Recent Tube

দ্যা চয়েস ইজ ইউরস- ৪১ ; - জিয়াউল হক।

 দ্যা চয়েস ইজ ইউরস-৪১
                              ★★★★★

     বাবার কবরের পাশে নীরবে মাকে চোখ মুছতে দেখে এতিম ছেলেটা নিজেও কি মায়ের কান্নার সঙ্গী হয়েছিলেন? কচি দুটো হাত দিয়ে অশ্রুতে ভরে আসা চোখদুটো মুছেছিলেন? বাবার স্মৃতিতে কি কাতর হয়েছিলেন! বুুকের ভেতর থেকে কী একটা চাপা কষ্টে ভরা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল?
 
    কেমন ছিল এক যুবতী বিধবা মা আর বাবার মুখ না দেখা তার শিশু সন্তানের সেই সম্মিলনক্ষণটুকু! মানুষ হিসেবে আমরা তা কল্পনা করতে পারি। আমাদের নিজেদের চোখগুলোই ভিজে আসে বাঁধ না মানা প্লাবনের ধারায়!

     সমবয়স্কদের সাথে ইয়াসরিবের খেজুর বাগানে খেলা করা, প্রিয়জনদের বাড়িতে আপ্যায়িত হওয়া, তাদের আদর যতেœ ধন্য হওয়া, ইয়াসরিবে মামার বাড়ির কাছেই ছোট্ট একটা জলাশয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো সাঁতার কাটা শেখা। এ সবই ছিল তাঁর জীবনের এক আনন্দময় স্মৃতি। তবে সবচেয়ে বড়ো যে অর্জন ছিল এই সফরে, সেটা হলো, বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মৃত বাবার স্মৃতির সাথে নিজের কচি মনের মানসিক বন্ধন তৈরি করে নেয়া। 

     এভাবে দেখতে দেখতে প্রায় পুরো একটা মাসই পেরিয়ে যাবার উপক্রম। এবার মায়ের সাথে আবার মক্কায় ফেরার পালা। কিন্তু এটাই যে তাঁর জীবনে সর্বশেষ সফর, সেটা তিনি জানতেন না। জানার কথাও নয়। তেমনি তাঁর সন্তানও জানতেন না যে, এই সফরটাই তার মায়ের সাথে সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ এবং একমাত্র সফর, যার স্মৃতি সারাটা জীবন তাঁর মনে গেঁথে থাকবে।

      আমিনা বাবার বাড়ি মদিনা থেকে আদরের সন্তান মুহাম্মদ’কে সাথে করে মক্কায় ফিরে যাবার জন্য রওয়ানা করলেন। শিশুটিও ইয়াসরিব থেকে সারা জীবন লালন করার মতো একগুচ্ছ চমৎকার স্মৃতি নিয়ে উটের হাওদায় চড়ে মায়ের সাথে ফিরে চলছে মক্কা পানে। 

      মদিনা থেকে মক্কা পর্যন্ত দুরত্ব প্রায় ৪০০ কিলোমিটার বা ২৭০ মাইলের মত। সন্তান মুহাম্মদকে সাথে করে নিয়ে ইয়াসরীব থেকে মাত্র দিন তিনেকের পথ, তথা, প্রায় একশত মাইল বা সেরকমই দুরত্বের গ্রাম আবওয়া পর্যন্ত এসেছেন, এ সময় হঠাৎ করেই পথিমধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। জ¦রে আক্রান্ত হলেন। খুব দ্রুত তাঁর অবস্থার অবনতি হতে থাকলো। 

     জায়গাটা জনবসতিহীন ছিল। চারিদিকে ছোট বড়ো পাথুরে পাহাড়, ছোট ছোট কাঁটাওয়ালা গাছের জঙ্গলে পরিপূর্ণ। ১৯৯৫-৯৬ সালের দিকেও প্রায় একই অবস্থা বিরজামান ছিল, যদিও এখন তার পাশ দিয়েই একটা পাকা সড়কও হয়েছে। তবে এখনও সেই এলাকাটা একটা জনবসতিহীন এলাকা হিসেবেই রয়ে গেছে।

    আমিনার অবস্থার দ্রুত অবনতি হলো। ছোট একটা পাহাড়, সম্ভবত চল্লিশ বা পঞ্চশ ফুট উঁচু হবে, সেই পাহারের উপরে তারা যাত্রবিরতি করলেন। উম্মে আইমান বর্ণনা করেন; সে রাতটা ছিল এক ভীষণ অন্ধকার রাত, তথা, আমাবশ্যার রাত 

     জনবসতিহীন পাহাড়ের উপরে নিকষ আঁধার রাতে মাত্র তিনজন প্রাণী, দ্ইু নারী আর এক শিশু। মায়ের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে লাগলে বালক মুহাম্মদ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করলেন। মা আমিনা হাত বাড়িয়ে ছেলেকে আরও কাছে টেনে নিয়ে বলে উঠলেন;

‘       বাছা, প্রত্যেককেই বৃদ্ধ হতে হবে, প্রত্যেক জীবনকেই একদিন মরতে হবে। মনে হচ্ছে, আমারও যাবার সময় হয়েছে। তবে আমি তোমার মতো এমন এক সন্তানকে জন্ম দিয়েছি, যে সারা বিশ্বকে পথ দেখাবে’
 
        প্রিয় মুহাম্মদ সা. কে উদ্দেশ্য করে বলা এটাই ছিল তাঁর শেষ কথা। প্রাণপ্রিয় মায়ের বলা শেষ এই কথাগুলো শিশুটির মনে সারাজীবনের জন্য গেঁথে গেছে। আর এই শিশু পরিণত বয়সেও মায়ের সেই বিদায়ক্ষণের স্মৃতি স্মরণে কাতর হয়ে পড়তেন।

        যা হোক, বারাকাহ উম্মে আইমান যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন বিবি আমিনার জ্বর কমানোর। কিন্তু তাঁর সব চেষ্টাই বৃথা গেলো। অবস্থা খুবই সংগীন হয়ে উঠলো। তাঁর গলার স্বরও ক্ষীণ হয়ে এলো। এরকম অবস্থাতেও বাবাহারা এতিম সন্তানের চিন্তা মা আমিনার মাথা থেকে যায় নি। 

       শেষমুহর্তে খুব কষ্ট করে বিবি আমিনা উম্মে আইমানের মাথাটা কাছে টেনে নেবার চেষ্টা করছেন দেখে উম্মে আইমান নিজেই মাথা এগিয়ে নিয়ে তাঁর মুখের কাছে কান পাতলেন। বিবি আমিনা ক্ষীণ কন্ঠে খুব কষ্ট করে বলে উঠলেন; 

   'বারাকাহ, আমি খুব শীঘ্রই এ দুনিয়া ছেড়ে যাচ্ছি। আমার ছেলেটাকে তোমার জিম্মায় ছেড়ে গেলাম। পেটে থাকতেই ওর বাবাকে হারিয়েছে। আর এখন সে নিজের চোখের সামনেই তার মাকেও হারাচ্ছে। বারাকাহ, তুমিই ওর মা হয়ো, কখনোই ওকে ছেড়ে যেও না।’ 

     শেষ মহুর্তের করুণ চিত্রটা আমরা উম্মে আইমানের বর্ণনায় দেখতে পাই। সেই কঠিন সময়টুকুতে পুরো ঘটনার চাক্ষুস স্বাক্ষী হিসেবে একমাত্র তিনিই উপস্থিত ছিলেন। সেই রাতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি পরবর্তিতে বলেছেন;

   'তাঁর (উম্মে আইমানের) বুকটা খাঁন খাঁন হয়ে গেল, তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। শিশু মুহাম্মদ ‘ইয়া উম্মি’ ‘ইয়া উম্মি’ কাঁদতে কাঁদতে আমিনার বুকে মাথা রেখে মায়ের গলাটা দু’হাত দিয়ে পেঁচিয়ে রাখলো। ঠিক এরকম অবস্থায় মা আমিনা জোরের সাথে একটা নি:শ্বাস নিয়েই নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন চিরদিনের মতোই! (সংক্ষেপকৃত, চলবে)
-----------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments