Recent Tube

মুসলিম উম্মাহর পতনের প্রধান কারণ হলো সুন্নাহ কে সংকীর্ণ করা। মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।

 
                   মুসলিম উম্মাহর পতনের প্রধান কারণ                        হলো সুন্নাহ কে সংকীর্ণ করা।

 পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ 
.
هُوَ ٱلَّذِىٓ أَرْسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلْهُدَىٰ وَدِينِ ٱلْحَقِّ لِيُظْهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ 

 তিনি (আল্লাহ তা'য়ালা)  তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হিদায়াত এবং সত্য দীনসহ, সকল দীন (তথা ধর্ম, দর্শন, মতবাদ) এর উপর ওকে (দীন ইসলামকে) বিজয়ী করার জন্য।
(সূরা তওবাঃ৩৩; সূরা ফাতাহঃ২৮; সূরা সফঃ০৯)

 অর্থাৎ আল্লাহ তা'য়ালা তার রাসূল (সা) কে সকল ভ্রান্ত ধর্ম ও মতবাদের উপরে ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁর সে দায়িত্ব পালন করেছেন। সাহাবাগণ (রা) ইসলামকে বিজয়ী করে রেখে ছিলেন কিন্তু আমরা তা ধরে রাখতে পারিনি। কারণ আমরা সুন্নাহ কে কাটছাট করেছি, সংকীর্ণ করে ফেলেছি।

  সুন্নাহ বলতে এখন কেউ শুধু আমীন বলা, রফউল ইয়াদাঈন করা না করাকে বুঝে। আবার কেউ শুধু দাড়ি টুপিকে বুঝে। কেউ কেউ মিলাদ কিয়াম কে বুঝে। এইভাবে আমরা সুন্নাহ কে সংকীর্ণ করে ফেলেছি। শুধু তাই নয় নিজের পছন্দ অপছন্দ কে সুন্নাহর মানদন্ড বানিয়ে নিয়েছি।

   কিন্তু সুন্নাহ যে সংকীর্ণ নয় বরং এর পরিধি ব্যাপক তা আমরা ভুলে গেছি বললেই চলে। যার কারণে আজ পৃথিবীতে খ্রিষ্টান জাতি তাদের ভ্রান্ত ধর্মকে দুনিয়ার বুকে শ্রেষ্ঠ বলে চালিয়ে দিচ্ছে।

     অথচ রাসূলুল্লাহ (সা) এমন অনেক সুন্নাহ বা আদর্শ রেখে গেছেন যার উপরে আমল জরুরী, আমল করলে এই জাতি আবার ইসলাম বিজয়ী করতে পারবে, মুসলিম ভ্রাতৃত্ব শক্তিশালী হিসাবে গড়ে ওঠবে, ইসলামের প্রতি অন্যান্য জাতি আকৃষ্ট হবে, ইসলামের প্রচার প্রসার বেড়ে যাবে, এক পর্যায়ে দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করবে, ইনশাআল্লাহ! 

    উদাহরণস্বরূপ এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ তুলে ধরা হলো যার উপরে সকলের জন্যই জরুরী।

১। প্রথমে সালাম প্রদান করা (মুসনাদে আহমদ; মুসলিম, হাঃ৬৫৩২; আবূ দাউদ, হাঃ৫১৯৮; বায়হাক্বী৬/৪৩৩)

২। সকলের সাথে হাস্যোজ্জল মুখে সাক্ষাত করা (বুখারী২/৯৬৪; মুসলিম:২৩৩৫; আবূ দাউদ:৪০৮৪; তিরমিজী:১৮৩৩)

৩। সবার সাথে কোমল ও নম্র আচারণ করা (বুখারী:৬০২৪; তিরমিজী:২০০৭, ২২৬৩; আবূ দাউদ:৪৭৯০,৪৯৪১)

৪। কাউকে কষ্ট না দেওয়া (বুখারী:১১, ৩০৪৬, ৫৬৪৯, ৬০৪৪; ইবনে হিব্বানঃ১৩/৩৪)

৫। নিজের জন্য যা পছন্দ করা অন্যের জন্য তাই পছন্দ করা (বুখারী:১৩; তিরমিজী: ২৩০৫)

৬। হাদিয়া আদান প্রদান করা (বুখারী:২৫৮৫; তিরমিজী:২১৩০)

৭। খাবার (খানা) খাওয়ানো। (বুখারী:১২, ৩০৪৬, ৫১৭৪, ৫৩৭৩; মুসলিম:৬১৮২, ৬৫৫৬; তিরমিজী:১৮০০; আবূ দাউদ: ১৬৮২, ৩১০৫; আহমদ:৩/৩২৫; বায়হাক্বী:৩/২১৮; মাজমায়ে যাওয়ায়েদ:৮/৩০৬)

৮। এতিম-অনাথের রক্ষণাবেক্ষণ করা। (আহমদ, বুখারী:৫/২০৩২, ২২৩৭; মাজমায়ে যাওয়ায়েদ:৮/২৯৩)

৯। বিধবা ও দরিদ্রদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। (বুখারী:৬০০৬, ইবনে মাযা:২৪৪৩)
.
১০। রোগী দেখতে যাওয়া এবং সেবা করা। (বুখারী:৩০৪৬, ৫১৭৪, ৫৩৭৩, মুসলিম:২৫৬৯, ৬১৮২, ৬৫৫৪; আবূ দাউদ:৩১০৫; আহমদ:১৯০২৩)

১১। ঋণগ্রস্ত ও বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করা। (বুখারী:২৪৪২, ৩০৪৬, ৫৩৭৩; মুসলিম:২৫৮০, তিরমিজী:১৪২৬; আবূ দাউদ:৩১০৫ আহমদ:২/২৭৪, ৪/৪৪২)

১২। দরিদ্র বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। (তিরমিজী:৩/৫২২; আবূ দাউদ:২/১২০; ইবনে মাযা:২/৭৪০)

১৩। অন্যের ভুল ত্রুটি ক্ষমা করা। (বুখারী:৬১২৬; আবূ দাউদ:৪৩৭৫)

১৪। অন্যের দোষ ত্রুটি গোপন করা। (বুখারী:২৪৪২; মুসলিম:২৫৮০; তিরমিজী:১৪২৬; নাসাঈ:৪৮৯৩; আহমদ:২/২৭৪; আবূ দাউদ:৪৮৮০, ৪৮৮৮, ৪৯০০; ইবনে হিব্বান:১৩/৮৫)

১৫। অন্যের প্রয়োজন মেটানো। (বুখারী:২৪৪২; মুসলিম:২৫৮০; তিরমিজী:১৪২৬; নাসাঈ:৪৮৯৩; আবূ দাউদ:৪৮০৩)

১৬। বিবাদ মিটিয়ে ন্যায়-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা। (বুখারী:২/৯৬৪; মুসলিম:২৩৩৫; তিরমিজী:২৫০৯; আবূ দাউদ:৪৯২০)

১৭। মানব সেবা সংক্রান্ত সকল কাজ করা। (বুখারী:৬০২১; মুসলিম:৪/২০৭৪; আহমদ:২/২৭৪)

এখানে কয়েকটি হাদীস পেশ করা হলোঃ
ِ وَعَنْ أَبي مُوسَى رضي الله عنه، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم صلى الله عليه وسلم: « عُودُوا المَريضَ، وَأطْعِمُوا الجَائِعَ، وَفُكُّوا العَانِي ». رواه البخاري

আবূ মূসা ‘আশআরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘তোমরা রুগী দেখতে যাও, ক্ষুধার্তকে অন্ন দাও এবং বন্দীকে মুক্ত কর।’’
( বুখারী ৩০৪৬, ৫১৭৪, ৫৩৭৩, ৫৬৪৯, ৭১৭৩, আবূ দাউদ ৩১০৫, আহমাদ ১৯০২৩, ১৯১৪৪, দারেমী ২৪৬৫)


  عَنْ صَفْوَانَ بْنِ سُلَيْمٍ، يَرْفَعُهُ إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ "‏ السَّاعِي عَلَى الأَرْمَلَةِ وَالْمِسْكِينِ كَالْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، أَوْ كَالَّذِي يَصُومُ النَّهَارَ وَيَقُومُ اللَّيْلَ ‏"‏‏.‏

 সফওয়ান ইবনু সুলায়ম হতে বর্ণিত। তিনি নাবী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মারফূ‘রূপে বর্ণনা করেছেন। নাবী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক বিধবা ও মিস্কীনদের ভরণ-পোষণের ব্যাপারে চেষ্টা করে, সে আল্লাহর পথে জিহাদকারীর মত। অথবা সে ঐ ব্যক্তির মত, যে দিনে সিয়াম পালন করে ও রাতে ‘ইবাদাতে) দন্ডায়মান থাকে।
(বুখারী:৬০০৬)


ْ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ مَهْلاً يَا عَائِشَةُ، إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الرِّفْقَ فِي الأَمْرِ كُلِّهِ ‏"‏‏.

রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেনঃ "হে ‘আয়িশাহ! আল্লাহ যাবতীয় কার্যে নম্রতা পছন্দ করেন।"
(বুখারী:৬০২৪) 

 عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ ـ رضى الله عنهما ـ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ "‏ كُلُّ مَعْرُوفٍ صَدَقَةٌ ‏"‏‏.

জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ হতে বর্ণিত। তিনি নাবী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন। নাবী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সকল সৎ ‘আমাল সদাকাহ হিসেবে গণ্য।
(বুখারী:৬০২১)


ْ وَعَنِ ابنِ عُمَرَ رَضِيَ الله عَنهُمَا : أنَّ رَسُولَ الله صلى الله عليه وسلم، قَالَ: «المُسْلِمُ أَخُو المُسْلِم، لا يَظْلِمهُ، وَلاَ يُسْلِمُهُ. مَنْ كَانَ في حَاجَة أخيه، كَانَ اللهُ في حَاجَته، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِم كُرْبَةً، فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ بها كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَومِ القِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِماً سَتَرَهُ اللهُ يَومَ القِيامَةِ». مُتَّفَقٌ عَلَيه

  ইবনু উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘মুসলিম মুসলিমের ভাই, সে তার উপর অত্যাচার করবে না এবং তাকে অত্যাচারীর হাতে ছেড়ে দেবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূর্ণ করবে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূর্ণ করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের কোনো এক বিপদ দূর করে দেবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বহু বিপদের একটি বিপদ দূর করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন করবে, আল্লাহ কিয়ামতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন করবেন।’’
(বুখারী ২৪৪২, মুসলিম ২৫৮০, তিরমিযী ১৪২৬, নাসায়ী ৪৮৯৩, আহমাদ ৫৩৩৪, ৫৬১৪)

 
ٍ عَنْ أَبِي مُوسٰى الأَشْعَرِيِّ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَطْعِمُوا الْجَائِعَ وَعُودُوا الْمَرِيضَ وَفُكُّوا الْعَانِيَ.

আবূ মূসা আশ‘আরী  হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা ক্ষুধার্তকে অন্ন দাও, রোগীর সেবা কর এবং কষ্টে পতিতকে উদ্ধার কর।
(বুখারী, হাঃ৩০৪৬, ৫৬৪৯)

উপরোক্ত হাদীসে নাবী (সা) ক্ষুধার্তকে অন্নদান, রোগীকে সেবা করা, এতিম-অনাথের রক্ষণাবেক্ষণ করা, বিধবা ও দরিদ্রদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা, নিপীড়িত ব্যক্তির মুক্তি দানের জন্য মানবগোষ্ঠিকে তাকীদ দিয়েছেন। বস্ত্ততপক্ষে রসূল (সা) এর সারা জীবনে উক্ত কালজয়ী বাণীর বাস্তবতা অসংখ্য বার নিজেই প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। নবুয়াতের কষ্টি পাথরের পরশে যারা সোনার মানুষে পরিণত হয়েছিলেন তাদের কাজে-কর্মে চলনে-বলনে মানব সেবা, আর্তের সেবাই ছিল রসূলﷺ-এর উক্ত মহান বাণীর বাস্তব প্রতিফলন। অনাহারী, অর্ধাহারী, বুভুক্ষু নর-নারী, অসহায় নিরাশ্রয় মানুষের পরম বন্ধু ছিলেন আমাদের মহানাবীﷺ। অতঃপর সহাবা রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম) হতে শুরু করে খলীফা চতুষ্টয়ের শেষ আমলসহ তাবি-তাবিয়ীনদের শেষ আমল পর্যন্ত মানব সেবায় রসূলﷺ-এর উক্ত অমিয় বাণীকে মুসলিমগণ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যারা পৃথিবীতে এক সোনালী ইতিহাস রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যার ফলে মাত্র ২৫ বছরের মুসলিম শাসনের পর অর্ধ পৃথিবী মুসলিম শাসনাধীন হয়েছিল। আজকের বিশ্বেও পুনর্বার সেই উদ্দীপনা নিয়ে যদি মুসলিম জাতি সমাজে, রাষ্ট্রে আবির্ভূত হতে পারে তাহলে সমগ্র পৃথিবী মুসলিমদের বিজয় দুন্দুভি বেজে উঠবে। মুসলিম জাতির শাসন প্রতিবন্ধকহীনভাবে ততদিন চলমান ছিল যতদিন পর্যন্ত তাদের ত্যাগ তিতিক্ষা, কুরবানী, মানব সেবা, সততা, ন্যায়নীতি ক্রম ধাবমান গতিতে এগিয়ে চলেছিল। মুসলিম জাতি যখন সেবা, সততা, ন্যায়নীতিকে ইস্তফা দিয়ে ও নাকে তেল দিয়ে ভোগ বিলাসের নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো তখন হতেই তাদের বিশ্বময় কর্তৃত্বের দিন শেষ হয়ে যায়। নাবীﷺ আলোচ্য হাদীসকে স্বীয় উম্মাতের নৈতিক দায়িত্ব বলে ঘোষণা করার মূলে ও উম্মাতের শ্রেষ্ঠত্বের গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখার অভিপ্রায় নিহিত আছে। ‏
‏-------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা ও মাওলানা।         

Post a Comment

0 Comments