সেদিনের সেই স্মৃতি ;
দিন তারিখ মনে নেই, তবে সেটা ছিল ২০০৬ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি । ড্রয়িংরুমে বসে সাপ্তাহিক ইউরোবাংলার উপসম্পাদকীয়টা লিখছিলাম, সেদিনই তা জমা দেবার কথা। তখন সন্ধা ৯ টা। মাগরিবের নামাজের মিনিট চারেক সময় রয়েছে। অজুটা সেরে দোতলায় উঠে গেলাম। মোবাইল ফোনটা হাতে নিতেই দেখি একটা অপরিচিত নম্বর থেকে কল এসেছে। রিং টোন শুনতে পাইনি। নামাজ শেষে চুলায় চা বসলাম।
এই ফাঁকে সেই অপরিচিত নম্বরে কল করলাম । এক ভদ্রমহিলা ধরলেন। বাংগালি মনে হলো। ফোন পাবার কথা বলায় তিনি অন্য একজন পুরুষকে ফোনটা ধরিয়ে দিলে তাঁকেও বললাম যে; এই নম্বর থেকে কল এসেছিল, মিস করেছি, তাই জানতে চাচ্ছি কে কল করেছিলেন?
ভদ্রলোক জানতে চাইলে নিজের পরিচয় দিলাম। তিনি বলে উঠলেন, 'সম্ভবত আব্বা কল করেছিলেন। একটু ধরেন'। আব্বা কে? জানতে চাইবো কিন্তু তার আগেই অপরপ্রান্ত একেবারে নিশ্চুপ।
কিছুক্ষণ পরেই এক ভারি কন্ঠে সালাম ভেঁসে আসলো; 'আসসালামু আলাইকুম'। জবাব দিলাম। কিন্তু চিনতে পারি নি। আবারও নিজের পরিচয়টা দিয়ে জানতে চাইলাম; কে বলছেন প্লিজ?
'আমি গোলাম আজম, লোকে আমাকে অধ্যাপক গোলাম আজম বলেই ডাকে। আপনি কি জিয়াউল হক বলছেন?'
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। বিশ্বাসই হচ্ছিল না যেন। একসময় বললেন; ভাবলাম আপনাকে আসতে বলবো মাগরিবের পরে একসাথে বসে এক কাপ চা খাবো।
বললাম; স্যার আপনার কাছ থেকে আমি এই মহুর্তে প্রায় পৌনে তিনশত মাইল দুরে রয়েছি। তিনি অবাক হলেন। ভেবেছিলেন, আমিও বোধ হয় লন্ডনে রয়েছি।বললেন; গতবছর এসেছিলাম, আপনার সাথে দেখা হবে ভেবেছিলাম, কিন্তু হয়নি, নম্বার না থাকায় যোগাযোগ করতে পারিনি। এবারেও তো যাবার সময় হয়ে এলো, এবারেও কি দেখা হবে না?
বললাম, স্যার ঠিকানাটা দেন, এখান থেকে সাড়ে পাঁচঘন্টার ড্রাইভিং, আমি সকালে পৌছে যাবো ইনশাআল্লাহ। তিনি তাঁর ছোট ছেলে ড: সালমানকে ধরিয়ে দিলেন, ড: সালমানই ঠিকানা দিলেন, আমিও লিখে নিলাম।
আমি তখন একটা বেসরকারি মেন্টাল হাসপাতালের উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত। আমার ইমিডিয়েট বস ম্যানেজার মাইকেল কেভ'কে ফোন করে পরের দুদিন ছুটি ম্যানেজ করলাম। পরদিন যথাসময়ে পৌছে গেলাম লন্ডনে ড; সালমান আজমির বাসায়। তিনি নীচের ড্রয়িং রুমে বসতে দিলেন। কিছুক্ষণ পর দোতলা থেকে বর্ষীয়ান অধ্যাপক গোলাম আজম হাঁটুর ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিলেন বলে রেলিং ধরে আস্তে আস্তে নামলেন।
আমার মাথায় এক রাশ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এক এক করে তাঁর কাছ থেকে সবপ্রশ্নের উত্তর পেলাম। মরহুম আব্দুল মান্নান তালিব সাহেবের কাছ থেকে আমার লেখা 'ইসলাম সভ্যতার শেষ ঠিকানা' বইটা পেয়েছিলেন, সেটা পড়েছেন। এর পরে আরও গোটা দু'য়েক বই পড়েছেন, সেটাও জানালেন। 'ধরণীর পথে পথে' কলাম পড়ছেন যায় যায় দিনে তা বলার পাশাপাশি সাপ্তাহিক ইউরোবংলায় আমার কলামগুলোও পড়েন বললেন। গতকাল লন্ডনে এক কর্মী সমাবেশে আমাকে খুঁজেছিলেন। সাংবাদিক ও ইউরোবাংলার তৎকালীন সম্পাদক জুবায়ের ভাই আমার নম্বর দিলে তিনি ফোন করেন।
ড্রয়িং রুমে বসে বসে এই পন্ডিত বটবৃক্ষের কথা শুনছিলাম। তিনি আমার 'ইসলাম সভ্যতার শেষ ঠিকানা' বইটা নিয়ে এমন চুলচেরা বিশ্লেষণ করলেন, মনে হলো বইটা তার সামনে তখনও খোলা রয়েছে। অথচ তিনি বলে চলেছেন স্মৃতি থেকে! ঐ বৃদ্ধ বয়সেও তাঁর স্মৃতিশক্তির প্রখরতা দেখে আমি অবাক হচ্ছি। লেখালেখির ব্যাপারে পরামর্শ দিলেন।
সেদিন একটা বিষয় দেখেছি, তাঁর বিনয়। আমি তাঁর ছেলের বয়সী, অথচ তিনি আপনি আপনি করেই চলেছেন, আমি বিব্রত হচ্ছিলাম ভীষণভাবে। আপনি থেকে তুমি সম্বোধন করাতেই আমার অন্তত কুড়ি মিনিট সময় লেগেছে, তাও কয়েবার মিনতি করার পরে।
ক্রিটিক্যাল স্টাডি নিয়ে কিছু কথা হলো। বলেছিলাম; স্যার, ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে ইসলামের গায়ে এমনসব কালিমা লেপন করা হয়েছে, সে ইতিহাস শুধরাতে ক্রিটিক্যাল স্টাডিতে সময় ও শ্রম দিতে প্রস্তুত একদল বুদ্ধিজীবী গবেষক ও লেখক তৈরি না হলে এ সমাজে ইসলাম দিয়েই, একদল মুসলমান দ্বারাই ইসলামের বিরোধিতা হবে, সহজে তা বন্ধ হবে না।
বুদ্ধিবৃত্তিক ময়দানে এমন একদল বুদ্ধিবীবী ও লেখক দরকার, যারা ইসলামের প্রতিটি বিষয়ে ক্রিটিক্যাল স্টাডি করবেন ও সেই সাথে যুগকে ইসলাম দিয়ে ব্যখা করবেন। ইসলামকে যুগ দিয়ে নয়।
তিনি কথাটা খুবই পছন্দ করেছিলেন। দোওয়াও করেছিলেন। অসুস্থতা সত্তেও প্রায় ঘন্টা দুয়েক সময় দিয়েছেন। আসার আগে ড: সালমানের ক্লিকে দুটো ছবিও তোলা হয়েছিল। আজ ছবিগুলো কেবলই স্মৃতি। তবে এর চেয়েও বড়ো স্মৃতি জমা রয়েছে আমার মননে। আজীবন তা ভাস্বর থাকবে। আল্লাহ এই মহান বুদ্ধিজীবিকে জান্নাতের মেহমান বানিয়ে রাখুন।
---------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার, গবেষক ও বিশ্লেষক।
0 Comments