Recent Tube

একটি আজান, এরদোয়ান ও ২২ শহীদঃ জিয়াউল হক।

 একটি আজান, এরদোয়ান ও ২২ শহীদ
                        ******
    এরদোয়ান ইতিহাস সৃষ্টি করলেন একটি আজান হেঁকে।  ভূস্বর্গ কাশ্মীরেও বাইশ মুসলিম যুবক জীবন দিয়ে মাত্র একটা আজান হেঁকে সৃষ্টি করেছিলেন এক বিষ্ময়কর ইতিহাস! বিশ্বে যার কোন নজীর নেই! 

   ঘটনাটি ১৯৩১ সালের ১৩ই জুলাই। কাশ্মীরের ক্ষমতায় কট্টর ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী রাজপুত 'ডোগরা' শাসকগোষ্ঠী । ইংরেজ, শীখ ও রাজপুত’সহ সকল অমুসলিম জাতিগোষ্ঠী শতকরা নব্বইজন মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভূস্বর্গটিতে বরাবরই চেষ্টা করেছে মুসলমানদেরকে পশ্চাৎপদ করে রাখতে।  

       নিজ উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত কয়েকজন মুসলিম জনগোষ্ঠীর আাগমি প্রজন্মকে ইসলামের মৌলিক জ্ঞানটুকু দিয়ে চলেছিলেন। মুসলমানদের জন্য আধুনিক শিক্ষার সকল পথ রুদ্ধ করে রেখেছিল কুখ্যাত ডোগরা শাসকগোষ্ঠী। তাদের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড দখলদার ইংরেজ, তাদের সেবাদাস স্থানীয় হিন্দু এবং শীখ সমাজের কারণে অনেক আগেই ভেঙ্গেছে। রাজ্য সরকারের সেনাবাহিনী জোর করে মুসলিম যুবকদের ধরে নিয়ে বনাঞ্চল পরিষ্কার করা, পাহাড় কাটা থেকে শুরু করে দুরুহ কাজগুলো করিয়ে নিতো বিনাশ্রমে। মুসলিম কৃষকদের উপরে অনায্য ভারী করের বোঝা, সরকার বিরোধি হিসেবে সন্দেহ হলে এবং গরু জবাইয়ের জন্য মৃত্যুদন্ডের মাধ্যমে হত্যা ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা।

    সরকারের এসব জুলুম অবিচারের প্রতিবাদ করলেই নির্যাতন নেমে আসতো, ধরে নিয়ে গিয়ে কারাগারে ভরতো, পরবর্তিতে আর কোনো দিন কোনো খবরই পাওয়া যায়নি! প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক ও ব্রিটিশ ভারতে সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে কর্মরত Sir Walter Lawrence (১৮৫৭-১৯৪০) তাঁর ‘The India we served’ গ্রন্থে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন।

   এরকমই এক বৈরী পরিবেশে মুসলমান সমাজের আত্মিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থানীয় দুই আলেম মেলৈভি মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ ও খাজা গোলাম নবী সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক এক উদ্যোগ নিয়ে মুসলিম যুব সমাজের মধ্যে একটা পাঠাগার আন্দোলন গড়ে তুললেন 'Reading Room Party' নামে। নিরেট অরাজনৈতিক সংগঠন, বই পড়া আর পড়ানো, সামাজিক কার্যক্রম! শ্রীনগর থেকে শেখ আব্দুল্লাহই মূলত এটি পরিচালনা করতেন।

    মহারাজা হরিসিংহের মন্ত্রী ;কোলকাতার বাঙ্গালী খৃষ্টান Sir Albion Benerji মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রতি এরকম জুলুমের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, তিনি ১৯২৫-২৬ এ মুসলিম জুলুমের প্রতিবাদে বিবৃতি দিয়ে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এ ঘটনা মুসলমানদের উজ্জীবিত করে দারুণভাবে। ইতোমধ্যেই 'Reading Room Party' থেকে মুসলিমদের একটা দল Reading Room Club নামে আলাদা সংগঠন করে বেরিয়ে আসে এবং মহারাজা হরিসিংহের অন্যায্য নীতির প্রতিবাদে সোচ্চার হয়।

     এভাবেই তারা ক্রমেই একটা রাজনৈতিক প্লাটফরম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় যা মহারাজাকে ভাবিয়ে তোলে। মন্ত্রীসভার এক ইংরেজ সদস্য G.C.E. Wakefield মুসলিম যুবকদের বলেন অভিযোগগুলোকে লিখিতভাবে সরকারের নজরে আনতে । 

      ক্লাবের সদস্যরা এগারো সদস্য বিশিষ্ঠ একটি কমিটি গঠন করে যার নেতৃত্বে রইলেন শেষ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ, চৌধুরি গোলাম আব্বাস এবং খাজা সা'দ উদ্দীনের মত লোকজন। তারা ১৯৩১ সালের ২১ শে জুন শ্রীনগরের খানক্বাহ-এ মাওলা'য় এক জনসভার আয়োজন করে। উক্ত জনসভায় আব্দুল কাদের খান নামক এক পাঠান নেতা দীর্ঘদিন ধরে মহারাজার জুলুম নির্যাতনের প্রতিবাদ করে ও তার পদত্যাগ দাবী করে জ্বালাময়ী ভাষণে বলেন; মহারাজা যদি জুলুম নির্যাতন বন্ধ না করে, তবে কাশ্মীরের জনগণ মহারাজার প্রাসাদ আক্রমণ করে তার প্রতিটি ইট খুলে আনবে!

    মূলত এই ২১ শে জুনই ছিল কাশ্মীর জনগণের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরুর মাহেন্দ্রক্ষণ! আনুষ্ঠানিক যাত্রা!! হরিসিংহের কাছে এ বক্তব্য ছিল সহ্যের বাইরে। আব্দুল কাদের খানকে গ্রেফতার করা হলো ২৫ শে জুন, ১৯৩১। তিন সপ্তাহের মাথায় ১৩ই জুলাই রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বিচারের দিনও ধার্য হলো।

   জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়লো। ১৩ই জুলাই সোমবার হাজার হাজার কাশ্মীরি জনগণ শ্রীনগর আদালত চত্বরে জমায়েত হয়, পুলিশ জনগণকে ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ শুরু করলে জনতা-পুলিশ সংঘর্ষ শুরু হয়।

    এরই মধ্যে জোহরের নামাজের সময় হলে একজন আজান দিতে শুরু করে। সাথে সাথে পুলিশ উক্ত মুযাজ্জিনকে গুলি করে , বেচারা আজানের প্রথম লাইনটাও শেষ করতে পারেনি, শহীদ মুয়াজ্জিনের পাশ হতে একজন দাঁড়িয়ে যান, যেখান থেকে আজান থেমে গিয়েছিল ঠিক সেখান থেকেই আবার শুরু করলেন।

    এবারেও পুলিশ উক্ত মুয়াজ্জিনকে শহীদ করে! পাশ থেকে আরও একজন দাঁড়িয়ে আগের শহীদ যেখানে থেমে গিয়েছেন সেখান থেকেই শুরু করেন আজান! সেই একই করুণ ঘটনা!, তাকেও শহীদ করে পুলিশ! এভাবে এক এক করে বাইশ জন কাশ্মীরি মুসলমান শহীদ হয়ে যান একটা মাত্র আজান শেষ করতে! ইতিহাসের সেই ঐতিহাসিক চিহ্ন বহন কারে আজও দাঁড়িয়ে আছে শ্রীনগরের প্রাণকেন্দ্রে 'মা্জার এ শুহাদা'! ৮৯টি বছর পেরিয়েছে সেই আজানের পরে, আজও সেখানে পরিপূর্ণ ইসলামি জামাত দাঁড়ায়নি। সংগ্রাম চলছেই। ত্যাগের যে নজরাণা তারা দেখাচ্ছে, জামাত সেখানে দাঁড়াবেই ইনশাআল্লাহ।   

     এদিকে বসফরাসের পাড়ে এরদোয়ান ৮৫ বছর পরে আবার আজান হেঁকেছেন আয়া সোফিয়ায়!  সম্ভবত এর মূল্য দিতে হবে তুর্কি জনগণকে।  আমি নিশ্চিত যে সেখানেও ওরকম শত শত এরদোয়ান দাঁড়িয়ে যাবেন এই আজান প্রক্রিয়াকে স্থায়ী করতে।  কারণ, একটা দেশ  ও সমাজ বদলায় যে গণমনস্তত্তের কারণে, তুরস্কের ইসলামি আন্দোলন সেটা তৈরি করে ফেলেছে বিগত একটি শতাব্দিতে।
  
     বাংলার মাটিতে হয়তো অচিরেই আজান হাঁকার মতো এরদোয়ান বেরিয়ে আসবেন, কিন্তু সেই আজানকে পূর্ণতা দেবার মতো লোক পাওয়া যাবে তো? আমরা আমাদের দেশে ইসলামি আন্দোলনের সাথে সেরকম গণসম্পৃক্ততা সৃষ্টি করতে পেরেছি? ইতিহাসের এ ক্রান্তিলগ্নে সে প্রশ্নটাই ভাবতে হবে।
------------------------------------------------  
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা  গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments