দ্যা চয়েস ইজ ইউরস-১২;
পুত্র হারিসকে পাঠিয়ে যেমন আব্দুল মুত্তালিব থাকলেন একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে অধির আগ্রহভরা অপেক্ষায়, ঠিক তেমনি মা আমিনাও প্রতিটা দিন পথ চেয়ে থাকেন, দিন গোণেন, কবে তিনি তাঁর অসুস্থ স্বামীর খবর পাবেন! কবে স্বামী তাঁর সামনে এসে দাঁড়াবেন!
গর্ভধারনের পর থেকে দেখতে দেখতে ইতোমধ্যেই পাঁচমাস কেটে গেছে, তিনিও বাবা হতে চলেছেন, আমিনা যে গর্ভবতী হয়েছেন, স্বামী তাঁর সেটাই তো জানেন না! নিজমুখে তিনি খবরটা দেবেন তাঁকে, প্রতিটি স্ত্রীর আজন্ম লালিত স্বপ্ন। প্রতিটি নারীর মানসিক প্রবৃত্তি ও প্রকৃতি।
আমরা এ পর্যায়ে এই মানসিক প্রকৃতি নিয়ে কিছুুটা আলোকপাত করবো। আজ হতে দেড় হাজার বছর আগেকার এই মহান চরিত্রগুলোকে তাদের মানসিক অবস্থার আলোকে বুঝতে ও উপলব্ধী করতে হলে এই পর্যালোচনাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। তা না হলে তা নিছক ইতিহাস পাঠ হবে মাত্র। অথচ আমরা ইতিহাসের চেয়েও আরও বেশি কিছু চাই। পুরো ঘটনাপ্রবাহের সাথে নিজেদের আত্মিক সম্পৃক্ততা অনুভব করতে চাই। আমরা মা আমিনার দু:খ কষ্ট ও আনন্দকে আমাদের নিজেদের দু:খ কষ্ট ও আনন্দ হিসেবে উপলব্ধী করতে চাই।
আমরা কেবলমাত্র সিম্প্যাথেটিক (Sympathetic) হয়ে তাঁদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের মধ্যেই নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না, বরং মা আমিনার প্রতি, সর্বোপরি শিশু মুহাম্মদের (আমাদের প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা:) ইম্প্যাথেটিক (Empathetic) হয়ে তাঁদের সকল কষ্টকে আমাদের নিজেদের কষ্ট, সকল দু:খকে আমাদের নিজেদের দু:খ এবং সকল আনন্দকে আমাদের নিজেদের আনন্দ হিসেবে ভাগ করে নিতে চাই। এটুকুতে সফল হলে এই মহামানব ও তাঁর জীবনের সকল কর্মকান্ডকে যথাযথভাবে বুঝাটা আমাদের জন্য সহজ হবে ইনশাআল্লাহ।
পুরো গর্ভকালীন সময়টাই মা আমিনা এক ধরনের নি:সঙ্গতার মধ্যে কাটিয়েছেন। একমাত্র ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাঁরই দাসী; কিশোরী উম্মে আইমান। দাসী ও মনিবের সম্পর্ককে ছাড়িয়ে তাঁরা যেন বান্ধবী হয়ে উঠেছিলেন কিংবা বলা চলে, বড় বোন ও ছোট বোনের মতো একে অপরের ঘনিষ্ঠ।
আরও একটা বাস্তবতা আমাদের সামনে রাখা প্রয়োজন। আমিনার এক চাচাতো বোন হালা বিনতে ওহাইব’ও ঐ একই সময় আব্দুল মুত্তালিবের বাড়িতে, তথা, মা আমিনা যে বাড়িতে বসবাস করতেন, সেই একই বাড়িতে থাকতেন। হালা বিনতে উহাইব চাচাতো বোন হলেও এখন বিবাহসুত্রে তিনি আমিনার শাশুড়ি। কারণ যেদিন আব্দুল্লাহর সাথে আমিনার বিয়ে হয় ইয়াসরিবে, সেই একইদিন হালার সাথে আব্দুল মুত্তালিবও বিয়ে করেন।
ইয়াসরিবে সমসাময়িক সময়ে একই সাথে বেড়ে উঠা দুই চাচাতো বোন, বিবাহসুত্রে একই দিনে মক্কায় এসেছেন, তাও আবার একই বাড়িতে এবং একই পরিবারে, এ বাস্তবতা আমাদের সামনে বিবি আমিনার বর্তমান সংকটকালীন সময়ে মনের দু:খ ও কষ্টগুলো ভাগাভাগি করে নেবার একটা সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলে। আর এটাই স্বাভাবিক সামজিক প্রক্রিয়াও বটে। বলাই বাহুল্য, এই হালা বিনতে উহাইব’ই হলেন হযরত হামযা রা: এঁর মা।
আব্দুল মুত্তালিবের একটা মানসিক দিক আমাদের সামনে বিদ্যমান রাখা প্রয়োজন। সেটা হলো, তিনি সম্ভবত আন্তরিকভাবে এবং অত্যন্ত ব্যগ্রতার সাথেই চেয়েছিলেন শেষ নবীর সাথে সম্পৃক্ত হতে। এই চাওয়াটাই তাঁকে একই পরিবারে, তথা, একই বংশে একইসময়ে পর পর দু-দু’টো বিয়ে সম্পাদনের দিকে তাড়িত করে।
আব্দুল মুত্তালিব মক্কার অন্যান্য নেতাদের মতোই ব্যবসার জন্য ইয়েমেন ও সিরিয়া নিয়মিতই যাতায়াত করতেন। ইয়েমেনে গেলে তিনি সেখানকার এক ধনাঢ্য ব্যক্তির আতিথেয়তা গ্রহণ করে তার বাড়িতেই থাকতেন। ইয়েমেনি এই ভদ্রলোক প্রাচীন আসমানি কিতাব অধ্যয়ন করতেন এবং সে সব কিতাবের ব্যাপারে বেশ পান্ডিত্য রাখতেন।
একবার উক্ত ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়িতে অবস্থান করাকালীন তিনি আব্দুল মুত্তালিবকে বললেন, আমাকে অনুমতি দিন, আমি আপনার নাক ভালো করে পরখ করে দেখতে চাই। আব্দুল মুত্তালিব বললেন, দেখো। তিনি তাঁর নাক দেখার পর বললেন, আমি নবুওয়াত ও সাম্রাজ্য দেখতে পাচ্ছি। আর আমি এ নবুয়াত ও সাম্রাজ্য দুই মানাফের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। একজন আব্দে মানাফ বিন কুসাই, আর অপরজন আব্দে মানাফ বিন যুহরা। আব্দুল মুত্তালিব এ কথা শুনে মক্কায় ফিরে গিয়ে আমিনা বিনতে ওয়াহাব যুহরার সাথে তাঁর সন্তান আব্দুল্লাহর বিয়ে দিয়ে দেন।
অপরদিকে আব্দুল মুত্তালিব নিজেও চমৎকার এক স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর নাতি মুহাম্মদের জন্মের আগে। তিনি দেখেছিলেন, তাঁর পৃষ্ঠদেশে রুপার এক শিকল দৃশ্যমান হলো, যার কয়েকটি মাথা রয়েছে। একটি মাথা আকাশের দিকে, একটি মাটির দিকে, একটি পুর্ব দিকে এবং আরেকটি পশ্চিম দিকে। কিছুক্ষণ পর এ শিকলটা গাছে রুপান্তরিত হলো, যার প্রতিটি পাতায় রয়েছে নূরের চন্দ্রপরিমন্ডল। আর পূর্ব-পশ্চিমের মানুষ তার ডালগুলো জড়িয়ে রয়েছে।
স্বপ্নের ব্যাখাতাগণ আব্দুল মুত্তালিবকে এ স্বপ্নের এ ব্যাখা প্রদান করেন, আপনার বংশে এক নজিরবিহীন সন্তানের জন্ম হবে। তার মান মর্যাদা হবে অতুলনীয়। পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত মানুষ তার আনুগত্য করবে। আসমান ও জমিনের অধিবাসী তার প্রশংসা করবে।’
মক্কায় যে অচিরেই একজন নবীর আগমণ ঘটতে যাচ্ছে, এ বিষয়টা সমকালীন সমাজে প্রায় সকলের মনেই বদ্ধমূল ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পুরো সমাজই যেন একজন নবীর আগমনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠী, সবার মধ্যেই প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত বাসনা আসন গেড়ে ছিল কোন না কোনভাবে আসন্ন সেই মহান ব্যক্তিত্বের সাথে নিজেকে বা নিজেদেরকে জড়িয়ে নেবার মাধ্যমে সম্মানিত হবার। আব্দুল মুত্তালিবও সম্ভবত অতি সঙ্গতকারণেই এধরনের আবেগ আর অনুভুতির বাইরে ছিলেন না।
সমকালীন ইতিহাসে কমিউনাল সাইকোলোজি, তথা, সোস্যাল সাইকোলোজি বা গণমনস্তত্ব যে এমনটাই ছিল তার সপক্ষে অনেক তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায়। এমনকি, মা আমিনার বিয়ে হয়েছে যার সাথে, সেই আব্দুল্লাহর ঔরসেই যে সেই সম্মানিত নবীর জন্ম হতে পারে, এমন ধারণাও কেউ কেউ করতেন। বিষয়টি আমরা ‘সমকালীন মক্কাবাসীর সংস্কৃতিক ও আদর্শিক পরিচয়’ অধ্যায়ে আলোচনা করবো বিস্তারিত, তবুও এখানে ঐতিহাসিক একটা ঘটনার উদ্ধৃতি দিলেই বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। (,সংক্ষেপকৃত)
চলবে,,,,,,।
------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।
0 Comments