীনের ইলাহ হওয়া অর্থহীন, অবান্তর। আর তার দিকে প্রত্যাবর্তন নিষ্ফল।

এ কেন্দ্রীয় ধারণাটি কোরআন যেভাবে উপস্থাপন করেছে, নিন্মোক্ত ধারায় তার ভুমিকা ও ফলাফল ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করা যায়।

একঃ অভাব পূরণ, জটিলতা দূরীকরণ, আশ্রয় দান, সাহায্য- সহযোগিতা প্রদান, তত্ত্বাবধান ও সংরক্ষণ এবং আহবানে সাড়া দান - এ সবকে তোমরা মামুলী কাজ মনে করছো, আসলে এগুলো কোন মামুলী কাজ নয়, বরং সমগ্র বিশ্ব-জাহানের সৃষ্টিধর্ম এবং ব্যবস্থাপনা শক্তির সাথে এ সবের যোগসূত্র নিহিত। তোমাদের সামান্যতম প্রয়োজন যেভাবে পূরণ হয়,তা নিয়ে চিন্তা করলে জানতে পারবে যে, আসমান যমীনের বিশাল কারখানায় অসংখ্য-অগণিত কার্য- কারণের সার্বিক ক্রিয়া ছাড়া তা পূরণ হওয়া অসম্ভব। তোমাদের পান করার এক গ্লাস পানি, আহার্যের একটি কণার কথাই চিন্তা করো; এ সামান্য জিনিস সরবরাহের জন্যে সূর্য, যমীন, বায়ু ও সমুদ্রকে কতো কাজ করতে হয়, তা আল্লাহ্‌ -ই জানেন। তবেই তো এসব জিনিস তোমাদের কাছে পৌছায়। সুতারাং তোমাদের দোয়া শ্রবণ এবং অভাব অভিযোগ দূরীকরণের জন্যে কোন মামুলী ক্ষমতা নয়,বরং এমন এক ক্ষমতা দরকার; আসমান-যমীনের সৃষ্টি, গ্রহ-নক্ষত্রের আবর্তন, বায়ু প্রবাহ এবং বারি বর্ষণের জন্যে-এক কথায়, সমগ্র বশ্বি-জাহানের পরিচালনা ও শৃংখলা বিধানের জন্যে যে ক্ষমতা দরকার।

দুইঃ এ ক্ষমতা অবিভাজ্য। সৃষ্টি করার ক্ষমতা একজনের হাতে থাকবে আর জীবিকা সরবরাহের ক্ষমতা থাকবে অন্য জনের হাতে, সূর্য একজনের অধিকারে থাকবে, যমীন অন্যজনের অধিকারে, সৃষ্টি করা করো ইখতিয়ারে থাকবে, সুস্থতা- অসুস্থতা অন্যকারো ইখতিয়ারে, জীবন ও মৃত্যু কোন তৃতীয় জনের ইখতিয়ারে- এটা কিছুতেই সম্ভব নয়। এমন হলে বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্হাপনা কিছুতেই চলতে পারতো না। সুতরাং সকল ক্ষমতা ইখতিয়ার একই কেন্দ্রীয় শাসকের অধিকারে থাকা একান্ত জরুরী। এমনটি হোক, তা বিশ্বজাহানের ব্যবস্থাপনারও দাবি। মূলত হয়েছেও তাই।

তিনঃ যেহেতু একই শাসকের হস্তে সমস্ত ক্ষমতা নিহিত, ক্ষমতায় বিন্দুমাত্র কারো কোন হিস্যা নেই, সুতরাং উলুহিয়াতও সর্বতোভাবে সে শাসনকর্তার জন্যেই নিদির্ষ্ট, তাতেও কেউ অংশীদার নেই। তোমাদের ফরিয়াদে সাড়া দিতে পারে, দোয়া কবুল করতে পারে-এমন ক্ষমতা কারো নেই। সুতরাং ইলাহর যে অর্থ-ই তোমাদের মানস-পটে আছে, তার প্রেক্ষিতে অন্য কোন ইলাহ নেই। এমন কি বিশ্ব-জাহানের নিয়ন্তা-পরিচালকের নৈকট্য লাভের প্রেক্ষিতে তার কিছুটা ক্ষমতা চলবে এবং তার সুপারিশ কবুল করা হবে-এ অর্থেও কোন ইলাহ নেই। তার রাজ্য পরিচালন ব্যবস্থায় কারও বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপের অধিকার নেই। তাঁর কার্যাবলীতে কেউ দখল দিতে পারে না। সুপারিশ কবুল করা না করা সম্পূর্ণ তাঁর ইখতিয়ারে। কারো এমন কোন ক্ষমতা নেই, যার ভিত্তিতে সে তার সুপারিশ কবুল করাতে পারে।

চারঃ একক সর্বোচ্চ ক্ষমতার দাবি এই যে, সার্বভৌমত্ব ও নেতৃত্ব কতৃর্ত্বের যত শ্রেণী বিভাগ আছে, একক সার্বিক ক্ষমতার অধিকারীর অস্তিত্বের মধ্যে তা সবই কেন্দ্রীভূত হবে। সার্বভৌমত্বের কোন অংশও অন্য কারো দিকে স্থানান্তরিত হবে না। তিনিই যখন স্রষ্টা, সৃষ্টি-কর্মে কেউ তাঁর শরীক নেই, রিজিকদাতা তিনি, রিজিক দানে কেউ তাঁর অংশীদার নেই, বিশ্ব জাহানের ব্যবস্থাপনায় তিনি একক চালক, ব্যবস্থাপক- পরিচালনায় কেউই তাঁর সাথে শরীক নেই। সুতরাং নির্দেশদাতা এবং আইনদাতা-বিধাদাতারও তিনিই। ক্ষমতার এ পর্যায়েও কারো অংশীদার হওয়ার কোন কারণ নেই। যেমনি করে তাঁর রাজ্যের পরিসীমায় অন্য কারো ফরিয়াদে সাড়া দানকারী, অভাব পুরণকারী এবং আশ্রয়দাতা হওয়া মিথ্যা, তেমনি করে স্বতন্ত্র নির্দেশদাতা, স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী নৃপতি এবং স্বাধীন আইন-বিধানদাতা হওয়াও ভুল-মিথ্যা। সৃষ্ট করা এবং জীবিকা দান, জীবন মৃত্যু দান, চন্দ্র সূর্যের বশীকরণ, রাত দিনের আবর্তন-বিবর্তন, পরিমাণ নির্ধারণ, নির্দেশ দান এবং একক রাজত্ব-কর্তৃত্ব, আইন বিধান দান- এ সবই হচ্ছে একক ক্ষমতা ও সার্বভৌমিকথার বিভিন্ন দিক। এ ক্ষমতা এবং সার্বভৌমত্ব অবিভাজ্য। কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহ্‌র নির্দেশের অনুমোদন ছাড়াই কাউকে আনুগত্যের যোগ্য মনে করে, তবে সে তেমনি শির্‌ক করে, যেমনি শির্‌ক করে গায়রুল্লার কাছে প্রার্থনাকারী ব্যক্তি। কোন ব্যক্তি যদি রাজনৈতিক অর্থে রাজাধিরাজ (مَالِكَ الْمُلْكِ) সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী এবং নিরংকুশ শাসক (حاکم علی الاطلاق) বলে দাবী করে, তবে তার এ দাবী সরাসরি আল্লাহ্‌র দাবীর অনুরূপ; যেমন, অতি-প্রাকৃতিক অর্থে কারো এ দাবী করা যে, আমিই তোমার পৃষ্ঠপোষক, কর্মকুশলী, সাহায্যকারী ও সংরক্ষক। এজন্যে যেখানেই সৃষ্টি বস্তুর পরিমাণ এবং বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনা পরিচালনায় আল্লাহকে লা-শরীক বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানেই له لحکم নির্দেশ দেয়ার অধিকার একমাত্র তাঁর (له الملک) বৈধ অধিকার কেবল তাঁরই এবং (لَم يَكُن لَّهُ شَرِيكٌ فِي الْمُلْكِ) কর্তৃত্ব-সার্বভৌমত্বে কেউই তাঁর শরীক নেই ইত্যাদিও বলা হয়েছে। এসব থেকে স্পষ্টই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, রাজত্ব-কর্তৃত্বের অর্থও উলুহিয়াত (الوھت) -এর তাৎপর্যের শামিল। এ অর্থের দিক থেকেও আল্লাহ্‌র সাথে অন্য কারো অংশীদারিত্ব স্বীকার না করা ইলাহর একত্বের জন্যে অপরিহার্য। নিন্মোক্ত আয়াতে এ কথাটি আরও স্পষ্ট করে ব্যক্ত করা হয়েছেঃ

قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاء وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاء وَتُعِزُّ مَن تَشَاء وَتُذِلُّ مَن تَشَاء
বল, হে আল্লাহ। রাজত্বের মালিক। যাকে খূশী রাজ্য দান কর, যার কাছ থেকে খুশী রাজ্য ছিনিয়ে নাও। যাকে ইচ্ছা ইজ্জত দান করো, যাকে খুশী অপদস্তকরো। 
সূরা আলে-ইমরান-২৬

فَتَعَالَى اللَّهُ الْمَلِكُ الْحَقُّ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْكَرِيمِ
সুতরাং প্রকৃত বাদশা আল্লাহ অতি মহান। তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। মহান আরশ-এর অধিকারী। 
সূরা আল-মুমিনূনঃ ১১৬

قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ 
مَلِكِ النَّاسِ 
إِلَهِ النَّاسِ
বল, মানুষের রব, মানুষের বাদশা, মানুষের ইলাহর নিকট আমি আশ্রয় প্রার্থনা করি। 
সূরা আন-নাস-১-৩

সূরায়ে আল মুমিন -এর ১৬ নং আয়াতে এর চেয়েও স্পষ্ট করে বলা হয়েছেঃ

যেদিন সব মানুষই আবরণ মুক্ত হবে, তাদের কোন রহস্যই আল্লাহ্‌র কাছে গোপন থাকবে না। আজ কার রাজত্ব? নিশ্চই একক মহাপ্রতাপশালী আল্লাহর।

অর্থাৎ যেদিন সকল মানুষের নেকাব খুলে ফেলা হবে, কারো কোন রহস্যই আল্লাহর কাছে গোপন থাকবে না, তখন ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করা হবেঃ আজ রাজত্ব কার? একমাত্র একক আল্লাহ্‌র, যাঁর ক্ষমতা সকলের ওপরে প্রবল-এ ছাড়া সেদিন অন্য কোন জবাব হবে না। ইমাম আহমদ (রঃ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ভাষণ দান প্রসঙ্গে বলেছেন : আসমান-যমীনকে মুষ্টি বদ্ধ করে আল্লাহ তায়ালা ডাক দিয়ে বলবেনঃ আমি বাদশা, আমি পরাক্রমশালী, আমি প্রবল প্রতিপত্তির অধিকারী, যমীনে যারা বাদশা সেজে বসেছিলো, তারা কোথায় প্রভাব-প্রতাপশালী দাম্ভিক নরপতিরা?

এ হাদীসটি আলোচ্য আয়াতের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যাখ্যা। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমন (রাঃ) বলেন-হুজুর (সঃ) যখন ভাষণে এ শব্দগুলো উচ্চারণ করছিলেন, তখন তাঁর দেহে এমন কম্পন হচ্ছিলো, আমরা আশংকা করছিলাম তিনি যেন মিম্বর থেকে পড়ে না যান! 
চলবে.....
------------------------------------------  

Post a Comment

0 Comments