Recent Tube

তাক্বদীর প্রেরণার বাতিঘর ; আব্দুল্লাহ আরমান।

     

   তাক্বদীর
   প্রেরণার বাতিঘর ;


      তাক্বদীরে বিশ্বাসের মাঝে গভীর থেকে গভীরতর ইতিবাচক সাইকোলজিক্যাল প্রভাব আছে যা মানুষকে একটি সুখী ও সফল জীবন গঠনে কয়েকধাপ এগিয়ে দেয়! শুধু তাই নয় এর মাঝেই লুকিয়ে আছে বহু রোগের মহৌষধ যা মানুষকে উপহার দেয় শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রাণবন্ত একটি জীবন। প্রশ্ন আসতেই পারে নিছক একটি ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে এসবের কী সম্পর্ক?! মনে এমন কৌতুহল তৈরী হলে লেখাটি আপনার জন্যই….।

      এক্ষেত্রে প্রথমেই তাক্বদীর সম্পর্কে বিশুদ্ধ কনসেপ্ট থাকা জরুরী। তাত্বিক আলোচনা এড়িয়ে সহজ ভাষায় বলা যায়, “জীবনাচরণ ও কর্মের ক্ষেত্রে মানুষ তার সর্বোচ্চ চেষ্টা  ও আল্লাহর কাছে কল্যাণের দোআ অব্যাহত রেখে পরিশেষে যে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক ফলাফল পায়, তাই তাক্বদীর”। মোটকথা ‘কর্ম অকার্যকর’ ও ‘কর্মই সব’ এই উভয় প্রান্তিক মতের মধ্যপন্থাই হলো তাক্বদীরে বিশ্বাসের সঠিক রূপরেখা। এই বিশ্বাস ব্যতীত ঈমানের দাবী নিতান্তই মূল্যহীন।

 
       ফলিত মনোবিজ্ঞানের জনক প্রফেসর উইলিয়াম জেমস বলেছেন, “আমাদের জীবনে দুর্ভাগ্যজনক যা কিছু ঘটে তা মেনে নেওয়াটাই হলো এর অশুভ পরিণতি এড়াবার প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ”।
আরেকজন বিখ্যাত চিকিৎসক ডঃ ও.এফ.গবার বলেছেন, “ডাক্তারদের কাছে যত রোগী আসেন তার ৭০ শতাংশ নিজেরাই নিজেদের রোগ মুক্ত করতে সক্ষম হতেন যদি তারা তাদের জীবন থেকে অহেতুক দুশ্চিন্তা দূর করতে পারতেন।”

      তাক্বদীরে বিশ্বাস আমাদের একই শিক্ষা দেয়। কর্ম অনুযায়ী আশানুরূপ ফল না পেলে কিংবা জীবনে আকস্মিক কোনো বিপদ উপস্থিত হলে দুশ্চিন্তা না করে এটাকে আল্লাহর সিন্ধান্ত তথা তাক্বদীর হিসেবে মেনে নেওয়া এবং বিপদকে ওভারকাম করতে চেষ্টা করা মুমিনের জন্য আবশ্যক। কারণ বাহ্যিক বিপদের মাঝেই নিহিত থাকে আমাদের নিয়ে আল্লাহর সুদূরপ্রসারী  মহা-পরিকল্পনা। অনেকসময়  ছোট্ট বিপদের মাধ্যমেই উন্মোচিত হয় বৃহত্তর সফলতার দ্বার। রাসূলের (সাঃ) হিজরতের ঘটনা এর জলজ্যান্ত প্রমাণ। ছোট্ট মক্কা শহরের গুটিকয়েক কুরাইশের হুমকিতে কষ্টের পাহাড় বুকে চাপিয়ে তিনি বিতাড়িত হয়েছিলেন নিজের জন্মস্থান ও বসতভিটা থেকে। বাহ্যিকভাবে এই হিজরত মাক্কী জীবনের ব্যর্থতাকেই ইঙ্গিত করে। কিন্তু আল্লাহর প্রতি আস্থা অবিচল রেখে মদীনায় নব উদ্যমে দাওয়াতী কার্যক্রম শুরু করার বদৌলতে সেই বিতাড়িত মানুষটির হাতেই সমগ্র বিশ্বে ইসলামের নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়। হিজরতের ফলশ্রুতিতে শত শত বছর বিশ্ব রাজনীতি ও কয়েকটি মহাদেশ নিয়ন্ত্রিত হয়েছে মুসলিমদের হাতেই। বর্তমানে সাত মহাদেশের প্রায় ১৮০ কোটি মুসলিম জনগোষ্ঠী সেই তিক্ত হিজরতেরই সুমিষ্ট ফল। সুতরাং আল্লাহর নির্ধারিত তাক্বদীর মেনে নিয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই তাক্বদীরে বিশ্বাসের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া সম্ভব।

     জীবনের নানামুখী ব্যর্থতায় দুশ্চিন্তা ও ডিপ্রেশনের কারণে শরীরে নানা রোগ বাসা বাঁধে। বদহজম, আলসার, অনিদ্রা, হৃদরোগ, মাইগ্রেন, প্যারালাইসিস, হাই প্রেশার, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড,বাতের ব্যথা ইত্যাদি বহু রোগের কারণ এই মানসিক অস্থিরতা। World health organisation(WHO)'র রিপোর্ট অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রায় ২৬৪ মিলিয়ন তথা ২৬ কোটির অধিক মানুষ ডিপ্রেশনে আক্রান্ত। শুধু তাই নয় ডিপ্রেশনের কারণে প্রতিবছর প্রায় ৮ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে! একজন মানুষ তখনই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় যখন সে বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পায় না। অপরদিকে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা-বিশ্বাস এবং তাক্বদীরকে মেনে নেওয়ার প্রবণতা এই দুশ্চিন্তা ও ডিপ্রেশন থেকে উত্তরণের সবচেয়ে সহজ পথ। এজন্য মুসলিম দেশগুলোতে নানামুখী সমস্যা সত্বেও উন্নত দেশগুলোর তুলনায় মানুষের আত্মহত্যা প্রবণতা অনেক গুণ কম। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ ফিনল্যান্ডের আত্মহত্যার হার প্রতি এক লক্ষে ১৩.৪, অথচ চরম যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ায় মাত্র ২.১!! ভাবুন তো এই প্রেরণা উৎস কী? 

    ইসলামে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া হারাম (যুমারঃ৫৩), তাক্বদীরে বিশ্বাস ফরজ (সূরা আবাসাঃ১৯) ও আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখা মুমিনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য (আনফালঃ০২)। শুধু তাই নয় তাক্বদীরকে ঈমানের রুকন হিসেবে ঘোষণা করে ঈমানী চেতনা লালনকারী প্রতিটি মুসলিমকে দৃঢ়চেতা হিসেবে গড়ে তুলতে শরীয়ত প্রণেতা বদ্ধপরিকর।
 জীবনের সকল বিপদ ও দুশ্চিন্তাকে দূর করতে রাসূলের (সাঃ) এই একটি হাদীসই যথেষ্ট…
أنَّ مَا أَخْطَأكَ لَمْ يَكُنْ لِيُصِيبكَ وَمَا أصَابَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُخْطِئَكَ وَاعْلَمْ : أنَّ النَّصْرَ مَعَ الصَّبْرِ وَأَنَّ الفَرَجَ مَعَ الكَرْبِ وَأَنَّ مَعَ العُسْرِ يُسْراً

   ভাবানুবাদঃ “যা তুমি পাওনি (তাক্বদীর অনুযায়ী) তা আসলেই তোমার প্রাপ্য ছিল না। যা তোমার জীবনে ঘটেছে (তাক্বদীর অনুযায়ী) তা ঘটা অনিবার্য ছিলো। আর জেনে রাখো, সফলতা নিহিত আছে ধৈর্যের মাঝে, মুক্তির উপায় নিহিত আছে কষ্টের মাঝে এবং কঠিনের সাথেই সহজ জড়িয়ে আছে।” (মুসনাদে আহমাদ ২৮০৩)।

    একজন হতাশাগ্রস্ত মানুষের জন্য এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ মোটিভেশান আর আছে কি?

    সংসার জীবনে চলার পথে যে সুখ আমরা লাভ করি, যে গভীর দুঃখে আমরা নিপতিত হই কিংবা এমন অপ্রত্যাশিত বিপদ যা হৃদয়কে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয় এর কোনো কিছুই আল্লাহর নিকট বৃথা নয়। পার্থিব জীবন যত কঠিন পরকালীন হিসাব ও মুক্তি ততই সহজ হবে, এটাই আল্লাহর ওয়াদা। এদিকে ইঙ্গিত করে  রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন, “ মু’মিনের প্রতিটি অবস্থাই বিস্ময়কর। সকল কাজই তার জন্য কল্যাণকর। মু’মিন ছাড়া অন্য কেউ এ বৈশিষ্ট্য লাভ করতে পারে না। তারা সুখ-শান্তি লাভ করলে শুকর-গুজার করে আর অস্বচ্ছলতা বা দু:খ-মুসীবাতে আক্রান্ত হলে সবর করে (এবং পরকালে এর বিনিময় লাভ করে), তাই (সুখ/দুঃখ) সবই তার জন্য কল্যাণকর”। (মুসলিমঃ৭৩৯০)

    তাক্বদীর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মোটিভেশান। শারীরিক-মানসিক সুস্থতা ও সুখী জীবন গঠনের জন্য তাক্বদীরে বিশ্বাসের বিধান মহান আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত বটে। এটিই আমাদের বিপদসংকুল জীবন চলার পথে প্রেরণার বাতিঘর।
--------------------------
প্রেরণার বাতিঘর (বই থেকে সংক্ষেপিত)
প্রকাশিতব্য বইঃ বিনি সুতোর বাঁধন।
--------------------------------- 
লেখকঃ ইসলামিক আর্টিকেল লেখক গ্রন্থপ্রনেতা অনলাইন এক্টিভিস্ট ও শিক্ষক। 

Post a Comment

0 Comments