খোলা চিঠি:
পর্ব- ১২,
হে যুবক, বহুভাষী (Multilingual) হয়ে উঠুন-
ভাষা, আল্লাহর এক অনূপম ও বিষ্ময়কর সৃষ্টি। ভাষার অস্তিত্ত না থাকলে মনুষ্যপ্রজাতিরই অস্তিÍত্ত থাকতো না, থাকতো না এ বিশ্বের অস্তিত্তটাও। মানুষের অন্যতম এক সম্পদ, হলো তার ভাষা। আর এই যে অন্যান্য সৃষ্টির মতো ভাষার মধ্যেও নানা বৈচিত্র, তাও উদ্দেশ্যমূলকভাবেই সৃষ্ট ( সুরা রূম : ২২)।
কুরআনে আল্লাহ পাক ‘ভাষা’ ও তার ‘সমার্থক শব্দ’ (লিসান/ বয়ান) কুরআনের ১৫টি সুরার সতেরোটি আয়াতে বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয় বুঝাতে উল্লেখ করেছেন। এই আয়াতগুলো নিয়ে ভাবলে ভাষার মর্যাদা, গুরুত্ব নিয়ে এক ভিন্ন জগৎ উন্মুক্ত হয়ে চিন্তার জগতে এক শক্তিশালী ধারা তৈরি হবে।
ভাষা জানলেই হয়না, জানাটাই কেবল গুরুত্বপূর্ণ নয়, এর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে বয়ান করতে, মনের ভাবকে যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারাটাও অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ বিষয় (সুরা আর-রহমান : ৩-৪)। ভাষার ব্যবহার, তথা, বয়ান আল্লাহই মানুষকে শিখিয়েছেন সৃষ্টির শুরুতেই। হযরত আদম আ: এঁর মাধ্যমে এ ধারার শুরু ( সুরা বাকারা : ৩১ )।
আদম আ: কর্তৃক কুশলি বয়ানে বিমোহিত ও মুগ্ধ ফেরেশতারা সিজদাহ করলেন আর ইবলিশ হিংসাবশত সিজদাহ না করে নিজের ধ্বংস ডেকে নিল। আদম আ: এঁর মাধ্যমেই মানুষ কর্তৃক ভাষার কুশলি ব্যবহার শুরু। এ ধারা চলমান এবং কেয়ামত পর্যন্ত তা চলবে নিশ্চিত।
মানুষ কথা বলে। তবে সবাই বাকপটু হন না। একই ভাষাভাষীদের মধ্যেও সবাই একইরকম দক্ষতায় ভাষার ব্যবহার করতে পারেন না। আল্লাহর সম্মানিত নবীদের তিনি ভাষার ব্যবহারের ক্ষেত্রে এ যোগ্যতাটা দিয়েছিলেন যেন শ্রোতাদের মনে তাঁদের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এর এই যোগ্যতা ছিল বিষ্ময়কর মাত্রার। তিনি ভাষার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি দক্ষ ছিলেন।
সেই প্রিয় রাসুল সা: এর উম্মত ও অনুসারী হিসেবে ভাষা জানা ও ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করাটা প্রত্যেক মুসলিম যুবকের দক্ষতা অর্জন করতে হবে। মাতৃভাষা ছাড়াও বিদেশি ভাষা শেখা প্রয়োজন জ্ঞানার্জনের জন্য। এটা দেশ ও সমাজবাসীকে সত্য ও সুন্দরের বাণী পৌছে দিতে কাজে লাগবে। কুরআনই আমাদের এ শিক্ষাটা দিয়েছে ( সুরা আহক্বাফ : ১২ )।
একবিংশ শতাব্দিতে এ বিশ্বে প্রায় কয়েক হাজার ভাষার অস্তিÍত্ত রয়েছে। সংখ্যাটা বলা হয়েছে সাড়ে ছয় হাজারের মতো। এ ভাষাগুলোর মধ্যে কোনটা সবচেয়ে বড়ো ভাষা, তথা, কোন ভাষায় সবচেয়ে বেশি মানুষ কথা বলে থাকে? সে প্রশ্নটা আসতে পারে। কোন কোনে দেশে একাধিক ভাষাকে সরকারিভাবে প্রধান ভাষা ও দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
উদাহারণও দিতে পারি। কানাডার কথা ধরুন, সেখানে একইসাথে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা চলছে। আফ্রিকা ও উত্তর আফ্রিকার অনেক দেশেই নিজ নিজ ভাষার পাশাপাশি ফরাসি ভাষা চালু রয়েছে। আমাদের দেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও এরই পাশাপাশি ইংরেজিও চালু রয়েছে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে।
বিশ্বে সংখ্যাবিচারে সবচেয়ে বেশি মানুষ কথা বলে থাকেন; মান্ডারিন চাইনিজ ভাষায়; একানব্বই কোটি, স্প্যানিশ ভাষায় আচল্লিশ কোটি, ইংরেজি ভাষায় আটত্রিশ কোটি, হিন্দি ভাষায় চৌত্রিশ কোটি, পর্তূগিজ ভাষাতেও চৌত্রিশ কোটি, ফরাসি ভাষায় আঠাশ কোটি, বাংলা ভাষায় সাড়ে ছাব্বিশ কোটি এবং রাশিয়ান ভাষায় পনেরো কোটি।
তবে, আলোচ্য বিষয় বিবেচনায় আমি সেদিকে না গিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ দু’একটি ভাষার কথা বলতে চাই। সেটা হলো, পৃথিবীর বুকে জ্ঞানার্জনের জন্য আমাদের মাতৃভাষা ছাড়া আধুনিক সময়কালে কোন ভাষা, কিংবা ভাষাগুলো চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিৎ? সে বিষয়টি।
জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পদচারণা কোন জনপদে এবং কোন ভাষাভাষীদের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে সেটা যদি যদি একটু খতিয়ে দেখি তা হলে জ্ঞানার্জনের জন্য আপাতত কোন ভাষাগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে, সে বিষয়টাও পরিস্কার হয়ে যায়।
চলতি বসর (২০২০ খৃষ্টাব্দ) বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একশত ইউনিভার্সিটির মধ্যে আটলান্টিকের ওপারেই অবস্থিত ৪৪টি (আমেরিকা ৪০ ও কানাডা ৪), পুরো ইউরোপজুড়ে রয়েছে ৩৭টি, অস্ট্রেলিয়ায় ৬টি। ইংরেজিভাষী দেশসমূহে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একশতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্ততপক্ষে ৬১ টি বিশ্বদ্যিালয় রয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা আর অস্ট্রেলিয়া মিলে রয়েছে ঐ একশতটির মধ্যে ৮৭টি বিশ্ববিদ্যালয়।
এ তথ্য আপনাকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেবে যে, কোন সব ভাষার প্রতি আপনার প্রাধান্য দেয়া উচিৎ। ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান এসবই হলো ইউরোপের প্রধান ভাষা।
পৃথিবীর যতো জ্ঞান রয়েছে, যে বিষয়ের জ্ঞানই হোক না কেন বা যে সমাজ ও জনপদেরই হোক না কেন, তা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আপনি পছন্দ করেন বা না করেন, ইংরেজি ভাষা জানাটা আপনার সামনে জ্ঞানের ভিন্ন এক দূয়ার খুলে দেবে।
এর পাশপাশি আরবি ভাষা আপনার জন্য হবে জ্ঞানার্জনের পথে দ্বিতীয় সবচেয়ে বৃহত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ইংরেজি ভাষায় যতো জ্ঞানই পাওয়া যাক না কেন, তার মৌলিক সুত্র, পুরোনো জ্ঞানগুলো প্রায় সবই পওয়া যাবে আরবি ভাষায়। তা ছাড়া, একজন মুসলমান হিসেবে কুরআন ও হাদিস, ইজমা, কিয়াস, ফিক্বহ ছাড়া জীবনটাই বৃথা হতে বাধ্য। এ ছাড়া আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানচর্চার পথে বিভ্রান্ত না হওয়াটা নিশ্চিত করবে কুরআন ও হাদিসের নিখাঁদ জ্ঞান।
এসব বিবেচনায় আপনিই স্বিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন, দ্বিতীয় ও তৃতিয় ভাষা হিসেবে কোন ভাষা শিখবেন। তবে শিখুন। জ্ঞানের জগৎকে সমৃদ্ধ করতে বিদেশি ভাষা শিখুন। বিশ্বাস করুন, ইংরেজি, আরবি ও ফারসি ভাষা শেখাটা বাংলাদেশি মুসলমানদের পক্ষে অত্যন্ত সহজ। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তা সম্ভবপর। (সংক্ষেপকৃত)
-----------------------------------------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক ও কলামিস্ট,।
0 Comments