Recent Tube

দ্যা চয়েস ইজ ইউরস- ৪৪; জিয়াউল হক।

    
         দ্যা য়ে ইজ রস- ৪৪
                           

অনেক বুঝিয়ে তাঁকে বিয়েতে রাজী করিয়ে স্বামী স্ত্রী উভয়ে মিলে উবাইদ বিন যিয়াদের সাথে তাঁর বিয়ে দেন। এই দম্পতির গর্ভে জন্ম নেন এক পুত্র সন্তান; আইমান। সেই থেকে বারাকাহ হয়ে উঠেন উম্মে আইমান বা আইমানের মা। আমৃত্যু এই নামেই পরিচিতা ছিলেন।

ভালোই চলছিল। কিন্তু কিছুদিন পরে স্বামী উবাইদ ইন্তেকাল করলে সন্তান’সহ বারাকাহকে প্রিয় মুহাম্মদ সা: নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন আবারও। ততোদিন প্রিয় মুহাম্মদ সা: নবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। উম্মে আইমান তখন পঞ্চাশোর্ধা এক নারী। ইসলাম গ্রহণকারী দ্বিতীয় নারী, প্রথম একুশজনের একজন।

ইতোমধ্যেই বেশকিছু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছেন। দিনে দিনে তাদের সংখ্যাও বড়ো হচ্ছে। এরকম একটা পর্যায়ে প্রিয় রাসুল সা: একদিন কয়েকজন সাহাবির উপস্থিতিতে বললেন; ‘আমি একজন নারীকে জানি, যার কোন সম্পদ নেই, বয়স্কা এবং সাথে একটা ইয়াতিম ছেলেও আছে কিন্তু তিনি জান্নাতি, তোমাদের মধ্যে কেউ কি একজন জান্নাতি নারীকে বিয়ে করতে চাও?’

প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এর মুখ থেকে এর চেয়ে আর বেশি কিছু মন্তব্য, বক্তব্য ও পরিচয়ের প্রয়োজন ছিল না। হযরত যায়েদ রা: এগিয়ে এলেন (যায়েদ ইবনে হারিসা) নবিজী সা: এঁর কাছে বিয়ের প্রস্তাব করলে পরবর্তিতে রাসুলুল্লাহ সা: উম্মে আইমানের সাথে পরামর্শ করে তাঁর মতামত নেন। পরিশেষে বিয়ের আয়োজন ও বিবাহ সম্পাদনও হলো।

এতিম মুহাম্মদ সা: এর জীবনে জন্মমহুর্ত থেকে মায়ের ভূমিকা ও দায়িত্ব পালনকারী উম্মে আইমানকে সংসারজীবনে পূনর্বাসন করতে পারাটা প্রিয় নবী সা: এর জন্যও অত্যন্ত আবেগময় স্বিদ্ধান্ত ও উদ্যোগ ছিল। বিয়ের দিন তিনি কান্নাজড়িত গলায় যায়েদ রা:কে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে জানতে চেয়েছিলেন; তুমি কি জানো কাকে বিয়ে করছো?
 
যায়েদ রা: উত্তর দিয়েছিলেন‘ উম্মে আইমানকে ইয়া রাসুলুল্লাহ সা.
‘না, তুমি আমার মা’কে বিয়ে করছো।’ প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা. জবাব দিলেন।
এই দম্পতির গর্ভেই জন্ম নিয়েছিলেন প্রখ্যাত সাহাবি উসামা বিন যায়েদ রা.। প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা. উসামাকে নিজের সন্তানের মতোই স্নেহ করতেন। এ ঘটনা উম্মে আইমান ও রাসুলুল্লাহ সা. এঁদের দু’জনের মধ্যে আত্মিক ও মানসিক বন্ধন তথা, সাইকোলোজিক্যাল ও ইমোশনাল বন্ডিংকে (Psychological and Emotional Bonding) আমাদের সামনে খুব সুন্দরভাবেই তুলে ধরে। 

ইতিহাসের পাতায় পাতায় উভয়ের মধ্যে এই যে বন্ধন তার প্রমাণ আমরা পাই। কেবলমাত্র পারিবারিক পরিমন্ডলেই এই নারী মুহাম্মদ সা. কে আগলে রাখেননি। তিনি ছুটে গেছেন যুদ্ধের ময়দানেও। ওহুদ যুদ্ধের সময় ময়দানে, আহতদের তাঁবুতে উপস্থিত থেকে আহতদের সেবা করেছেন। যুদ্ধের কঠিনতম মহুর্তে মুসলমানদের একটা অংশ যখন পিছু হটছিলেন, তখন এই নারী তাদের ধমকে ধমকে যুদ্ধের ময়দানে ফেরত পাঠাচ্ছিলেন।

হুনাইনের যুদ্ধেও তিনি মাঠে ছিলেন। সেই সাথে মাঠে ছিলেন তাঁর দুই পুত্র; আইমান আর উসামা। এই যুদ্ধেই তাঁর আদরের বড় সন্তান আইমান রা. শাহাদাত বরণ করেন।

বাস্তবিকই এই বন্ডিংয়ের কারণেই প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এর উপরে এই নারীর প্রভাব ছিল অপরিসীম। দু’জনের মধ্যে মানসিক বন্ধনও ছিল প্রগাড়। তিনি সা: কখনওই তাঁকে আরবের প্রথানুযায়ী উম্মে আইমান বলে, নাম ধরে ডাকেন নি। ডেকেছেন; ইয়া উম্মি; ‘মা গো’ বলে। পরিচয় করিয়ে দিতে প্রকাশ্যেই বলতেন; উম্মি বা ‘আমার মা’ 

মুহাম্মদ সা: কিছু খেতে না চাইলে তাকে কেউ তা খাওয়াতে পারতেন না। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন উম্মে আইমান, তিনি বললে মুহাম্মদ সা: কোনরকম দ্বিরুক্তি করতেন না, খেয়ে নিতেন। রাসুল সা: যতোক্ষণ খেতেন, উম্মে আইমানও তাঁর পাশে বসে থাকতেন।

এই ভালোবাসার প্রকাশ কেবল একমূখী ছিল না। প্রিয় রাসুল সা: এঁর পক্ষ থেকেও এরকম আচরণের প্রকাশ ছিল। এই নারী, মক্কা থেকে দীর্ঘ এক ক্লান্তিকর যাত্রার মাধ্যমে হিজরত করে মদিনায় এসে পৌছুলে নিজের গায়ের চাদরের একটা অংশ ভিজিয়ে সেই ভেজা অংশ দিয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত উম্মে আইমান রা. এঁর মুখ থেকে ঘাম ও ধুলো বালি মুছে দিয়ে তাঁকে শান্তনার বাণী শুনিয়ে বলেছিলেন; ‘মা গো (উম্মি) জান্নাতে আপনার এরকম কোন কষ্ট থাকবে না।’

প্রিয় নবীজি সা: উম্মে আইমানের প্রযোজন ও তাঁর সুবিধা অসুবিধার দিকে তীক্ষè দৃষ্টি রাখতেন। তাঁর নিজের ইন্তেকালের সময় তিনি সাহাবিদের উদ্দেশ্যে অসিয়ত করে যান;  

‘তোমরা উম্মে আইমান রা. এঁর যত্ন নিবে, তিনি আমার মায়ের মত। তিনিই একমাত্র নারী, যিনি আমাকে জন্ম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখেছেন। আমার পরিবারের একমাত্র সদস্য, যিনি সারা জীবন আমার পাশে ছিলেন।’ সাহাবীরা সেই কথা মেনে চলেছেন সারা জীবন।

প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: কে তিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। সারা জীবন নিজেকে তাঁর মায়ের ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন। প্রিয় নবী সা. এঁর ইন্তেকালে তিনি অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছিলেন। ‘অহির দরোজা চীরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল’ বলে আক্ষেপও করেছিলেন। 

এর মাধ্যমে আল্লাহর তাওহিদ ও রেসালাতের সাথে তাঁর যে আত্মিক সম্পৃক্ততা কতোটা গভীর ও আবেগময় ছিল, সেটা বুঝা যায়। প্রিয় রাসুল সা: এঁর ইন্তেকালের কিছুদিন পরে তিনি মদিনায় ইন্তেকাল করেন।

একজন দাসী, কৃষ্নাঙ্গী নারীর এই যে আত্মত্যাগের এমন উজ্জল দৃষ্টান্ত প্রিয় নবী সা. এঁর জীবনের প্রারাম্ভ থেকে, তা শিশু মুহাম্মদ সা. এঁর মানসপটে নিশ্চিতভাবেই এক বিরাট প্রভাব ফেলেছে বলেই আমাদের মনে হয়। 

শিশু মুহাম্মদ নবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ও অহি পাওয়া শুরুর অনেক আগে থেকেই সমাজে দাস দাসীদের মানবিক অধিকার ও মুক্তি নিশ্চিত করার ব্যপারে যে উদ্যোগী হয়েছিলেন, সম্ভবত তার অন্তর্ণীহিত কারণও এখানেই বিদ্যমান।
----------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments