Recent Tube

ডিপ্রেশনে ভুগছেন? তার জন্য আমি, আমরা দায়ী। আপনি নন। জিয়াউল হক।

ডিপ্রেশনে ভুগছেন? তার জন্য আমি, আমরা দায়ী। আপনি নন।  
   

      প্রথম ওহি প্রাপ্তির পর দীর্ঘ ছয়টি মাস প্রিয় রাসুল সা: আল্লাহর কাছ থেকে কোন ওহি পাননি। তিনি মানসিক পীড়নে দীর্ঘ ছয়টি মাস পার করেছেন। দিনের পর দিন, রাতের পর কেটেছে মানসিক অস্থিরতার ভেতর দিয়ে। তিনি ভাবতে শুরু করেছিলেন সম্ভবত আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন তাকে পরিত্যাগ করেছেন। নবুয়ত পেয়েও তা থেকে কোন কারণে হয়তো তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। সম্ভবত তার নিজের কোন অপরাধ ও অপূর্ণতার কারণে আল্লাহ তাকে তার মিশন থেকে বাদ দিয়েছেন।

       প্রিয় রাসুল সা:, আব্দুল্লাহ - আমিনা দম্পতির এতিম সন্তান, মানুষ মুহাম্মদ সেই শিশু বয়স থেকেই একের পর এক হারানোর বেদনায় বেদনার্ত ছিলেন। একজন মানুষ হিসেবে বিষন্ন থাকার কিংবা ডিপ্রেশনে ভুগার সবরকম উপকরণ ও পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেই তিনি তাঁর জীবনে কী ডিপ্রেশনের মুখোমুখি হন নি?

      প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আল কুরআনের একটি মাত্র সুরাই যথেষ্ঠ। আল কুরআনের ৯৩ নম্বর সুরা; আদ দুহা। একজন সাইকিয়াট্রিস্ট কিংবা একজন সাইকোলোজিস্ট কিংবা একজন কাউন্সিলরের চোখ দিয়ে সুরা দুহাটি পড়ুন, বার বার পড়ুন, বুঝুন, চিন্তা করে দেখুন। 

      অন্তত কিছুক্ষণ ভেবে দেখুন। হয়তো আল্লাহপাক আপনার হৃদয় খুলে দেবেন। আপনি বুঝবেন ডিপ্রেশন সত্যিকার অর্থেই রয়েছে। 

    রয়েছে কোটিকোটি মানুষের জীবনে। ডিপ্রেশন যে আর্থসামাজিক পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হয়, যে পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল প্রিয় রাসুল সা: এর জীবনকালে, ঠিক সেই একইরকম পরিস্থিতি ও পরিবেশ বিদ্যমান রয়েছে এখনও।

      ডিপ্রেশন তৈরি হয় নানাবিধ কারণে। ডজন ডজন ব্যক্তিগত বা পারিবারিক, সামাজিক কিংবা আর্থসামাজিক কারণ দেখাতে পারেন আপনি। রয়েছে জেনেটিক কারণ, আমাদের শরিরে রাসায়নিক পরিবর্তন বা হরমানের পরিবর্তনেও ডিপ্রেশন হতে পারে। 

     তা ছাড়াও কয়েকটা কারণে মানুষ ডিপ্রেশনের মুখোমুখি; A sense of Rejection, A sense of Deprivation, A sense of Failure, A sense of Loss। এ তিনটির মধ্যে সবগুলোই এ সময়ে প্রিয় মুহাম্মদ সা: এর জীবনেও এসেছিল। তিনি বিষণ্ন হয়েছিলেন, ডিপ্রেশনের মুখোমুখি হয়েছিলেন।

     তবে মুক্তিও পেয়েছিলেন। মুক্তি পেয়েছিলেন যে পথ ও পদ্ধতিতে বাস্তবিকই ডিপ্রেশনের হাত থেকে কার্যকরভাবে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে, সেই পদ্ধতিতে। তিনি ধৈর্যের সাথে আল্লাহর কাছে ধর্ণা দিয়েছিলেন। আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করেছিলেন।

    প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: একাই কেবল ডিপ্রেশনে ভুগেননি। এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি অন্যান্য নবী পয়গম্বরগণও হয়েছেন। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন নিজেই সে বাস্তবতার স্বাক্ষ্য দিয়েছেন। আল কুরআনের ভাষায়;

    এমনকি যখন পয়গম্বরগণ নৈরাশ্যে পতিত হয়ে যেতেন, এমনকি, এরূপ ধারণা করতে শুরু করতেন যে, তাদের অনুমান বুঝি মিথ্যায় পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন তাদের কাছে আমার সাহায্য পৌছে। অতঃপর আমি যাদের চেয়েছি তারা উদ্ধার পেয়েছে। আমার শাস্তি অপরাধী সম্প্রদায় থেকে প্রতিহত হয় না। (সুরা ইউসুফ ১২:১১০)

     এটা ঠিক যে আল্লাহপাক মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে সৃষ্টি করেছেন (সুরা তীন : ৪)। তবে তিনি একইসাথে মানুষকে খুব দূর্বল করে সৃষ্টি করেছেন; ('মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই দুর্বল'- সুরা নিসা : ২৮)। তাই দু:খ কষ্ট, হতাশা, বঞ্চনা, ক্ষোভে সে প্রভাবিত হয়। তার জীবনে ডিপ্রেশন আসে। এটা তার দোষ নয়। তবে সেই ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠতে বা তা ঠেকিয়ে দিতে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান ও পথের ব্যবহার না করাটা তার ব্যর্থতা। হতে পারে এই ব্যর্থতা তার অজ্ঞাতর কারণে।

     ডিপ্রেশন ও মানসিক রোগ নিয়ে অজ্ঞতা আমাদের সমাজে জেঁকে বসেছে। বিজ্ঞান দেখিয়েছে ডিপ্রেশনে কিভাবে মানবদেহে ডোপমিন, সেরেটোনিন, অস্কিটোসিন’সহ নানা হরমোনের পরিবর্তন হয়। পরিবর্তন অকাট্য বাস্তবতা। 

    এটাকে অস্বীকার করাটা কুরআনকেই অস্বীকার করা। এইসব হরমোনের পরিবর্তন যে কারণে হয়ে থাকে, সেই সব কারণগুলো আল কুরআন আমাদেরকে ইশারা ইঙ্গিতে দিয়েছে, গবেষণা করতে বলেছে। এটা বুঝতে আমাদের উচিৎ ছিল আল্লাহর ভাষায় ‘উলিল আলবাব (চৌকষ ব্রেনের অধিকারী)’ হওয়া। 

    কিন্তু তা না হয়ে আমরা কেবল ‘আহলে আলবাব (ব্রেনের অধিকারী)’ হয়েই রইলাম! উলিল আলবাব হতে পারলে দেখতে পেতাম কিভাবে ব্রেনের বায়োমেগনেটিক ফিল্ড পরিবর্তনের কারণে আমাদের শরিরে হরমোনের পরিবর্তন ঘটে ডিপ্রেশনের জন্ম দিচ্ছে।

     ডিপ্রেশন রয়েছে। মানসিক রোগ এক বাস্তবতা, তাই আল্লাহপাক কুরআনের পাতায় পাতায় সাইকিয়াট্রিক কাউন্সিলিং করেছেন মুসলমানদের জন্য। এটাকে অস্বীকার করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।

    ডিপ্রেশন জীবনের এক অকাট্য বাস্তবতা। কোটি কোটি নারীপুরুষ এর শিকার হয়ে রয়েছেন। তারা মুক্তির পথ খুঁজছেন। তাদের মুক্তির পথ না দেখিয়ে উল্টো দোষারোপ করাটা, অপরাধী বানানোটা অমানবিক, অযৌক্তিক। আবেগ দিয়ে, রসালো সাহিত্য দিয়ে ড্রিপেশনে আক্রান্ত হবার দায়ভার তাদের উপরে চাপিয়ে দিয়ে নিজের দায় এড়ানোটা নিছক অসততা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই সমাজ, এই পরিবেশ গঠনে আমাদের সকলেরই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দায় রয়েছে। এটাকে স্বীকার করতে হবে। সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।
 
      ডিপ্রেশন ও অন্যান মানসিক রোগ আধুনিক জীবনের এক বিরাট সমস্যা। অস্বীকার করে এ সমস্যাকে মোকাবেলা করা যাবে না। এর অস্তিত্তটা সবার আগে স্বীকার করে নিতে হবে। এর পরে একে মোকাবেলা করার পথটা জানতে হবে। ভুল পদ্ধতিতে মোকাবেলা করে এ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না।

      মুখ খুলে, বুক ফুলিয়ে বলুন; হ্যাঁ ডিপ্রেশন আছে, মনোরোগ এক বাস্তবতা। কিন্তুু এর কোনটার জন্যই আপনি দায়ী নন। ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হওয়াটা আপনার অপরাধ নয়। আপনি ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়েছেন, এর জন্য দায়ী হলো এই সমাজ ও পরিবেশ। এরা সম্মিলিতভাবে আপনার উপরে জুলুম করেছে। এরা অপরাধী, আপনি নন। 

    আসুন, আপনাকে এ থেকে উঠে আসতে, মুক্তি পেতে আমরা সাহায্য করবো। হতাশ হবেন না, আল্লাহ আমাদেরকে কার্যকর পথ দিয়েছেন। সে পথেই ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সম্ভব যে, তার প্রমান হলো প্রিয় মুহাম্মদ সা: এর জীবন। প্রিয় ইয়াকুব আ:, আইউব আ: যাকারিয়া আ: প্রমূখ মনীষীদের জীবন। অতএব হতাশ হবেন না।
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ, গ্রন্থপ্রনেতা,  গীতিকার ও   বিশ্লেষক

Post a Comment

0 Comments