Recent Tube

'রব' رب ‏এর মর্মার্থ ও পরিচয়ঃ ‎মুহাম্মদ ‎তানজিল ‎ইসলাম ‎।

   'রব' শব্দটির প্রধান দুইটি অর্থ রয়েছে। 
১. সকল সৃষ্টি জগতের স্রষ্টা, রিযিকদাতা, প্রতিপালক, জীবন-মৃত্য দানকারী, নিয়ন্ত্রক ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ইত্যাদি। (এ অর্থ আমাদের সমাজে প্রসিদ্ধ ও প্রচলিত, সুতরাং দলিলের প্রয়োজন নেই) 
.
২. স্বয়ংসম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত আইন প্রণয়নকারী ও বিধানদাতা; সকল বিধানের উপর যার বিধানকে প্রাধান্য দিয়ে আনুগত্য করা হয়। 
উল্লেখ্য যে, 'ইলাহ' এর দ্বিতীয় অর্থের সাথে 'রব' এর দ্বিতীয় অর্থের মিল রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এ দু'টি শব্দকে কুরআনে একই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেনঃ 
ﭐﺗَّﺨَﺬُﻭٓﺍ۟ ﺃَﺣْﺒَﺎﺭَﻫُﻢْ ﻭَﺭُﻫْﺒَٰﻨَﻬُﻢْ ﺃَﺭْﺑَﺎﺑًﺎ ﻣِّﻦ ﺩُﻭﻥِ ﭐﻟﻠَّﻪِ ﻭَﭐﻟْﻤَﺴِﻴﺢَ ﭐﺑْﻦَ ﻣَﺮْﻳَﻢَ ﻭَﻣَﺎٓ ﺃُﻣِﺮُﻭٓﺍ۟ ﺇِﻟَّﺎ ﻟِﻴَﻌْﺒُﺪُﻭٓﺍ۟ ﺇِﻟَٰﻬًﺎ ﻭَٰﺣِﺪًﺍۖ ﻟَّﺎٓ ﺇِﻟَٰﻪَ ﺇِﻟَّﺎ ﻫُﻮَۚ ﺳُﺒْﺤَٰﻨَﻪُۥ ﻋَﻤَّﺎ ﻳُﺸْﺮِﻛُﻮﻥَ. 
"তারা (আহলে কিতাবরা) আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের পন্ডিত ও নেতাদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছে এবং মারইয়ামের পুত্র মসীহকেও। অথচ তাদের প্রতি শুধু এই আদেশ করা হয়েছে যে, তারা শুধুমাত্র এক ইলাহর ইবাদাত করবে যিনি ব্যতীত ইলাহ হওয়ার যোগ্য কেহই নয়। তিনি তাদের অংশী স্থির করা হতে পবিত্র।)" (সূরা তওবাঃ৯/৩১) 
.
    সাহাবী আদী ইবনু হাতিম (রা) বলেনঃ 
আমি যখন রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে পৌঁছি তখন তিনি সূরা বারআর আয়াত ﭐﺗَّﺨَﺬُﻭٓﺍ۟ ﺃَﺣْﺒَﺎﺭَﻫُﻢْ ﻭَﺭُﻫْﺒَٰﻨَﻬُﻢْ ﺃَﺭْﺑَﺎﺑًﺎ ﻣِّﻦ ﺩُﻭﻥِ ﭐﻟﻠَّﻪ তিলওয়াত করছিলেন। আমি বললাম: 
ﻗﻠﺖ ﻳﺎ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻧﺎ ﻟﺴﻨﺎ ﻧﻌﺒﺪﻫﻢ ﻓﻘﺎﻝ ﺃﻟﻴﺲ ﻳﺤﺮﻣﻮﻥ ﻣﺎ ﺃﺣﻞ ﺍﻟﻠﻪ ﻓﺘﺤﺮﻣﻮﻧﻪ ﻭﻳﺤﻠﻮﻥ ﻣﺎ ﺣﺮﻡ ﺍﻟﻠﻪ ﻓﺘﺤﻠﻮﻧﻪ؟ ﻗﺎﻝ ﻗﻠﺖ ﺑﻠﻲ ﻗﺎﻝ ﻓﺘﻠﻚ ﻋﺒﺎﺩﺗﻬﻢ . 
হে আল্লাহর রাসূল (সা), আমরা তো তাদের ইবাদত করি না! তিনি বলেন, আল্লাহ যা হালাল (বৈধ) করেছেন তারা তা তোমাদের জন্য হারাম (নিষিদ্ধ) করলে তোমরা কি তা হারাম বলে গ্রহণ কর না? আর আল্লাহ যা হারাম (নিষিদ্ধ) করেছেন তারা তা হালাল (বৈধ) করলে তোমরা কি তা হালাল বলে মেনে নাও না? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বলেন, "এটাই হলো তাদের ইবাদত করা।" (মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী হাঃ৩০৯৫; বায়হাকী হাঃ২৬১, ২০৩৫; সহীহ তিরমিযী আলবানী হাঃ২৪৭১; সহীহাহ হাঃ৩২৯৩ , তাফসীরে তাবারী, সূরা তওবাহঃ৯/৩১, হাঃ১৬৬৩১) 
অর্থাৎ আল্লাহর বিধানের উপর তাদের বিধানকে প্রাধান্য দিয়ে মেনে চলতো। আর এভাবে তাদের 'রব' তথা বিধানদাতা বানিয়েছিল। 
.
     হাসান বসরী বলেনঃ ﭐﺗَّﺨَﺬُﻭٓﺍ۟ ﺃَﺣْﺒَﺎﺭَﻫُﻢْ ﻭَﺭُﻫْﺒَٰﻨَﻬُﻢْ ﺃَﺭْﺑَﺎﺑًﺎ ﻣِّﻦ ﺩُﻭﻥِ ﭐﻟﻠَّﻪ এর অর্থ, তারা আনুগত্যের ব্যাপারে তাদের সমাজনেতা ও দরবেশগণকে রব হিসাবে গ্রহণ করত। (তাফসীরে তাবারী, হাঃ১৬৬৩৮) 
হযরত হুযায়ফা (রা) ﭐﺗَّﺨَﺬُﻭٓﺍ۟ ﺃَﺣْﺒَﺎﺭَﻫُﻢْ ﻭَﺭُﻫْﺒَٰﻨَﻬُﻢْ ﺃَﺭْﺑَﺎﺑًﺎ ﻣِّﻦ ﺩُﻭﻥِ ﭐﻟﻠَّﻪ এর ব্যাখ্যায় বলেন, তারা তাদের উপাসনা করত না বটে, তবে তারা পাপকার্যে তাদের আনুগত্য করত। (তাফসীরে তাবারী, হাঃ১৬৬৪২) 

     হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন,
لم يأمروهم أن يسجدوا لهم، ولكن أمروهم بمعصية الله، فأطاعوهم، فسماهم الله بذلك أربابا. 
ধর্মনেতারা তাদেরকে সিজদা করার জন্য বলেনি। বরং আল্লাহর নাফরমানীর কাজে লোকদের হুকুম (বিধান) দিত আর তারা তা মান্য করত। ফলে আল্লাহ তাদেরকে 'রব' হিসাবে অবিহিত করেন। 
(তাফসীরে তাবারী, সূরা তওবাহঃ৯/৩১, হাঃ১৬৬৪০) 
     সুতরাং যার হুকুম বা বিধানকে অপরাপর সকল বিধানের উপর প্রাধান্য দিয়ে মান্য করা হয় সেই 'রব' বলে গণ্য। এখানে ইহুদী খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্মনেতাদের হুকুম/বিধানকে আল্লাহর বিধানের উপর প্রাধান্য দিয়ে মেনে চলত বিধায় আল্লাহ তা'য়ালা তাদেরকেই 'রব' হিসাবে অভিহিত করেছেন। 
.
   ফিরআউন বলেছিল 
أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَىٰ. 
‘আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ রব’। (সূরা নাজিয়াতঃ৭৯/২৪) 
ফিরাউনের কথার এ অর্থ ছিল না এবং এ অর্থ হতেও পারে না যে, সে-ই এই বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা এবং এ পৃথিবীটাও সে সৃষ্টি করেছে। সেই ফল-ফসল থেকে রিযিকের ব্যবস্থা করে দেয়, দিন রাত, চাঁদ সূর্য তারই নিয়ন্ত্রণে চলে। বরং দ্বিতীয় (বিধানদাতা) অর্থে নিজেকে প্রধান বর হিসেবে পেশ করতো। অর্থাৎ এর অর্থ ছিল, আমি হচ্ছি প্রধান কর্তৃত্বের মালিক। আমি ছাড়া আর কেউ আমার রাজ্যে হুকুম চালাবার অধিকার রাখে না। আর আমার ওপর আর কোন উচ্চতর ক্ষমতাধরও নেই, যার আইন এখানে জারী হতে পারে। 
একই ভাবে যারা আল্লাহর আইন না মেনে উল্টা নিজেরাই আইন রচনা করে দেশে জারী করে তারাও ফিরআউনের মত নিজেদের 'রব' এর আসনে বসিয়েছে। তবে ফিরআউন হলো স্বঘোষিত 'রব' আর তারা হলো অঘোষিত 'রব'। আর যারা আল্লাহর আইন বর্জন করে তাদের আইনই মেনে নেয় তারা তাদের 'রব' হয়ে যায়। এটি মুখে স্বীকার করুক বা না করুক তাতে কিছুই যায় আসে না। 
.
      সুতরাং আল্লাহকে আইনদাতা হিসাবে মেনে নেওয়া তওহীদুর রুবুবিয়্যাত ও উলুহিয়্যাতের শর্ত এবং আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করা তওহীদের অংশ। যেমন শায়খ ইবনে উসাইমীন (রাহ) বলেছেনঃ 
  "আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করা একদিক থেকে তা তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহর সাথে সম্পৃক্ত, অপরদিকে তা তাওহীদুল উলুহিয়্যাহর সাথে সম্পৃক্ত। আল্লাহকে একমাত্র আইনদাতা হিসাবে না মানলে তাওহীদুর রুবুবিয়্যাতে শিরক করা হয়। অপরদিকে আল্লাহ্‌র আইনকে না মেনে অন্য কারো আইনে বিচার-ফয়সালা করলে তাতে তাওহীদুল উলুহিয়াতে শিরক করা হয়। অনুরূপভাবে, আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কোন আইনের বিচার-ফয়সালা মনে-প্রাণে মেনে নেয়াও তাওহীদুল উলুহিয়াতে শিরক করা হয়। সুতরাং এ থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে, আইনদাতা হিসেবে আল্লাহকে মেনে নেয়া এবং আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করা তাওহীদের অংশ।" (মাজমু ফাতাওয়া ও রাসাইলে ইবন উসাইমীন ২/১৪০-১৪৪ ও ৬/১৫৮-১৬২)
-------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ লেখকও মাওলান।   

Post a Comment

0 Comments