মুজাসসিমাদের কবলে মজলুম
ইমাম ইবনু হিব্বান:
ইমাম আবু হাতিম মুহাম্মাদ ইবনু হিব্বান আল-বুসতী (রাহঃ) চতুর্থ হিজরী শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ছিলেন। হাদীসের তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্থানসমূহে তিনি সফর করে বহু সংখ্যক মুহাদ্দিসের নিকট হাদীস শ্রবণ করেন এবং সংকলন করেন। তিনি সহীহ হাদীস সংকলনের উদ্দেশ্যে যে কিতাবটি রচনা করে তা 'সহীহ ইবনু হিব্বান' নামে সুপরিচিত। ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রাহঃ) এর পরে যারা প্রকৃত সহীহ হাদীসের সমন্বয়ে গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রথমে যদি ইবনে খুযাইমা (রাহঃ) নাম উল্লেখ করতে হয়, তবে তাঁর পরই উল্লেখ করতে হবে ইবনু হিব্বান (রাহঃ)-এর নাম (হাদীস ওয়াল মুহাদ্দিসুন, পৃঃ ৩২৬)। হাদীস সংকলন ছাড়াও নির্ভরযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য রাবীদের বিষয়সহ তিনি একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আকিদা লালন করতেন এবং আল্লাহর জন্য সীমা-পরিসী, স্থান, কাল ও দৈহিক অঙ্গ-প্রতঙ্গ সাব্যস্তকারী মুজাসসিমা তথা দেহবাদীদের কুফুরী আকিদার বিরোধীতা করতেন।
ইমাম ইবনু হিব্বান রহ. (মৃত্যু: ৩৫৪ হিজরী) বলেন,
ﺍﻟﺤﻤﺪ ﻟﻠﻪ ﺍﻟﺬﻱ ﻟﻴﺲ ﻟﻪ ﺣﺪ ﻣﺤﺪﻭﺩ ﻓﻴﺤﺘﻮﻯ، ﻭﻻ ﻟﻪ ﺃﺟﻞ ﻣﻌﺪﻭﺩ ﻓﻴﻔﻨﻰ، ﻭﻻ ﻳﺤﻴﻂ ﺑﻪ ﺟﻮﺍﻣﻊ ﺍﻟﻤﻜﺎﻥ، ﻭﻻ ﻳﺠﺘﻤﻊ ﻋﻠﻴﻪ ﺗﻮﺍﺗﺮ ﺍﻟﺰﻣﺎﻥ، ﻭﻻ ﻳﺪﺭﻙ ﻧﻌﺘﻪ ﺑﺎﻟﺸﻮﺍﻫﺪ ﻭﺍﻟﺤﻮﺍﺱ، ﻭﻻ ﻳﻘﺎﺱ ﺻﻔﺎﺕ ﺫﺍﺗﻪ ﺑﺎﻟﻨﺎﺱ .
"সকল প্রশংসা আল্লাহর, যার কোনো সীমিত সীমা-পরিধি নেই যে, তিনি বেষ্টিত হয়ে পড়বেন। তাঁর কোনো শেষ সময় নেই যে, তিনি ধ্বংস হয়ে যাবেন। সর্বব্যাপী স্থানসমূহ তাঁকে পরিব্যাপ্ত করতে পারে না। কালের ধারাবাহিকতা তাঁর ওপর একত্র হয় না। দৃশ্য ও ইন্দ্রিয় বিষয় দ্বারা তাঁর গুণ উপলব্ধি করা যায় না। তাঁর সত্তার গুণাবলিকে মানুষের দ্বারা অনুমান করা যায় না।" (আস-সিকাত: ১/১)
সর্বযুগেই সহীহ আকিদাকে গলদ হিসাবে উপস্থাপন করার অপপ্রয়াস চলেছে এবং গলদ আকিদাধারীরা নিজেদেরকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করে হকপন্থীদের ওপর নির্মমভাবে চড়াও হয়েছে। ইমাম ইবনু হিব্বান (রহ.)-এর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি নব্য আসারি, মাদখালী, দেহবাদীদের মতো আল্লাহ তাআলার জন্য স্থান, কাল, সীমা-পরিধি ও দৈহিক অঙ্গ-প্রতঙ্গ স্বীকার করতেন না বলে তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে দিয়েছিল এদের পূর্বসূরি তৎকালীন হকের ঠিকাদাররা। আবু ইসমাইল হারাওয়ী হাম্বলী (রাহঃ) বলেন,
ﻭﺳﺄﻟﺖ ﻳﺤﻴﻰ ﺑﻦ ﻋﻤﺎﺭ ﻋﻦ ﺃﺑﻲ ﺣﺎﺗﻢ ﺑﻦ ﺣﺒﺎﻥ ﺍﻟﺒﺴﺘﻲ، ﻗﻠﺖ: ﺭﺃﻳﺘﻪ؟ ﻗﺎﻝ : ﻛﻴﻒ ﻟﻢ ﺃﺭﻩ، ﻭﻧﺤﻦ ﺃﺧﺮﺟﻨﺎﻩ ﻣﻦ ﺳﺠﺴﺘﺎﻥ، ﻛﺎﻥ ﻟﻪ ﻋﻠﻢ ﻛﺒﻴﺮ، ﻭﻟﻢ ﻳﻜﻦ ﻟﻪ ﻛﺜﻴﺮ ﺩﻳﻦ، ﻗﺪﻡ ﻋﻠﻴﻨﺎ ﻓﺄﻧﻜﺮ ﺍﻟﺤﺪ ﻟﻠﻪ ﻓﺄﺧﺮﺟﻨﺎﻩ ﻣﻦ ﺳﺠﺴﺘﺎﻥ .
"আমি ইয়াহইয়া ইবনু আম্মার (আসারি)- কে আবু হাতিম ইবনু হিব্বান বুসতী রাহঃ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে বললাম, আপনি তাকে দেখেছেন? তিনি বললেন, দেখব না কেন, অথচ আমরা তাকে সিজিস্তান থেকে বের করে দিয়েছিলাম। তার অনেক ইলম ছিল, কিন্তু তার বেশি দীন ছিল না। সে আমাদের মধ্যে এসে আল্লাহর সীমা-পরিধি অস্বীকার করেছে। তাই আমরা তাকে সিজিস্তান থেকে বের করে দিয়েছিলাম।" (জাম্মুল কালাম, পৃ. ২৭৮)
ইমাম তাজুদ্দীন সুবকী (রাহ.) বড় দুঃখ করে বলেছেন,
ﻭﻣﻦ ﺫﻟﻚ ﻗﻮﻝ ﺑﻌﺾ ﺍﻟﻤﺠﺴﻤﺔ ﻓﻲ ﺃﺑﻲ ﺣﺎﺗﻢ ﺑﻦ ﺣﺒﺎﻥ : ( ﻟﻢ ﻳﻜﻦ ﻟﻪ ﻛﺒﻴﺮ ﺩﻳﻦ، ﻧﺤﻦ ﺃﺧﺮﺟﻨﺎﻩ ﻣﻦ ﺳﺠﺴﺘﺎﻥ؛ ﻷﻧﻪ ﺃﻧﻜﺮ ﺍﻟﺤﺪ ﻟﻠﻪ ). ﻓﻴﺎ ﻟﻴﺖ ﺷﻌﺮﻱ ﻣﻦ ﺃﺣﻖ ﺑﺎﻹﺧﺮﺍﺝ؟ ﻣﻦ ﻳﺠﻌﻞ ﺭﺑﻪ ﻣﺤﺪﻭﺩﺍ ﺃﻭ ﻣﻦ ﻳﻨﺰﻫﻪ ﻋﻦ ﺍﻟﺠﺴﻤﻴﺔ .
"এমনই একটি বিষয় হলো, আবু হাতিম ইবনু হিব্বান (রাহ.)-এর ব্যাপারে জনৈক মুজাসসিমাহ দেহবাদীর মন্তব্য—‘তার বেশি দীন ছিল না। সে আমাদের মধ্যে এসে আল্লাহর সীমা-পরিধি অস্বীকার করেছে। তাই আমরা তাকে সিজিস্তান থেকে বের করে দিয়েছিলাম।’ হায়, আমি যদি জানতাম, কে বহিষ্কৃত হওয়ার অধিক হকদার ছিল? যে তার রবকে সীমাবদ্ধ বানিয়ে ফেলে সে নাকি ওই ব্যক্তি, যে তার রবকে দেহের বৈশিষ্ট্য থেকে পবিত্র ঘোষণা করে?" (কায়িদাতুন ফিল জারহি ওয়াত তাদিল, পৃঃ ৩১)
একই ধরনের কথা তিনি তাঁর তবাকাত গ্রন্থে উল্লেখ করে বলেন :
ﺃﻧﻈﺮ ﻣﺎ ﺃﺟﻬﻞ ﻫﺬﺍ ﺍﻟﺠﺎﺭﺡ، ﻭﻟﻴﺖ ﺷﻌﺮﻱ ﻣﻦ ﺍﻟﻤﺠﺮﻭﺡ؟ ﻣﺜﺒﺖ ﺍﻟﺤﺪ ﻟﻠﻪ ﺃﻭ ﻧﺎﻓﻴﻪ؟
"দেখো, এই সমালোচক কত বড় গণ্ডমূর্খ! হায়, আমি যদি জানতাম, কে সমালোচনাযোগ্য? আল্লাহর জন্য সীমা-পরিধি সাব্যস্তকারী নাকি তা নাকচকারী।" (তবাকাত : ৩/১৩২-১৩৩)
হাফিজ ইবনু হাজার আসকালানী (রহ.) বলেন,
ﻭﺍﻟﺤﻖ ﺃﻥ ﺍﻟﺤﻖ ﻣﻊ ﺍﺑﻦ ﺣﺒﺎﻥ ﻓﻴﻬﺎ .
"প্রকৃত সত্য হলো, এক্ষেত্রে হক ইবনু হিব্বান (রহ.)-এর সঙ্গেই ছিল। (লিসানুল মিজান : ৭/৪৯-৫০)
কেননা, আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আকিদা হলো- আল্লাহ তা'য়ালা স্থান, কাল, দিক সহ সকল অঙ্গ-প্রতঙ্গ এবং দেহ/শরীর থেকে মুক্ত ও পবিত্র এক মহান সত্বা। আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের প্রসিদ্ধ ভাষ্যকার ইমাম ত্বহাবী (রাহঃ) বলেন,
وتعالي عن الحدود والغايات، الأركان والأعضاء الأدوات، لا تحويه الجهات الست كسائر المبتدعات،.. والعرش والكرسي حق. وهو مستغن عن العرش وما دونه. محيط بكل شيء وفوقه، وقد أعجز عن الإحطة خلقه.
"আল্লাহ তা'য়ালা সীমা-পরিধি, অঙ্গ-প্রতঙ্গ ও উপাদান-উপকরণের বহু উর্ধে। যাবতীয় উদ্ভাবিত সৃষ্ট বস্তুর ন্যায় তাঁকে (পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, উপর, নিচ) ষষ্ঠ দিক পরিবেষ্টন করতে পারে না। আল্লাহর আরশ ও কুরসী সত্য। প্রতিটি বস্তু তাঁর পরিবেষ্টনে রয়েছে এবং তিনি সবকিছুর উর্ধে। সৃষ্টিজগত তাঁকে আয়ত্ব করতে পারে না।" (আবূ জাফর ত্বহাবী, মাতানুল আকীদাহ আত-ত্বহাবিয়্যাহ, পৃঃ ১০)
সুতরাং আল্লাহ তা'য়ালা স্থান, দিক, সময়, দেহ, শরীর, দৈহিক অঙ্গ-প্রতঙ্গ সহ মাখলুকের সকল সদৃশ থেকে পবিত্র। মাখলুকের সাথে তাঁর সামান্য সাদৃশ্য দেওয়াও কুফুরী। কেননা তিনি ইরশাদ করেন, لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ."তাঁর সদৃশ্য কিছুই নেই।" (সূরা শুরা ৪২/১১) فَلَا تَضْرِبُوا لِلَّهِ الْأَمْثَالَ "সুতরাং তোমরা আল্লাহর জন্য কোন সদৃশ স্থির করো না।" (সূরা নাহল: ১৬/৭৪)
দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আকিদার জন্য জুলুম সহ্য করার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে শুধু মুতাজিলা কর্তৃক ইমাম আহমদ (রাহঃ)-এর জুলুমের ঘটনাই উঠে আসে। কিন্তু যুগে যুগে নব্য আসারি নামধারী দেহবাদীরা আহলুস সুন্নাহর ইমামগণের সঙ্গে কী নির্মম আচরণ করেছে, তাদের সেই হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো পর্দার আড়ালেই থেকে যায়। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনু হিব্বান (রাহঃ) এর মত মজলুম ইমামদের জন্য অশ্রু ঝরানোরও কেউ নেই!
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা ও মাওলানা।
0 Comments