Recent Tube

আল্লামা মওদুদীর বিরোধিতার কারণ জানতে ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ বইটি পড়তে হবেঃ ফখরুল ইসলাম খান।

আল্লামা মওদুদীর বিরোধিতার কারণ জানতে 
ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ বইটি পড়তে হবে

এক জাতিত্ব ও ইসলামঃ-
দারুল উলুম দেওবন্দ-এর প্রিন্সিপাল জনাব মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী ‘একজাতিত্ব ও ইসলাম’ নামে একখানি পুস্তিকা লিখেছেন। একজন সুপ্রসিদ্ধ আলেম এবং পাক-ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের লিখিত এ পুস্তিকায় জটীল ‘জাতিতত্ত্বের’ সরল বিশ্লেষণ এবং প্রকৃত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীর পূর্ণ অভিব্যক্তি হবে বলেই স্বভাবতই আশা করা গিয়েছিল। কিন্তু এটা পাঠ করে আমাদেরকে নির্মমভাবে নিরাশ হতে হয়েছে এবং এ বইখানাকে গ্রন্থকারের পদমর্যাদার পক্ষে হানীকর বলে মনে হয়েছে। বর্তমান যুগে অসংখ্য ইসলাম বিরোধী মতবাদ ইসলামের মূল তত্ত্বের উপর প্রবল আক্রমন চালাতে উদ্যত-ইসলাম আজ তার নিজের ঘরেই অসহায়। স্বয়ং মুসলমান দুনিয়ার ঘটনাবলী ও সমস্যাবলী খালেছ ইসলামের দৃষ্টিতে যাচাই করে না; বলাবাহুল্য-নিছক অজ্ঞনতার ইসলামের দরুনই তারা তা করতে পারছে না। পরন্তু ‘জাতীয়তার’ ব্যাপারটি এতই জটীল যে, তাকে সুস্পষ্টরূপে হৃদয়াঙ্গম করার উপরই এক একটি জাতির জীবন-মরণ নির্ভর করে। কোনো জাতি যদি নিজ জাতীয়তার ভিত্তিসমূহের সাথে সম্পূর্ণ ভিন্ন মূলনীতির সংমিশ্রণ করে, তবে সে জাতি ‘জাতি’ হিসাবে দুনিয়ার বুকে বাঁচতে পারে না। এ জটীল বিষয়ে লেখনী ধারণ করতে গিয়ে মাওলানা হুসাইন আহমদের ন্যায় ব্যক্তির নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল। কারণ তাঁর কাছে নবীর ‘আমানত’ গচ্ছিত রয়েছে। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও মূল তত্ত্বের উপর যদি কখনো জঞ্জাল-আবর্জনা পুঞ্জীভূত হয়, তবে এদের ন্যায় লোকদেরই তা দূরীভূত করে ইসলামের শিক্ষাকে সর্বজন সমক্ষে সুস্পষ্ট করে তোলা কর্তব্য।
বর্তমান অন্ধকার যুগে তাঁদের দায়িত্ব যে সাধারণ মুসলমানদের অপেক্ষা অনেক বেশী এবং কঠোর, সে কথা তাদের পুরোপুরিই অনুধাবন করা কর্তব্য ছিল। সাধারণ মুসলমান যদি ভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে থাকে তবে সে জন্য সর্বপ্রথম এ শ্রেণীর লোকদেরকেই দায়ী করা হবে। সেজন্য আমাকে আবার বলতে হচ্ছে যে, মাওলানা মাদানীর এ পুস্তিকায় তাঁর দায়িত্বজ্ঞান ও দায়িত্বানুভূতির কোনো প্রমাণই পাওয়া যায়নি।

#অবৈজ্ঞানিক_দৃষ্টিকোণঃ-

একজন গ্রন্থকারের রচিত গ্রন্থে সর্বপ্রথম তাঁর দৃষ্টিকোণেরই সন্ধান করা হয়। কারণ মূল বিষয়বস্তু পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা এবং সর্বশেষ কোনো নির্ভুল বা ভ্রান্ত পরিণতিতে উপনীত হওয়া একমাত্র এ দৃষ্টিকোণের উপর নির্ভর করে। একটি দৃষ্টিকোণ এই হতে পারে যে, অন্যান্য সকল দিক থেকে দৃষ্টি ফিরায়ে একমাত্র প্রকৃত সত্য ব্যাপার জানতে চেষ্টা করতে হবে, মূল সমস্যাকে তার আসল ও প্রকৃতরূপে দেখতে ও বিচার করতে হবে এবং এরূপ প্রকৃত সত্যের নিরপেক্ষ পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে পৌছায়-তা কারো বিরোধী আর কারো অনুকূল, সে বিচার না করেই সরাসরিভাবে তাই গ্রহণ করা কর্তব্য। বস্তুত আলোচনা ও বিশ্লেষণের এটাই হচ্ছে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গী; আর ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীও এটাই। কারণ এ ব্যাপারে الحُبُّ فِى اللهِ واللَغْضُ فِىْ اللهِ-“আল্লাহর জন্যই ভালবাসা এবং আল্লাহর জন্যই শত্রু“তাই” হচ্ছে ইসলামের মূলনীতি।

এ সহজ-সরল দৃষ্টিকোণ ছাড়া আরো অনেক কুটীল ও জটীল দৃষ্টিকোণ রয়েছে। বিশেষ কোনো ব্যক্তির অন্ধ ভালবাসায় মোহিত হয়ে প্রত্যেক কাজে ও ব্যাপারে কেবল তার অনুকূলেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাও একপ্রকার দৃষ্টিভঙ্গী। অনুরূপভাবে কারো অন্ধ বিরোধীতায় লিপ্ত হয়ে কেবল ঘৃণিত ও ক্ষতিকর জিনিসের সন্ধান করা এবং তা গ্রহণ করাও এক প্রকারের দৃষ্টিকোণ। কিন্তু এ ধরণের বক্র, কুটীল ও জটীল দৃষ্টিভঙ্গী যতই হোক না কেন, তা সবই প্রকৃত সত্যের বিপরীত হবে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কাজেই তা গ্রহণ করে তার সাহায্যে কোনো আলোচনায় নির্ভুল সিদ্ধান্তে উপনীতি হওয়ার কোনোই আশা করা যায় না। অতএব এ দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করে কোনো সমস্যা সম্পর্কে আলোচনায় লিপ্ত হওয়া অন্তত একজন আলেম ব্যক্তির কিছুতেই শোভা পায় না। কারণ, এটা সম্পূর্ণত অনৈসলামী দৃষ্টিকোণ।

এখন আমরা যাচাই করে দেখবো যে, মাওলানা মাদানী আলোচ্য পুস্তিকায় উল্লিখিত দৃষ্টিকোণসমূহের কোনটি অবলম্বন করেছেন।
পুস্তিকার সূচনাতেই তিনি বলেছেনঃ
“একজাতিত্বের বিরোধিতা এবং তাকে ন্যায়-নীতির বিপরীত প্রমাণ করার প্রসঙ্গে যা কিছু প্রকাশ করা হয়েছে, তার ভুল-ত্রু“টি দেখিয়ে দেয়া এখন জরূরী মনে হচ্ছে। কংগ্রেস ১৮৮৫ খৃস্টাব্দ থেকে ভারতবাসীর নিকট স্বাদেশিকতার ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্যের দাবী করে যথেষ্ট পরিমাণে চেষ্টা ও সাধনা করছে। তার বিরোধী শক্তিসমূহ তার অ-স্বীকারযোগ্য হওয়া-বরং নাজায়েয ও হারাম হওয়ার কথা প্রমাণ করার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করছে। বস্তুত বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে এটা অপেক্ষা মারাত্মক আর কিছুই নেই। এটা আজ নয়, ১৮৮৬ খৃস্টাব্দ কিংবা তারও পূর্ব থেকে এসব কথা প্রকাশ করা হয়েছে। এবং বিভিন্নভাবে এর ‘ওহী’ ভারতবাসীদের মন ও মস্তিষ্ক বৃটিশ কূটনীতিকদের যাদুর প্রভাবে পক্ষঘাতগ্রস্ত হয়েছে, তারা একথা কবুল করবে বলে আশা করা যায় না।” -(পৃষ্ঠাঃ ৫-৬)

এ প্রসঙ্গে ড. ইকবাল সম্পকে বলেছেন, “তাঁর ব্যক্তিত্ব কোনো সাধারণ ব্যক্তিত্ব নয়। কিন্তু এসব গুণপনা সত্ত্বেও তিনি বৃটিশ ‘যাদুকর’দের যাদু প্রভাবে পড়ে গেছেন।”
অতপর এক দীর্ঘ আলোচনার পর তিনি নিজের দৃষ্টিকোণ নিন্মলিখিত কথাগুলোর ভিতর দিয়ে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছেনঃ

“ভারতবাসীদের স্বাদেশিকতার ভিত্তিতে এক জাতিতে পরিণত হওয়া ইংল্যাণ্ডের পক্ষে যে কতখানি মারাত্মক, তা অধ্যাপক সীলে’র প্রবন্ধের উদ্ধৃতাংশ থেকে নিঃসন্দেহে বুজতে পারা যায়। ভারতবাসীদের মধ্যে এ ভাবধারা যদি খুব ক্ষীণ ও দুর্বলভাবে জাগ্রত হয়, তবে তাতে ইংরেজদেরকে ভারতর্বষ থেকে বহিষ্কার করার শক্তি না থাকলেও ‘বিদেশী জাতির’ সাথে সহযোগিতা করা লজ্জাকর ব্যাপার, এ ভাবটি তাদের মধ্যে বদ্ধমূল বলেই ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের সমাধি হয়ে যাবে।” – (পৃষ্ঠাঃ ৩৮)

এরপর তিনি এমন একটি আশ্চর্যজনক মত প্রকাশ করেছেন যে, তা পাঠ করলে একজন সুপ্রসিদ্ধ আল্লাহভীরু আলেম যে এটা কিরূপে লিখতে পারেন, তা ভাবতেও লজ্জা হয়!

“এক জাতীয়তা যদি এমনিই অভিশপ্ত ও নিকৃষ্ট বস্তু হয়েও থাকে, কিন্তু তবুও ইউরোপীয়গণ যেহেতু এ অস্ত্র প্রয়োগ করেই ইসলামী বাদশাহ ও উসমানী খিলাফতের (?) মূলোচ্ছেদ করেছিল, তাই এ হাতিয়ারকে বৃটিশের মূলোতপাটনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা আজ মুসলমানদের কর্তব্য।” -(পৃষ্ঠাঃ ৩৮)

এ আলোচনা প্রসঙ্গে মাওলানা মাদানী প্রথমত একথা স্বীকার করেছেন যে, “বিগত দুই শতাব্দীকাল পর্যন্ত মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ যতোদূর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ইসলামী ঐক্য ও সংহতির বিরুদ্ধে ইউরোপীয়দের কঠিন ও মারাত্মক প্রচার-প্রোপাগাণ্ডার কারণেই তা হয়েছে।” “ইউরোপীয়গণ মুসলমানদের মধ্যে বংশীয়, স্বাদেশিক ও ভাষাগত বৈষম্য ও বিভেদ সৃষ্টি করেছে” তাদের মধ্যে এ ভাবধারাও জাগিয়ে দিয়েছে যে, ধর্ম ও আধ্যাত্মিকা রক্ষার জন্য কোনো জিহাদ করা উচিত নয়, তা করতে হবে বংশ-গোত্র ও জন্মভূমির জন্য। অতএব ধর্মীয় ভাবধারা পরিহার করাই বাঞ্ছনীয়।”- (পৃষ্ঠাঃ ৩৫-৩৬)

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিগূঢ় সত্যের এতো নিকটে পৌছে তিনি ইংরেজ বিদ্বেষের গোলকধাঁধায় দিগভ্রান্ত হয়েছেন। তিনি লিখেছেনঃ

“দুঃখের বিষয় মুসলমানদের তখন একজাতিত্ব, স্বাদেশিকতা, বংশ-ও গোত্রের বিরুদ্ধে ওয়াজ বর্ণনাকারী কেউই দণ্ডায়মান হয়নি। এমনকি ইউরোপের পত্র-পত্রিকা ও বক্তাদের বক্তৃতার সর্বপ্লাবী বন্যারও প্রতিরোধ করা হয়নি। এর ফলে প্যান-ইসলামবাদ এক অতীত কাহিনীতে পরিণত ও তার পরিসমাপ্তি ঘটেছে এবং ইসলামী রাজ্যসমূহ ইউরোপীয় জাতিদের কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে। এখন মুসলমানদেরকে যখন আফ্রিকা, ইউরোপ, এশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে খণ্ড-বিখণ্ড করে ধ্বংস করেছে, তখন আমাদেরকে বলা হয় যে, কেবল একই মিল্লাতের লোকদের ঐক্য ও সংহতির গুরুত্ব দেয়-এরূপ কোনো অমুসলিমের সাথে মিলিত ও সংযুক্ত হতে পারে না এবং কোনো অমুসলিমের সাথে মিলিত ‘একজাতি’ও গঠন করতে পারে না।” – (পৃষ্ঠাঃ ৩৬-৩৭)

উল্লিখিত উদ্ধৃতাংশ পাঠ করলেই সুস্পষ্টরূপে বুঝতে পারা যায় যে, মাওলানা মাদানীর দৃষ্টিতে সত্য ও মিথ্যা, হক ও বাতিলের চূড়ান্ত মাপকাঠি হচ্ছে বৃটিশ। তিনি সমস্ত ব্যাপার নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে যাচাই করে দেখতে চান না যে, প্রকৃত ও অন্তর্নিহিত সত্যের বাস্তবরূপ কি! তিনি মুসলমানদের কল্যাণকামী দৃষ্টি থেকেও বিচার করেন না যে, মুসলমানদের জন্য প্রকৃতপক্ষে হলাহল কোনটি! এ উভয় দৃষ্টিকোণকেই তিনি পরিত্যাগ করেছেন। শুধু ‘বৃটিশ-শত্রু“তার’ দৃষ্টিকোণেই তাঁর উপর সর্বাত্মক প্রভাব বিস্তার করেছে। এখন বৃটিশের পক্ষে যে জিনিসটি হলাহল, মাওলানা মাদানী ঠিক সেটিকেই সঞ্জীবনী সুধা মনে করেন। এমতাবস্থায় উক্ত জিনিসকেই যদি কেউ মুসলমানদের জন্যও হলাহল বলে মনে করে এবং এজন্য সে তার বিরোধীতা করে, তবে মাওলানার দৃষ্টিতে এ ব্যক্তি ‘বৃটিশভক্ত’ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। কারণ বৃটিশের মৃত্যুতে তিনি যতোদূর উৎসাহী মুসলমানদের জীবনলাভের ব্যাপারে তিনি ততোটা উৎসাহী নন। এজন্যই তিনি জানতে পেরেছেন যে, ভারতবাসীদের ‘একাজাতিত্ব’ বৃটিশের জন্য মারাত্মক; এখন এ একজাতিত্বের বিরোধী প্রত্যেকটি মানুষই মাওলানা মাদানীর দৃষ্টিতে বৃটিশভক্ত ছাড়া আর কি-ইবা হতে পারে? বৃটিশ ধ্বংসের আর একটি অব্যর্থ পন্থা যদি কেউ মাওলানাকে বলে দিতো; যদি বলতো, ভারতের ৩৫ কোটি অধিবাসীদের এক সাথে সামগ্রিক আত্মহত্যা বৃটিশ সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত সমাধি নিশ্চিত; আর মাওলানা যদি নোস্খাটির অব্যর্থতা বুঝতে পারতেন, তবে এর বিরোধী প্রত্যেকটি ব্যক্তিকেই তিনি বৃটিশভক্ত বলে দোষী করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না। আত্মহত্যা নিতান্ত নিকৃষ্ট ও অভিশপ্ত কাজ হলেও, এর দ্বারা বৃটিশের মূলোতপাটন করা সম্ভব বলে, মাওলানার দৃষ্টিতে এ পাপানুষ্ঠান করাও কর্তব্য হয়ে পড়তো।

বস্তুত এ ধরণের কথা ও মতবাদের দৃষ্টিতে ‘আল্লাহর জন্য ভালবাসা ও আল্লাহর জন্য ক্রোধ’কে ইসলামী সত্যের মানদণ্ড করার যৌক্তিকতা এবং তার নিগূঢ় রহস্য বুঝতে পারা যায়। আল্লাহর সম্পর্ক যদি মাঝখান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং অন্য কোনো বস্তু যদি প্রত্যভাবে প্রিয় বা অপ্রিয় হয়ে পড়ে. তবে সেখান থেকেই বর্বরতামূলক হিংসা-দ্বেষ শুরু হয়ে যায়। তখন মানুষের প্রেম ও অ-প্রেমের সকল ভাবধারা চরিতার্থ করার অনুকূল সকল উপায় ও পন্থাই হালাল ও সংগত হয়ে পড়ে। মূলত তা আল্লাহর বিধানের অনুকূল কি-না, সে বিচার তখন আদৌ করা হয় না। এজন্যই বলা হয়েছে যে, ব্যক্তিগত শত্রু“তা শয়তানের সাথেও হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়, তাতেও আল্লাহর সম্পর্ক মাঝখানে থাকা আবশ্যক। অন্যথায় এ শয়তান শত্রু“তাই একটি আইনে পরিণত হতে এবং শয়তানের অন্ধ শত্রু“তায় আল্লাহর নির্ধারিত সীমাগুলো লংঘন হতে পারে। ফলে শয়তানের কাজ করা হবে।

#নিজের_কথা_প্রমাণের_জন্য_অন্ধ_আবেগঃ-

এরূপ মানসিকতার ফলেই মাওলানা মাদানী নিজের দাবী প্রমাণের অন্ধ আবেগে ইতিহাসের সুপ্রসিদ্ধ ও উজ্জ্বল ঘটনাগুলোকেও উপেক্ষা করতে কুন্ঠিত হননি। ইউরোপ মুসলমানদের মধ্যে যখন বংশ-গোত্রীয়; স্বাদেশিক ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা প্রাচার করছিল, তখন মুসলমানদের মধ্যে থেকে তার প্রতিরোধের জন্যে সত্যিই কি কেউ দাঁড়াননি ? ………টিপু সুলতান, জামালুদ্দীন আফগানী, মুফতি মাহাম্মাদ আবদুহু, মোস্তফা কামেল মিশরী, আমীর শাকীব আরসালান, আনোয়ার পাশা, জালাল নুরী, শিবলী নোমানী, সাইয়্যেদ সুলাইমান নদভী, মাহমুদুল হাসান, মুহাম্মাদ আলী, শওকত আলী, ইকবাল, আবুল কালাম (মরহুম) প্রমুখ কারো নাম কি তিনি শুনতে পাননি? উক্তরূপ জাতীয়ভাবে জাহেলী বিভেদ মুসলমানদেরকে যে চূর্ণবিচূর্ণ ও ছিন্নভিন্ন করে দিবে-এ বলে কি উল্লিখিত লোকদের মধ্যে থেকে কেউই মুসলমানদেরকে সাবধান করেননি? এ প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা মাদানী হয়তো ‘না’ বলতে পারবেন না। কিন্তু তবুও তিনি এসব বাস্তব ঘটনা থেকে দৃষ্টি ফিরায়ে ‘মুসলমানদের একজাতিত্ব সম্পর্কে ওয়াজকারী কেউ দণ্ডায়মান হয়নি’ বলেই দুঃখ প্রকাশ করছেন। …… এরূপ ভ্রান্ত দাবী উত্থাপন করার কি প্রয়োজনীয়তা ছিল? ……… শুধু এ কথাই প্রমাণ করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল যে, মুসলমানদের জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বৃটিশের স্বার্থের বিপরীত, এজন্যই সকল মুসলমান বংশীয়-গোত্রীয়, স্বাদেশিক এবং ভাষাগত বৈষম্য ও বিভেদ বিস্তারে আত্মনিয়োগ করেছিল। আর এখন ইসলামিক ঐক্য সংহতি বৃটিশ স্বার্থের অনুকূল হয়েছে (?) বলে মুসলমানদের জাতীয় ঐক্যের ওয়াজ প্রচার করা শুরু হয়েছে। অতএব প্রমাণ হলো যে, স্বাদেশিকতার বিরোধী প্রত্যেকটি মানুষই বৃটিশভক্ত, বৃটিশের যাদুই তাদের মুখে একথা বলাচ্ছে। বস্তুত এটা জাহেলী বিদ্বেষ রীতিরই পরিণাম, সন্দেহ নেই। সত্য ও মিথ্যা, হক ও বাতিলের মানদণ্ড ‘বৃটিশ’ হওয়ার কারণে প্রকৃত সত্য ও বাস্তবের বিপরীত কথা রটনা করাও সংগত হতে পারে-যদি তা বৃটিশ স্বার্থের উপর আঘাত হানতে পারে।

মাওলানা মাদানীর গোটা পুস্তিকাতেই এরূপ মানসিকতার স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি হয়েছে। তাতে অভিধান, কুরআনের আয়াত, হাদীস ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে ভেঙে-চুরে নিজের মন মতো সাজিয়ে নিজের দাবী প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে এবং নিজ দাবীর বিপরীতে প্রত্যেকটি সত্যকে তিনি অকুন্ঠচিত্তে অস্বীকার ও উপোক্ষা করেছেন-তা ভিতর বাইর সবদিক দিয়ে যতোবড় সত্যই হোক না কেন। এমনকি শব্দগত ভ্রান্তিবোধের সৃষ্টি করতে, সাদৃশ্যহীন উদাহরণ দিতে এবং ভুলের উপর ভুল মতের ভিত্তি স্থাপন করতেও তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। বস্তুত একজন আল্লাহভীরু আলেমের এরূপ কর্মকাণ্ড দেখে লজ্জায় মাথানত হয়ে আসে।

#আঞ্চলিকতার_ভিত্তিতে_জাতি_গঠন_কোথায়_হয়?

“বর্তমান সময় জাতি আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে গঠিত হয়” বলে মাওলানা মাদানী দাবী কেরছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা সম্পূর্ণরূপে ভুল ও প্রতারণাময় এবং আগাগোড়া ভিত্তিহীন। কেবল একটি অঞ্চলের অধিবাসী হওয়ার কারণে কোথাও একটি জাতি গঠিত হয়েছে-মানবতার ইতিহাস থেকে এরূপ একটি উদাহরণও পেশ করা যেতে পারে না। বর্তমান দুনিয়ার জাতিসমূহও সকলেরই সামনে বিরাজমান। এদের মধ্যে নিছক আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে কোন্ জাতিটি গঠিত হয়েছে? আমেরিকার নিগ্রো ও রেড ইণ্ডিয়ান এবং শ্বেতবর্ণের লোকেরা কি একই জাতির অন্তর্ভূক্ত? জার্মানির ইহুদী ও জার্মানরা কি এক জাতি? পোল্যাণ্ড, রুশিয়া, তুরস্ক, বুলগেরিয়া, গ্রীক, যুগোশ্লাভিয়া ও চেকোশ্লোভিয়া, লাথুনিয়া, ভিনল্যাণ্ড-কোথাও কি মার্তৃভূমি এক হওয়ার কারণেই ‘একাজাতি’ রয়েছে, কেবল মার্তৃভূমির ঐক্যই কি তা সৃষ্টি করেছে? এসব বাস্তব ঘটনা অস্বীকার করা যায় না। আপনি যদি বলতে চান যে, এখন থেকে স্বাদেশিকতার ভিত্তিতে জাতি গঠন হওয়া উচিত, তবে তা বলতে পারেন। কিন্তু যুক্তি ও প্রমাণ ছাড়া-স্বাদেশিকতা ও মার্তৃভূমির ঐক্যের ভিত্তিতে জাতি গঠিত হয়- এরূপ উক্তি করার আপনার কি অধিকার আছে?

একটি দেশের সমগ্র অধিবাসীকে বৈদেশিক লোকগণ সেই দেশের অধিবাসী বলে জানে এবং অভিহিত করে। ‘আমেরিকান’ বলতে আমেরিকা নামীয় দেশের প্রত্যেকটি অধিবাসী বুঝায়-সে নিগ্রো হোক কি শ্বেতাঙ্গ; বাইরের লোক তাকে ‘আমেরিকান’ই বলবে। কিন্তু মূলত এরা যে দুটি বিভিন্ন জাতির লোক, সে সত্য এতে মিথ্যা হয়ে যায় না। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজ নিজ রাজ্যের ‘ন্যাশনাল’ বলে পরিচিত হয়, এতে সন্দেহ নেই। যদি মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী বর্হিভারতে চলে যান, তবে তাঁকে ‘বৃটিশ ন্যাশনালিটি’ বলে অভিহিত করা হবে। কিন্তু এরূপ পারিভাষিক জাতীয়তা কি মাওলানার প্রকৃত জাতীয়তার পরিণত হবে। তাহলে “ভারতের অধিবাসী হিসেবে হিন্দু, মুসলমান, শিক, খৃস্টান ও পার্শী সকলেই ‘একজাতি’ বলে পরিচিত হয়”- একথায় বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি কি থাকতে পারে? ‘পরিগণিত’ হওয়া এবং প্রকৃতপে ‘একজাতি হওয়ায়’ আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। কাজেই এর একটিকে প্রমাণ করার জন্য অন্যটিকে যুক্তি হিসাবে পেশ করা যেতে পারে না।
------------------------------------------------  
ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ বই থেকেঃ

Post a Comment

0 Comments