Recent Tube

মাথা ঠান্ডা রাখুন, প্রজ্ঞা কাজে লাগান। ফাঁদে পড়বেন না যেন- ৷ --- জিয়াউল হক।

 
 মাথা ঠান্ডা রাখুন, প্রজ্ঞা কাজে লাগান। ফাঁদে পড়বেন না যেন-? 
--------------------------------- 

    ঘটনাটা নবম শতাব্দির ঠিক মাঝামাঝি ৮৫০ খৃষ্টাব্দে ।কর্ডোভার কাজীর আদালতে বিচার এসেছে। একদল আন্দালুসিয়ান মুসলমান এক খৃষ্টান ফরাসি পাদ্রিকে টেনে হেঁচড়ে হাজির করেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে প্রিয় রাসুল সা; এঁর বিরুদ্ধে অত্যন্ত অবমাননাকর মন্তব্য করেছে, প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: কে খৃষ্টবিরোধি হিসেবে অভিহিত করে প্রকাশ্যে বাজারের মধ্যে, জনসম্মুখে কদর্য ভাষায় গালাগালি করেছে। কিছু মুসলমান তাকে প্রথমে মারধর করে অবশেষে ধরে এনেছে কাজির দরবারে। তাদের দাবী হলো, পাদ্রিকে মৃত্যুদন্ড দিতে হবে।

    আদালতে কাজী বাদি যুবকদের কাছে ঘটনাপ্রবাহের বিস্তারিত জানতে চাইলে তারা তা খুব উৎসাহের সাথেই  জানালো। স্বাক্ষীও উপস্থিত ছিল। যেহেতু বাজারের মধ্যে, প্রকাশ্যে জনসম্মুখে অনেক লোকের সামনে ঘটনা ঘটেছে সেহেতু স্বাক্ষীর কোন অভাবও হলো না। 

      তা ছাড়া, মুসলমানদের প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এর বিরুদ্ধে গালাগাল করায় আশে পাশে উপস্থিত সকল মুসলমানেরই আবেগে আঘাত লাগার কারণে সেখানে যারা উপস্থিত ছিল তাদের মনে ক্ষোভ জন্মেছিল, আর যারা ঘটনা ঘটার সময় সেখানে উপস্থিত ছিল না তারাও কেবলমাত্র তা শুনেই এক পায়ে খাড়া পাদ্রির বিরুদ্ধে স্বাক্ষী দিতে। 

    বিজ্ঞ কাজী বাদি মুসলমানদের বক্তব্য মন দিয়ে শুনে অভিযুক্ত পাদ্রিকে প্রশ্ন করে জানতে পারলেন পুরো ঘটনা। পাদ্রি লোকটা কর্ডোভার বাজারে বাজার করতে গেছে। সেখানে যে দোকান থেকে সে জিনিসপত্র কেনার জন্য ঢুকেছে, সেখানে আগে থেকেই কিছু লোক বসে গল্প করছিল নিজেদের মধ্যে। ঘটনাচক্রে তারা সকলেই ছিল মুসলমান।

    এইসব মুসলমান লোকগুলো হঠাৎ করে সেখানে একজন খৃষ্টান পাদ্রিকে ঢুকতে দেখে তার সাথে আলাপ জুড়ে দেয়। নানা ধরনের প্রশ্ন করতে থাকে, যার অধিকাংশই ছিল ইসলাম ও খৃষ্টধর্ম সংক্রান্ত। এ দু’য়ের মধ্যে কোনটা শ্রেষ্ঠ, কেন শ্রেষ্ঠ? এরকম কিছু। 

      প্রশ্নের ধারাবাহিকতায় মুসলমান লোকগুলো পদ্রিকে এক পর্যায়ে প্রশ্ন করে বসে খৃষ্টানদের যিশু, তথা, হযরত ইসা আ: এবং আমাদের নবী মুহাম্মদ সা: এ দু’য়ের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? এ পর্যায়ে এসে খৃষ্টান পাদ্রি প্রিয় নবী হযরত ইসা আ: কে শ্রেষ্ঠ বলে দাবী করে এবং প্রিয় রাসুল সা: তার মতে কেন শ্রেষ্ঠ নয়, সে ব্যাখা দিতে গিয়ে তাকে নিয়ে অনেক আপত্তিকর মন্তব্য করে বসে, ব্যঙ্গ বিদ্রæপও করে।

    পাদ্রির মুখে প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা: এর ব্যাপার আপত্তিকর মন্তব্য ও বক্তব্য শুনে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে মুসলমানদের মধ্যে বিরাট প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। অনেকেই ক্ষোভে বিক্ষোভে উত্তেজিত হয়ে পাদ্রির উপরে হামলে পড়ে। কিছু ব্যক্তি ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাবার আগেই উক্ত পাদ্রিকে ধরে কাজীর দরবারে নিয়ে আসে।

পুরো ঘটনা এবং স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ্য শোনার পরে কাজী উক্ত পাদ্রিকেও প্রশ্ন করলেন। পাদ্রি সব অভিযোগ অবলীলায় স্বীকার করে নিলে অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলো। কিন্তু তারপরেও বিজ্ঞ কাজী উক্ত পাদ্রিকে সতর্ক করে ছেড়ে দিলেন। বাদি মুসলমানদের দাবী অনুযায়ী তাকে মৃত্যুদন্ড দিলেন না। 

এবারে ঘটনাকে আপনি প্রায় বারোশত বছর পরে নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধির আলোকেই কেবল নয়, বরং ইসলামি ফিক্বহ ও আল কুরআনের শিক্ষার  আলোকে বিচার করে দেখুন। দয়া করে উত্তেজিত হবেন না, ক্ষণিকের জন্য মাথা ঠান্ডা রাখুন।  আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করুন এক্ষেত্রে, বরং জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগান। 

সুরা বাকারার শেষে আমাদের, তথা, মুসলমানদের বৈশিষ্ঠ বলতে গিয়ে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন; ‘আমরা এমন মুসলমান, যারা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কর্তক প্রেরিত সকল নবী রাসুলকে বিশ্বাস করি ও তাদের উপরে ঈমান পোষণ করি। তাদের কারো মধ্যেই কোনরকম পার্থক্য করি না।’

ধর্মবিশ্বাসে একজন খৃষ্টান, তা তিনি সাধারণ খৃষ্টান হোক বা তাদের ধর্মীয় নেতা, তারা এই কারণে খৃষ্টান যে, তারা কেউই প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা. কে শেষ নবী হিসেবে মানে না, স্বীকারই করে না। এটা জানা সত্তেও তাদেরকে এ ধরনের বিতর্কে টেনে নামানো বা যত্রতত্র আল্লাহর সম্মানিত দুই নবীর মধ্যে কে বেশি উত্তম বা কে বড়ো? এ ধরনের প্রশ্ন করাটাই তো এক মহা অন্যায়। 

এ ধরনের প্রশ্ন করার পেছনে উদ্দেশ্যই থাকে প্রতিপক্ষকে উত্তেজিত করা,  উস্কে দেয়া। উস্কে দিতে পারলে সে নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারাবে, তখন তাকে দিয়ে এমন কিছু করানো বা বলানো যাবে যার ফলে তাকে সমাজের সামনে কিংবা আঈনের সামনে অপরাধী সাব্যস্ত করা সহজ হবে।

এ প্রবণতা আজও রয়েছে সমাজে। বলা চলে প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশে। খৃষ্টান বা হিন্দু বা অন্য কোন ধর্মাবলম্বীকে ডেকে এ ধরনের বিতর্কে জড়ানোর পেছনে কোন কল্যাণ নেই। এর দ্বারা একাডেমিক আলোচনার সুত্রপাত হয় না। এটা কোন সচেতন মুসলমান করতে পারেন না। করা উচিৎ নয়। কাজেই এটা বন্ধ হওয়া উচিৎ। 

আবার এই একই কৌশলটি মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দু, খৃষ্টান, ইহুদি, বৌদ্ধ’সহ নানাধর্মের মানুষদের দ্বারা আধুনিক বিশ্বে প্রয়োগ হচ্ছে দেশে দেশে। তারা ইসলাম, আল্লাহ, রাসুল ও ইসলামী ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছে যেন মুসলমানরা ক্ষিপ্ত হয়, নিজেদের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধ্বংসাত্মক কিছু করে বসে এবং তার সুত্র ধরে তাদের নাগরিক ও মৌলিক মানবাধিকার হরণ করা যায়, তাদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে প্রমাণ করা যায়। 

এ কৌশলের ব্যাপক উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছি দেশে। কাজেই সাবধান থাকুন। আবেগ দিয়ে নয়, প্রজ্ঞা দিয়ে আপনার কর্মকান্ড পরিচালিত করুন। তা না হলে আখেরে পস্তাতে হবে  নিশ্চিত।
--------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক। 

Post a Comment

0 Comments