Recent Tube

দ্যা চয়েস ইজ ইউরস-৯ ; জিয়াউল হক।

         
      দ্যা চয়েস ইজ ইউরস-
                                  
   এতিম ছোট্ট শিশু মায়ের সান্নিধ্যে এসে খুব চমৎকার ভাবেই মানিয়ে নিচ্ছিল। মা তার পরম মমতায় যেমন ছেলেটাকে আগলে রাখতেন, তেমনি সাথে ছিলেন মায়েরই দাসী উম্মে আইমান। কৃষ্ণাঙ্গী এই নারী তাকে চোখে চোখে রাখতেন। আর বাড়ির পুরুষ সদস্যরা, বিশেষ করে, বৃদ্ধ সৌম্য ও সুদর্শন আব্দুল মুত্তালিব তো নাতিকে সারাটা দিন সাথে নিয়েই ঘুরতেন।

     খুব অবাক করার বিষয় হলো, মাত্র ছয় বছরের নাতিও ছিয়াত্তর বছরের প্রৌড় দাদার প্রতি খুবই অনুরক্ত হয়ে উঠলো অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যেই। আব্দুল মুত্তালিব দৈহিক অবয়বে মক্কায় সবচেয়ে সুদর্শন ছিলেন। ছোটকাল থেকেই তিনি অত্যন্ত উজ্জল ফর্সা ছিলেন বলে তাকে শায়বা নামে ডাকা হতো। তার চুলও ছিল সাদা।  

    দীর্ঘদেহী, দুধে আলতা উজ্জল লাল গাত্রবর্ণ, মুখভর্তি সাদা ধবধবে দাঁড়ি, মাথায় মেহেদি মাখা লালচে চুল, স্উুচ্চ কপাল, উন্নত খাড়া নাক আর গভীর সুতীক্ষ এক জোড়া কালো চোখবিশিষ্ঠ আব্দুল মুত্তালিবের দিকে একবার তাকালে ভেতরটা কেমন যেন শ্রদ্ধা, ভক্তি আর ভয়ে গলে গলে পড়তো। তিনি অত্যন্ত স্বল্পভাষী ছিলেন। দরাজ ও ভরাট ছিল তার কন্ঠস্বর।
 
    অত্যন্ত আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের এই ছাপ থেকে সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি, রোমান সম্রাটও নিস্তার পাননি। কাবাঘর ধ্বংস করতে সেনাবাহিনী নিয়ে ছুটে আসা দাম্ভিক আবরাহাও ছিয়াত্তর বছর বয়সী প্রৌড়কে সামনে পেয়ে প্রথম দর্শনেই খেই হারিয়ে ফেলেন। কুটনৈতিক প্রোটোকল ভেঙ্গে নিজ আসনের পাশে ডেকে গভীর সমীহ করে বসতে দিয়ে অত্যন্ত সৌজন্যতার সাথে কথা বলেন এবং তার সকল উটগুলোকে বিনা বাক্যব্যয়ে ফেরত দেন।

     পুরো মক্কায় কারণে অকারণে, যে কোন ছল ছুতায় মদ্য পানের প্রথা যখন চিল সর্বজনগ্রাহ্য একটা বিষয়, সেই পরিবেশেও আব্দুল মুত্তালিব জীবনেও মদ স্পর্শ করেন নি। ফলে তার চরিত্রে ও আচরণে কখনোই কোনধরনের অসংলগ্নতা কেউ দেখেনি। ধীর, স্থির ও খুব শান্ত মেজাজের ছিলেন তিনি।

    ফলে বাড়ির ভেতর তো বটেই, এমনকি, বাড়ির বাইরে, রাস্তা ঘাটে পথে চলতে, কোন বৈঠকে কিংবা সমাবেশে, কাবার চত্তরেও সকলেই আব্দুল মুত্তালিবের পাশে কাছাকাছি থেকেও যেন শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা, ভয় আর ভক্তি মেশানো নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখতো, অথচ কেউই যেন তার সামনে থেকে দূরে সরে যেতে চাইতো না। এমনই তীব্র ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ।

   এই আকর্ষণে শিশু মুহাম্মদ ঝাঁপিয়ে পড়লো যেন। আব্দুল মুত্তালিবের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক অবারিত দ্বার তার জন্য। তায়েফে বনু সা’দ গোত্রে থাকাকালীন এমন সম্ভ্রান্ত ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব তার নজরে পড়েনি। তাই মক্কার পরিবেশে এসে যখন প্রথম দেখলো এবং ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে যেতে পারলো, বলা চলে, অত্যন্ত উষ্নতার সাথে বরিত হলো, তখন শিশুটও তাঁর প্রতি ঝুঁকে পড়লো। তার উপরে যখন সে জানতে পারলো যে, বয়োবৃদ্ধ সৌম্যদর্শন এই মহান ব্যক্তিটিই তার জিদ্দি বা দাদা!

     প্রায় দুই বছরকাল সময়েরও বেশি শিশুটি এই মহান ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য পেয়েছে। তার মধ্যেই শিশুটির সাথে আব্দুল মুত্তালিবের একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আব্দুল মুত্তালিবও নাতিকে একটা মহুর্তের জন্য কাছ ছাড়া করতেন না। বয়সকাল বিবেচনায় বিপরতি মেরুর দুই আত্মজের মধ্যে এই নিবিড় সম্পর্কের পেছনে আব্দুল মুত্তালিবের মনস্তাত্বিক কারণটাও আমাদের ভাবতে হয় বৈকি! আর সেটা ভাবতে গেলে আমাদেরকে আবারও ফিরে যেতে হয় মা আমিনার জীবনে।

     আহা মা আমিন! মাত্র সতোরো বছর বয়সে ইয়াসরিব থেকে তিনি বধু হিসেবে আসেন মক্কায়। স্বামী আব্দুল্লাহ। কুড়ি বছরের এ যুবক বাবা আব্দুল মুত্তালিবের মতোই সুদর্শন, ভদ্র এবং ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। মক্কাতো বটেই, পুরো আরব জনপদ জুড়েই তার সুনাম, তা কেবল মক্কার সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান হিসেবেই নয়, বরং তার নিজের অসাধারণ দৈহিক সৌন্দর্য, ভদ্রতা, উত্তম চরিত্র আর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে কারণেও। ষোড়শী যুবতী নিজেরাই এসে তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিতো আর তিনি তা স্বলাজে ফিরিয়ে দিতেন।

    মা আমিনা সেই স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন বিয়ের মাত্র দুই সপ্তাহ পার হবার পর পরই। হাতের মেহেদির দাগ তখনও শুকায়নি, তখনও নবদম্পতির মন থেকে নতুন বিয়ের স্বলাজ আবেশ কেটে যায়নি, ঠিক সে রকম একটা সময়ে বৃদ্ধ বাবা আব্দুল মুত্তালিব একদিন পুত্র আব্দুল্লাহকে ডেকে মক্কা থেকে একটা বাণিজ্যিক কাফেলা শামের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে, সে খবর দিয়ে সেই কাফেলার সাথে বাণিজ্য রসদ নিয়ে যেতে হুকুম করলেন। বাবার হুকুম পেয়ে এবং কাফেলার সাথে নির্ধারিত দিনে যেন বেরুতে পারেন, সে জন্য আব্দুল্লাহও যথাযথ প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন।

    মা আমিনা সে কথা শুনে স্বামী আব্দুল্লাহর আসন্ন দীর্ঘ অনুপস্থিতির সম্ভাবনা দেখে কেঁদে বুক ভাঁসিয়েছিলেন। তাঁর চেয়ে মাত্র পাঁচ ছয় বছরের ছোট নিগ্রো কিশোরী দাসী বারাকা উম্মে আইমান, যে মেয়েটিকে মাত্র কয়েকটি দিন আগে স্বামী আব্দুল্লাহ’ই দাসী হিসেবে কিনে এনেছেন আমিনার সেবা যত্ন করার জন্য; সেই উম্মে আইমানের কাঁধে মাথা রেখে অঝোরে কেঁদে বুক ভাঁসাতে ভাঁসাতে বলে উঠেছিলেন; ‘এটা কিভাবে সম্ভব? আমার হাতের মেহেদি দাগই তো এখনও শুকলো না!’ এর কোন জবাব ছিল না উম্মে আইমানের কাছে। সম্ভবত কারো কাছেই নয়!

      বাবা ওয়াহাব ইবনে আব্দুল মান্নাফ এবং মা বাররাহ বিনতে আব্দুল ওজ্জা থেকে চারশত কিলোমিটার দুরের মক্কায় নববধু আমিনার সবচেয়ে নিকটজন হলেন তার স্বামী, আর সেই স্বামীর সাথে পরিবারে সদ্য দাসী হিসেবে যোগ দেওয়া চমৎকার এই কিশোরী মেয়েটা; বারাকাহ উম্মে আইমান। আমিনা আর স্বামী আব্দুল্লাহ মিলে সুশ্রী, কালো মায়াবি মুখের ভদ্র আর শান্ত মেয়েটার নতুন নাম রেখেছেন; বারাকাহ। সেই বারাকাহ’ই হয়ে উঠলেন আমিনার সকল সুখ দু:খের সাথী।

   যেদিন আব্দুল্লাহ মা আমিনাকে ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন শামের উদ্দেশ্যে, সে দিন কাফলা বেরিয়ে যাবার পরে মা আমিনা স্বামীর বিয়োগ ব্যথায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন ঘরের মেঝেতে! কিশোরী বারাকা চিৎকার করে ছুটে এসে মা আমিনার শীয়রে বসলেন, ডাকতে থাকলেন। 

    মা আমিনা চোখ খুললেন, তার সেই চোখ দিয়ে দরদর করে বাধাহীন শ্রোতে অশ্রুর ধারা গড়িয়ে পড়ছে দু’গাল বেয়ে। ঠোঁট জোড়া থরথর কম্পমান। উঠে দাঁড়াবার শক্তিও তার নেই, বারাকার শান্তনা বাণীর জবাবে খুব কষ্ট করে কেবল বলতে পারলেন; বারাকা, আমাকে একটা বিছানায় শুইয়ে দাও তো বোন। (চলবে) (প্রকাশিতব্য গ্রন্থ ‘দ্যা চয়েস ইজ ইউরস’ থেকে সংক্ষেপকৃত)
------------------------------------------------
লেখকঃইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।          

Post a Comment

0 Comments