Recent Tube

সত্যিই কি হযরত আবু বকর (রাঃ) এর আমল হাসান জামিলের চেয়ে বেশি ছিল না? মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।



সত্যিই কি হযরত আবু বকর (রাঃ) এর আমল হাসান জামিলের চেয়ে বেশি ছিল না? 
----------------------------------------------------------------
কাওমী ঘরানার আলেম ও বক্তা হাসান জামিল সম্প্রতি তার বয়ানে বলেছেন, হযরত আবু বকর (রাঃ) এর আমল (আমি) হাসান জামিলের চেয়ে বেশি ছিল না। তার কথার প্রমাণে তিনি নামাজ, রোজা, হজ্জ, ওমরার কুরআন তিলাওয়াতের আমল পেশ করে বলেন, তিনি না কি হযরত আবু বকর (রাঃ) এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি আমল করেছেন। (নাউজুবিল্লাহ)! বিষয়টি নিয়ে যখন সমালোচনা হচ্ছে তখন তিনি লাইভে এসে বললেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর পরে সবচেয়ে বেশি তিনি আবু বকর (রাঃ) কে পড়াশোনা করেছেন। তাহলে বুঝা গেল, এত পড়াশোনা করে তিনি জানতে পেরেছেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর সর্বশ্রেষ্ঠ ও জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত সাহাবী, ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ) এর আমলের চেয়ে তার আমল কয়েক গুণ বেশি ছিল। (নাউজুবিল্লাহ মিন জালিক)! এর চেয়ে চরম দাম্ভিকতা, অহংকার ও ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য আর কি হতে পারে? 

রাসুলুল্লাহ (ﷺ) সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। তিনি যেমন ছিলেন মাসুম ও নির্দোষ, তেমনি সবার সবচেয়ে বেশী আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা ও আমলকারী। তারপরও আল্লাহ তাঁকে লক্ষ্য করে বলেন , 
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ ۚ إِنَّهُ كَانَ تَوَّابًا.
অতএব তুমি তোমার রবের প্রশংস সহ তাসবীহ পাঠ কর এবং তাঁর কাছে ক্ষমা চাও নিশ্চয় তিনি তাওবা কবুলকারী। (সূরা নাসর ১১০/০৩)

আল্লাহর রাসুল (ﷺ) নিজেও বলতেন,
اللَّهُمَّ أَنْتَ الْمَلِكُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَنْتَ رَبِّي وَأَنَا عَبْدُكَ ظَلَمْتُ نَفْسِي وَاعْتَرَفْتُ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي ذُنُوبِي جَمِيعًا إِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ...
হে আল্লাহ! তুমিই বাদশাহ্‌ তুমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আমি তোমার সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করি। তুমি আমার রব ও আমি তোমার দাস। আমি নিজের উপর জুলুম করেছি এবং আমি আমার অপরাধ স্বীকার করেছি। সুতরাং তুমি আমার সমস্ত অপরাধ, ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দাও, যেহেতু তুমি ছাড়া অন্য কেউ পাপ মাফ করতে পারে না।... (সহীহ মুসলিম হাঃ ৭৭১; জামে তিরমিযী হাঃ ৩৪২১, ৩৪২৩; সুনান নাসায়ী হাঃ ৮৯৭; আবু দাউদ হাঃ ৭৬০; মুসনাদে আহমদ হাঃ ৭৩১, ৮০৫, ১০৩০৩; সুনান দারেমী হাঃ ১২৩৮)

ইসলাম বান্দাকে এ আদব ও শিষ্টাচার শিখিয়েছে। কোন মানুষের দ্বারা আল্লাহর দ্বীনের যতবড় খিদমতই সম্পন্ন হোক না কেন, তাঁর পথে সে যতই ত্যাগ স্বীকার করুক না এবং তাঁর ইবাদাত ও আমল করার ব্যাপারে যতই প্রচেষ্টা ও সাধনা চালাক না কেন, তার মনে কখনো এ ধরনের চিন্তার উদয় হওয়া উচিত নয় যে, তার ওপর তার রবের যে হক ছিল তা সে পুরোপুরি আদায় করে দিয়েছে। বরং সব সময় তার মনে করা উচিত যে, তার হক আদায় করার ব্যাপারে যেসব দোষ-ত্রুটি সে করেছে তা মাফ করে দিয়ে যেন তিনি তার এ নগণ্য খেদমত কবুল করে নেন। এ আদব ও শিষ্টাচার শেখানো হয়েছে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) কে। অথচ তাঁর চেয়ে বেশী আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা ও আমলকারী আর কোন মানুষের কথা কল্পনাই করা যেতে পারে না। তাহলে এক্ষেত্রে অন্য কোন মানুষের পক্ষে তার নিজের আমলকে বড় মনে করার অবকাশ কোথায়? আল্লাহর যে অধিকার তার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তা সে আদায় করে দিয়েছে এ অহংকার মত্ত হওয়ার কোন সুযোগই কি তার থাকে? 

দ্বিতীয়তঃ হাসান জামিলের এ দাবি শুধু আদব ও শিষ্টাচার পরিপন্থী দাম্ভিকতা ও ধৃষ্টতাপূর্ণই নয়; বরং শতভাগ মিথ্যা। তিনি তার কথার পক্ষে প্রমাণ দিয়েছেন, নামাজ-রোজা ইত্যাদি ইবাদত দ্বারা। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আবু বকর (রাঃ) মোট কয়টা রোজা রেখেছেন আর তিনি জীবনভর কয়টা রোজা রেখেছেন, সেই হিসাব উল্লেখ করে এই তুলনা টেনেছেন। তবে অবাক করার মত মারাত্মক ব্যাপার হলো, আমলকে নামাজ-রোজায় সীমাবদ্ধ করে দলিল দেওয়া কি আদৌও জায়েজ ও ইনসাফ হলো? 

জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত সাহাবী হযরত আবু বকর (রাঃ) এর আমলের তালিকায় এমনসব বিষয়ও আছে, যা হাসান জামিল জীবনেও করেননি। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে তাঁর সহযোগী হওয়া, আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর সকল অর্থ সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দান করা ও কাফির কর্তৃক জুলুম নির্যাতনের শিকার হওয়া, হিজ/রত করা, হিজরতে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর সঙ্গী হওয়া, কাফির, মুরতাদ ও ভণ্ডনবীদের বিরুদ্ধে জি/হাদ ও কি/তাল করা, খিলা/ফাতের দায়িত্ব পালন করা, আল্লাহর হুদুদ কায়েম করা থেকে শুরু করে এর উদাহরণ অসংখ্য। 

জি/হাদের বিষয়টিই ধরা যাক! আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞাসা হল, 
أيُّ العَمل أفْضَلُ ؟ قَالَ: «إيمَانٌ بِاللهِ وَرَسُولِهِ» قيلَ: ثُمَّ مَاذَا؟ قَالَ: «الجهادُ في سَبيلِ اللهِ» 
‘সর্বোত্তম আমল কি?’ তিনি বললেন, “আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।” জিজ্ঞাসা করা হল, ‘তারপর কি?’ তিনি বললেন, “আল্লাহর পথে জি/হাদ করা।” (সহীহ বুখারী হাঃ ২৬, ১৫১৯, সহীহ মুসলিম হাঃ ৫৩, মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা হাঃ ১৯৩৫২, তিরমিযী হাঃ ১৬৫৮, নাসায়ী হাঃ ২৬২৪, ৩০৩০, আহমাদ হাঃ ১২৮১, দারেমী হাঃ ২৩৯৩, সহীহ ইবনে হিব্বান হাঃ ৯৪, ৪৫৯৮, সুনানুল কুবরা হাঃ ১৮৮৪৩)

আবূ জর (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, 
قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم، أَيُّ العَمَلِ أَفْضلُ؟ قَالَ: «الإِيمَانُ بِاللهِ، وَالجِهَادُ في سَبِيلهِ». 
আমি নিবেদন করলাম, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (ﷺ) সর্বোত্তম আমল কি?’ তিনি বললেন, “আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখা ও তাঁর রাস্তায় জি/হাদ করা।” (সহীহ বুখারী হাঃ ২৫১৮, সহীহ মুসলিম হাঃ ৮৪, নাসায়ী হাঃ ৩১২৯, ইবনু মাজাহ হাঃ ২৫২৩, আহমাদ হাঃ ২৩৮৪৫, ২০৯৩৮, ২০৯৮৯, দারেমী হাঃ ২৭৩৮) 

মুয়াজ বিন জাবাল (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
رَأْسُ الْأَمْرِ الْإِسْلَامُ وَعَمُودُهُ الصَّلَاةُ وَذِرْوَةُ سَنَامِهِ الْجِهَادُ.
"সবকিছুর মূল হচ্ছে ইসলাম, তার স্তম্ভ হচ্ছে নামাজ এবং সর্বোচ্চ চূড়া জি/হাদ।" (জামে তিরমিযী হাঃ ২৬১৬, ইবনে মাজাহ হাঃ ৩৯৭৩, আহমহ হাঃ ২১৫৫১, মিশকাত হাঃ ২৯, সহীহুল জামে হাঃ ৫১৩৬)

আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন,
فَإِنَّ مُقامَ أَحَدِكُمْ في سَبيلِ اللهِ أَفْضَلُ مِنْ صَلاَتِهِ فِي بَيْتِهِ سَبْعِينَ عَاماً، أَلاَ تُحِبُّونَ أَنْ يَغْفِرَ الله لَكُمْ، وَيُدْخِلَكُمُ الجَنَّةَ ؟ أُغْزُوا فِي سَبيلِ اللهِ، 
"আল্লাহর রাস্তায় তোমাদের কোন ব্যক্তির (জি/হাদ উপলক্ষে) অবস্থান করা, নিজ ঘরে সত্তর বছর ব্যাপী নামায পড়া অপেক্ষা উত্তম। তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করান? তাহলে আল্লাহর রাহে জি/হাদ কর।” (জামে তিরমিযী হাঃ ১৬৫০, আহমাদ হাঃ ১০৪০৭, রিয়াযুস স্বালিহীন হাঃ ১৩০৫)

আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত,
أَنَّ رَجُلاً قَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم، دُلَّنِي عَلَى عَمَلٍ يَعْدِلُ الجِهَادَ ؟ قَالَ: لاَ أَجِدُهُ» ثُمَّ قَالَ: «هَلْ تَسْتَطِيعُ إِذَا خَرَجَ المُجَاهِدُ أَنْ تَدْخُلَ مَسْجِدَكَ فَتَقُوْمَ وَلاَ تَفْتُرَ، وَتَصُومَ وَلاَ تُفْطِرَ» ؟ فَقَالَ: وَمَنْ يَسْتَطِيعُ ذَلِكَ ؟! 
একটি লোক বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাকে এমন একটি আমল বাতলে দিন, যা জি/হাদের সমতুল্য হবে।’ তিনি বললেন, “আমি এ ধরনের আমল তো পাচ্ছি না।” তারপর তিনি বললেন, “তুমি কি এরূপ করতে পারবে যে, মুজা/হিদ যখন জি/হাদে বের হয়ে যাবে, তখন থেকে তুমি মসজিদে ঢুকে অ-ক্লান্তভাবে নামাযে নিমগ্ন হবে এবং অবিরাম রোযা রাখবে।” সে বলল, ‘এমন কাজ কেউ কি করতে পারবে? (সহীহ বুখারী হাঃ ২৭৮৫, সহীহ মুসলিম হাঃ ১৮৭৮, তিরমিযী হাঃ ১৬১৯, নাসায়ী হাঃ ৩১২৮, আহমাদ হাঃ ৮৩৩৫, ৯১৯২, ৯৬০৪, ৯৬৭৪, ২৭২০৮)

এখন প্রশ্ন হল, হযরত আবু বকর (রাঃ) জীবনে মোট কতটি জি/হাদ করেছেন স্বশরীরের উপস্থিত থেকে? মোট কয়টি সারি/য়্যাহ পাঠিয়েছেন তার শাসনামলে? ইসলামের সর্বোচ্চ শিখর বলা হয়েছে যেই ইবাদতকে, ইমানের পর যেই ইবাদতের সমতুল্য হয় না কোনো কিছুই, যেই ইবাদতের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন দিনভর সিয়াম ও রাতভর কিয়াম করলেও এর সমপরিমাণ প্রতিদান মিলবে না; সেটাকে হিসাবের বাইরে রাখা কি সমীচীন হলো? যেই হিজ/রত এমনই মহৎ আমল, যা পূর্বের সব পাপ মুছে দেয়, সেটা গোপন করাই বা কতটুকু যৌক্তিক হলো? দ্বীনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দেওয়া, গুরা/বার জীবন যাপন, জুলুম নির্যাতনের শিকার হওয়া এগুলো যেনতেন আমল তো নয়। আবু বকর (রাঃ) এর ইসলাম গ্রহণ থেকে মৃত্যু অবধি প্রতিটা মুহূর্তই আমল। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) -কে ইমানের সঙ্গে নিজ চোখে দেখে তাঁর সহযোগী হওয়ার চাইতে বড় আমল কী হয়? উপরন্তু তিনি সিদ্দিক আর আমরা সর্বোচ্চ সালিহীন। সালিহীনের আমল সিদ্দিকের চেয়ে বেশি কীভাবে হবে? অন্তরের আমল, কথার আমল, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আমল সবক্ষেত্রেই সিদ্দিকরা এগিয়ে। তাছাড়া হযরত আবু বকর (রাঃ) হলেন জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত শ্রেষ্ঠতম সাহাবী। সেই সাহাবীর  আলমলের সাথে নিজের দু' চারটা আমলকে তুলনা করে প্রকাশ্যে হাজারো জনতার সামনে হাসান জামিলের আমল বেশি বলে দাবি করা ছিল তার চরম দাম্ভিকতা, অহঙ্কার, ধৃষ্টতাপূর্ণ ও মিথ্যাচার।

Post a Comment

0 Comments