খোলা চিঠি: হে যুবক
পর্ব-৭;
---------------------------------
কি শিখছেন? কতোটা স্বচ্ছ? সেটাও ভাবুন-
পারস্য যুদ্ধের সময় হজরত ওমর রা: আলাদা একটা শহর; কুফা নির্মাণ করেন পারস্যেরই বিজিত অংশে মুসলমান সৈন্য ও বেসামরিক লোকজনকে পারস্য সাংস্কৃতিক আগ্রসেনের হাত থেকে বাঁচাতে।
কুফা ছিল ক্যন্টনমেন্ট শহর। সামরিক ঘাঁটি। হজরত আলি রা: যখন কুফায় তার রাজধানী স্থানান্তর করেন, তখনও এই শহরটি পুরোপুরি একটা ক্যন্টনমেন্ট শহর হিসেবেই বিদ্যমান ছিল। পরে সেটা বেসামরিক শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে।
হজরত ওমর রা: এঁর আশংকাই শেষ পর্যন্ত সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ‘সালাত’ হয়েছে নামাজ, ‘রামাদ্বান’ হয়েছে রোজা, ‘জান্নাত’ বেহেশত হয়েছে, ‘জাহান্নাম’ হয়েছে দোজখ। আরও কতো কি বদলেছে! এসব তো বাহিক্য পরিবর্তন, মানসিক পরিবর্তন আরও ভয়ানক। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্কের মধ্যে এসে ভাগ বসিয়েছে কতো পীর, আর দরবেশ বাবা, তাদের ছাড়া নাকি সরাসরি আল্লাহকে পাওয়া যায় না, চাওয়াও যায় না, ডাকাও যায় না! ঠিক এটা ঠেকাতেই দূরদর্শী ওমর রা: আলাদা শহরটির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তি মুসলমানদের অসতর্কতা ও অসচেতনতায় সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি।
মদিনা থেকে ইসলাম বেরিয়ে তার গায়ে লেগেছে পারসিক পোশাক। আজ সেই পোশাকের গায়ে কতো রং, কত ঢং! কতো বর্ণের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন! বৈধতা পেয়েছে কিছু কিছু পারসিক সাংস্কৃতি, মিশে গেছে ইসলামের নামে, ইসলামের পরিচয়ে। আজ তাকে মুসলমানদের জীবন থেকে আলাদা করাই যায় না। ভিন্নতা দেখলেই হৈ হৈ করে তেড়ে আসে মুসলমানদেরই সন্তান; জাত গেল, জাত গেল বলে!
নিজেদের বিশ্বাস আর নিয়ন্ত্রণহীন আবেগকে বাস্তবে রুপ দিতে এই কুফাতেই কারামাতিরা ৮৯৪ খৃষ্টাব্দে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ফেলে! উদ্বেশ্য: ইসলামের সাম্য ও ইনসাফ, সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করবে! এ রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল ‘হাজর’ (বর্তমানে বাহরাইনের ছোট্ট শহর)
এটিই বিশ্বের বুকে সর্বপ্রথম কমিউন্সিট রাষ্ট্র। কমিউনিস্ট, তবে নাস্তিক / ধর্মহীন রাষ্ট্র নয়। ইসলামী শিক্ষাকে ভিত্তি করে বিশ্বের সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রে ব্যক্তিগতভাবে কেউই কোন সম্পদের মালিকানা ভোগ করতে পারতো না। সব কিছুর মালিক ছিল রাষ্ট্র, রাষ্ট্রই প্রত্যেকের খাদ্য, বস্ত্র ও যাবতীয় প্রয়োজন মেটাতো।
এটা ছিল চরম উগ্রপন্থী রাষ্ট্র। চিন্তা ও দর্শনে উগ্রতাকে লালন করতো। তাদের মতের বিরোধিতা করলেই কঠোর হাতে দমন করতো। ‘দমন’ মানে সংশোধনের সুযোগ নয়; সোজা কতল! মাঝে অন্য কোন পথ নেই, ছিলও না।
এদেরই একজন উবাইদুল্লাহ মাহদি নিজেকে ইমাম মাহদি হিসেবে ঘোষণা করে সমাজে ইসলামের প্রকৃত রুপ (!)প্রতিষ্ঠায় নামে। সাথে জুটে অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, আবেগে নাচা একদল অনুসারীও। দীর্ঘ ২৫টা বছর শাসনকার্য চালিয়ে যান (৯০৯-৯৩৪)। তাদের প্রভাব ও ক্ষমতা বৃদ্ধি হলে উত্তর আফ্রিকার মরক্কোতে এরাই ফাতেমি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে।
কি বিষ্ময়কর ব্যাপার! যে শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাই ঘটেছিল ইসলাম প্রতিষ্ঠা, সমাজকে সাম্য, সুবিচার ও মর্যাদার আসনে আসীন করতে, সেই শাসনব্যবস্থা; ফাতেমি খেলাফতই পরবর্তিতে ইউরোপ থেকে, বিশেষ করে, ফ্রান্স থেকে আসা খৃষ্টান উগ্র ক্রসেডারদের সাথে হাত মিলিয়ে, বন্ধুত্ব করে নুর উদ্দিন জিংকি, সুলতান সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে একের পর এক! সে আলোচনা অবশ্য ইতিহাসের ভিন্ন এক বিষয়, এখানে নয়।
এই কারামতিরা মুসলমানদের অন্যতম ইবাদাত; বাৎসরিক হ্জ্জকেও অপ্রয়োজনীয় মনে করতো। হাজীদের সম্পদ লুঠ করতো। তাদের জন্য বহু হাজী পথিমধ্যে নিজেদের স্বর্বস্ব হরিয়েছেন। এমনকি, প্রাণও খুইয়েছেন। ৯০৬ খৃষ্টাব্দে হজ্জের সময় এরা প্রায় ২০ হাজার হাজীকে হত্যা করে।
এর দুই যুগ পরে ৯৩০ খৃষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে হজ্জের মৌসুমে সরাসরি কাবা আক্রমণ করে বসে, তখন পুরো মক্কা আগত হাজীদের পদচারনায় মুখরিত ছিল। এগারো দিনের পৈশাচিক বর্বরতায় প্রায় ৩০, ০০০ হাজীকে হত্যা করে। কাবা ঘর থেকে হজরে আসওয়াদকেও চুরি করে নিয়ে যায়।
প্রিয় রাসুল সা: নবুওয়ত পাবার আগেই মক্কার বিবাদমান গোত্রপতিদের সহায়তায়, তাদের নেতৃত্ব দিয়ে যে হজরে আসওয়াদকে কাবার গায়ে বসিয়েছিলেন পবিত্র এ ঘরটির সংস্কার কাজের সময়, সেই পাথরটিকেই তারা প্রায় আড়াইশত বসর পরে সেখান থেকে স্থানচ্যুত করে!
সারা মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার চটকদার শ্লোগাণকে সামনে রেখে তারা ঐক্যবদ্ধ হলেও নিজেরাই নিজেদের মধ্যে ঐক্য টিকিয়ে রাখতে পারেনি। নিজেরা এক এক করে সাতটি ভিন্ন ভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে হজরে আসওয়াদকে ভেঙ্গে সাতটি টুকেরা করে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। ৭৫১ খৃষ্টাব্দে হজরে আসওয়াদকে আবার কাবা ঘরে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত একটানা একুশটা বসর আল্লাহ ঘরে তার কোন অস্তিত্ব ছিল না! কল্পনা করা যায় এ বর্বরতার কথা!
এসব কিছুই হতে পেরেছিল বা ক্রতে পেরেছিল ইসলামের নামে, ইসলাম পালনের আবেগে। তারা ভেবেছিল বিরাট ভালো কাজ, পুণ্যের কাজ করছে! ইসলামের গা থেকে অন্যায়, জঞ্জাল দূর করছে!
এই যে বিশ্বাস, এরকম বিশ্বাস তাদের মনোজগতে ঠাঁই করে নিতে পেরেছিল একমাত্র কারণে, আর তা হলো উবাইদুল্লাহ মাহদি ও তার অনুসারীদের চিন্তা চেতনায় গ্রোথিত হয়ে যায়া জ্ঞানের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা, বিকৃত বোধ ও বিশ্বাস, জ্ঞানের নামে মূর্খতা।
কাজেই আপনি যা শিখবেন ও শিখছেন, তা যেন স্বচ্ছ ও বিকৃতিমুক্ত থাকে সেটার দিকে খেয়াল রাখুন, তা না হলে কষ্ট করে অর্জিত এই জ্ঞানই আপনাকে বিপথে চালিত করবে একদিন। (সংক্ষেপকৃত)
-----------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ও বিশ্লেষক।
0 Comments