Recent Tube

হায় ইতিহাস! হায় মুসলমান! জিয়াউল হক।

     
             হায় ইতিহাস! হায় মুসলমান!

   কোহিনূর ; বিশ্ববিখ্যাত হীরা কহিনুর ব্রিটিশ রাণীর মুকুটে শোভা পাচ্ছে। সাম্রাজ্যের Crown Jewels! এক সময় ছিল মোগল সম্রাটের মাথার মুকুট। 
    আলাউদ্দিন খিলজীর হাত হতে এক পর্যায়ে মোগল সম্রাট বাবর, হুমাউন এবং তারও পরে সম্রাট শাহজাহানের হাতে পড়লে তিনি এটাকে ময়ুর সিংহাসনে বসান। পরে তা আওরঙ্গজেবের হস্তগত হয়, সবশেষে ১৭৩৯ সালে নাদির শাহ যখন দিল্লি লুট করেন, তখন তিনি এটাকে নিয়ে যান পারস্যে, আর ১৭৪৭ সালে তিনি খুন হলে কোহিনুর আহমদের শাহ দুররানীর হাতে পড়ে, এক বৎসর না যেতেই আফগানিস্থানে রাশিয়ান আগ্রাসন ঘটলে তারই উত্তরসূরী মাসুদ শাহ কোহিনুরটা সাথে করে কোনমতে পালিয়ে আসেন লাহোরে, আশ্রয় নেন শিখ রাজা; মহারাজা রঞ্জিত সিং এর কাছে।

  রাজা রঞ্জিত সিং পলাতক মাসুদ শাহকে নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের শর্ত হিসেবে ঐ কোহিনূরের মালিকানা দাবী করেন। নিজের প্রাণ বাঁচাতে ওরকম শত কোহিনূর হাতছাড়া করতে প্রস্তুত ছিলেন মাসুদ শাহ। এভাবেই কোহিনুর এসে পড়ে মহারাজা রঞ্জিত সিং এর হাতে ১৮১৩ খৃষ্টাব্দে।

          দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের (১৮৪৯ খৃষ্টাব্দে) পরে লাহোর চুক্তির মাধ্যমে পাঞ্জাবকে ব্রিটিশের হাতে তুলে দিতে হয়। চুক্তির শর্ততানুযায়ী কোহিনূর দিতে হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে। লর্ড ডালহৌসী বিশেষ নিরাপত্তায় তা ইংল্যন্ডে পাঠান, ১৮৫০ খৃষ্টাব্দের ৩রা জুলাই বাকিংহাম প্যালেসে রাণী ভিক্টোরিয়ার হাতে তুলে দেয়া হয়। আধুনিক সময়কালের (২০১৫) বিচারে মূল্য ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। 

    একসময় তা বসানো হয়েছিল ময়ুর সিংহাসনে। ইতিহাসখ্যাত ময়ুর সিংহাসন সম্রাট শাহজাহান বানিয়েছিলেন (১৬২৯ – ১৬৩৫) দীর্ঘ সাত বৎসর সময়কাল ধরে। হযরত সুলাইমান আ: এর সিংহাসনের কথা শুনছিলেন, তাই তার ও তার চাটুকারদের শখ জেগেছিল সম্রাটের জন্য ওরকম একটা সিংহাসন বানানোর ।

   যেহেতু নবাবের অভাব ছিল না, তাই ১১৫০ কেজি (এক লক্ষ ভরি) সোনা, ২৫০ কেজি ওজনের বিভিন্ন হীরা, মনি, মুক্তা, রুবি পাথর দিয়ে তিন গজ লম্বা, আড়াই গজ চওড়া ও পাঁচগজ উচ্চতার এ সিংহাসনটা বানানো হয়। নবাব শাহজাহান যেখানে পশ্চাৎদেশ স্থাপন করবেন, সেই স্থানে একটা বিশেষ গদি বা কুশন বসানো হয়েছিল, যার বর্তমান মুল্যই প্রায় দশ লক্ষ রুপী!

         প্রখ্যাত ফরাসি পর্যটক ও রত্নব্যবসায়ী Jean-Baptiste Tavernier সচক্ষে দেখেছেন; এরকম সাতটি সিংহাসন ছিল মোগল রাজদরবারে। তার মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও দামীটাই হলো ময়ুর সিংহাসন। তিনি গুনে দেখেছেন বড় বড় ২২৪টি হীরার টুকরো বসানো রয়েছে! সেকালের বাজারমুল্যে একটা হিসাবও দিয়েছেন; একলক্ষ ছয় হাজার রুপি (নভেম্বর; ১৬৬৫ সালের হিসেব )! আজকের বাজার মুল্যে অন্তত দশ বিলিয়ন রুপি!
       এবারে তাজমহল। ১৬৩২ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৬৫৩; একনাগাড়ে বাইশ বৎসর ধরে বাইশ হাজার শ্রমিকের ঘাম আর রক্তে তৎকালিন মুল্যের তিন কোটি কুড়ি লক্ষ রুপি (বর্তমান সময়ে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) খরচ করে নিজ স্ত্রীর কবরের উপরে সৌধ বানিয়েছিলেন শাহজাহান, সেটাই তাজমহল।

     জিনিসপত্রের দাম ছিল অতি সস্তা ও সহজলভ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ তারিখে দাউদি’ র বরাতে জানা যায় সিকান্দার লোদীর আমলে একজন বিদেশি পর্যটক ভারতে খাওয়া দাওয়াসহ যাবতীয় ব্যায় নির্বাহ করেছেন, পুরো এক মাসে তার খরচ হয়েছে, এক রুপি বারো আনা মাত্র। (সুত্র: The Gazetteer Of India দ্বিতীয় খন্ড)
আগ্রার বাজার পর্যবেক্ষণ শেষে উক্ত পর্যটক আরও জানান, সে সময় গমের মিহি আটার মূল্য ছিল ১৫ দাম (Dam) বা সাড়ে সাইত্রিশ পয়সা প্রতি মন (এক দাম’ ছিল আড়াই পয়সা সমমানের একটি মুদ্রা।) 

     এই 'দাম' শব্দটিই কালক্রমে বাংলা ভাষায় অঙ্গিভূত হয়েছে । চাউল ছিল কুড়ি দাম বা পঞ্চাশ পয়সা প্রতি মন, গুড় ৫৬ দাম (Dam) বা এক রুপি চল্লিশ পয়সা , ঘি ১০৫ দাম (Dam) বা দুই রুপি বাষট্টি পয়সা প্রতি মন। (সুত্র ঐ)

      আবুল ফজলের (১৫৯০ খৃ:) আঈন ই আকবরি জানায় ; সম্রাট আকবর শ্রমিক ও সরকারি কর্মচারীদের জন্য যে বেতন হার নির্ধারণ করেছিলেন, তা কঠোরতার সাথে মানা হতো। একজন কাঠমিস্ত্রির দৈনিক মজুরি ছিল দক্ষতাভেদে ২ থেকে ৭ দাম (Dam) বা ৫ থেকে ১৫ পয়সা। একজন রাজমিস্ত্রির ৩ থেকে ৩.৫ দাম (Dam - সাড়ে সাত থেকে পৌনে নয় পয়সা)। একজন সৈনিকের মাসিক বেতন ছিল আড়াই রুপি। কুড়ি মন চালের একটি চালানের মূল্য ছিল মাত্র ৪ রুপী ! (সুত্র ঐ) অর্থাৎ এক রুপীতে পাঁচ মন চাল পাওয়া যেত!
ভারতে মুসলিম শাসনের শুরুর দিকে, দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে (১১৯২) কুতুবউদ্দীন আইবেক থেকে শুরু করে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে (১৩৬৯ খৃ:) ফিরোজশাহ তুঘলক পর্যন্ত সকল শাসকেরই চোখ ধাঁধাঁনো সৌধ, ইমারাত তৈরিই দায়িত্ব ছিল যেন!

     অথচ ইচ্ছা করলেই তারা ভারতের প্রতিটি খাল-বিল,  নদ-নদীর উপরে ব্রিজ-কালভার্ট, প্রতিটি মহল্লায় স্কুল-কলেজ- ইউনিভার্সিটি বানাতে পারতেন । পুরো ভারতে অন্তত একশত ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড বা হাভার্ড বানানো যেত, প্রতিটি ইউনিয়নে, পঞ্চায়েতে বানানো যেত হাসপাতাল। প্রতিটি নাগরিকের জন্য আজীবন বিনামুল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা যেতো। 

       এসব ভাবি, বড় আক্ষেপে নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, মুসলিম নামধারী এই সব শাসকরা কোথা হতে, ইসলাম শিখেছিলেন যে, সোনা-দানা-হীরা-জহরতের কদর বুঝেছেন কিন্তু মানুষের কদর বোঝেন নি! তারা বোঝেন নি যে, জনগণের আত্মিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানবিক উন্নয়ন না হলে না দেশের নিরাপত্তা বজায় থাকে, আর না বজায় থাকে সমাজ, সভ্যতা ও সরকারের নিরাপত্তাটুকু!
  বোঝেন নি বলেই কোহিনুর আজ অপরের শিরে শোভা পাচ্ছে! ময়ুর সিংহাসনও হাতছাড়া! কুতুব মিনার আজও দাঁড়িয়ে আছে, দাঁড়িয়ে আছে তাজমহলও ঠিক, কিন্তু ধুলোয় লুটেছে কেবল মুসলমানের শিরটাই! 

    ভারতেই কেবল নয়, বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা আজ নিজের প্রাণটুকু বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে ফিরছে! হায়, এযুগের মুসলমানরা কি বুঝবে না যে, সময়ের স্বৎব্যবহার যে মুসলমান করে না, সময় তার/ তাদের উপরে প্রতিশোধ নেয়! সময় কাউকেই ক্ষমা করে না, সময়ের প্রতিশোধ বড়ই নির্মম হয় !
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা ও বিশ্লেষক।     

Post a Comment

0 Comments