Recent Tube

দা চয়েস ইজ ইউরস- ৩২ ; জিয়াউল হক।

    
                 দা চয়েস ইজ ইউরস;
                                            পর্ব- ৩২;
   
  মক্কা পুরো আরব উপদ্বীপে একটা কসমোপলিটন নগরী। সেই ষষ্ঠ দশকে এতদ্বাঞ্চলে সবচেয়ে বড়ো কসমোপলিটন নগরী। আশে পাশের অন্যান্য কসমোপলিটন নগরী; এডেন, কনস্টান্টিনেপল, জেরুজালেম আর আলেকজান্দ্রিয়ার কোন না কোন সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছিল বলেই সেগুলো আন্তর্জাতিক নগরিতে উন্নিত হতে পেরেছিল।
 
কিন্তু মক্কার বেলাতে তেমন কিছুই ছিল না। তবুও সেটা কসমোপলিটন নগরী হিসেবে আন্তর্জাতিক গুরুত্ব পেয়েছিল। এর একমাত্র কারণ ছিল আরব উপদ্বীপের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ সিল্করুটের পূর্ব ও পশ্চিম মেরুর একেবারে মধ্যবর্তি ও সবচেয়ে কঠিন ও দূর্গম ভৌগলিক জায়গাটাতে তার অবস্থান। 

  তৎকালিন বিশ্ববাণিজ্যের প্রাণ; সিল্করুটের এই এলাকাটা কারো পক্ষেই নিরাপদে পাড়ি দেয়া সম্ভবপর ছিল না স্থানীয় আরবদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগীতা ছাড়া। একাজে তারাই ছিল সবচেয়ে উপযুক্ত, কারণ মরুভূমিতে পথ চেনা, পানির উৎস খুঁজে বের করা এবং মরুদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার মত সামরিক, শারিরীক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা, কৌশল, সাহস ও জ্ঞান তাদেরই ছিল।

   এইসব বহুমাত্রিক যোগ্যতাই মক্কা’সহ এতদ্বাঞ্চলের আরবদের সামনে বেঁচে থাকা, আয় উপার্জনের একটা উপায়, কোন কোন ক্ষেত্রে বা কারো কারো ক্ষেত্রে একমাত্র মাধ্যম ছিল। এই সুযোগে স্থানীয় আরবরাও ব্যবসায় ঝুঁকে পড়ে। ব্যবসা অথবা ব্যবসার অংশীদার হওয়া কিংবা ব্যবসা পরিচালনায় সহযোগীতা প্রদানের মাধ্যমে উপার্জন ছাড়া তাদের সামনে আয় উপার্জনের আর তেমন কোন মাধ্যম ছিল না। ব্যবসার প্রতি এই আসক্তিই মক্কার সংস্কৃতি ও জীবনব্যবস্থাকে একটা বিশেষধাঁচে সাঁজিয়েছে। কুরআনুল কারিমে সুরা কুরাইশেও আল্লাহ স্পষ্টভাবেই এই আসক্তির কথা বলেছেন;

‘   কোরাইশের আসক্তির কারণে, আসক্তির কারণে তাদের শীত ও গ্রীষ্মকালীন সফরের। অতএব তারা যেন ঈবাদাত করে এই ঘরের পালনকর্তার, যিনি তাদেরকে ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং যুদ্ধভীতি থেকে তাদেরকে নিরাপদ করেছেন।’

    শীত ও গ্রীষ্মকালীন এই যে সফর, এ সফর ছিল বাণিজ্যিক সফর। ব্যবসার জন্য শাম থেকে ইয়েমেন আবার ইয়েমেন থেকে শাম এবং পুর্বদিকে চিন থেকে মেসোপটোমিয়া, বসরা হয়ে  লোহিতসাগর তীরের জেদ্দার পর্যন্ত কাফেলার যাতায়াত ছিল। উভয় রুটের মধ্যস্থানে মক্কার অবস্থান। মক্কা ও পার্শ্ববর্তি মরুঅঞ্চলে বসবাসকারী গোত্রগুলোর মধ্যে কুরাইশ ছিল অন্যতম। অন্যান্য গোত্রের মতো কুরাইশ গোত্রও এইসব বাণিজ্যিক সফরে যেতো। তাদেরও অন্যতম পেশা ছিল বাণিজ্য। 

 . এটা ছাড়া তাদের আরও একটা বিশেষ অবস্থান ও মর্যাদা ছিল সর্বসাধারণের চোখে, কাবার তত্তাবধায়ক তারা। এই পরিচয় তাদেরকে সবার কাছে, সব সময় একটা আলাদা মর্যাদা ও নিরাপত্তা দিয়ে এসেছে।
কাবা, একটা ঘর, চারটা দেয়াল, একটা ছাদ। একটা মাত্র দরজা। ঘরটি বানিয়েছিলেন হজরত ইব্রাহিম আ:। বিবি হাজেরা ও তাঁর শিশু পুত্র ইসমাইলকে সেখানে ছেড়ে গিয়েছিলেন। মাঝে মাঝেই তিনি আসতেন স্ত্রী ও সন্তানকে দেখতে। 

     এরকমই এক সফরে যখন তিনি আসেন, ততোদিনে ইসমাইল আ: যুবক হয়ে গেছেন। জমজমের পাশে একটা গাছের নীচে বসে তীর ধনুক নিয়ে প্র্যাকটিস করছিলেন। বাবা ইব্রাহিম আ: এ আসতে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে আলিঙ্গন করলেন। কুশল বিনিময়ের পর বাবা ইব্রাহিম আ: ছেলে ইসমাইলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন অনতিদূর ছোট একটা মাটির ঢিবির দিকে। 

    সন্তানকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলে উঠলেন, ‘বাছা, আল্লাহ আমাকে একটা নির্দেশ দিয়েছেন।’ সন্তান ইসমাইল সোজাসুজি বাবার কথার জবাবে কোনরকম দ্বিধা না করেই বলে উঠলেন, ‘আল্লাহ যদি হুকুম করে থাকেন, তবে তা পালন করুন।’

     তুমি কি আমাকে সাহায্য করবো আল্লাহর হুকুমটা পালন করতে।’
‘অবশ্যই করবো’ ইসমাইল আ: এঁর জবাব শুনে পিতা ইব্রাহিম আ: মাটির ঐ ঢিবি দেখিয়ে জানালেন যে, আল্লাহ তাঁকে ঐখানে একটা ঘর বানাতে বলেছেন।

    এর পরে বাবা ছেলে দু’জনে মিলে শুরু করলেন কাবার নির্মাণ কাজ। ইসমাইল আ: আশে পাশে পাহাড় থেকে পাথর এনে দেন ইব্রাহিম আ: তা দিয়ে একের পর ধীর পরিকল্পনায় ভীত থেকে শুরু করে দেয়াল বানিয়ে ঘরের আকৃতি দেন। কি নিদারুণ পরিশ্রমই না তাঁরা দু’জনে করেছেন। 

     মানুষের মাথার সমান বা তার কাছাকাছি উঁচু হয়ে যাওয়া দেয়ালের উপরের অংশ গাঁথতে তাঁকে একটা পাথরের উপরে দাঁড়াতে হয়েছিল। তাঁর শরির আর পাথরের ভারে ঐ কঠিন পাথরের উপরেও ইব্রাহিম আ: এর পায়ের ছাপ বসে গেছে! আজও তা মাকামে ইব্রাহিম-এ অক্ষত রয়েছে। হাজিরা তা দেখতে পান।

      একটা সভ্যতা নির্মাণ কি এতোই সহজ! রুুক্ষ পাথরের গায়ে পায়ের ছাপ পড়ে যাবার মতো শ্রম দিতে হয় সভ্যতা নির্মাণকারীকে। সভ্যতা নির্মাণের কাজটা শুরু হয় পরিবার থেকে, পরিবার নির্মাণ শুরুর মাধ্যমে। নিজের ঘর থেকে যদি সহায়তা সাহায্য না আসে, তা হলে সেই ব্যক্তির পক্ষে সমাজ ও সভ্যতা পরিবর্তন অসম্ভব। এ জন্য আগে নিজের পরিবার, নিজের ঘর নির্মাণ করতে হয় সেই কাংক্ষিত মান ও ধাঁচে।

    মক্কার সমাজব্যবস্থাটা আদতে গড়ে উঠেছে একটা আদর্শকে ভিত্তি করে। সেই আদর্শটা ছিল তাওহিদবাদী আদর্শ। এই তাওহিদকে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত ও বিস্তৃত হওয়া এ সমাজ কি করে পৌত্তলিক সমাজে পরিণত হলো? কি করে সেখানকার মানুষজন পৌত্তলিক হিসেবে আবির্ভূত হলো? মৌলিক এ প্রশ্নটা কি আমরা ভাবি কখনও? বাঁচতে হলে ভাবতেই হবে।

     ভাবতে হবে নিজেদের মনোজগতে তাওহিদের অবস্থানকে সুসংহত রাখতে। মনোজগতে অবিশ্বাসের আক্রমণ ও সংক্রামণের গতি প্রকৃতি ও চোরা পথগুলোতে না চিনলে মক্কার সেই সমাজের মতো আমাদের মন, মানস, পরিবার এবং সমাজও একদিন হারিয়ে যাবে পৌত্তলিকতার ভয়াল ছোবলে। 

যারা ইব্রাহিম ও তাঁর সন্তানের ইতিহাস পড়ে কাঁদতে চান, আবেগ ভেসে যেতে চান, তাদের জন্য ইতিহাসটাই যথেষ্ঠ কান্না করার। কিন্তু যারা আরও কিছু চান, চান নিজেদের জীবন, পরিবার ও সমাজ গড়তে তাদের জন্য এ পাঠের সাথে প্রয়োজন গভীর ভাবনা। আপনি এই চিন্তাভাবনাটুকু করবেন কি না, সে স্বিদ্ধান্ত নেবার দায়ও আপনারই। দা চয়েস ইজ ইউরস। (ক্রমশ, সংক্ষিপ্তকৃত)
---------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।         

Post a Comment

0 Comments