Recent Tube

আমীরে মুয়াবিয়ার পক্ষ নিয়ে আমীরুল মু'মিনীন খলিফাতুল মুসলিমীন মাওলা আলী রাঃ এর খিলাফতের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করার অপরাধে মৃত্যুর পূর্বে আমর ইবনুল আস (রাঃ) এর কান্না ও অনুশোচনাঃ ------- মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।




 

আমীরে মুয়াবিয়ার পক্ষ নিয়ে আমীরুল মু'মিনীন খলিফাতুল মুসলিমীন মাওলা আলী রাঃ এর খিলাফতের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করার অপরাধে মৃত্যুর পূর্বে আমর ইবনুল আস (রাঃ) এর কান্না ও অনুশোচনাঃ
----------------------------------------------
হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ) এর বীরত্ব, রাজনৈতিক  প্রজ্ঞা ও বিজয় কাহিনীতে ইতিহাসের পাতা সমৃদ্ধ হয়ে আছে। মুসলিমদের মিসর বিজয় তাঁরই দূরদর্শিতা ও অপূর্ব বিচক্ষণতার ফল। আবার উমাইয়া বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাঁর ভূমিকাই ছিল প্রধান। আমীরুল মু'মিনীন খলিফাতুল মুসলিমীন মাওলা আলী রাঃ এবং খেলাফতে রাশেদার শক্তিকে কেবলমাত্র আমীরে মুয়াবিয়াই পরাজিত করে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেননি, তাতে আমর ইবনুল আসের ধূর্ত কূটনৈতিকতা ছিল সবচেয়ে বেশি কার্যকর। অথচ সে সময় সকলের জন্য জরুরী ছিল সুপথপ্রাপ্ত খলিফা হযরত আলী রাঃ এর আনুগত্য করা।

আবূ নাজীহ আল-ইরবাদ ইবনু সারিয়াহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এমন মর্মস্পর্শী বক্তৃতা শুনালেন যে, তাতে অন্তর ভীত হল এবং চোখ দিয়ে অশ্রু বয়ে গেল। সুতরাং আমরা বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এ যেন বিদায়ী ভাষণ মনে হচ্ছে। তাই আপনি আমাদেরকে অন্তিম উপদেশ দিন।’ তিনি বললেন, 
أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللَّهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَة.
"আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতি এবং (খলিফার) কথা শোনার ও তার আনুগত্য করার উপদেশ দিচ্ছি; যদিও তোমাদের উপর কোন নিগ্রো খলিফা হয়। (স্মরণ রাখ) তোমাদের মধ্যে যে আমার পর জীবিত থাকবে, সে অনেক মতভেদ বা অনৈক্য দেখবে। সুতরাং তোমরা আমার সুন্নাহ ও সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদ্বীনের সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরবে এবং তা দাঁত দিয়ে মজবূত করে ধরে থাকবে। আর তোমরা দ্বীনে নব উদ্ভাবিত কর্মসমূহ (বিদ‘আত) থেকে বেঁচে থাকবে। কারণ, প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা।’’ (আবূ দাউদ হাঃ ৪৬০৭, তিরমিযী হাঃ ২৬৭৩, ইবনে মাজাহ হাঃ ৪২, মুসনাদে আহমদ হাঃ ১৬৬৯৪, ১৬৬৯৫, দারেমী হাঃ ৯৫)

খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত আলী ও আমীরে মুয়াবিয়ার মতভেদ ও দ্বন্দ্বের সময় আমর ইবনুল আস সুপথপ্রাপ্ত খলিফা হযরত আলী রাঃ এর মতাদর্শ গ্রহণ না আমীরে মুয়াবিয়ার পক্ষ নিয়ে সিফফিনের যুদ্ধে সরাসরি খিলাফতের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন, এতে অসংখ্য মুসলিম নিহত হয়। মুসলিম উম্মাহর আত্মঘাতী বিরোধ নিষ্পত্তির যে সম্ভাবনা সালিশী বোর্ড গঠনের মাধ্যমে দেখা দিয়েছিল, ঐতিহাসিকদের মতে তা আমর ইবনুল আসের কূটকৌশলের কারণে ব্যর্থ হয়। উভয় পক্ষে আবার বিরোধ ও যুদ্ধ শুরু করে। আমর মিসর আক্রমণ করে খলিফা হযরত আলী রাঃ কর্তৃক নিযুক্ত গভর্নর মুহাম্মদ বিন আবী বকর রাঃ কে পরাজিত ও হত্যা করেন। এক পর্যায়ে খিলাফত ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজতন্ত্র। তবে জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি তার অতীত ভুলের জন্য অনুশোচনায় ভীষণ দগ্ধিভূত হন এবং নিজের অপরাধ স্বীকার করে অনুতপ্ত হন এবং কেঁদে কেঁদে অনুশোচনা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, "আমার দুনিয়া তৈরি হয়েছে, কিন্তু দ্বীন ধ্বংস হয়েছে। যদি এমন না হয়ে এর বিপরীত হতো, তাহলে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস আমি সফল হতাম...।" (আল-ইসতিয়াব; আসহাবে রাসূলের জীবন কথা ২/৬০)

মুহাম্মাদ ইবনু মূসান্না আল আনাযী, আবূ মাআন আল রাকাশী ও ইসহাক ইবনু মানসূর (রহঃ) ইবনু ওমাসা আল মাহরী (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, 
حَضَرْنَا عَمْرَو بْنَ الْعَاصِ وَهُوَ فِي سِيَاقَةِ الْمَوْتِ فَبَكَى طَوِيلًا وَحَوَّلَ وَجْهَهُ إِلَى الْجِدَارِ فَجَعَلَ ابْنُهُ يَقُولُ يَا أَبَتَاهُ أَمَا بَشَّرَكَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِكَذَا أَمَا بَشَّرَكَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِكَذَا قَالَ فَأَقْبَلَ بِوَجْهِهِ فَقَالَ إِنَّ أَفْضَلَ مَا نُعِدُّ شَهَادَةُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ إِنِّي كُنْتُ عَلَى أَطْبَاقٍ ثَلَاثٍ لَقَدْ رَأَيْتُنِي وَمَا أَحَدٌ أَشَدَّ بُغْضًا لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنِّي وَلَا أَحَبَّ إِلَيَّ أَنْ أَكُونَ قَدْ اسْتَمْكَنْتُ مِنْهُ فَقَتَلْتُهُ فَلَوْ مُتُّ عَلَى تِلْكَ الْحَالِ لَكُنْتُ مِنْ أَهْلِ النَّارِ فَلَمَّا جَعَلَ اللَّهُ الْإِسْلَامَ فِي قَلْبِي أَتَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقُلْتُ ابْسُطْ يَمِينَكَ فَلْأُبَايِعْكَ فَبَسَطَ يَمِينَهُ قَالَ فَقَبَضْتُ يَدِي قَالَ مَا لَكَ يَا عَمْرُو قَالَ قُلْتُ أَرَدْتُ أَنْ أَشْتَرِطَ قَالَ تَشْتَرِطُ بِمَاذَا قُلْتُ أَنْ يُغْفَرَ لِي قَالَ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ الْإِسْلَامَ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ وَأَنَّ الْهِجْرَةَ تَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلِهَا وَأَنَّ الْحَجَّ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ وَمَا كَانَ أَحَدٌ أَحَبَّ إِلَيَّ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَا أَجَلَّ فِي عَيْنِي مِنْهُ وَمَا كُنْتُ أُطِيقُ أَنْ أَمْلَأَ عَيْنَيَّ مِنْهُ إِجْلَالًا لَهُ وَلَوْ سُئِلْتُ أَنْ أَصِفَهُ مَا أَطَقْتُ لِأَنِّي لَمْ أَكُنْ أَمْلَأُ عَيْنَيَّ مِنْهُ وَلَوْ مُتُّ عَلَى تِلْكَ الْحَالِ لَرَجَوْتُ أَنْ أَكُونَ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ ثُمَّ وَلِينَا أَشْيَاءَ مَا أَدْرِي مَا حَالِي فِيهَا فَإِذَا أَنَا مُتُّ فَلَا تَصْحَبْنِي نَائِحَةٌ وَلَا نَارٌ فَإِذَا دَفَنْتُمُونِي فَشُنُّوا عَلَيَّ التُّرَابَ شَنًّا ثُمَّ أَقِيمُوا حَوْلَ قَبْرِي قَدْرَ مَا تُنْحَرُ جَزُورٌ وَيُقْسَمُ لَحْمُهَا حَتَّى أَسْتَأْنِسَ بِكُمْ وَأَنْظُرَ مَاذَا أُرَاجِعُ بِهِ رُسُلَ رَبِّي.

আমরা আমর ইবনু আস (রাঃ)-এর মুমুর্ষ অবস্হায় তাকে দেখতে উপস্হিত হলাম। তখন তিনি দেয়ালের দিকে মুখ করে অনেকক্ষণ কাঁদছিলেন। তার পুত্র তাঁকে তাঁর সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত বিভিন্ন সুসংবাদের উল্লেখ পূর্বক প্রবোধ দিচ্ছে যে, আব্বা! রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি আপনাকে অমুক সুসংবাদ দেননি? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি আপনাকে অমুক সুসংবাদ দেননি? রাবী বলেন, তখন তিনি পুত্রের দিকে মুখ ফিরালেন এবং বললেন, আমার সর্বোৎকৃষ্ট পাথেয় হচ্ছে লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম - এ কালিমার সাক্ষ্য দেয়া। আর আমি অতিক্রম করেছি আমার জীবনের তিনটি পর্যায়। 

(১) এক সময় তো আমি এমন ছিলাম যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর বিরুদ্ধাচরণে আমার চেয়ে কঠোরতর আর কেউই ছিল না। আমি যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে কবজায় পেতাম আর হত্যা করতে পারতাম, এ ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় ভাবনা। যদি সে অবস্হায় আমার মৃত্যু হতো, তবে নিশ্চিত আমাকে জাহান্নামে যেতে হতো। 

(২) এরপর আল্লাহ যখন আমার অন্তরে ইসলামের অনুরাগ সৃষ্টি করে দিলেন, তখন আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকটে উপস্থিত হয়ে অনুরোধ জানোানাম যে, আপনার ডান হাত বাড়িয়ে দিন, আমি বায়আত করতে চাই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন, তখন আমি আমার হাত টেনে নিলাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আমর , কি ব্যাপার? বললাম, পূর্বে আমি শর্ত করে নিতে চাই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেনঃ কি শর্ত করবে? আমি উত্তর করলাম, আল্লাহ যেন আমার সব শোনাহ মাফ করে দেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আমর! তুমি কি জানো না যে, ইসলাম পূর্ববর্তী সকল অন্যায় মিটিয়ে দেয়। হিজরত পূর্বেকৃত শোনাহসমুহ মিটিয়ে দেয় এবং হাজ্জ ও পূর্বের সকল শোনাহ মিটিয়ে দেয়। আমর বলেন, এ পর্যায়ে আমার অন্তরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপেক্ষা বেশি প্রিয় আর কেউ ছিল না। আমার চোখে তিনি অপেক্ষা মহান আর কেউ ছিল না। অপরির্সীম শ্রদ্ধার কারণে আমি তার প্রতি চোখ ভরে তাকাতেও পারতাম না। আজ যদি আমাকে তাঁর দেহ আকৃতির বর্ণনা করতে বলা হয়, তবে আমার পক্ষে তা সম্ভব হয়ে উঠবে না। কারণ চোখভরে আমি কখনোই তাঁর প্রতি তাকাতে পারি নি। ঐ অবস্হায় যদি আমার মৃত্যু হতো তবে অবশ্যই আমি জান্নাতী হওয়ার আশাবাদী থাকতাম। 

(৩) পরবর্তীকালে (আমীরে মুয়াবিয়া রাঃ এর পক্ষ নিয়ে খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত আলী রাঃ এর খিলাফতের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে গিয়ে) আমরা নানা বিষয়ের সাথে জড়িয়ে পড়েছি। তাই জানিনা, এতে আমার (পরিণতি কি,) অবস্হান কোথায়? সুতরাং আমি যখন মারা যাব, তখন যেন কোন বিলাপকারিনা অথবা আগুন যেন আমার জানাযার সাথে না থাকে। আমাকে যখন দাফন করবে তখন আমার উপর আস্তে আস্তে মাটি ফেলবে এবং দাফন সেরে একটি উট যবাই করে তার গোশত বল্টন করতে যে সময় লাগে, ততক্ষন আমার কবরের পাশে অবস্থান করবে। যেন তোমাদের উপস্হিতির কারণে আমি আতঙ্কমুক্ত অবস্হায় চিন্তা করতে পারি যে, আমার রবের দূতের কি জবাব দেব। (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, হাঃ ১২১; ইসলামিক সেন্টার, হাঃ ২২৯; ইসলামী ফাউন্ডেশন, হাঃ ২২১)

মৃত্যুর সময় যখন ঘনিয়ে আসল, তখন তিনি তার দুই হাত তুলে প্রার্থনা করতে শুরু করলেন, হে আল্লাহ! তুমি নির্দেশ দিয়েছ, আর আমি তা পালন করতে পারিনি। তুমি নিষেধ করেছ, আমি নাফরমানি করেছি। আমি নির্দোষ নই যে, তোমার নিকট ওজর পেশ করব, আমি শক্তিশালী নই যে, বিজয়ী হব। তোমার রহমত যদি না আসে, তবে নিশ্চিত ভাবে আমি ধ্বংস হয়ে যাব। (তাবাকাতে ইবনে সাদ; আসহাবে রাসূলের জীবন কথা ২/৬০; জীবন সায়াহ্নে মানবতার রূপ, পৃঃ ১২৪)

Post a Comment

0 Comments