Recent Tube

খোলা চিঠি: হে যুবক-৯ ; জিয়াউল হক।



   খোলা চিঠি: হে যুবক
                          পর্ব-৯;
  

জ্ঞানের জাকাত দিন-

  বিশ্বের প্রতিটি সমাজেই মুসলমান জনগোষ্ঠী আজ আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে যেন। আর এর বহুবিধ কারণ থাকলেও আমাদের মুসলিম সমাজের অজ্ঞতা, নিরক্ষরতা ও সার্বিক পশ্চাদপরতা এবং সাংস্কৃতিক দূষণ অন্যতম একটা বড়ো কারণ।

    আর্থিক দৈন্যতার কথা বলে লাভ নেই, কারণ, আর্থিক দৈন্যতা উম্মাহর পতনের কারণ নয়। শিক্ষা ও সাংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে জাতি উন্নত, তারা নিজেদের প্রচেষ্টায় তাদের আর্থিক দৈন্যদশা কাটিয়ে উঠে। ফলে তাদের আর্থিক অবস্থা যেমন উন্নত হয়, তেমনি তাদের সামাজিক ব্যবস্থাপনাও সকল ধরনের অরাজকতা, বিশৃংখলা, অব্যবস্থাপনা থেকে ক্রমেই মুক্ত হয়ে পড়ে।

   এর সবচেয়ে বড়ো উদাহারণ রয়েছে আমাদের সামনে। মরুর আরব গোষ্ঠী মাত্র একটি শতাব্দির মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী উন্নত ও দক্ষ গোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে বিশ্বকেই পথ দেখিয়েছে। এটা হতে পেরেছে যখন তারা নিজেদের মনোজগত উন্নত শিক্ষা ও সুস্থ সংস্কৃতিতে সাঁজিয়ে নিয়েছে। অশিক্ষা এবং অপসংস্কৃতি থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করেছে।
অতএব, এটা চুড়ান্ত ও স্বতস্বিদ্ধ এবং স্বিকৃত বাস্তবতা যে, যথাযথ শিক্ষা না থাকাই মুসলিম উম্মাহর বর্তমান পরিণতি ও পশ্চাদপরতার সবচেয়ে বড়ো কারণ। এ কারণের হাত ধরেই তৈরি হয়েছে অন্যান্য কারণগুলো।

  এ বিষয়টা নিশ্চিতভাবে উপলব্ধী করে নিলে উম্মাহর একজন সচেতন যুবক হিসেবে আমাদের কি করণীয় সেটিও সুস্পষ্ট হয়। পরিবার থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশি এবং বৃহত্তর সমাজবাসীর মধ্যে যারা যথাযথ শিক্ষা পাননি, সেই তাদেরকে শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে সচেতন করে তোলাই আমাদের সবচেয়ে বড়ো দায়িত্ব। 

  ঘনিষ্ঠজনদের উত্তম ও যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার চেয়ে বড়ো কোন উপকার তাদের জন্য কারো পক্ষেই করা সম্ভবপর নয়। কারণ এই এটাই তাদেরকে জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে সাফল্যের পথগুলো দেখিয়ে দেবে। 

  গুরুত্বপূর্ণ এ দায়িত্বটা উম্মাহর একজন সদস্য হবার কারণে আপনাতেই আমাদের উপরে এসে পড়ে। এটা নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। কারো চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এটাকে কোনমতেই অস্বীকার করা, এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। 

     অথচ এ দায়িত্বটি কদাচিৎ দু’একজন ব্যতিক্রম ব্যাতিরেকে অধিকাংশজনই পালন করেন না। ফলে সমাজে নিরক্ষরতা কমছে না, সচেতনার বৃদ্ধি ঘটছে না। অশিক্ষা দূর হচ্ছে না। অপসংস্কৃতিও জগদ্দল পাথরের মতোই চেপে রয়েছে, জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নও হচ্ছে না।

   আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমাদের ধারণা; রাষ্ট্রই তার ব্যবস্থাপনায় নাগরিকদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করবে। এটা সমাজের একজন নাগরিকের দায়িত্ব নয়। আবার যারা এটাকে নিজের দায়িত্ব হিসেবে মনে করেন, তাদের বেশিরভাগেরই ধারনা হলো, তিনি নিজে এখনও শেখানোর জন্য প্রস্তুত নন। তার জ্ঞানের পরিধি সে মানের নয় যে, তিনি কাউকে শেখাবেন। আগে নিজের জ্ঞানের স্তরটা আরও উন্নত হোক, তারপরে দেখা যাবে।

    বস্তুত এরকম নানা ধারনা পোষণ করি বলেই মুসলিম উম্মাহর একজন সদস্য হয়েও আমাদের উপরে অর্পিত এই মৌলিক দায়িত্বটা পালন করি না। এটা অত্যন্ত দু:খজনক। এর জন্য সমাজকে যেমন মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে, তেমনি এই আমাদের প্রত্যেককেই এ জীবনে তো বটেই, এমনকি, এ দায়িত্বহীনতার জন্য ওপারের জীবনেও চরম মূল্য পরিশোধ করতে হবে।

   আমাদের এ নিস্পৃহতার সুযোগেই তো মুসলিম সমাজে নানা দেশের, নানা জাতির, নানা ধর্মের সংস্কৃতি ও দর্শন বাণের পানির মতো হু হু করে ঢুকেছে। আর এই যে ভিন্ন সাংস্কৃতির অনুপ্রবেশ, সেটাই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। ভিক্টর হুগোর একটা মূল্যবান কথা রয়েছে। তিনি একবার বলেছিলেন;
An invasion of Armies can be resisted but invasion of ideas cannot be resisted.
অর্থাৎ এক একটি সেনাদলের আগ্রাসনকে ঠেকানো যায় কিন্তু চিন্তার আগ্রাসনকে নয়।

    ভিক্টর নিরেট খাঁটি কথাই বলেছেন। চিন্তার আগ্রাসনকে ঠেকানো যায় না। এই আগ্রাসনকে ঠেকানোর একমাত্র কার্যকর রাস্তা হলো নিজেদের, তথা, সমাজবাসীর প্রতিটি সদস্যের মন মানসকে নিজেদের শিক্ষা, দর্শন ও সাংস্কৃতি দ্বারা সাঁজিয়ে নেয়া। নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সযতেœ লালন করা। 

  অনেকে আবার ভাবেন আরও একটু বয়স বাড়লে ‘মুরুব্বি’ এবং প্রাজ্ঞ ও পরিণত হয়ে া সমাজে ছোটদেরকে শেখাবেন, নসিহত করবেন। ইত্যাদি। অথচ তারা ভুলেই যান যে; 
By the time people are Old enough to know better, they don’t know anything at all.
অর্থাৎ পর্যাপ্ত জেনে জন্য বুড়ো বা পরিণত হওয়া সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে গিয়ে দেখা যায় যে, তারা তখন আর কিছুই জানেন না, বরং। ততোদিনে স্মৃতিভষ্ট হয়ে গেছেন!

   কাজেই আপনি যেটুকু জানেন, সেটুকু অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে অকাট্য তথ্যসুত্র’সহ স্পষ্টভাবে জেনে নিন এবং সেটাই উপযুক্ত ব্যক্তির নিকটে পৌছে দিন, জানিয়ে, শিখিয়ে দিন। জ্ঞানকে নিজের ভেতরে আটকে না রেখে ছড়িয়ে দিন। এটাই হলো জ্ঞানের জাকাত। সম্পদের জাকাত দিতে হয়। জ্ঞানও সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। এটির জাকাত দিন। সময় থাকতেই এর জাকাত আদায় করুন। জ্ঞানের হকদার খুঁজে খুঁজে বের করুন এবং তাকে জ্ঞান দিন। 

   জ্ঞানের হকদার কে? এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। জ্ঞানের হকদার মানুষ। প্রতিটি মানুষ। তবে আপনার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু থাকবে সেই মানুষ, যিনি জানতে ও শিখতে আগ্রহী, জ্ঞান খুঁজছেন, তার কদর করবেন। তাকে জ্ঞান দিন। যাকে তাকে এবং যখন তখন এবং যেখানে সেখানে জ্ঞান দিয়ে কোন লাভ হবে না। 

   আপনার চারিপাশে তাকিয়ে দেখুন আধুনিক যুব প্রজন্ম, নারী বা পুরুষ সকলের মাঝেই ইসলামকে জানা, সঠিক ইসলাম জানার ব্যপারে এক বিরাট আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের জানার এই আগ্রহটাকে কাজে লাগানো উম্মাহর সবচেয়ে শক্তিশালী গোষ্ঠী হিসেবে আপনারই দায়িত্ব। সময় থাকতে এ দায়িত্বটা পালন করুন (সংক্ষেপকৃত)।
----------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments