Recent Tube

দ্যা চয়েস ইজ ইউরস- ৪১, জিয়াউল হক।




     দ্যা চয়েস ইজ ইউরস- ৪১,
                           ★★★★★

  আমিনার প্রসবকালীন সময়ে যে নারী তাঁর পাশে উপস্থিত ছিলেন, তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন বারাকাহ উম্মে আইমান। কি অদ্ভূত ভাগ্য সংযোগ! আরও বিষ্ময়ের ব্যাপার হলো; এই উম্মে আইমান ছিলেন ইসলাম গ্রহণকারী দ্বিতীয় ব্যক্তি। তাঁর আগে একমাত্র বিবি খাদিজা রা. ইসলাম গ্রহণ করেন। এই নারী জন্ম থেকে, এমনকি, জন্মেরও আগে থেকেই প্রিয় রাসুল সা. কে তাঁর মায়ের পেটে বেড়ে উঠতে দেখেছেন।
তিনিই একমাত্র ব্যক্তি এই পৃথিবীর বুকে যিনি, এই মহামানব আল্লাহর রাসুল সা. এর শেষদিনটি পর্যন্ত তাঁর সাথে সম্পর্কযুক্ত থেকেছেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি মহুর্ত, প্রতিটি কাজ কর্ম, প্রতিটি চড়াই উতরাই সুখ দূ:খকে তার সঠিক রুপ ও অবয়বে দেখেছেন। তিনিই প্রিয় রাসুল সা: এঁর তেষট্টি বছরের জীবনের প্রতিটি দিনের স্বাক্ষী।
এই নারীই সর্বপ্রথম প্রিয় নবীকে স্পর্শ করেছেন। সর্বপ্রথম চর্মচোখে দেখেছেন। সর্বপ্রথম নিজের কোলে তুলে নিয়েছেন। কল্পনা করা যায় বিষয়টা। এই নারী, এমনকি, বিশ্বের কেউ কি জানতেন যে, তারা যে শিশুটিকে দেখছেন, যে শিশুটিকে স্পর্শ করছেন, যে শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়েছেন, সেই শিশু সাধারণ কোন শিশু নয়! সেই শিশু কাল কেয়ামতের মাঠে সমকালীন ও পরবর্তি প্রতিটি মানব সন্তানের মুক্তি ও নাজাতের উপলক্ষ্য হবেন!
তারা কি কোন ঘূর্ণাক্ষরেও ভেবেছিলেন যে, তাদের সামনে হেসে খেলে বোড়ানো এই এতিম শিশুটিই অনাদিকাল পর্যন্ত বিশ্বকে শাসন করবেন, এমনকি, একজন মানুষের মানবীয় স্বাভাবিক ও নিয়মতান্ত্রিক পরিণতি; মৃত্যুর পরেও এই শিশুই বিশ্বের বুকে তার শেষ দিনটি পর্যন্ত সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে চিরদিনের জন্য অধিষ্ঠিত হয়ে থাকবেন!
এই সব ব্যক্তিবর্গের মধ্যে নবজাতক শিশু মুহাম্মদের (মুহাম্মদ সা.) মাতৃকুল বা পিতৃকুলের আত্মীয় স্বজন রয়েছেন। পাড়া প্রতিবেশি ও সমাজবাসী রয়েছেন। কিন্তু এই কৃষ্নাঙ্গী নারী উম্মে আইমান তো না এই শিশুর পিতৃকূলের কেউ আর না তিনি তার মাতৃকূলের কোন একজন। তিনি না তার প্রতিবেশিদের কোন একজন আর না তিনি এ সমাজের সমাজবাসী একজন।
তাঁর জন্ম, তাঁর বাবা মা পরিবার পরিজনের ব্যাপারে বিশেষ কিছু একটা জানাও যায় না। কেবলমাত্র এতোটকু জানা যায় যে, তার জন্ম হয়েছিল তৎকালিন খৃষ্টরাজ্য আকসুমে। আকসুম ছিল আজকের ইথিউপিয়া, ইরিত্রিয়া এবং সুদানের অংশবিশেষ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা এক খৃষ্টরাজ্য। সেখান থেকেই নিজ সংসার থেকে বাবা মায়ের কাছ থেকে লুট হয়ে তিনি দাসী হিসেবে মক্কার বাজারে এসে উঠেন, বিক্রির জন্য। সেটাও নিশ্চিত নয়, কেউ কেউ বলেন বাবা মা’ই তাকে দাস বাজারে বিক্রি করে দিয়েছিলেন।
এ উভয় মতের মধ্যে কোনটা প্রকৃতার্থেই সত্য, সেটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। আকসুম রাজ্যের ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাই, সা¤্রাজ্যটি খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দি থেকে শুরু করে দশ শতাব্দির প্রথমার্ধ পর্যন্ত প্রায় এক হাজাার বছরেরও বেশি সময়কাল টিকে ছিল।
এক সময় এ সা¤্রাজ্যটি পারস্য, রোম ও চিনের পাশাপাশি তৎকালিন বিশ্বের চতুর্থ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। সিল্করুটের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে তারা নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থানকে অত্যন্ত সক্ষমতার সাথে কাজে লাগায়। সেকালে তাদের ধর্মবিশ্বাস ছিল খৃষ্টবাদ। এই খৃষ্টবাদ আজকের যে পলিন খৃষ্টবাদ, অর্থাৎ ত্রিত্ববাদ নির্ভর, সেরকম ছিল না। বরং সেটা ছিল এরিয়ান খৃস্টিয়ানিটি। অনেকটা একশ্বেরবাদী তা তাওহিদপন্থী রুপ।
আমরা বাদশাহ নাজ্জাশির কথা শুনেছি প্রিয় রাসুলুল্লাহর নবুওয়ত প্রাপ্তির পরে নির্যাতিতা মুসলমানদের মক্কা থেকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করার সময়ে। তিনি কুরআনের আয়াত শুনে কেঁদেছিলেন এবং মক্কার কুরাইশদের আবেদন মঞ্জুর করে তার আকসুম রাজ্যে, তথা আবিসিনিয়ায় হিজরত করে আশ্রয় নিয়ে নওমুসলিমদের ফেরত পাঠাতে অস্বীকার করেছিলেন, সেটাও জানি। সেই নাজ্জাশি ছিল আকসুম রাজ্যের রাজার রাষ্ট্রীয় উপাধি। যেমনটা আজকের যুগে প্রেসিডেন্ট বা প্রাইমিনিস্টার।
এই ইতিহাসটুকু মাথায় রাখলে আমরা উম্মে আইমানের আদর্শিক মনোজগত সন্মন্ধ্যে একটা প্রাথমিক ধারনা পেতে পারি। তবে এটা ওমনে রাখতে হবে যে, তিনি যে বয়সে ইথিওপিয়ায় নিজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লোপহিত সাগরের এপারে মক্কার বাজারে দাসী হিসেবে আসেন, সেটা নিতান্তই শশু বয়স। তখন তার বয়স ছিল মাত্র দশ বা এগারো বছর।
   আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব কেনা-কাটার জন্য একদিন মক্কার বাজারে গিয়েছিলেন। বাজারের এক প্রান্তে কোণার দিকে স্লেভ মার্কেট বা দাস দাসী বিক্রির জন্য নির্ধারিত স্থান ছিল। সেখানে তিনি দেখলেন বিক্রির জন্য আনা অনেক দাস দাসীর মধ্যে বেশ মায়াবী মুখের এক বাচ্চাা মেয়ে, সম্ভবত এগারো বারো বছর বয়সের হবে, জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এমনিতেই রোগা পাতলা মেয়েটাকে সম্ভবত দীর্ঘ সফর কিংবা যথাযথ বিশ্রাম না পাওয়ায় আরও বেশি ক্লান্ত, শ্রান্ত দেখাচ্ছে। আব্দুল্লাহর সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে। মেয়েটাকে দেখে আব্দুল্লাহর মায়া হলো। খোঁজ নিয়ে জানলেন মেয়েটা আকসুম রাজ্যের আবিসিনিয়া, তথা, আধুনিক ইথিওপিয়া থেকে আগত।
   মক্কার বাজারে বহু আগে থেকেই আবিসিনীয় দাস দাসী পাওয়া যেতো। সেখানকার ব্যবসায়ীরা অনেকেই স্থায়ীভাবে সারা বছরই মক্কায় বসবাস করতো ব্যবসার কাজে। আর মক্কাবাসীদের নানা প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে আবিসিনিয়ায় যাতায়াত ছিল। ঘরে আমিনা একাই থাকেন, বাড়ির কাজে সহায়তা করা ছাড়াও তার দেখা শোনাও করতে পারবে মেয়েটা, এমনটা ভেবেই  পূর্ব থেকেই কোন পরিকল্পনা না থাকলেও তিনি তাকে কিনে বাড়িতে নিয়ে আসলেন।স্নেহ ও আদর বশে স্বামী স্ত্রী মেয়েটার নতুন নাম দিলেন; বারাকাহ।
আমরা ইতোমধ্যেই উল্লেখ করেছি একটা ঘটনার কথা। সেটা হলো, সিরিয়ার উদ্দেশ্যে আব্দুল্লাহর যাত্রা করার সপ্তাহখানেক না যেতেই আমিনা এক অদ্ভূত স্বপ্ন দেখেন। তিনি দেখলেন রাতে স্বপ্নে দেখলেন, আকাশ থেকে উজ্জল একটা তারা চারিদিক আলো করে উড়ে এসে পড়লো তার কোলে। ঘুম ভেঙ্গে যেতেই তিনি বারাকাহকে তাঁর অদ্ভূত এ স্বপ্নের কথাটা বললেন।
   খুব মনযোগ দিয়ে মা আমিনার কথা শুনে কিশোরি বারাকাহ হেসে বলে উঠলেন; ‘আমার কি মনে হয় জানেন? মনে হয় আপনার একটা সুন্দর সন্তান হবে।’ (সংক্ষেপকৃত)।
------------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments