Recent Tube

দাসীর হাদীস : আল্লাহ কোথায়? তানজিল ইসলাম।

                                 দাসীর হাদীস : আল্লাহ কোথায়?

    রাসুলুল্লাহ (সা.) লক্ষাধিক সাহাবীকে ইমান শেখালেন। তাওহীদ শেখালেন। কই, কখনো তো তিনি তাদেরকে আল্লাহর অবস্থানস্থল (?) সম্পর্কে কিছু জানালেন না। কিন্তু এক সাহাবী যখন তার দাসী আজাদ করতে চাইলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) সেই দাসীকে ডাকিয়ে এনে তাকে দুটো প্রশ্ন করলেন। প্রথম প্রশ্ন ছিল, أَيْنَ اللَّهُ আল্লাহ কোথায়। দাসী জবাবে বলল, فِي السَّمَاءِ আকাশে। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, مَنْ أَنَا আমি কে। দাসী বলল, أَنْتَ رَسُولُ اللَّه আপনি আল্লাহর রাসুল। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, أَعْتِقْهَا فَإِنَّهَا مُؤْمِنَةٌ তাকে আজাদ করে দাও। নিশ্চয়ই সে মুমিন। (সহীহ মুসলিম হাঃ ৫৩৭)

    রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে সাহাবীরা ইমানের স্বীকারোক্তি দিতেন তাওহিদুল উলুহিয়্যাহর সাক্ষ্য দেওয়ার মাধ্যমে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)ও তাদেরকে এভাবেই শিখিয়েছেন। যাচাইয়ের প্রয়োজন হলেও এ প্রসঙ্গেই জিজ্ঞাসা করতেন যে, তুমি কি সাক্ষ্য দাও, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই? অর্থাৎ তুমি কি তাওহিদুল উলুহিয়্যায় বিশ্বাসী? কিন্তু হাদীসের এই সুবিশাল ভাণ্ডারে দাসীর হাদীসের ক্ষেত্রে এসে বিষয়টা ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। উপরন্তু এর দ্বারা রাসুলুল্লাহ (সা.) আবার এ-ও বুঝে নিলেন যে, সে মুমিন। এটা কীভাবে?

আরবিতে 'أين' (কোথায়) শব্দ দ্বারা দু'টি জিনিস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়: 'মাকান' তথা স্থান/জায়গা সম্পর্কে, 'মাকানাহ' তথা মর্যাদা সম্পর্কে। বাংলায়ও আমরা বলি, বিল গেটস কোথায় আর আদার ব্যাপারী কোথায়! এই কথার দ্বারা মাকান বা জায়গা বোঝানো উদ্দেশ্য হয় না; বরং মাকানাহ তথা মর্যাদা বোঝানো উদ্দেশ্য হয়। উভয়ের মর্যাদাগত তারতম্য বোঝানোর জন্যই এরূপ বলা হয়। যেহেতু আল্লাহ তাআলা স্থান-কাল-পাত্রের বন্ধন থেকে মুক্ত। কারণ, তিনিই এসবের স্রষ্টা। তাই এ কথা তো নিশ্চিত যে, রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর প্রশ্ন দ্বারা 'মাকান' জায়গা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা উদ্দেশ্য নয়; বরং 'মাকানাহ' মর্যাদা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা উদ্দেশ্য।

    দাসী জবাব দিলো, في السماء 'আকাশে'। আসলে সে তো উত্তরটা বাংলায় দেয়নি; দিয়েছে আরবিতে। শব্দ ব্যবহার করেছে, 'সামায়ুন'। আরবিতে 'সামায়ুন' (আকাশ) শব্দ দ্বারা বাস্তবিক আকাশও বোঝায়, আবার 'উচ্চতা'ও বোঝায়। বলা হয়, 'কুল্লু মা আলাকা ফা হুওয়া সামায়ুন'। অর্থাৎ তোমার ওপর যা কিছু আছে, তা পুরোটাই 'সামায়ুন'। যেহেতু আমরা আগেই স্পষ্ট করে এসেছি, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রশ্ন দ্বারা স্থান/জায়গা সম্পর্কে জানতে চাওয়া উদ্দেশ্য ছিল না; বরং উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর মর্যাদা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা। কারণ, সে যদি মুমিন হয়, তার অন্তরে আল্লাহর মর্যাদা থাকবে সবার ওপরে। আর যদি কাফির হয়, তাহলে অবস্থা এর বিপরীত হবে। তো দাসীও বিষয়টি বুঝতে পেরে উত্তর দিলো, 'في السماء' অর্থাৎ, ঊর্ধ্বে। এর দ্বারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-ও তার অন্তরে আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বুঝে নিলেন। যার কারণে তাকে মুমিন বলে ঘোষণা দিলেন।

    কেউ আবার বলতে পারে, আপনি তো
হাদীসটিকে তার বাহ্যিক অর্থে না
নিয়ে ভিন্ন অর্থে নিলেন! আমরা বলব,
না, আমরা হাদীসের সবগুলো শব্দকে আরবদের নিকট স্বীকৃত অর্থেই নিয়েছি। কোনো শব্দেরই অপব্যাখ্যা করিনি। এক শব্দের একাধিক অর্থ থাকলে কোন জায়গায় কোনটি গৃহীত হবে, তা বাক্যের পূর্বাপর ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখেই বিবেচনা করতে হয়। এখানে যেই অর্থ গ্রহণ করা সংগত, আমরাও সেই অর্থই গ্রহণ করেছি। আর মনে রাখবেন, এই হাদীসটিকে আপনারা যারা বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করার দাবি করেন এবং বিপরীতপক্ষকে এর সূত্র ধরে কটাক্ষ করেন, তারাই বরং এর তাবিল করেন। সেটা কীভাবে? তাদের আকিদা আল্লাহ আকাশে নয় বরং আরশে। যেহেতু আকাশ ও জমিনের পার্থক্যের চেয়েও আকাশ ও আরশের পার্থক্য বিশাল। তাই তারা বলেন, এখানে আকাশে দ্বারা উদ্দেশ্য আকাশের ওপরে আরশে। আরবি 'في' শব্দটি ব্যবহার হয়েছে 'علي' অর্থে। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা আকাশের ওপরে আরশে রয়েছেন। সুরা মুলকের আয়াতেও এই ব্যাখ্যাই উদ্দেশ্য। আমরা বলব, 'في' (মধ্যে) শব্দকে 'علي' (ওপরে) অর্থে গ্রহণ করলে সেই স্বঘোষিত বাহ্যিক অর্থ আর থাকল কোথায়? এটাই তো তাবিল হয়ে গেল। তারচেয়ে আরও মজার বিষয়, এখানে 'في' (মধ্যে) শব্দকে 'علي' (ওপরে) অর্থে নেন, আবার 'ইসতাওয়া আলাল আরশ' আয়াতের ক্ষেত্রে নিজেদের আকিদা বর্ণনা
করতে গিয়ে 'আলা'কে 'ফি' অর্থে রূপান্তরিত করে ফেলেন। আপনারা বলেন, আল্লাহ আরশে। এটা বলেন না যে, তিনি আরশের ঊর্ধ্বে। তাহলে আলাল আরশকে বানিয়ে দিলেন ফিল আরশ। জিজ্ঞেস করলে আবার তাবিলের পসরা খুলে দেন। তখন বলেন, আমরা আকাশে বলে আকাশের ওপরে উদ্দেশ্য নিই। আরশে বলে আরশের ঊর্ধ্বে বোঝাই। তাহলে ঘুরেফিরে সেই তাবিলই তো হচ্ছে! স্ববিরোধী কথাকে জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। তারচেয়ে আরও মজার বিষয়, কোনো হাদীসে 'أين الله' (আল্লাহ কোথায়) এর জবাবে 'ফিল আরশি' (আরশে) উল্লেখ হয়নি। কুরআনে তো 'أين الله' শব্দই নেই। কিন্তু আপনারা আকিদা বর্ণনা করতে গেলে 'আরশে' শব্দ দ্বারাই সাধারণত তা ব্যক্ত করেন। তাহলে বাহ্যত দাসীর সঙ্গেই বা মিলল কোথায়! টেনেটুনে মিলাতে চাইলে সেই তো তাবিলই হয়ে গেল, যেই তাবিল থেকে বাঁচার জন্য এত কসরত আপনারা করলেন! তদুপরি লক্ষাধিক সাহাবিরাও এত তাওহিদের মুজাকারা (পারস্পরিক আলোচনা) করলেন। তারাও তো ঢালাওভাবে 'আল্লাহ কোথায়' এর চর্চা করলেন না। তাহলে আপনারা কেন এ বিষয়টাকে আকিদার মূল বিষয় বানিয়ে ফেললেন এবং এর আলোচনা এত ব্যাপক করে দিলেন যে, এখন জনসাধারণ নিজেদের অজ্ঞাতসারে ১৯ আর ২০ এর পার্থক্য না বুঝে সরাসরি সাদৃশ্যবাদ ও দেহবাদেই আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। 

   মোদ্দাকথা, আল্লাহর মর্যাদা বোঝানোর জন্য কখনো 'في السماء' (তার মর্যাদা সবার ঊর্ধ্বে) উল্লেখিত হয়েছে। একইভাবে আল্লাহ তাআলার একটি কর্মবাচক সিফাত 'ইসতিওয়া'র মহিমা বোঝানোর জন্য আরশের কথা বিবৃত হয়েছে। কিন্তু এগুলো কোনোটাই আল্লাহ তাআলার অবস্থানস্থল নয়। আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রকার স্থানের বন্ধন হতে মুক্ত। আকাশ-আরশ কোনো কিছুই আল্লাহর অবস্থানস্থল নয়। বরং আল্লাহ তাআলা গোটা সৃষ্টিজগতের ওপর সমুন্নত। তিনি আরশেরও ঊর্ধ্বে। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। তাঁর কোনো নজির বা সাদৃশ্য নেই।

    আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আকিদা হলো- আল্লাহ তা'য়ালা স্থান, কাল, দিক সহ সকল অঙ্গ-প্রতঙ্গ এবং দেহ/শরীর থেকে মুক্ত ও পবিত্র এক মহান সত্বা। আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের প্রসিদ্ধ ভাষ্যকার ইমাম ত্বহাবী (রাহঃ) বলেন, 
وتعالي عن الحدود والغايات، الأركان والأعضاء الأدوات، لا تحويه الجهات الست كسائر المبتدعات،.. والعرش والكرسي حق. وهو مستغن عن العرش وما دونه. محيط بكل شيء وفوقه، وقد أعجز عن الإحطة خلقه.
"আল্লাহ তা'য়ালা সীমা-পরিধি, অঙ্গ-প্রতঙ্গ ও উপাদান-উপকরণের বহু উর্ধে। যাবতীয় উদ্ভাবিত সৃষ্ট বস্তুর ন্যায় তাঁকে (পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, উপর, নিচ) ষষ্ঠ দিক পরিবেষ্টন করতে পারে না। আল্লাহর আরশ ও কুরসী সত্য। প্রতিটি বস্তু তাঁর পরিবেষ্টনে রয়েছে এবং তিনি সবকিছুর উর্ধে। সৃষ্টিজগত তাঁকে আয়ত্ব করতে পারে না।" (আবূ জাফর ত্বহাবী, মাতানুল আকীদাহ আত-ত্বহাবিয়্যাহ, পৃঃ ১০) - আল্লাহুআ'লম। 
-------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা ও মাওলানা।        

Post a Comment

0 Comments