Recent Tube

আল্লামা মওদুদী (রাহঃ) এর নামে 'হাদীস অস্বীকার' এর মিথ্যা অপবাদ ও আমাদের জবাবঃ পর্ব ৩ ; মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।


আল্লামা মওদুদী (রাহঃ) এর নামে 'হাদীস অস্বীকার' এর মিথ্যা অপবাদ ও আমাদের জবাবঃ পর্ব ৩
------------------------------------------------------------

 (সহীহ বুখারীতে জাল যঈফ হাদীসের উদাহরণ) 

 ইমাম সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী (রাহঃ) 'সহীহ বুখারী'র দু' একটি হাদীসের উপর সমালোচনা করার কারণে দেওবন্দী ও আহলে হাদীসের কতিপয় আলেম তাকে হাদীস অস্বীকারকারী বলে অপবাদ দেয়। তাদের দাবী, সহীহ বুখারীতে বর্ণিত সকল হাদীস সহীহ। তাই বুখারীর হাদীসের সনদ বা মতন নিয়ে সমালোচনা করার অর্থই হলো, সহীহ হাদীস অস্বীকার করা। (নাউজুবিল্লাহ) বুখারীর কোনো হাদীসের সনদ বা মতন নিয়ে সমালোচনা করলেই কেউ হাদীস অস্বীকারকারী হয়ে যান না এবং তাদের অপবাদ যে মিথ্যা, আমরা তা প্রমাণ করব ইনশাআল্লাহ!

 হাদীস গ্রন্থের মধ্যে 'সহীহ বুখারী' সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও সহীহ গ্রন্থ বলে পরিচিত হলেও এ কিতাব পবিত্র কুরআন মাজীদের মত শতভাগ নির্ভুল নয়। সহীহ বুখারীর কতিপয় হাদীসের সনদ ও মতনের উপর মুহাদ্দিস ও মুজতাহিদ ইমামগণ সমালোচনা করেছেন। সহীহ বুখারীর এমন কিছু হাদীস আছে যেগুলি সহীহ নয়। নিম্নে তার কতিপয় উদাহরণ দেওয়া হলো।

 উদাহরণঃ ০১
حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ عَبْدِ اللهِ بْنِ جَعْفَرٍ حَدَّثَنَا مَعْنُ بْنُ عِيْسَى حَدَّثَنَا أُبَيُّ بْنُ عَبَّاسِ بْنِ سَهْلٍ عَنْ أَبِيْهِ عَنْ جَدِّهِ قَالَ كَانَ لِلنَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فِيْ حَائِطِنَا فَرَسٌ يُقَالُ لَهُ اللُّحَيْفُ قَالَ أَبُوْ عَبْد اللهِ وَقَالَ بَعْضُهُمُ اللُّخَيْفُ.
সাহল (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাদের বাগানে নাবী (ﷺ) এর একটি ঘোড়া থাকত, যাকে লুহাইফ বলা হত। আর কেউ কেউ বলেছেন ‘‘লুখাইফ’’। (সহীহ বুখারী হাঃ ২৮৫৫; আধুনিক প্রকাশনী হাঃ ২৬৪৫, ইসলামী ফাউন্ডেশন হাঃ ২৬৫৫)

 হাদীসটির একজন রাবী উবাই বিন আব্বাস। সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার হাফেজ ইবনে হাজার আস্কালানী তাহযীবুত তাহযীবে তার সম্পর্কে বলেনঃ ইমাম আহমদ, ইমাম নাসায়ী, ইমাম ইবনে মাঈন, ইমাম বুখারী সহ সবাই উক্ত রাবী কে ضعيف যঈফ বলেছেন। 
قال ابن معين ضعيف وقال أحمد منكر الحديث وقال النسائي لَيْسَ بِالْقَوِيّ وقال العقيلى له أحاديث لا يتابع على شئ منها.
 ইমাম ইবনে মাঈন বলেন, তিনি দুর্বল। ইমাম আহমদ বলেন, তিনি পরিত্যক্ত হাদীস বর্ণনাকারী। ইমাম নাসায়ী বলেন, তিনি শক্তিশালী নন। ইমাম উকাইলী বলেনঃ তার বর্ণিত সকল হাদীস তার একক বর্ণনা। তার বর্ণিত হাদীসগুলোর সমর্থনে কাউকে পাওয়া যায় না। (তাহযীবুল কামাল ২/২৫৯; তাহযীবুত তাহযীব ১/৯৭)

 ইবনে হাজার আস্কালানী আলোচ্য হাদীসটির সমার্থনে আব্দুল মুহাইমিন বিন আব্বাসের বর্ণনার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তিনিও যঈফ রাবী। তাকে স্বয়ং ইমাম বুখারী (منكر الحديث) পরিত্যক্ত হাদীস বর্ণনাকারী বলেছেন। এছাড়া ইমাম নাসাঈ, আবূ হাতেম, দারাকুতনী প্রমুখ সকলেই তাকে যঈফ বলেছেন। (তাহযীবুত তাহযীব, তরজমা নং ৪৮৯৭)

  উদাহরণঃ ০২
حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ حَرْبٍ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ طَلْحَةَ عَنْ طَلْحَةَ عَنْ مُصْعَبِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ رَأَى سَعْدٌ أَنَّ لَهُ فَضْلاً عَلَى مَنْ دُوْنَهُ فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم هَلْ تُنْصَرُوْنَ وَتُرْزَقُوْنَ إِلَّا بِضُعَفَائِكُمْ.
মুস‘আব ইবনু সা‘দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন সা‘দ (রাঃ)-এর ধারণা ছিল অন্যদের চেয়ে তাঁর মর্যাদা অধিক। তখন নাবী (ﷺ) বললেন, ‘তোমরা দুর্বলদের (দু‘আয়) ওয়াসীলায়ই সাহায্য প্রাপ্ত ও রিয্ক প্রাপ্ত হচ্ছ।’ (সহীহ বুখারী হাঃ ২৮৯৬; আধুনিক প্রকাশনী হাঃ ২৬৮২, ইসলামী ফাউন্ডেশন হাঃ ২৬৯৬)

 উক্ত হাদীসের একজন রাবী মুহাম্মদ বিন তালহা বিন মুসাররিফ। ইমাম নাসায়ী, ইমাম ইবনে মাঈন, ইমাম ইবনে সা'দ প্রমুখ তাকে যঈফ বলেছেন। দেখুন,
قال النسائي: محمد بن طلحة بن مصرف كوفي ليس بالقوي، وقال ابن معين: ضعيف. وقال ابن سعد: كانت له أحاديث منكرة، وقال أبو داود: كان يخطئ، وقال ابن حبان: كان يخطئ.
 ইমাম নাসায়ী বলেন, মুহাম্মদ বিন তালহা বিন মুসাররিফ শক্তিশালী নন। ইমাম ইবনে মাঈন বলেন, তিনি দুর্বল। ইমাম ইবনে সা'দ বলেন, তিনি পরিত্যক্ত হাদীস বর্ণনা করতেন। ইমাম আবু দাউদ ও ইবনে হিব্বান বলেন, তিনি হাদীস বর্ণনায় ভুল করতেন। (আল জারহু ওয়াত তা'দীল ৭/২৮১; আল কামিল ফি দুআফা ৭/৪৭৪; তাহযীবুল কামাল ২৫/৪১৭; তাহযীবুত তাহযীব ৩/৫৯৭;  

 সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার ইবনে হাজার আস্কালানী বলেনঃ
صدوق له أوهام، وأنكروا سماعه من أبيه ؛ لصغره. 
'সাদুক, তবে তার অনেক ভুলভ্রান্তি /বিভ্রম রয়েছে। হাদীস বিশারদগণ বলেছেন, সে তার পিতা থেকে শোনে নি।' (তাকরীবুত তাহযীব ১/৮৫৭)

 ইবনে হাজার আস্কালানী ফাতহুল বারীর ভূমিকায় বলেনঃ ইমাম বুখারী মুহাম্মদ বিন তালহা বিন মুসাররিফ থেকে তিনটি হাদীস সংকলন করেছেন। তন্মধ্যে, দুইটি হাদীস অন্য হাদীসের সামর্থন পাওয়ার দরুণ সহীহ হিসাবে গ্রহণ করা যায়। কিন্তু তৃতীয় হাদীসটি তথা আলোচ্য হাদীসটি মুহাম্মদ বিন তালহার একক বর্ণনা হওয়ায় এবং তার সমার্থনে কেউ না থাকায় হাদীসটি যঈফ থেকে যায়। (ফাতহুলবারী, মুকাদ্দিমা; যিকরে যাকারিয়াঃ ৩৪১)

 উদাহরণঃ ০৩
حَدَّثَنَا نُعَيْمُ بْنُ حَمَّادٍ حَدَّثَنَا هُشَيْمٌ عَنْ حُصَيْنٍ عَنْ عَمْرِو بْنِ مَيْمُونٍ قَالَ رَأَيْتُ فِي الْجَاهِلِيَّةِ قِرْدَةً اجْتَمَعَ عَلَيْهَا قِرَدَةٌ قَدْ زَنَتْ فَرَجَمُوْهَا فَرَجَمْتُهَا مَعَهُمْ.
আমর ইবনু মাইমূন (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি জাহিলীয়্যাতের যুগে দেখেছি, একটি বানরী ব্যাভিচার করার কারণে অনেকগুলো বানর একত্র হয়ে প্রস্তর নিক্ষেপে তাকে হত্যা করল। আমিও তাদের সাথে প্রস্তর নিক্ষেপ করলাম। (সহীহ বুখারী হাঃ ৩৮৪৯; আধুনিক প্রকাশনী হাঃ ৩৫৬২, ইসলামী ফাউন্ডেশন হাঃ ৩৫৬৭)

 এ হাদীসের রাবী (نُعَيْم بن حَمَّاد) নুআইম ইবন হাম্মাদ জাল হাদীস তৈরি করতেন। (যাহাবী, মিজানুল ই'তিদাল ৩/২৪১; আব্দুল হাই লাখনবী, আজবুয়া ফাজিলা পৃঃ ৪৫-৪৬; ইজহারুল হক পৃঃ ১০) তার সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ বলেন,
كان يضع الحديث في تقويةالسنةوحكاياتفي ثلب أبي حنيفة كلها كذب.
তিনি সুন্নাহ শক্তিশালী করার জন্য জাল হাদীস তৈরি করতেন এবং আবু হানিফা (রাহঃ) এর নিন্দায় গল্প বানাতেন, যা সবই মিথ্যা। (সিয়ারু আলামিন নুবালা ১/৬০৯; তাহযীবুত তাহযীব ১/৪১২)

 উপরে উল্লেখিত কয়েকটি উদাহরণ থেকে প্রমাণিত, জাল-যঈফ হাদীস থেকে সহীহ বুখারী একেবারে মুক্ত নয়। ইমাম শাফেয়ী (রাহঃ) যথার্থই বলেছেন:
ان أبى أن يتم كلام إلا كلام الله
“আল্লাহর কালাম কুরআন ছাড়া শতভাগ বিশুদ্ধ বা নির্ভুল কোনো গ্রন্থ নেই।”

চলবে....
------------------------- 
লেখক ঃ প্রবন্ধ লেখক কলামিস্ট ইতিহাস গবেষক, শিক্ষক, ও অনলাইন একটিভিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments