Recent Tube

পরবর্তি দৃশ্যপট: চোখ খোলা রাখুন- জিয়াউল হক।

         
পরবর্তি দৃশ্যপট: চোখ খোলা রাখুন-!
       

      একটানা দুই শত বছর ক্রুসেড এবং অবর্ণনীয় নৃশংসতা চালিয়েও ইসলাম ও মুসলমানদের পৃথিবী থেকে নির্মূল করতে না পেরে খৃষ্টানজগত হতাশ হলেও হঠাৎ আশার আলো দেখলো ত্রয়োদশ শতাব্দিতে তাতারদের দ্বারা মুসলিম জনপদগুলোকে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতা আর নৃশংসতায় তছনছ করার মধ্যে। নিজেরা যে লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, সেটাই তাতারদের দিয়ে সম্ভব! সাহায্য চেয়ে পোপের চিঠি’সহ এক প্রতিনিধিদল গিয়ে হাজির কারাকোরামে। 
      আশাবাদী হবার কারণও ছিল, চেঙ্গিজ খাঁনের নাতি সম্রাট গুইউক খাঁন ক্ষমতায়, তার রাণী ছিলেন পোপের ভক্ত, আর্মেনীয় খৃষ্টান নারী। এই রাণীর মাধ্যমেই পোপ সম্রাট গুইউক খাঁনের কাছে আর্জি করেন বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের বিরুদ্ধে আবার সামরিক অভিযান শুরুর। কিন্তু তাদের সে আশা ব্যর্থ হয়েছে, আর্নল্ড টয়েনবি  সুন্দরভাবে তা বর্ণনা করেছেন। ( Mankind and Mother Earth, A Narrative History of the World. Arnold Toynbee,পৃ: ৪৪৯)

     শুধু তাই নয়, ইসলাম যে তুর্কিদের মাধ্যমে নতুন এক উজ্জতায় উঠে এলো কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটির আরও এক ঐতিহাসিকও তার গবেষণায় সেটা দেখিয়েছেন। (দ্রষ্টব্য:  Civilazation of Faith, Solidarity, A Journey Through Islamic History, Dr Mostofa as Siba’ee, Translated by Niasiruddin Al Khattab, International Islamic Publishing House,  ৪৫-৪৬)

     বাস্তবতা হলো, ইসলামের বিরুদ্ধে পোপের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলো। ইসলাম নির্মূলে আসা তাতার তুর্কিরাই ইসলামের রক্ষক হিসেবে উঠে এলো! পোপের নির্দেশে যে বাইজান্টাইন খৃষ্টান প্রতিনিধিদল গুইউক খাঁনের কাছে মুসলিম নিধনের আব্দার করেছিল, সেই বাইজান্টাইনই  ওসমানীয় খেলাফতের হাতে বিলিন হলো; ১৪৫৩ খৃষ্টাব্দে। 

    এটা ছিল ইউরোপীয়দের জন্য আতংকজনক, অপমানজনক ও ভীতিকর অবস্থা। ইসলামি খেলাফতের কারণেই ক্রুসেডে তারা ব্যর্থ হয়েছে। আর এখন খোদ খৃষ্টবাদী ইউরোপের দোরগোড়ায়, বুকের উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল আরও এক খেলাফত! মাত্র দুই থেকে তিনটি শতাব্দির মধ্যেই ওসমানীয়রা শক্তি-সামর্থ, বিত্ত-বৈভব, শিক্ষা আর সংস্কৃতিতে অপ্রতিদ্বন্দি হয়ে বৈশ্বিক খৃষ্টশক্তির মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠে ।
 
   ইসলামের সাথে খৃষ্টবাদের সংঘাত আরও আগের, কিন্তু তুর্কিরা এ সংঘাতকে একেবারে ইউরোপের বুকে নিয়ে গেছে। ফলে পুরো ইউরোপব্যাপী গণমানস এমনভাবে তুর্কিবিরোধি হয়েছে যে, তারা তুর্কি আর ইসলাম সমার্থক করে ফেলে। সেই থেকে ইউরোপীয় মানসপট আরবদের পরিবর্তে তুর্কিদের দখলে। তাদের দৃষ্টিতে ইসলামের সাথে বোঝাপড়া মানেই তুর্কিদের সাথে বোঝাপড়া !

     এই মানসিকতাই পরবর্তি বিশ্বরাজনীতির নিয়ামক হয়েছে। আজও সেটাই বিদ্যমান। আরবরা যতোটা ইউরোপীয় মনস্তত্ব বুঝেছে, ঘনিষ্ঠ ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংশ্লিষ্ঠতার কারণে তুর্কিরা তার চেয়ে অনেক গভীরভাবে ইউরোপীয়দের বুঝে। আর তাই খৃষ্টসমাজ ১৪৯২ খৃষ্টাব্দ নাগাদ যখন স্পেনে মুসলমান ও ইসলামের বিরুদ্ধে অর্জিত বিজয় পালনে ব্যস্ত, তার মাত্র তিনটি দশকের মধ্যেই তুর্কিরা ইউরোপের ভিয়েনা, বেলগ্রেড, আর্মেনিয়া, গ্রিস, হাঙ্গেরি, রুমানিয়ায় ও বুলগেরিয়ায় আসন গেড়ে আজান হাঁকছে পাঁচবেলা! কোথাও কোথাও নিজেদের শাসনব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠা করেছে। ফলে ইউরোপীয় সমাজেও ইসলাম ও তুর্কি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে ব্যাপকভাবে।
 
     সাংস্কৃতির এই আদান প্রদানের ভিত্তিটাই ছিল পাস্পরিক অবিশ্বাস আর বৈরিতা। ইউরোপ তুর্কিদের, তথা, মুসলমানদের বরাবরই দেখেছে আগ্রাসি শক্তি এবং ইসলামকে বৈরি দর্শন হিসেবে। 

    ১৫২৬ সালে হাঙ্গেরি বিজয় এবং ১৫২৯ খৃষ্টাব্দে তুর্কি বাহিনী কর্তৃক ভিয়েনা অবরোধে মনে হচ্ছিল পুরো ইউরোপই তুর্কিরা দখল করে ফেলবে, কারণ, তুর্কিদের ঠেকাবার মতো কোন শক্তি তখন ইউরোপীয় খৃষ্টসমাজে ছিল না। তবে সেটা হয়নি। তুর্কিরা থামতে বাধ্য হয়েছে। কোন ইউরোপীয় শক্তি নয়, তাদের থামিয়েছে স্বজাতি মুসলমানরা; শিয়া ইরান আর মিশরের মামলুক খেলাফত। 
মামলুকরা সিরিয়া-ফিলিস্তিনে তুর্কিদের যুদ্ধে ব্যস্ত রাখে। ওসমানীয় খলিফা প্রথম সেলিম মামলুকদের পরাজিত করে সিরিয়া-ফিলিস্তিন এবং মিশরও নিজেদের আয়ত্তে নেন। সেই থেকে মিশরীয়রাও ইউরোপীয়দের মতো তুর্কিদের আগ্রাসি শক্তি ভাবে।

      পুর্বসীমান্তে ইরানিদের বেলায় ঘটেছে উল্টো। কাদ্বেসিয়ায় মুসলমানদের কাছে রাজ্য হারানোর পরে পারসিকরা সর্বপ্রথমবারের মত আজারবাইজান থেকে আগত উগ্র শিয়ামতাদর্শী শাহ ইসমাইল সাফাভি’র নেতৃত্বে ১৫০১ - ১৫২৪ খৃষ্টাব্দের মধ্যে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে শিয়ামতবাদকে পারস্যের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। ( দ্রষ্টব্য: What Went Wrong; the Clash between Islam and Modernity in the Middle East, Bernard Lewis,  পৃ: ৮)

     ইসলামের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত আরবদের পরিবর্তে পারস্যে সুন্নি ইসলামের পরিবর্তে  রাষ্ট্রধর্ম হওয়া শিয়া মতবাদই ইউরোপকে বাঁচিয়েছে তুর্কিদের থেকে। এরাই ইসলামের অগ্রযাত্রাকে ঠেকিয়েছে ভেতর থেকে, ইউরোপ নয়।

   ওসমানিয় খেলাফতে অস্ট্রিয় রাষ্ট্রদূত Ogier Ghiselin de Busbecq  নিজ দেশের সরকারকে একটা গোপন চিঠিতে হাঙ্গেরির আর্থসামাজিক ও প্রতিরক্ষার দূর্বলতা নিয়ে ক্ষোভ ও তুর্কিদের সমরশক্তি নিয়ে আতংক প্রকাশের পাশাপাশি তুরস্ক যে কেবলমাত্র পারস্যের কারণেই ইউরোপকে গিলতে পারছে না, সেটা বলেছেন। (দ্রষ্টব্য: ঐ,)

   অবশ্য রাষ্ট্রদূতের সেই আশংকা সত্য হয়নি। কারণ, ইরানিরা সকল শক্তি নিয়ে ওসমানিয় খেলাফতের পিছে লেগে থেকে তাকে দূর্বল করেছে। ইউরোপ এটাকেই পুরোমাত্রায় কাজে লাগিয়েছে। যুদ্ধের ময়দানে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে লক্ষ্য তারা অর্জন করতে পারেনি, সেটাই তারা ভিন্নপন্থায় নানা কুটকৌশলে অর্জনের চেষ্টা করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধপরবর্তিতে খেলাফত ভেংগে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করা পর্যন্ত।

   সব ঠিকই ছিল। কিন্তু সাঈদ নুরসি, আরবাকান আর তাদের মানসপুত্র এরদোয়ান এসে হিসাব উল্টে দিল। এই উল্টে দেয়া হিসেবটাকেই ইউরোপ আবার উল্টে দিতে চায়। সে কারণেই সংঘাত আসন্ন। তবে সমস্যা হলো তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র। তাই নিজেদের মধ্যে সংঘাত না বাধিয়ে তুরস্কের সাথে সংঘাত বাধানো হবে মিশর, সৌদি আমিরাত ত্রীপক্ষীয় জোটের সাথে। সেই সংঘাতের ক্ষেত্রটাই তৈরি হচ্ছে। দেখতে থাকুন আগামি দিনগুলো।
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক। 

Post a Comment

0 Comments