ইসমতে আম্বিয়া (আঃ) এর ক্ষেত্রে দেওবন্দীদের স্ববিরোধী আকিদা ও চাটুকারদের মুখোশ উন্মোচনঃ
-------------------------------------------------------------
জামায়াত বিদ্বেষী এক শ্রেণীর হিংসুক কাওমী আলেম বলে থাকেন, ইসমতে আম্বিয়া (আঃ) এর ক্ষেত্রে দেওবন্দীদের আকিদা হচ্ছে, নবীগণ মাসুম, গুনাহ থেকে পবিত্র এবং তাঁরা সমালোচনার উর্ধ্বে। মাওলানা মওদুদী (রাহঃ) নবীদের গুনাহগার বলেন এবং সমালোচনা করেন, তাই তিনি আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত বহির্ভূত ও পথভ্রষ্ট। যেমন, কাওমী আলেম হাসান জামিল বলেন, মাওলানা মওদুদী এবং উনার প্রতিষ্ঠিত দলের লোকেরা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আকিদা লালন করেন না, তারা নবী রাসুলদের ভুল ধরেন এবং গুনাহগার বলেন।
আমরা জবাবে বলব, এসব আল্লামা মওদুদী (রাহঃ) এর বিরুদ্ধে তাদের মিথ্যা অপবাদ ছাড়া কিছু নয়। কারণ আম্বিয়া কিরাম বা সম্মানিত নবীদের মাসুম বা নিষ্পাপ হওয়া বিষয়ে ইমাম সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী (রাহঃ) তাঁর আকিদা পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেন,
১. মাসুম বা নিষ্পাপত্ব একমাত্র নবীদেরই বৈশিষ্ট্য। (রাসায়েল ও মাসায়েল ৫/১৯৮)
২. নবীগণের মাসুম বা পাপমুক্ত হওয়াটা নিঃসন্দেহে একটি মৌলিক বিষয়। (রাসায়েল ও মাসায়েল ৩/৬১)
৩. আমি নবী ছাড়া অন্য কাউকে মাসুম বা নিষ্পাপ মনে করি না। (রাসায়েল ও মাসায়েল ১/২৮৯)
মজার বিষয় হল, জামায়াত বিদ্বেষী যেসব কাওমী আলেম ও চাটুকাররা ইমাম সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী (রাহঃ) এর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেন তাদের আকাবীরেরাই সেসব অভিযোগে অভিযুক্ত। অর্থাৎ দেওবন্দীদের বড় বড় আলেমগণ নবীদের গুনাহগার বলেছেন এবং নবীদের কড়া সমালোচনা করেছেন। দেখুন-
০১. পবিত্র কুরআনের ৪০ নং সূরা মু'মিন এর ৫৫ নং আয়াত এবং ৪৭ নং সূরা মুহাম্মদ এর ১৯ নং আয়াতে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) কে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'য়ালা وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ বলেছেন। শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী (রাহঃ) তাঁর 'তরজমায়ে কুরআন' গ্রন্থে, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী দেওবন্দী (রাহঃ) তাঁর 'তাসহীলু বায়ানিল কুরআন' গ্রন্থে, মুফতি মুহাম্মদ শাফী দেওবন্দী (রাহঃ) 'মা'আরেফুল কুরআন' গ্রন্থে وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ এর অনুবাদ করেছেন এভাবে, "(হে নবী) তুমি তোমার নিজ গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো।
পক্ষান্তরে ইমাম সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী (রাহঃ) 'গুনাহ' বর্জন করে وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ এর অনুবাদ করেছেন এভাবে, "নিজের ভুল-ত্রুটির জন্য মাফ চাও/ক্ষমা প্রার্থনা করো।" (তাফহীমুল কুরআন)
০২. সূরা নাসরে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) কে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন,
فَسَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّكَ وَاسۡتَغۡفِرۡهُؕ اِنَّهٗ كَانَ تَوَّابًا.
এ আয়াতের অনুবাদে ইমাম সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী (রাহঃ) বলেন, "তুমি তোমার রবের হামদ সহকারে তাঁর তাসবীহ পড়ো এবং তাঁর কাছে মাগফিরাত চাও। অবশ্যি তিনি বড়ই তাওবা কবুলকারী।" (তাফহীমুল কুরআন, সূরা নাসর ১১০/৩)
শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী এ আয়াতের অনুবাদে বলেন, "তুমি স্বীয় রবের পবিত্রতা ঘোষণা করো প্রশংসার সাথে ও তাঁর নিকট গুনাহের প্রার্থনা করো। (তরজমায়ে কুরআন পৃঃ ৭৮৯, সূরা নাসর ১১০/৩)
এবার বলেন, নবীদের গুনাহগার কারা মনে করেন, আল্লামা মওদুদী (রাহঃ) না কি দেওবন্দী ওলামাগণ?
০৩. চরমোনাই পীর সাবেরা সর্বদা নিজের দেওবন্দী ঘরনার আলেম বলে দাবী করেন এবং আমাদের দেশে বর্তমান যারা দেওবন্দীদের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করে তারাও তা স্বীকার করেন। সেই দেওবন্দী ঘরনার মরহুম পীর মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ এছহাক (বর্তমান পীরদ্বয়ের দাদা হুজুর পীর কেবলা) তার লিখিত 'আশেক মাশুক বা এস্কে এলাহী' বইয়ে নবীকে গুনাহগার ও পাপী বলেছেন। দেখুন পীর সাব চরমোনাই লিখেছেন,
"বাবা আদম (আঃ) খাইলেন গন্দম শয়তান দিল ধোঁকা।
আছমান সকল ভেদ করিয়া পাঠাইলেন এই জঙ্গলে,
পাপে না ছাড়িলো আমার বাবা (আদম) কে,
তিনশত বৎসর কাইন্দালেন ময়দানে;
তখন হইতে হুকুম হইল কান্দ জারে জার,
শত গুনাহ করে কান্দ আরাফাত মাঝার!"
(আশেক মাশুক বা এস্কে এলাহী, পৃঃ ২৮; লাইন ১৯-২৪)
দেখুন, এখানে তিনি নবী আদম (আঃ) কে শুধু পাপী বা গুনাহগার বলেই ক্ষান্ত হননি বরং শত গুনাহ করে আরাফাত ময়দানে কেঁদেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। এতকিছুর পরেও নাকি তাদের আকিদা সহীহ আর আমাদের আকিদা খারাপ!
০৪. দেওবন্দীদের আধ্যাতিক গুরু হুসাইন আহমদ মাদানী বলেন,
معصوموں سے اگر چه قصدا گناه نهیں هوسکتا مگر غلط فہمی سے بسا اوقات ان سے بڑے سے بڑ گناه هو جا تاہے.
“মাসুমের দ্বারা যদিও ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো পাপ কার্য হতে পারেনি, কিন্তু ভুল বুঝাবুঝিতে অনেক সময়েই তাঁদের দ্বারা বড় বড় পাপ (কবীরা গুনাহ) কার্য হয়ে গেছে। কিন্তু বাহ্যত সেগুলো পাপ কাজ বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সেগুলো পাপ নয় ।
কাজেই সেগুলো প্রকৃত পাপ কাজ বলা যেতে পারে না। যেমন, উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে যে, হযরত মুসা (আ) তদীয় ভ্রাতা হযরত হারুন (আ) এর চুল ও দাড়ি ধরে টেনেছিলেন (আ'রাফ ০৭/১৫০)। এ কাজটি দ্বারা একজন নবী, যিনি তাঁর বড় ভাইও ছিলেন তাঁকে অপমান করা হয়েছে। এ কাজ অন্যের দ্বারা সংঘটিত হলে কুফরী বরং মারাত্মক ধরণের কুফরী বলে বিবেচিত হতো।অনুরূপ হযরত মুসা (আ) তাওরাত লিখিত পাথর ফলক ছুড়ে মেরেছিলেন। যেমন পবিত্র কুরআনে আছে:
ﻭَﻟَﻤَّﺎ ﺭَﺟَﻊَ ﻣُﻮﺳَﻰٰٓ ﺇِﻟَﻰٰ ﻗَﻮْﻣِﻪِۦ ﻏَﻀْﺒَٰﻦَ ﺃَﺳِﻔًﺎ ﻗَﺎﻝَ ﺑِﺌْﺴَﻤَﺎ ﺧَﻠَﻔْﺘُﻤُﻮﻧِﻰ ﻣِﻦۢ ﺑَﻌْﺪِﻯٓۖ ﺃَﻋَﺠِﻠْﺘُﻢْ ﺃَﻣْﺮَ ﺭَﺑِّﻜُﻢْۖ ﻭَﺃَﻟْﻘَﻰ ﭐﻟْﺄَﻟْﻮَﺍﺡَ ﻭَﺃَﺧَﺬَ ﺑِﺮَﺃْﺱِ ﺃَﺧِﻴﻪِ ﻳَﺠُﺮُّﻩُۥٓ ﺇِﻟَﻴْﻪِۚ .
মূসা নিজ জাতির নিকট ফিরে এসে রাগাম্বিত বিক্ষুদ্ধ অবস্থায় বললঃ আমার চলে যাওয়ার পর তোমরা কত নিকৃষ্ট প্রতিনিধিত্ব করেছ, তোমরা তোমাদের প্রভুর নির্দেশের পূর্বেই কেন তাড়াহুড়া করতে গেলে? অতঃপর সে (তাওরাত লিখিত) ফলকগুলি ফেলে দিল এবং স্বীয় ভাইয়ের মস্তক (চুল) ধরে নিজের দিকে টানতে লাগল। (সূরা আ'রাফ ০৭/১৫০)
আল্লাহর কিতাবকে তাও আবার সেই কিতাব যা স্বয়ং তাঁর উপরেই নাযিল করা হয়েছিল তা ছুড়ে মারা নিঃসন্দেহে বড় পাপ কাজ। যদি মাসূম নবীগণ বড় বড় অপরাধমূলক কার্যে লিপ্ত হয়ে পড়তে পারেন তবে যারা মাসূম বা নিষ্পাপ নয় তারা যত বড় গুণিই (ব্যাক্তি) হোক কেন তারা তা পারবেন না।"(মাকতুবাতে শায়খুল ইসলাম ১/২৫৯ ও মালফুজাতে শায়খুল ইসলাম ১/৪৭)
লক্ষ করুন হুসাইন আহমদ মাদানী কত আপত্তিকর ভাষায় নবীগণ এর সমালোচনা করেছেন। তিনি বাহ্যত ভাবে নবীদের মাসূম বলেছেন আর কার্যত ভাবে তাদেরকে বড় বড় পাপ ও অপরাধ মূলক কাজে লিপ্ত বলে কড়া সমালোচনা করেছেন।
০৫. হুসাইন আহমদ মাদানী হযরত মূসা (আ) সম্পর্কে আরো বলেনঃ"মূসা (আ) এর হাতে 'কিবতী' এর নিহত হওয়া নছলী আসাবিয়াত তথা বংশীয় পক্ষপাতিত্বের কারণে হয়েছিল।"(মাকতুবাতে শাইখুল ইসলাম ১/২৪৩-২৪৪; তাফহীমুল মাসাইল ১/৩১৫)
এখানে মাদানী সাহেব হযরত মূসা (আ) কে স্বজনপ্রীতি ও বংশীয় পক্ষপাতিত্বের দোষে অভিযুক্ত করেছেন। একজন শ্রেষ্ঠ নবীর নামে 'নছলী আসাবিয়াত' শব্দ প্রয়োগ করা অমার্জনীয় অপরাধ ও সম্পূর্ণ হারাম। কারণ, আসাবিয়াত অন্যায় ও জুলুম। নবী জুলুম করতে পারে না।
হাদীসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
لَيْسَ مِنَّا مَنْ دَعَا إِلَى عَصَبِيَّةٍ وَلَيْسَ مِنَّا مَنْ قَاتَلَ عَلَى عَصَبِيَّةٍ وَلَيْسَ مِنَّا مَنْ مَاتَ عَلَى عَصَبِيَّةٍ.
ঐ ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আসাবিয়তের দিকে ডাকে, সেও আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আসাবিয়তের কারণে লড়াই করে এবং সে-ও নয়, যে আসাবিয়তের উপর মৃত্যুবরণ করে।(সুনান আবু দাউদ, হাদীস ৫১২১)
অপর বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) কে আসাবিয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল,
يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا الْعَصَبِيَّةُ قَالَ أَنْ تُعِينَ قَوْمَكَ عَلَى الظُّلْمِ
"হে আল্লাহর রাসূল! আসাবিয়ত কী?তিনি (ﷺ) বললেন, নিজের কওমকে তার অন্যায়-অবিচারের বিষয়ে সাহায্য করা।’(সুনান আবু দাউদ,হাদীস ৫১১৯)
০৬. আল্লাহ তা'য়ালা বলেন,
فَلَوْلَا كَانَتْ قَرْيَةٌ آمَنَتْ فَنَفَعَهَا إِيمَانُهَا إِلَّا قَوْمَ يُونُسَ لَمَّا آمَنُوا كَشَفْنَا عَنْهُمْ عَذَابَ الْخِزْيِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَمَتَّعْنَاهُمْ إِلَىٰ حِينٍ.
সুতরাং এমন কোন দৃষ্টান্ত আছে কি যে, একটি জনবসতি চাক্ষুষ আযাব দেখে ঈমান এনেছে এবং তার ঈমান তার উপকারে এসেছে ইউনুসের কওম ছাড়া? তারা যখন ঈমান এনেছিল তখন আমি তাদের ওপর থেকে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনার আযাব হটিয়ে দিয়েছিলাম এবং আমি তাদেরকে একটি সময় পর্যন্ত ভোগ করতে দিলাম। (সূরা ইউনুস ১০/৯৮)
এ আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করে হুসাইন আহমদ মাদানী বলেনঃ"আযাব দেখার পর ঈমান আনলে এ ঈমান উপকারে আসেনা। ইউনুস (আ) এর সম্প্রদায় কেবল এর ব্যাতিক্রম। এর কারণ হচ্ছে এই যে, তাদের উপরে মূলত আযাবই আসেনি। বরং হযরত ইউনুস (আ) এর জলদবাজীর প্রেক্ষিতে আযাবের আকার পরিদৃষ্ট হয়েছিল।" (মালফুজাতে শাইখুল ইসলাম ১/৪৪, মাকতুবাতে শাইখুল ইসলাম ১/৮৩)
এখানে মাদানী হযরত ইউনুস (আ) কে জলদবাজ বললেন। নাউযূবিল্লাহ!
মুহতারাম পাঠক! দেখুন, দেওবন্দীদের আধ্যাত্মিক গুরু হুসাইন আহমদ মাদানী কত আপত্তিকর ভাষায় নবীগণ (আ) এর সমালোচনা করেছেন। তিনি বাহ্যত নবীদের মাসূম বলেছেন আর কার্যত তাদেরকে বড় বড় পাপ ও অপরাধ মূলক কাজে লিপ্ত বলে কড়া সমালোচনা করেছেন।দেওবন্দী আকাবীরগণ নবী রাসুলদের ভুল-ত্রুটির জন্য কড়া সমালোচনা করেন, গুনাহগার বলেন আর একচাটিয়া ভাবে সব দোষ আল্লামা মওদুদী (রাহঃ) নামে চাপিয়ে দেন। এটা কি মারাত্মক জুলুম নয়?
0 Comments