খেলাফত ও রাজতন্ত্র
পর্ব-৪
তিনঃ আল্লাহর আইনানুগ সার্বভৌমত্ব,
এ সব কারণে কুরআন ফায়সালা করে যে, আনুগত্য হবে নিরঙ্কুশ ভাবে আল্লাহর আর অনুসরণ অনুবর্তন হবে তাঁর আইন-বিধানের; এটিই বাঞ্ছনীয়। তাঁকে বাদ দিয়ে অন্যদের অথবা নিজের নফসের খাহেশের অনুসরণ নিষিদ্ধঃ
إِنَّا أَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصًا لَّهُ الدِّينَ. أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ
(হে নবী) আমরা এ কিতাব যথাযথভাবে তোমার প্রতি নাজিল করেছি। সুতরাং দ্বীনকে আল্লার জন্য খালেছ করে তাঁর বন্দেগী করো। সাবধান! খালেছ দ্বীন আল্লারই জন্য।
সূরা যুমারঃ ২
قُلْ إِنِّي أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللَّهَ مُخْلِصًا لَّهُ الدِّينَ. وَأُمِرْتُ لِأَنْ أَكُونَ أَوَّلَ الْمُسْلِمِينَ
বল দ্বীনকে আল্লার জন্য খালেছ করে তাঁর বন্দেগী করার জন্য আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর আমাকে এ নির্দেশও দেয়া হয়েছে যে, আমিই যেন সর্বপ্রথম আনুগত্যের শির অবনতকারী হই।
সূরা আয-যুমারঃ ১১-১২
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولاً أَنِ اعْبُدُواْ اللّهَ وَاجْتَنِبُواْ الطَّاغُوتَ
এবং আমি প্রত্যেক উম্মাতের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি (এ নির্দেশ দিয়ে) যে, আল্লার বন্দেগী করো এবং তাগুত থেকে বিরত থাকো।
সূরা আন-নহলঃ ৩৬
[যে সত্তা আল্লাহর মুকাবিলায় ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে এবং আল্লাহ ব্যতীত যার বন্দেগী করা হয়- বন্দেগীকারী ব্যক্তি তার প্রভাব-প্রতাপে বাধ্য হয়ে বন্দেগী করুক বা সেচ্ছায় সন্তুষ্টচিত্তে করুক- তাকেই বলা হয় তাগুত। সে মানুষ, শয়তান, প্রতীমা বা অন্য যাই কিছু হোক না কেন। (ইবনে জারীর, আত-ত্বাবারী-জামেউল বয়ান ফী তাফসীরুল কুরআন, ৩য় খন্ডঃ পৃষ্ঠা-১৩)]।
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاء
দ্বীনকে আল্লাহর জন্য খালেছ করে নিবিষ্টভাবে বন্দেগী করা ব্যতীত তাদেরকে আর কোন নির্দেশই দেয়া হয়নি।
সূরা আল-বাইয়্যেনাঃ৫
اتَّبِعُواْ مَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ وَلاَ تَتَّبِعُواْ مِن دُونِهِ أَوْلِيَاء
তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তার অনুসরণ কর তা বাদ দিয়ে তোমাদের নেতাদের অনুসরণ করো না।
সূরা আল-আরাফঃ ৩
وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءهُم بَعْدَ مَا جَاءكَ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَكَ مِنَ اللّهِ مِن وَلِيٍّ وَلاَ وَاقٍ
তোমার কাছে যে জ্ঞান এসেছে, তারপরও তুমি যদি তাদের খাহেশাতের অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহর মুকাবিলায় তোমার কোন সাহায্যকারী হবে না, হবে না কোন রক্ষাকারী।
সূরা রাদঃ ৩৭
ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَى شَرِيعَةٍ مِّنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاء الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ
অতঃপর আমি তোমাকে দ্বীনের এক বিশেষ পদ্ধতির ওপর স্থাপন করেছি। সুতরাং তুমি তারই অনুসরণ করো। যাদের কোন জ্ঞান নেই, তাদের খাহেশের অনুসরণ করো না।
সূরা জাসিয়াঃ ১৮
কুরআন বলে, মানুষের কার্যাবলীকে সংগঠিত সুবিন্যস্ত করার জন্য আল্লাহ যে সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তা লংঘন করার অধিকার কারোর নেইঃ
تِلْكَ حُدُودُ اللّهِ فَلاَ تَعْتَدُوهَا وَمَن يَتَعَدَّ حُدُودَ اللّهِ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
এসব হচ্ছে আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা। এগুলো লংঘন করো না। যারা আল্লার সীমারেখা লংঘন করে, তারাই যালেম-অত্যাচারী।
সূরা আল-বাকারাঃ ২২৯
......تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَمَن يَتَعَدَّ حُدُودَ اللَّهِ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ
এসব হচ্ছে আল্লাহর সীমারেখা। যে আল্লার সীমারেখা লংঘন করে, সে নিজেই নিজের নফসের ওপর যুলুম করে।
সুরা আত-তালাকঃ ১
وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَلِلْكَافِرِينَ عَذَابٌ أَلِيمٌ
এসব হচ্ছে আল্লাহর সীমারেখা। বাধ্য-বাধকতা মেনে চলতে যারা অস্বীকার করে, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।
সূরা আল-মুজাদালাঃ ৪
কুরআন এও বলে যে, আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে যে হুকুমই হোক না কেন, তা শুধু অন্যায় অবৈধই নয়, বরং তা হচ্ছে কুফরী, গুমরাহী, যুলুম-শিরক-অন্যায় এবং স্পষ্ট পাপাচার। এ ধরনের যে কোন ফায়সালা জাহেলিয়াতের ফায়সালা-ঈমান বিরুদ্ধ ফায়সালা। এ ধরনের ফায়সালা অস্বীকার করা ঈমানের অপরিহার্য দাবী-অবিচ্ছেদ্ধ অংশঃ
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللّهُ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী যারা ফায়সালা করে না, তারাই কাফের।
সূরা আল মায়েদাঃ ৪৪
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أنزَلَ اللّهُ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
আল্লাহর নাযিল করা হুকুম অনুযায়ী যারা ফায়সালা করে না, তারাই যালেম।
সূরা আল মায়েদাঃ ৪৫
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللّهُ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
আল্লাহর নাযিলকৃত নির্দেশ অনুযায়ী যারা ফায়সালা করে না, তারাই ফাসেক, পাপাচারী।
সুরা আল-মায়েদাঃ ৪৭
أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللّهِ حُكْمًا لِّقَوْمٍ يُوقِنُونَ
তারা কি জাহিলিয়াতের ফায়সালা চায়?
অথচ বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহর চেয়ে উত্তম ফায়সালাকারী আর কে হতে পারে?
সুরা আল -মায়েদাঃ ৫০
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُواْ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَن يَتَحَاكَمُواْ إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُواْ أَن يَكْفُرُواْ بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُضِلَّهُمْ ضَلاَلاً بَعِيدًا
তুমি কি সেসব লোককে দেখোনি, যারা দাবী করে যে, তোমার ওপর নাযিল করা কিতাবের প্রতি তারা ঈমান এনেছে, ঈমান এনেছে তোমার পূর্বে নাযিলকৃত কিতাবসমূহের ওপরও, অতঃপর ফায়সালার জন্য নিজেদের ব্যাপারে ‘তাগুতের’ কাছে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তাকে অস্বীকার করার? শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে দূরে নিয়ে যেতে চায়।
সূরা আন-নিসাঃ৬০
চারঃ রাসূলের মর্যাদা,
ওপরের আয়াতসমূহে আল্লাহর যে বিধান মেনে চলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা মানুষের নিকট পৌছার একমাত্র Media তাঁর রাসূল (সাঃ)। তিনিই আল্লার পক্ষ থেকে তাঁর বিধান এবং হেদায়েত মানুষের কাছে পৌঁছান এবং নিজের কথা এবং কাজের দ্বারা সে সব বিধি-বিধান ও হেদায়াতের ব্যাখ্যা দান করেন। সুতরাং রাসূল (সাঃ) মানব জীবনে আল্লাহর আইনগত সার্বভৌমত্বের (Legal Sovereignty) প্রতিনিধি। এর ভিত্তিতে আনুগত্য অবিকল আল্লাহরই আনুগত্য। রাসূলের আদেশ নিষেধ এবং ফায়সালাকে নির্দ্বিধায় মেনে নেয়ার জন্য আল্লাহই নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলের আদেশ-নিষেধ ফায়সালা এমনভাবে স্বীকার করে নিতে হবে, যেন অন্তরে সামান্যতম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এবং সংকোচও না থাকে, অন্যাথায় ঈমান কোন কাজেই আসবে নাঃ
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلاَّ لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللّهِ
আমি যে রাসূলই প্রেরণ করেছি, তা করেছি এ জন্য যে, আল্লাহর নির্দেশক্রমে তাঁর আনুগত্য করা হবে।
সুরা আন-নিসাঃ ৬৪
مَّنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللّهَ
যে রাসূলের আনুগত্য করে, সে মূলত আল্লাহরই আনুগত্য করে।
সুরা আন নিসাঃ৮০
وَمَن يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءتْ مَصِيرًا
হেদায়েত স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও যে ব্যক্তি রাসূলের সাথে মতবিরোধ করে, তাঁর বিরোধিতা করে এবং ঈমানদারদের পথ ত্যাগ করে অন্য পথ অবলম্বন করে সে নিজে যে দিক ফিরে যেতে চায়, আমি তাকে সে দিকে ফিরিয়ে দেবো। আর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। জাহান্নাম অতি নিকৃষ্ট ঠিকানা।
সূরা আন-নিসাঃ১১৫
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
রাসূল তোমাদেরকে যা কিছু দেন, তোমরা তা গ্রহণ করো, আর যেসব সম্পর্কে নিষেধ করেন, সে সব থেকে বিরত থাকো। আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।
সূরা হাশরঃ ৭
فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّىَ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُواْ فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسْلِيمًا
না, তোমার রবের শপথ, তারা কখনো মুমিন হবে না, যতক্ষণ তারা তোমাকে (হে নবী) নিজেদের সকল মতবিরোধে ফায়সালাকারী বলে মেনে না নেয়। অতঃপর তুমি যে ফায়সালা করবে, তাতে নিজেদের অন্তরে তারা কোন রকম সংকীর্ণতা বোধ করবে না; বরং পুরোপুরি তা মেনে নেবে।
সূরা আন নিসাঃ৬৫
পাঁচঃ উর্ধ্বতন আইন,
কুরআনের দৃষ্টিতে আল্লাহ এবং রাসূলের নির্দেশ হচ্ছে এমন এক উর্ধ্বতন আইন (Supreme Law), যার মুকাবিলায় ঈমানদার ব্যক্তি শুধু আনুগত্যের পন্থাই অবলম্বন করতে পারে। যেসব ব্যাপারে আল্লাহ এবং রাসূল ফায়সালা দিয়েছেন, সে সব ব্যাপারে কোন মুসলমান নিজের পক্ষ থেকে কোন স্বাধীন ফায়সালা দেয়ার অধিকারী নয়। আল্লাহ ও রাসূলের ফায়সালা থেকে দূরে সরে দাঁড়ানো এবং তার বিরোধিতা-অবাধ্যতা ঈমানের পরিপন্থীঃ
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَن يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُّبِينًا
আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়সালা দেয়ার পর সে ব্যাপারে কোন মুমিন নারী-পুরুষের কোন প্রকার ইখতিয়ারই থাকে না। যে কেউ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নাফরমারী (অবাধ্যতা) করে, সে স্পষ্ট গুমরাহীতে নিমজ্জিত।
সূরা আল-আহযাবঃ ৩৬
وَيَقُولُونَ آمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالرَّسُولِ وَأَطَعْنَا ثُمَّ يَتَوَلَّى فَرِيقٌ مِّنْهُم مِّن بَعْدِ ذَلِكَ وَمَا أُوْلَئِكَ بِالْمُؤْمِنِينَ.
وَإِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ إِذَا فَرِيقٌ مِّنْهُم مُّعْرِضُونَ
তারা বলে, আমরা আল্লাহ ও রাসূলের উপর ঈমান এনেছি এবং আনুগত্য কবুল করেছি, অতঃপর তাদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়; তারা কখনো মু’মিন নয়। তাদেরকে যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে আহবান করা হয়, যাতে রাসূল তাদের মধ্যে ফায়সালা করেন, তখন তাদের একটি দল মুখ ফিরিয়ে নেয়।
সূরা আন-নূরঃ ৪৭-৪৮
إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَن يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
ঈমানদারদের কাজ হচ্ছে এই যে, যখন রাসূল তাদের মধ্যে ফায়সালা করবেন এজন্য তাদেরকে আল্লাহ এবং রাসূলের দিকে আহবান জানানো হয়, তখন তারা বলে, আমরা শুনেছি এবং আনুগত্য করেছি। এমন ব্যক্তিরাই সফলতা লাভ করবে।
সূরা আন-নূরঃ ৫১
ইনশাআল্লাহ
চলবে,,,,,,,
----------------------------------
0 Comments