কুরআন ও হাদীসের আলোকে শিরক-মুশরিক কি ও মুশরিকদের বৈশিষ্ট্য এবং শিরকের ভয়াবহ পরিণতি;
============================
শিরক কি : شرك শিরক শব্দের অর্থ : অংশীদারিত্ব, অংশীবাদ, মিলানো, সমকক্ষ করা, সমান করা, ভাগাভাগি করা ইত্যাদি। ইংরেজীতে polytheism (একাধিক উপাস্যে বিশ্বাস),
Associate, Partner ।
শিরক এর শাব্দিক বিশ্লেষণ : ﺷِﺮْﻙ -এর আভিধানিক অর্থ অংশ। الشرك শব্দের মাসদার বা ক্রিয়ামূল হলো الاشراك শরীক করা। শিরক শব্দের Past form হল আশরাকা ( ﺃَﺷْﺮَﻙَ) এবং Present/Future form হল ইউশরেকু ( ﻳُﺸْﺮِﻙُ ) যার অর্থ শরীক করা, অংশীদার করা, মুশরিক হওয়া এবং এটি Verb form IV এবং এর Verbal Noun হল শিরক (ﺷِﺮْﻙ ) যার অর্থ অংশ, অংশীদারিত্ব, ঈমান কিংবা ইবাদতে অংশীদার করণ, অংশ, ভাগ, অংশীদার এবং এর Active Participle হল মুশরিক ( ﻣُﺸْﺮِﻙ) যার অর্থ Polytheistic Man, বহু ঈশ্বরবাদী, বহু ঈশ্বরবাদী মানুষ, সহযোগী, সহযোগিতাকারী।
সংক্ষেপে শিরকের সংজ্ঞা হল: ‘‘এমন সব বিশ্বাস, কাজ, কথা ও অভ্যাসকে শিরক বলা হয় যার দ্বারা মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাত, উলূহিয়্যাত ওআসমা ওয়াস-সিফাতে অপর কারো অংশীদারিত্ব বা সমকক্ষতা প্রতীয়মান হয়।’’
অপর কথায় বলা যায় : ‘‘শিরক হচ্ছে আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে (কাজে), উলূহিয়্যাতে (বান্দার সকল এবাদতে) ও আসমা ওয়াস-সিফাতে (নাম ওগুণাবলীতে) অথবা এর কোন একটিতে কোন কিছুকে শরীক স্থাপন করার নাম।”
পারিভাষিক অর্থ- আল্লাহর সত্ত্বা অথবা গুণাবলীর সাথে অন্যকে শরীক করা।
শিরকের সংজ্ঞা :
শির্কের সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা কুরআনুল কারীম থেকে প্রমাণ করা যায়।
মহান আল্লাহ তাআ'লা বলেন :
قَالُوا وَهُمْ فِيهَا يَخْتَصِمُونَ تَاللَّهِ إِنْ كُنَّا لَفِي ضَلالٍ مُبِينٍ إِذْ نُسَوِّيكُمْ بِرَبِّ الْعَالَمِينَ
‘‘তারা (মুশরিকরা তাদের উপাস্যদের সাথে) জাহান্নামে কথা কাটাকাটিতে লিপ্ত হয়ে বলবে: আল্লাহর কসম! আমরা তথায় (পৃথিবীতে) প্রকাশ্য বিভ্রান্তিতে লিপ্ত ছিলাম, যখন আমরা তোমাদেরকে বিশ্ব-পালনকর্তার সমতুল্য গণ্য করতাম।’’
সূরা আশ-শু‘আরাঃ ৯৬-৯৮
শিরকের সংজ্ঞায় আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, الشرك هو أن يتخذ من دون الله ندا يحبه كما يحب الله- ‘শিরক হ’ল আললাহ তা‘আলার সাথে অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ গ্রহণ করা এবং আল্লাহ তা‘আলার মত তাকে ভালবাসা’।
শিরকের প্রকারভেদ : শিরক দুই প্রকার-
প্রথম.- الشرك الاكبر বড় শিরক
দ্বিতীয়. الشرك الاصغر- ছোট শিরক
প্রথমঃ الشرك الاكبر বা সবচেয়ে বড় শিরক :
বড় শিরক হ’ল আল্লাহর কোন সমকক্ষ স্থির করে ইবাদতের কোন এক প্রকার আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের জন্য করা। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের কাছে দো‘আ করা, সিজদা করা, মানত করা, অন্যকে ডাকা, অন্যের নিকট সাহায্যে প্রার্থনা করা মৃত ব্যক্তি, জ্বিন কিংবা শয়তানের প্ররোচনাকে ভয় করা। যেমন, মূর্তি, জ্বিন এর নিকট সাহায্য চাওয়া অথবা কবরের নিকট সন্তান চাওয়া, অলী-আওলিয়ার নিকট সাহায্য চাওয়া যাতে তারা আল্লাহর নিকটবর্তী করে দিবে।
যেমন আল্লাহ বলেন,
وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى
‘আর যারা আল্লাহকে ছেড়ে অন্যকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছে (তারা বলে) আমরা তো এদের পূজা কেবল এজন্যেই করি যেন এরা (সুপারিশের মাধ্যমে) আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দিবে’।
সূরা যুমারঃ ৩
শিরকে আকবর الشرك الاكبر বা বড় শিরক ৩ প্রকার :
১. الشرك فى الربوية (আশ-শিরক ফির রুবূবিয়াহ)
২. الشرك فى الألوهية (আশ-শিরক ফিল উলূহিয়াহ)
৩. الشرك فى الاسماء و الصفات (আশ-শিরক ফিল আসমা ওয়াছ-ছিফাত)
একঃ الشرك فى الربووية (আশ শিরক ফির রুবূবিয়্যাহ) :
আল্লাহ তা‘আলার কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বে কাউকে তাঁর সমকক্ষ মনে করা বা অন্য কাউকে অংশীদার বানানো। যেমন : আল্লাহ তা‘আলা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। গায়েব বা অদৃশ্যের খবর একমাত্র তিনিই রাখেন। এমনকি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও গায়েবের খবর জানতেন না। মহান আল্লাহ বলেন,
قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
‘বল যা আল্লাহ ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমি আমার নিজের কোন কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক নই। যদি আমি অদৃশ্যের খবর রাখতাম, তাহ’লে আমি অধিক কল্যাণ অর্জন করতাম এবং কোনরূপ অমঙ্গল আমাকে স্পর্শ করত না। আমি বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য একজন ভয় প্রদর্শনকারী ও সুসংবাদদানকারী মাত্র’।
সূরা আ‘রাফঃ ১৮৮
দুইঃ الشرك فى الألوهية (আশ-শিরক ফিল উলুহিয়্যাহ) :
ইবাদতে মহান আল্লাহ তা‘আলার সাথে অন্য কাউকে শরীক করার নাম। ইবাদত হবে সম্পূর্ণ শিরক মুক্ত।
মহান আল্লাহ বলেন,
وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا
‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তার সাথে কাউকে শরীক করো না’।
সূরা নিসাঃ ৩৬
তিনঃ الشرك فى الاسماء و الصفات আশ-শিরক ফিল আসমা ওয়াছ ছিফাত :
এই শিরক হ’ল আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের সাথে অন্য কিছু বা তাঁর সৃষ্টির গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের তুলনা করা। যেমন : এ ধরণের কথা বলা যে, আল্লাহর পা আমাদের পায়ের মত বা তাঁর চেহারা আমাদের চেহারার মত। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেغوث বা غوث الاعظم ‘গাউসুল আযম’ বা ত্রাণকর্তা বলা ইত্যাদি।
শিরক প্রধানত ৪ প্রকার :
১. الشرك الدعاء দো‘আ বা প্রার্থনায় শিরক :
আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যদের দেব-দেবীকে আহবান করা, তার নিকটে প্রার্থনা করা। মাযার বা পীরের নিকট কিছু চাওয়া। মহান আল্লাহ বলেন,
فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُونَ
(মুশরিকদের চরিত্র এই যে,) যখন তারা নৌযানে আরোহণ করে, তখন (তারা ভয়ে) একনিষ্টভাবে আল্লাহকে ডাকে। অতঃপর যখন আল্লাহ তাদেরকে উদ্ধার করে স্থলভাগে এনে ভিড়িয়ে দেন (এবং ভয় কেটে যায়,) তখন তারা (পুনরায়) শিরকে লিপ্ত হয়’।
সূরা আনকাবুতঃ ৬৫
২. الشرك النية و العبادة و القصد নিয়ত, ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যে শিরক :
আল্লাহর উদ্দেশ্যে উপাসনা বা ধর্মীয় কাজকর্ম, সংকল্পের সাথে সম্পৃক্ত। সুতরাং দেব-দেবী, জ্বিন বা অন্য কিছু অর্থাৎ গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে সৎ আমল সম্পাদন করা যেমন পীর আওলিয়ার উদ্দেশ্যে ভাল কাজ করা এই শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
৩. الشرك الطاعة আনুগত্যে শিরক :
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার হারামকৃত বস্তুকে হালাল এবং হালালকৃত বস্তুকে হারাম করার ক্ষেত্রে আলেম-ওলামা, পীর আওলিয়া, কর্তৃপক্ষ বা নেতৃবৃন্দের অনুসরণ করা (আল্লাহ তা‘আলার হুকুমের বিরুদ্ধে)।
মহান আল্লাহ তাআ'লা বলেন,
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ
‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের আলেম-ওলামা ও পোপ-পাদ্রীদের এবং মারিয়াম পুত্র মসীহ ঈসাকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছে। অথচ তাদের প্রতি কেবল এই আদেশ করা হয়েছিল যে, তারা শুধুমাত্র এক উপাস্যের ইবাদত করবে। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আর তারা যাদেরকে শরীক সাব্যস্ত করে, তিনি সে সব থেকে পবিত্র’।
সূরা তাওবাহঃ ৩১
৪. الشرك المحبة ভালবাসায় শিরক :
মহান আল্লাহ তাআ'লা বলেন,
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ وَلَوْ يَرَى الَّذِينَ ظَلَمُوا إِذْ يَرَوْنَ الْعَذَابَ أَنَّ الْقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا وَأَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعَذَابِ
‘আর মানুষের মধ্যে এমন কিছু মানুষ রয়েছে, যারা অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে। তারা তাদেরকে ভালোবাসে আল্লাহকে ভালবাসার ন্যায়। কিন্তু যারা ঈমানদার তারা আল্লাহর জন্য সর্বাধিক ভালবাসা পোষণ করে থাকে। আর যালেমরা (মুশরিকরা)। যদি জানত যখন তারা আযাবকে প্রত্যক্ষ করবে যে সমস্ত ক্ষমতা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা (তাহ’লে তারা শিরকের ক্ষতিকারিতা ব্যাখ্যা করে দিত)’।
সূরা বাকারাঃ ১৬৫
দ্বিতীয়ঃ الشرك الاصغر ছোট শিরক :
যে সব কথা ও কাজের মাধ্যমে মানুষ শিরকের দিকে ধাবিত হয়ে অর্থাৎ আমলের কাঠামো ও মুখের কথায় আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করা, সেইরূপ কথা ও কাজকে ছোট শিরক বলা হয়। যেমন সৃষ্টির ব্যাপারে এমনভাবে সীমালংঘন করা যা ইবাদতের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ছোট শিরক মানুষক মুসলিম মিল্লাত থেকে বের করে না তবে তাওহীদের ঘাটতি করে। আর ছোট শিরক বড় শিরকের একটি মাধ্যম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمُ الشِّرْكُ الأَصْغَرُ. قَالُوا وَمَا الشِّرْكُ الأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ الرِّيَاءُ
‘আমি তোমাদের জন্য যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশী ভয় করি, তা হচ্ছে শিরকে আছগার বা ছোট শিরক। তাঁকে শিরকে আছগার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তরে বললেন, রিয়া বা লৌকিকতা’।
আহমাদ হা/২৩৬৮০; মিশকাত হা/৫৩৩৪।
রিয়া সম্পর্কে মানুষ অসচেতন এবং আল্লাহ তা‘আলা এটি ক্ষমা করেন না, তাই মহানবী (সাঃ) এ বিষয়ে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন।
রিয়া দু’প্রকার : (ক) মুনাফিকদের রিয়া (খ) তাওহীদপন্থী মুসলমানদের রিয়া। মুনাফিকদের রিয়া যারা মুখে ইসলাম প্রকাশ করে আর অন্তরে থাকে কুফুরী। মহান আল্লাহ বলেন,
يُرَاءُونَ النَّاسَ وَلَا يَذْكُرُونَ اللَّهَ إِلَّا قَلِيلًا
‘তারা লোকদের দেখায় এবং আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করে’।
সূরা নিসাঃ ১৪২
তাওহীদপন্থী মুসলমানদের রিয়া যারা খুব সুন্দর করে ছালাত আদায় করে যাতে মানুষ তা দেখে প্রশংসা করা। এটি ছোট শিরক।
ছোট শিরক দু‘প্রকার :
প্রকাশমান ছোট শিরক :
কথা ও কাজের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। কথার মাধ্যমে প্রকাশ্য ছোট শিরক। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যের নামে শপথ করা।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
عَنْ سَعْدِ بْنِ عُبَيْدَةَ أَنَّ ابْنَ عُمَرَ سَمِعَ رَجُلاً يَقُولُ لاَ وَالْكَعْبَةِ. فَقَالَ ابْنُ عُمَرَ لاَ يُحْلَفُ بِغَيْرِ اللَّهِ فَإِنِّى سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللَّهِ فَقَدْ كَفَرَ أَوْ أَشْرَكَ. قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ. وَفُسِّرَ هَذَا الْحَدِيثُ عِنْدَ بَعْضِ أَهْلِ الْعِلْمِ أَنَّ قَوْلَهُ فَقَدْ كَفَرَ أَوْ أَشْرَكَ عَلَى التَّغْلِيظِ
সা‘দ ইবনু উবাদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ইবনু উমর (রাঃ) একজন লোককে বলতে শুনলেন, কা‘বার শপথ! ইবনু উমর (রাঃ) বললেন, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কিছুর নামে শপথ করা যাবে না। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর নামে শপথ করল, সে যেন কুফরী অথবা শিরক করল’।
তিরমিযী হা/১৫৩৫।
মহান আল্লাহ বলেন,
يَقُولُونَ لَوْ كَانَ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ مَا قُتِلْنَا هَاهُنَا
‘ওরা বলে, যদি আমাদের কোন কর্তৃত্ব থাকত, তাহ’লে এখানে আমরা নিহত হতাম না’।
সূরা আল ইমরানঃ ১৫৪
তিনি আরো বলেন,
الَّذِينَ قَالُوا لِإِخْوَانِهِمْ وَقَعَدُوا لَوْ أَطَاعُونَا مَا قُتِلُوا
‘যারা ঘরে বসে তাদের ভাইদের সম্বন্ধে বলছিল, যদি তারা আমাদের কথা শুনত, তাহ’লে নিহত হ’ত না’ )আলে ইমরান ৩/১৬৮)। তারা (মুনাফিক) বলে, যদি এ ব্যাপারে আমাদের কোন কথা রাখা হ’ত তবে আমরা এখানে নিহত হ’তাম না। যদি শব্দটি যখন অতীতের জন্য ব্যবহার করা হবে তখন তা না জায়েয ও হারাম হবে। কেননা আয়াতটি প্রমাণ করে যে, যদি শব্দে বাক্যে প্রয়োগ করা মুনাফিকদের আলামত তাই ব্যবহার করা হারাম। যদির ব্যবহার অন্তরকে দুর্বল ও অপারগ করে দেয়। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য যদি ব্যবহার আল্লাহ তা‘আলার রহমত ও কল্যাণের আশাবাদ ব্যক্ত করে বলা হ’লে তখন তা বৈধ হবে। কিন্তু যদি ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে অহংকার ও বড়ত্ব প্রকাশ করা হয় তা নাজায়েয। কেননা এতে তাক্বদীরের প্রতি স্বীয় নিয়ন্ত্রণ প্রকাশ পায়।
ছোট শিরক থেকে বেঁচে থাকার উপায়
ছোট শিরক (রিয়া) থেকে বেঁচে থাকার উপায় হচ্ছে আমল করার সময় আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অনুসন্ধান করা। ছোট শিরক (রিয়া) প্রতিহত করার জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে দো‘আ করা। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, হে লোক সকল! তোমরা এই শিরক থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা কর কেননা উহা পিপিলীকার চলার শব্দ থেকেও গোপন ও সূক্ষ্ম। তাঁকে প্রশ্ন করা হ’ল হে আল্লাহর রাসূল কিভাবে আমরা তা থেকে বেঁচে থাকতে পারি? অথচ উহা পিপিলীকার চলার শব্দের চেয়েও গোপন ও সূক্ষ্ম? তিনি বললেন, তোমরা এই দো‘আ পাঠ করবে।
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أُشْرِكَ بِكَ وَأَنَا أَعْلَمُ، وَأَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لَا أَعْلَمُ
‘হে আল্লাহ! জেনে শুনে কোন কিছুকে শরীক করা হ’তে আপনার কাছে আশ্রয় কামনা করছি এবং না জেনে শিরক হয়ে গেলে তা থেকে আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি’।
আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৩৬।
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেছেন, কুলক্ষণের কারণে যে ব্যক্তি নিজের কাজ থেকে ফিরে গেছে সে শিরক করেছে। তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, এরূপ হয়ে গেলে তার কাফফারা কি?
রাসূল (সাঃ) বললেন, তা হ’ল এই দো‘আ
اللَّهُمَّ لاَ خَيْرَ إِلاَّ خَيْرُكَ وَلاَ طَيْرَ إِلاَّ طَيْرُكَ وَلاَ إِلَهَ غَيْرُكَ
‘হে আল্লাহ! তোমার কল্যাণ ব্যতীত আর কোন কল্যাণ নেই। আর তোমার পক্ষ থেকেই অকল্যাণ হয়ে থাকে অন্য কারো পক্ষ থেকে নেই। আর তুমি ব্যতীত সত্য কোন উপাস্য নেই’।
ছহীহুল জামে‘ হা/৬২৬৪; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১০৬৫।
গোপন শিরক :
শিরকে খফী এমন একটি সূক্ষ্ণ শিরক যা নিয়ত, সংকল্প ও উদ্দেশ্যে সাথে হয়ে থাকে। যেমন (الرياء و السمعة) মানুষকে দেখানোর উদ্দেশে বা নিয়তে এবং মানুষের প্রশংসা শোনানোর জন্য নেক আমল করা।
عَنْ أَبِى سَعِيدٍ قَالَ خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَنَحْنُ نَتَذَاكَرُ الْمَسِيحَ الدَّجَّالَ فَقَالَ أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِى مِنَ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ. قَالَ قُلْنَا بَلَى. فَقَالَ الشِّرْكُ الْخَفِىُّ أَنْ يَقُومَ الرَّجُلُ يُصَلِّى فَيُزَيِّنُ صَلاَتَهُ لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ رَجُلٍ
‘আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আমি কি তোমাদের এমন বিষয়ে সংবাদ দিব না? যে বিষয়টি আমার কাছে মাসীহ দাজ্জালের চেয়েও ভয়ঙ্কর? ছাহাবায়ে কেরাম বললেন, হ্যাঁ; তিনি বললেন, তা হচ্ছে শিরকে খফী বা গুপ্ত শিরক [আর এর উদাহরণ হচ্ছে] একজন মানুষ দাঁড়িয়ে শুধু এজন্যই তার ছালাতকে খুব সুন্দরভাবে আদায় করে যে, কোন মানুষ তার ছালাত দেখছে বলে সে মনে করে’।
আহমাদ হা/১১২৭০; ইবনু মাজাহ হা/৪২০৪।
রিয়া দাজ্জালের ভয়াবহতা থেকেও মারাত্মক। তার কারণ দাজ্জালের ফিৎনার বিষয়টি সুস্পষ্ট। এ সম্পর্কে নবী করীম (সাঃ) বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু রিয়া মানুষের মনকে অব্যক্ত করে যা সংরক্ষণ অতীব কঠিন। আর তা মানুষকে ধীরে ধীরে আল্লাহ তা‘আলার পরিবর্তে মানুষের দিকে ধাবিত করে। ফলে নবী করীম (সাঃ) এটাকে দাজ্জালের ভয়াবহতা থেকে বেশী ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ
‘অতএব তোমরা জেনে শুনে কাউকে আল্লাহর সাথে সমকক্ষ নির্ধারণ করো না’।
সুরা বাকারাঃ ২২
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, أَنْدَادًا হচ্ছে শিরক যা অন্ধকার রাতে নির্মল কালো পাথরের উপর পিপীলিকার পদাচরণার চেয়েও সূক্ষ্ণ। ইবনু আববাস (রাঃ) আরো বলেন, কেউ যদি বলে, আল্লাহ এবং অমুক যদি না থাকত এরূপ কথা শিরক কেননা واو যার অর্থ এবং যা অংশীদারিত্ব ও বিলম্বহীনতার অর্থ বহন করে। পক্ষান্তরে ثم যার অর্থ অতঃপর বিলম্বের অর্থ প্রকাশ করে। ফলে যদি আল্লাহ না থাকতেন অতঃপর অমুক না থাকত বলা বৈধ হবে। কিন্তুواو দিয়ে বাক্যটি শিরকে আসগার হবে।
মুশরিকঃ
শিরক (ﺷِﺮْﻙ) যার অর্থ অংশ, অংশীদারিত্ব, ঈমান কিংবা ইবাদতে অংশীদার করণ, অংশ, ভাগ, অংশীদার এবং এর Active Participle হল মুশরিক ( ﻣُﺸْﺮِﻙ) যার অর্থ Polytheistic Man, বহু ঈশ্বরবাদী, বহু ঈশ্বরবাদী মানুষ, সহযোগী, সহযোগিতাকারী।
অর্থাৎ যে শির্ক করে তাকে মুশরিক (مُشْرِك) বলা হয়।
قَالُوا وَهُمْ فِيهَا يَخْتَصِمُونَ تَاللَّهِ إِنْ كُنَّا لَفِي ضَلالٍ مُبِينٍ إِذْ نُسَوِّيكُمْ بِرَبِّ الْعَالَمِينَ
‘‘তারা (মুশরিকরা তাদের উপাস্যদের সাথে) জাহান্নামে কথা কাটাকাটিতে লিপ্ত হয়ে বলবে: আল্লাহর কসম! আমরা তথায় (পৃথিবীতে) প্রকাশ্য বিভ্রান্তিতে লিপ্ত ছিলাম, যখন আমরা তোমাদেরকে বিশ্ব-পালনকর্তার সমতুল্য গণ্য করতাম।’’
সূরা আশ-শু‘আরাঃ ৯৬-৯৮
উপরোল্লিখিত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুশরিকরা তাদের উপাস্যগুলিকে মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাত ও উলূহিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যে সমকক্ষ বানিয়ে নেয়ার কারণেই বিভ্রান্তিতে পতিত হয়ে মুশরিক হয়েছিল।
মুশরিকদের প্রতি রাসূল সাঃ এর মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন
قُلْ أَرَأَيْتُمْ مَا تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَرُونِي مَاذَا خَلَقُوا مِنَ الْأَرْضِ أَمْ لَهُمْ شِرْكٌ فِي السَّمَاوَاتِ ائْتُونِي بِكِتَابٍ مِنْ قَبْلِ هَذَا أَوْ أَثَارَةٍ مِنْ عِلْمٍ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ
‘বল, তোমরা আমাকে সংবাদ দাও তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক আমাকে দেখাও তো তারা যমীনে কী সৃষ্টি করেছে? অথবা আসমানসমূহে তাদের কোন অংশীদারিত্ব আছে কি? এর পূর্ববর্তী কোন কিতাব অথবা পরম্পরাগত কোন জ্ঞান তোমরা আমার কাছে নিয়ে এসো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’।
সূরা কাহাফঃ ৪
মুশরিকদের বৈশিষ্ট্যঃ
ذَلِكُمْ بِأَنَّهُ إِذَا دُعِيَ اللَّهُ وَحْدَهُ كَفَرْتُمْ وَإِنْ يُشْرَكْ بِهِ تُؤْمِنُوا فَالْحُكْمُ لِلَّهِ الْعَلِيِّ الْكَبِيرِ
[তাদেরকে উত্তরে বলা হবে] ‘তোমাদের শাস্তি এই জন্য যে, যখন এক আল্লাহকে ডাকা হত তখন তোমরা তাঁকে অস্বীকার করতে আর যখন তাঁর সাথে শরীক করা হত তখন তোমরা বিশ্বাস করতে; সুতরাং যাবতীয় কর্তৃত্ব সর্বোচ্চ, মহান আল্লাহর’।
সূরা আল-মুমিনঃ ১২
আল্লাহর বান্দাকে অংশ সাব্যস্ত করে শির্ক করে
وَجَعَلُوا لَهُ مِنْ عِبَادِهِ جُزْءًا إِنَّ الإنْسَانَ لَكَفُورٌ مُبِينٌ
আর তারা তাঁর (আল্লাহর) বান্দাদের মধ্য হতে কতকতে তাঁর অংশ সাব্যস্ত করেছে, নিশ্চয়ই মানুষ স্পষ্ট অকৃতজ্ঞ।
সূরা আয-যুখরুফঃ ১৫
মুশরিকরা বহু ইলাহ গ্রহণ করে
وَاتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ آلِهَةً لِيَكُونُوا لَهُمْ عِزًّا كَلا سَيَكْفُرُونَ بِعِبَادَتِهِمْ وَيَكُونُونَ عَلَيْهِمْ ضِدًّا
আর তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে বহু ‘ইলাহ’ গ্রহণ করেছে, যাতে ওরা তাদের জন্য সাহায্যকারী হয়। কক্ষনো নয়, এরা তাদের ইবাদত অস্বীকার করবে এবং তাদের বিরোধী হয়ে যাবে।
সূরা মারইয়ামঃ ৮১-৮২
وَاتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ آلِهَةً لَعَلَّهُمْ يُنْصَرُونَ لا يَسْتَطِيعُونَ نَصْرَهُمْ وَهُمْ لَهُمْ جُنْدٌ مُحْضَرُونَ
তারা আল্লাহর পরিবর্তে অনেক ইলাহ গ্রহণ করেছে, এই আশায় যে, তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। এরা তাদের কোন সাহায্য করতে সক্ষম নয়, বরং এগুলোকে তাদের বিরুদ্ধে বাহিনীরূপে হাযির করা হবে।
সূরা ইয়াসিনঃ ৭৪-৭৫
শিরকের পরিণতি :
শিরক সবচেয়ে বড় অপরাধ :
মহান আল্লাহ বলেন,
لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ
‘আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না। নিশ্চয়ই শিরক সবচেয়ে বড় পাপ’।
সূরা লোকমানঃ ১৩
عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ أَبِى بَكْرَةَ عَنْ أَبِيهِ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ. قُلْنَا بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ. قَالَ الإِشْرَاكُ بِاللَّهِ، وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ. وَكَانَ مُتَّكِئًا فَجَلَسَ فَقَالَ أَلاَ وَقَوْلُ الزُّورِ وَشَهَادَةُ الزُّورِ، أَلاَ وَقَوْلُ الزُّورِ وَشَهَادَةُ الزُّورِ. فَمَا زَالَ يَقُولُهَا حَتَّى قُلْتُ لاَ يَسْكُتُ
‘আব্দুর রহমান তার পিতা সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমি কি তোমাদের সব থেকে বড় গুনাহ সম্পর্কে সতর্ক করব না? আমরা বললাম; অবশ্যই সতর্ক করবেন হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে অংশীদার গণ্য করা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা। এ কথা বলার সময় তিনি হেলান দিয়ে উপবিষ্ট ছিলেন। এরপর সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেন, মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া একথা তিনি দু’বার করে বললেন এবং ক্রমাগত বলেই চললেন। এমনকি আমি বললাম, তিনি মনে হয় থামবেন না’।
বুখারী হা/৫৯৭২; মুসলিম হা/২৬৯; মিশকাত হা/৫০।
ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ :
মহান আল্লাহ তাআ'লা বলেন,
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে অন্যকে শরীক করে। এতদ্ব্যতীত তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে থাকেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক সাব্যস্ত করল, সে ব্যক্তি মহাপাপের অপবাদ দিল’।
সূরা নিসাঃ ৪৮
তিনি আরো বলেন,
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدً
‘নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে। এটা ব্যতীত যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করে থাকেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করল, সে ব্যক্তি দূরতম ভ্রষ্টতায় নিপতিত হ’ল’।
সূরা নিসাঃ ১১৬
শিরক করে মারা গেলে আল্লাহ তা‘আলা ঐ ব্যক্তিকে ক্ষমা করবেন না। তাই কেউ যদি এই পাপ করে ফেলে তাকে সাথে সাথে তাওবাহ কর ফিরে আসতে হবে।
عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ اللَّهُ تَعَالَى يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ مَا دَعَوْتَنِي وَرَجَوْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ عَلَى مَا كَانَ فِيكَ وَلَا أُبَالِي، يَا ابْنَ آدَمَ لَوْ بَلَغَتْ ذُنُوبُكَ عَنَانَ السَّمَاءِ، ثُمَّ اسْتَغْفَرْتَنِي، غَفَرْتُ لَكَ وَلَا أُبَالِي، يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ لَوْ لَقِيتَنِي بِقُرَابِ الْأَرْضِ خَطَايَا، ثُمَّ لَقِيتَنِي لَا تُشْرِكُ بِي شَيْئًا، لَأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً
‘আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, বরকতময় আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে আদম সন্তান! তোমার গুনাহর পরিমাণ যদি আসমানের কিনারা বা মেঘমালা পর্যন্তও পৌঁছে যায়, তারপর তুমি আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব। এতে আমি পরওয়া করব না। হে আদম সন্তান! তুমি যদি সম্পূর্ণ পৃথিবী পরিমাণ গুনাহ নিয়েও আমার নিকট আস এবং আমার সঙ্গে কাউকে অংশী স্থাপন না করে থাক, তাহ’লে তোমার কাছে আমিও পৃথিবী পূর্ণ ক্ষমা নিয়ে হাযির হব’।
তিরমিযী হা/৩৫৪০; মিশকাত হা/২৩৩৬
যাবতীয় সৎ আমল বাতিল :
মহান আল্লাহ তাআ'লা বলেন,
ذَلِكَ هُدَى اللَّهِ يَهْدِي بِهِ مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ‘
এটাই আল্লাহর হেদায়াত। তিনি স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যাকে চান এ পথে পরিচালিত করেন। তবে যদি তারা শিরক করত, তাহ’লে তাদের সব কাজকর্ম নিস্ফল হয়ে যেত।
সূরা আন‘আমঃ ৮৮
তিনি আরো বলেন,
وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
‘অথচ নিশ্চিতভাবে তোমার প্রতি ও তোমার পূর্ববর্তীদের (নবীদের) প্রতি (তাওহীদের) প্রত্যাদেশ করা হয়েছে। অতএব যদি তুমি শিরক কর, তাহ’লে তোমার সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে যাবে এবং তুমি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’।
সূরা যুমারঃ ৬৫
জান্নাত হারাম :
মহান আল্লাহ তাআ'লা বলেন,
إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ
‘বস্তুতঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করে, আল্লাহ অবশ্যই তার উপরে জান্নাতকে হারাম করে দেন এবং তার ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। আর যালেমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই’।
সূরা মায়েদাহঃ ৭২
শিরক জান্নাত ও জাহান্নামের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়:
শিরক না করলে জান্নাত আর করলে জাহান্নাম।
এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে,
عَنْ جَابِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثِنْتَانِ مُوجِبَتَانِ قَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَا الْمُوجِبَتَانِ؟ قَالَ: مَنْ مَاتَ يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا دَخَلَ النَّارَ، وَمَنْ مَاتَ لَا يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ
‘জাবির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেছেন, দু’টি বিষয় অপরিহার্য। জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) উক্ত বিষয় কি? তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক না করে মারা যাবে সে জান্নাতে যাবে। আর যে ব্যক্তি শরীক করে মারা যাবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’।
মুসলিম হা/২৯৭; মিশকাত হা/৩৮।
কাফির মুশরিকরা কখনই কল্যাণ ও সফলতা লাভ করতে পারে না :
মহান আল্লাহ তাআ'লা বলেন,
وَمَنْ يَدْعُ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ لَا بُرْهَانَ لَهُ بِهِ فَإِنَّمَا حِسَابُهُ عِنْدَ رَبِّهِ إِنَّهُ لَا يُفْلِحُ الْكَافِرُونَ
‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্যকে আহবান করে, তার উক্ত কথার কোন প্রমাণ নেই। তার হিসাব (বদলা) তো তার প্রতিপালকের কাছেই রয়েছে। নিশ্চয়ই অবিশ্বাসীরা সফলকাম হয় না’।
সূরা মুমিনুনঃ ১১৭
শিরককারীর জন্য রাসূল (সাঃ) শাফা‘আত করবেন না :
عَنْ عَوْفِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَتَانِي آتٍ مِنْ عِنْدِ رَبِّي، فَخَيَّرَنِي بَيْنَ أَنْ يُدْخِلَ نِصْفَ أُمَّتِي الْجَنَّةَ وَبَيْنَ الشَّفَاعَةِ، فَاخْتَرْتُ الشَّفَاعَةَ، وَهِيَ لِمَنْ مَاتَ لَا يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا
আওফ ইবনু মালিক আল-আশজাঈ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে একজন আগন্তুক আমার সামনে আসলেন এবং ২টি প্রস্তাবের যে কোন একটি গ্রহণের ইখতিয়ার (স্বাধীনতা) দিলেন।
(১) হয় আমার উম্মতের অর্ধেক সংখ্যক ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে অথবা
(২) আমার সুপারিশের সুযোগ থাকবে। আমি সুপারিশ করাকেই বেছে নিলাম। আর তা হবে সেই সকল ব্যক্তির জন্য যে সকল ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার সাথে কোন শরীক না করে মৃত্যুবরণ করেছে’।
তিরমিযী হা/২৪৪১; ইবনু মাজাহ হা/৪৩১৭; মিশকাত হা/৫৬০০।
শিরক মহা পাপ। তওবা ব্যতীত কখনো এ পাপ ক্ষমা হয় না। তবে অন্য পাপ করে তওবা ছাড়া মারা গেলে আল্লাহ তা‘আলা চাইলে তাকে ক্ষমা করতে পারেন। অথবা জাহান্নামে দিয়ে পাপের শাস্তি ভোগ করার পর কালিমার বদৌলতে এক সময় জান্নাতে পাঠাবেন।
শিরকের উপরোক্ত ভয়াবহ অবস্থার কারণেই রাসূল (সাঃ) অত্যন্ত কঠোর ভাষায় বলে দিয়েছেন।
عَنْ مُعَاذٍ قَالَ: أَوْصَانِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِعَشْرِ كَلِمَاتٍ، قَالَ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ شَيْئًا، وَإِنْ قُتِلْتَ وَحُرِّقْتُ
‘তুমি কোনকিছুকে আল্লাহর সাথ শরীক করো না। যদিও তোমাকে হত্যা করা হয় এবং আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়’।
আহমাদ হা/২১১২৮; উরওয়াউল গালীল হা/২০২৬; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব হা/২৫১৬; মিশকাত হা/৬১।
সতর্কবাণী :
কোন অবস্থাতেই যেন আল্লাহ তা‘আলার সাথে ছোট-বড় কোন ধরণের শিরক না হয় সে ব্যাপারে তীব্র সচেতন থাকতে হবে। তাওহীদ বা আল্লাহর অধিকার আদায়ের ব্যাপারেও অনেক বেশী সচেতন থাকতে হবে।
সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, পালনকর্তা হিসাবে বান্দা আল্লাহকে বিশ্বাস করে। তেমনি আইন ও বিধানদাতা হিসাবেও বিশ্বাস রাখবে। নিজের কিংবা কর্তৃপক্ষ কিংবা আলেম-ওলামা বা নেতৃবৃন্দের খেয়াল-খুশী মোতাবেক কোন বিধান রচনা করবে না যা প্রত্যাক্ষ বা পরোক্ষভাবে আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতা বা সার্বভৌমত্বের সাথে সাংঘর্ষিক হয়।
আসুন, আমরা সকলে ঈমানী দায়িত্ব পালন করি। মানুষকে শিরক মুক্ত ঈমানের আহ্বান জানাই। নবী ও ওলীদেরকে মহান আল্লাহ পাকের বৈশিষ্ট্যের সমকক্ষ না করি।রাষ্টীয় ক্ষমতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দেশের জনগণকে সকল ক্ষমতার মালিক বলে মনে না করি। কোন ভাস্কর্য্য ,মূর্তি, শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য নিরবে দাঁড়িয়ে না থাকি।
সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষবাদ, কমিউনিস্ট, মার্ক্সবাদ, পুঁজিবাদ, জাতীয়তাবাদ, সুফিবাদকে না বলি ও প্রত্যাখান করি ও বাদ দেই। মাজার ও কবরে নযর-মানত না করি। মাজার ও কবরে গিয়ে মাজার ও কবর মুখী হয়ে দোয়া ও নামায না করি।
বিপদাপদ-বালামুছীবাতে, রিং, পৈতা, সূতা শরীরে বাঁধা থেকে দূরে থাকি।
হাদীসে বর্ণিত দোয়া, আমলে আনার চেষ্টা করি।
গণক ও জোতির্বিদদের নিকট গমন থেকে দূরে থাকি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গায়েব জানতেন এ-আক্বীদা-বিশ্বাস থেকে বেঁচে থাকি।
শিরক সম্পর্কে সর্বদা মনে রাখার মতো কথা হল :৷ জীবন বিপন্ন হ’লেও শিরক করা যাবে না।
শিরকের পাপের কোন ক্ষমা নেই । শিরকের পরিণতি ধ্বংস । শিরক সমস্ত নেক আমলকে বিফল করে দেয়। মুশরিকরা চিরস্থায়ী জাহান্নামী।
মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নিষেধঃ
مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُواْ أَن يَسْتَغْفِرُواْ لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُواْ أُوْلِي قُرْبَى مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ
নবী ও মুমিনের উচিত নয় মুশরেকদের মাগফেরাত কামনা করে, যদিও তারা আত্নীয় হোক একথা সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে তারা দোযখী।
সূরা তাওবাঃ ১১৩
শিরক মিশ্রিত ঈমান কখনোই ঈমান হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
সুতরাং, শিরক থেকে বেঁচে থাকার জন্য সবসময় আল্লাহ তা‘আলার নিকটে প্রাণখুলে দো‘আ করা ও সাহায্য প্রার্থনা করা কর্তব্য। রসূল (সা) শিরক হ’তে বাঁচার জন্য আমাদেরকে দো‘আ শিখিয়েছেন:
اَللَّهُمَّ إِنَّا نَعُوْذُبِكَ أَنْ نُشْرِكَ شَيْئًا نَعْلَمُهُ وَنَسْتَغْفِرُكَ لَمَا لاَ نَعْلَمُ
‘আল্লাহুম্মা ইন্না না‘ঊযুবিকা আন নুশরিকা শাইআন না‘লামুহ, ওয়া নাসতাগফিরুকা লিমা লা না‘লামুহ।
“হে আল্লাহ্, জেনে বুঝে শিরক করা থেকে আমরা আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং আমাদের অজ্ঞাত শিরক থেকে আপনার নিকটে ক্ষমা চাচ্ছি।”
আদাবুল-মুফরাদঃ ৭১৬
আল্লাহ আমাদের সবাইকে ছোট-বড় সকল প্রকার শিরক হতে রক্ষা করুন, আমীন!
0 Comments