Recent Tube

শুধুমাত্র পানাহার বর্জনের নাম সিয়াম (রোযা) নয়। সিয়াম হলো আল্লাহর বিধান পালন ও বাস্তবায়নের ট্রেনিং কোর্স: মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।



    শুধুমাত্র পানাহার বর্জনের নাম সিয়াম (রোযা) নয়। সিয়াম হলো আল্লাহর বিধান পালন ও বাস্তবায়নের ট্রেনিং কোর্স: 


   আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ.
"হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।" (সূরা বাকারাঃ ২/১৮৩)

       শরীয়াতের পরিভাষায় তাকওয়া হলো, বান্দা যেন আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে, আর তা করতে হলে যা করতে হবে তা হলো, তাঁর নির্দেশকে পুরোপুরি মেনে নেয়া, এবং তাঁর নিষেধকৃত বস্তুকে পুরোপুরি ত্যাগ করা। আর মুত্তাকী হলেন, যিনি আল্লাহর বিধান পুরোপুরি মেনে নিয়ে এবং তার নিষেধ থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থেকে তার অসন্তুষ্টি ও শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। এক কথায় বলা যায় তাকওয়া হলো মুমিনের এমন হাতিয়ার যার মাধ্যমে সে আল্লাহর বিধান/আইন পালন ও তা বাস্তবায়নে সর্বদা সচেষ্ট থাকে। আর এটিই হলো সিয়ামের প্রশিক্ষণ।

      যারা সিয়াম পালন করেন, তাদের দুইটি শ্রেণী রয়েছে। এক শ্রেণী তাকওয়া অর্জন করে আল্লাহর বিধান পালনে ও বাস্তবায়নে সর্বদা সচেষ্ট থাকে বিধায় পূর্ববর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করা হয়। অন্য শ্রেণী সিয়ামের প্রশিক্ষণ অর্জন করতে পারে না, কুফুরী বিধানেই সন্তুষ্ট থাকে বিধায় তারা ক্ষুধা-পিপাসা ছাড়া কিছুই লাভ করতে পারে না। 
প্রথম শ্রেণীর রোযাদারদের বিষয়ে বিশ্ব নবী (সাঃ) বলেন,
 «مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَاناً وَاحْتِسَاباً، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ»
“যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রমযানের রোজা পালন করে, তার অতীতের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।” (সহীহ বুখারী হাঃ ৩৮, ১৯০১, ২০১৪, সহীহ মুসলিম হাঃ ৭৬০, জামে তিরমিযী হাঃ ৬৮৩, সুনান নাসায়ী হাঃ ২২০৩, ২২০৪, আবূ দাউদ হাঃ ১৩৭১, ইবনে মাজাহ হাঃ ১৬৪১, আহমাদ হাঃ ৭১৩০, ৭২৩৮,  ১০১৫৯, ২৭৬৭৫, দারেমী হাঃ ১৭৭৬, আবী শায়বা হাঃ ৮৮৭৫, ইবনে খুযাইমা হাঃ ১৮৯৪, ইবনে হিব্বান হাঃ ৩৪৩২, সুনানুল কুরবা বায়হাকী হাঃ ৮৫০৬; গৃহীত: আমার সংকলিত, 'নির্বাচিত হাদীস' পৃঃ ২১ হাঃ ৩১),

     ঈমান হলো আল্লাহর উলুহিয়্যাত ও রুবুবিয়্যাত বিশ্বাস স্থাপন করা, এর দাবী হলো আল্লাহর বিধানকে সকল জাহেলী বিধানের উপর প্রাধান্য দিয়ে একমাত্র তাঁরই দাসত্ব করা। আর ইহতিসাব এর অর্থ এই যে, মুমিন ব্যক্তি সব সময় নিজের কাজ কর্মের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখবে ও ভেবে দেখবে যে, আল্লাহর বিধান ও মর্জির খেলাফ হচ্ছে কি না। এ দু'টি জিনিসের সাথে যে ব্যক্তি রমযানের পূর্ণ রোযা রাখবে, সে তার অতীতের গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারবে। আর এমন সিয়াম পালনকারীদের আল্লাহ তা'য়ালা স্পেশাল সংবর্ধনার মাধ্যমে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।

     সাহল ইবনে সায়াদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন,
«إنَّ في الجَنَّةِ بَاباً يُقَالُ لَهُ: الرَّيَّانُ، يَدْخُلُ مِنْهُ الصَّائِمُونَ يَومَ القِيَامَةِ، لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أحدٌ غَيْرُهُمْ، يقال: أيْنَ الصَّائِمُونَ ؟ فَيَقُومُونَ لاَ يَدخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ، فَإذَا دَخَلُوا أُغْلِقَ فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ».
“জান্নাতের মধ্যে এমন একটি দরজা আছে, যার নাম হল ‘রাইয়ান’; সেখান দিয়ে কেবল সিয়াম পালনকারীগণই কিয়ামতের দিনে প্রবেশ করবে। তারা ছাড়া আর কেউ সেদিক দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা করা হবে, ‘রোজাদাররা কোথায়?’ তখন তারা দণ্ডায়মান হবে। (এবং ঐ দরজা দিয়ে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে) তারপর যখন তাদের সর্বশেষ ব্যক্তি প্রবেশ করবে, তখন দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। আর সেখান দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।” 
(সহীহ বুখারী হাঃ ১৮৯৬, ৩২৫৭, সহীহ মুসলিম হাঃ ১১৫২, জামে তিরমিযী হাঃ ৭৬৫, সুনান নাসায়ী হাঃ ২২৩৬, ২২৩৭, ইবনু মাজাহ হাঃ ১৬৪০, আহমাদ হাঃ ২২৩১১, ২২৩৩৫)

        আবার দ্বিতীয় শ্রেণী রোযাদারদের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেনঃ
 «رُبَّ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهِ إِلَّا الْجُوعُ وَرُبَّ قَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ قِيَامِهِ إِلَّا السَّهَرُ».
"অনেক সিয়াম পালনকারী আছে যারা সিয়ামের বিনিময়ে ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই অর্জন করতে পারে না। অাবার অনেক সালাত আদায়কারী আছে যারা সালাতের মাধ্যমে রাত জাগরণ ছাড়া আর কিছুই লাভ করতে পারে না।" (ইবনে মাজাহ হাঃ ১৬৯০, মুসনাদে আহমাদ হাঃ ৮৬৩৯, ৯৩৯২, দারেমী হাঃ ২৭২০, মিশকাত হাঃ ২০১৪, সহীহুত তারগীব ১/২৬২)

       আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
ِّ مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ للهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ.
"যে ব্যক্তি মিথ্যা ও পাপের কথা বলা এবং সে অনুযায়ী পাপ কর্ম বর্জন করেনি, তার পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।" (সহীহ বুখারী হাঃ ১৯০৩, জামে তিরমিযী হাঃ ৭০৭, আবু দাউদ হাঃ ২৩৬২, ইবনে মাজাহ হাঃ ১৬৮৯, মুসনাদে আহমদ হাঃ ১০৫৬২, সহীহ ইবনে খুযাইমা হাঃ ১৯৯৫, সহীহ ইবনে হিব্বান হাঃ ৩৪৮০, মিশকাত হাঃ ১৯৯৯)

       রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেনঃ
ليس الصيام من الأكل و الشرب إنما الصيام من الغو و الرفث.
"শুধু পানাহার বর্জনের নাম সিয়াম নয়। সিয়াম হলো অনর্থক ও অশ্লীল পাপের কথা-কাজ বর্জন করা।" (সহীহ ইবনে খুযাইমা হাঃ ১৯৯৬, সহীহ ইবনে হিব্বন ৮/২৫৫, মুস্তাদরাকে হাকেম ১/৫৯৫, সহীহুত তারগীব ১/২৬২)

      সুতরাং আল্লাহর বিধান লঙ্ঘনকারীর পানাহার বর্জন "উপবাস" বলে গণ্য হতে পারে তবে ইসলামী দৃষ্টিতে "সিয়াম" বলে গণ্য হবে না। আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করে হারাম কাজ-কর্মে রত থেকে হালাল খাদ্য ও পানীয় থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখার নাম সিয়াম নয়।  সিয়াম হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যাবতীয় হারাম ও পাপ সহ সকল ধরণের নাফরমানী বর্জন করার সাথে সাথে হালাল খাদ্য, পানীয় ও সম্ভোগ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। এভাবে হৃদয়ে সার্বক্ষণিক আল্লাহভীতি সচেতনতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে লক্ষ্য রেখে শত শয়তানী প্রলোভন ও ভ্রান্ত আবেগ দমন করে সততা ও নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর বিধানের উপর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য সিয়াম এক গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনিং কোর্স। এক কথায়, তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি অর্জনের মাধ্যমে সকল প্রকার কুফুরী বিধান বর্জন করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আল্লাহর বিধান মেনে তা বাস্তবায়ন করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করাই সিয়ামের শিক্ষা।

       কিন্তু যারা আল্লাহর আইন মানে না এবং তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করে না বরং তাগুতী জাহেলিয়্যাতের আইন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে কিংবা মানুষকে জাহেলী বিধানের দিকে আহ্বান করে অথবা সেই আহ্বানে সাড়া দেয় তারা সালাত, সিয়াম আদায় করার পরেও জাহান্নামে যাবে। তাদের সালাত, সিয়াম জাহান্নামের আযাব থেকে তাদেরকে রক্ষা করবে না। হারিস আল-আশয়ারী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন,
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.. مَنْ دَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ فَهُوَ مِنْ جُثَاءِ جَهَنَّمَ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَإِنْ صَامَ وَإِنْ صَلَّى قَالَ وَإِنْ صَامَ وَإِنْ صَلَّى وَزَعَمَ أَنَّهُ مُسْلِمٌ. 
  রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, "যারা (মানবরচিত) জাহেলী বিধানের দিকে মানুষকে আহ্বান জানাবে (আর যারা তা মেনে চলবে) তারা জাহান্নামী হবে। বলা হলো- হে আল্লাহর রাসূল! তারা যদি সিয়াম পালন করে এবং সালাত আদায় করে? তিনি বললেন, তারা যদি সিয়াম পালন করে, সালাত আদায় করে এবং নিেজের মুসলিম বলে ঘোষণা করে তবুও।" (মুসনাদে আহমদ হাঃ ১৬৭১৮, ১৭৩৪৪, জামে তিরমিযী হাঃ ২৮৬৩, সহীহ ইবনে হিব্বান হাঃ ৬২৩৩, সহীহ ইবনে খুযাইমা হাঃ ১৮৯৫, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক হাঃ ৫১৪১, জামিউল আহাদীস হাঃ ৪৪, মিশকাত হাঃ ৩৬৯৪, সহীহুল জামে হাঃ ১৭২৮; হাদীসটি সহীহ। গৃহীত: নির্বাচিত হাদীস, পৃঃ ৩৯-৪০, হাদীস নং ১০০)

       সুতরাং আমরা যারা সিয়াম পালন করছি তাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে, আমরা কোন শ্রেণীর রোযাদার। সিয়াম পালনের মাধ্যমে আল্লাহর বিধান মেনে চলা ও তা বাস্তবায়নের ট্রেনিং তথা শিক্ষা অর্জন করতে না পারেন বরং আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করে কুফুরী বিধানে সন্তুষ্ট থাকেন এবং বিভিন্ন হারাম কাজে লিপ্ত থাকেন, তাহলে আপনি নিশ্চিত জেনে রাখুন যে, আপনি সিয়ামের নামে আত্মপ্রবঞ্চনার মধ্যে লিপ্ত আছেন। ধার্মিকতা ও ধর্ম পালনের মিথ্যা অনুভূতি ছাড়া আপনার কিছুই লাভ হচ্ছে না। আর তাই এই ধর্ম পালনের মিথ্যা অনুভূতি আপনাকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। কুরআনে আল্লাহ তা'য়ালা সিয়াম পালনের নির্দেশ দিয়েছেন, আপনি আহার পানাহার বর্জন করে শত কষ্টের মাঝেও আল্লাহর নির্দেশ মেনে নিয়ে সিয়াম পালন করলেন কিন্তু আল্লাহ তা'য়ালা একই কুরআনে দ্বীন কায়েমের নির্দেশ দিয়েছেন, এ কাজে ঝুঁকি আছে তাই আপনি এ দুনিয়ায় কিছু ফায়দা ও আল্লাহদ্রহী শক্তির অনুকম্পনা পেতে  তাঁর নির্দেশ না মেনে বিরোধীতা করছেন, তাহলে আপনি কেমন রোযাদার?
--------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা আলোচক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments