Recent Tube

দ্যা চয়েস ইজ ইউরস- ৩৮ ; জিয়াউল হক।

     দ্যা চয়েস ইজ ইউরস- ৩৮
               ★★★★★

সামাজিক ও জনহিতকর কাজ কর্ম ছাড়াও কুসাইয়ের জীবনে সবচেয়ে বড়ো অর্জন ছিল, মক্কাবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করা। কাবার রক্ষণাবেক্ষণ ও ত্বত্তবাধানের অধিকার, জমজমের নিয়ন্ত্রণ এসব নানাবিধ বিষয় নিয়ে বিভিন্ন আরব গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ ছিল অতি সাধারণ বিষয়। বলা চলে, যুদ্ধ বিগ্রহ ছাড়া তারা টিকতেই পারতো না। 

এইসব সংঘাতের কারণে যে কেবল প্রাণ ও সম্পদেরই ক্ষয়ক্ষতি হতো, তাই নয়, বরং শান্তিকালীন সময়েও তাদের ভুগতে হতো অভাবের তাড়নায়। কেননা নিরন্তর সংঘাত, সামাজিক অস্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক বিশৃংখলার কারণে মক্কার ব্যবসা বাণিজ্য বিকশিত হতে পারতো না ঠিক মতো।

কুসাই ক্ষমতা পেয়েই এ অবস্থাটা কাটিয়ে উঠে সেখানে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা আনা ও গোত্রগুলোর মধ্যে বিবাদ কমিয়ে বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আশে পাশে গোত্রগুলোর নেতাদের ডেকে একটা সম্মেলনের আয়োজন করেন। এটাই ছিল ঐতিহাসিক ‘দার উন নাদওয়ার’ প্রথম বৈঠক, কুসাই তার সভাপতি, কুরাইশ গোত্র তার নেতৃত্বে। 

পরবর্তিতে এ কারণেই ইসলামের নবী মুহাম্মদ সা. কে কুরাইশ গোত্রের সমর্থন বা বিরোধিতা এতোটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। আবু তালিবের শর্তহীন সমর্থনের গুরুত্ব ও অন্যান্যদের প্রতি সে সমর্থনের প্রভাবকে বুঝতেও এ ঘটনা সাহায্য করবে।

পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে ছোট ছোট ও খুব কাছাকাছি সম্পর্ক বিদ্যমান, এমন সব উপগোত্রকে জুটিবদ্ধ করে বৃহৎ গোত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং নতুন ও পুরাতন সকল গোত্রকে নিজ নিজ গোত্রের পক্ষ থেকে তাদের উপাস্য দেবদবীর একটা করে মুর্তি এনে কাবার ভেতরে বা কাবাচত্তরে স্থাপন করিয়ে দেন।

এর ফলে কাবার আশে পাশে এবং আরবের প্রায় প্রতিটি গোত্রেরই বায়তুল্লাহর সাথে নিজের বা নিজেদের কোন না কোন রকমের মানসিক ও আদর্শিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। বায়তুল্লাহর স্বার্থ তাদেরই স্বার্থ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। এর পাশপাশি বায়তুল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণ করাটা তাদের নিজেদেরও দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে।
 
এ ধরনের আত্মিক ও আবেগি সম্পর্ক আরবদের মাঝে সংঘাত কমিয়ে বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত ফলপ্রসু হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে পরবর্তিতে। আর এ ধরনের প্রাজ্ঞ ও সুক্ষদর্শী স্বিদ্ধান্ত গ্রহণের ঘটনা কুসাইয়ের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শীতাকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে। 

কুসাইয়ের প্রভাব প্রতিপত্তি বেড়ে যায়। কেবলমাত্র সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, এমনকি, কাবা ঘরের ত্বত্তাবধানের ক্ষেত্রেও কুসাইয়ের ভূমিকাই ছিল আসল। তিনি তার জীবদ্দশাতে একইসাথে ঐ সমাজের রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বের পাশপাশি ধর্মীয় নেতৃত্বেরও অধিকারী ছিলেন। মক্কার কোন স্বিদ্ধান্তই তাকে বাদ দিয়ে গৃহিত হবার কোনরকম সুযোগ ছিল না। চাইলেও তাকে এড়ানো যেতো না।

কুসাইয়ের মৃত্যুর পরে তার চার পুত্রের মধ্যে কাবার রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যান্য দায়িত্ব পালনের অধিকার ও সুযোগ নিয়ে বিবাদ বেধে যায় এবং তা দীর্ঘদিন বজায় ছিল। তার এক পুত্রের নাম মুগিরা ইবনে কুসাই ওরফে আব্দে মানাফ। 

আসল নাম মুগিরা হলেও মা হুব্বা মানাত মুর্তির অনুরক্ত হওয়ায় তার নাম আবদে মানাত আর বাবা কুসাই মানাফ মুর্তির অনুরক্ত হওয়ায় ছেলের নাম রাখেন আব্দে মানাফ। সন্তানের নাম নিয়ে বাবা মায়ের টানাটানির মধ্যেই তার আসল নাম মুগিরাটা চাপা পড়ে ‘আব্দে মানাফ’ই প্রচলিত হয়ে যায়। দেখতে অত্যন্ত্র সুশ্রী ও সুন্দর ছিলেন বলে তাকে চাঁদের সাথে তুলনা করে ‘কামারুল বাতহা’ বা বাতহা উপত্যকার চাঁদ বলে ডাকা হতো।

এই আব্দে মানাফের পুত্র আ’মর, তথা, হাশিম ছিলেন অত্যন্ত স্বজ্জন ও প্রজাহিতৈষী ব্যক্তি। হাজীদের সেবা প্রদানে তার কোন জুড়ি ছিল না। হাশিমই হলেন সেই ব্যক্তি যিনি কুরাইশদের জন্য শীত ও গ্রীষ্ম, দুই মওসুমে আবিসিনিয়া, ইয়েমেন ও সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন অভিমূখে নিয়মিত বাণিজ্য কাফেলা পাঠানোর প্রথা চালু করেন। পিতামহ কুসাইয়ের মতোই হাশিমও অত্যন্ত চৌকষ কুটনীতিবীদ ছিলেন। 

দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমে আবিসিনিয়া এবং ইয়েমেন এবং উত্তরের শাম সিরিয়া এসব স্থানগুলো তৎকালিন বৈশ্বিক সুপার পাওয়ার বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অধিনে ছিল। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য ও তার সীমান্ত সংলগ্ন পুর্বদিকের পারস্যের সাসানাইড  সাম্রাজ্যের মধ্যে আঞ্চলিক রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা’সহ নানাবিধ বৈরিতা ছিল এক ঐতিহাসিক সত্য এবং দীর্ঘদিন উভয় সাম্রাজ্যের মধ্যে তা চলেও এসেছে। এমনকি, উভয় সাম্রাজ্য বহুবার সামরিক সংঘাতেও জড়িয়েছে।

আরবরা যেন সাসানাইড পারসিকদের সাথে মৈত্রিতা স্থাপন করে বাইজান্টাইন সা¤্রাজ্যের মাথাব্যথার কারণ না হয়, পারসিকরা যেন আরবদের কাছে টানতে না পারে, সম্ভবত সেরকম ভূ-রাজনৈতিক, সামরিক ও কুটনৈতিক কারণে বাইজান্টাইন সম্রাট আরবদের সাথে মৈত্রিতা সুদৃড় করার অংশ হিসেবে কুরাইশ গোত্রপ্রধান হাশিমের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে। আর তা ছাড়া এই বাজান্টাইন প্রভাবিত উত্তর আরবের নাবাতিয়ানরাই তো হাশিমের পিতা কুসাইকে মক্কার নিয়ন্ত্রণ দখল করতে সহায়তা করেছে এর আগেই। ফলে নাবাতিয়ান সংস্কৃতির ধারক বাহক কুসাইয়ের দৌহিত্র হাশিমকে বাইজান্টাইন সম্রাটের আনুকুল্য দেয়াটা আশ্চর্যজনক ছিল না।

পারস্পরিক সম্পর্কের ঠিক এরকম পটভূমিতেই হাশিম বাইজান্টাইন সম্রাটের নিকট থেকে ঐসব স্থানে (আবিসিনিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া ও ফিলিস্তিন) বিনাবাধা ও পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে বাণিজ্য করার সরকারি অনুমতি ও নিশ্চয়তাপত্র সংগ্রহ করেন।

এটা ছিল মক্কাবাসীর জন্য জীবনদায়ী ঘটনা। তাদের রুটি রুজীর নিশ্চয়তা প্রদানকারী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্জন। একইসাথে হাশিম ও তার কুরাইশ বংশের জন্যও তা ছিল অত্যন্ত যুগান্তকারী কৃতিত্ব। বলা চলে, নির্ভয়ে অবাধ বাণিজ্য করার এই সুযোগ ও নিরাপত্তার এই গ্যারান্টিও কুরাইশিদের বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকে পড়ার অন্যতম একটা কারণ। আরবদের চোখে কুরাইশরা উঠে আসে তাদের অস্তিত্ত রক্ষার নায়কের ভূমিকায়। (সংক্ষেপকৃত)
--------------------------------- 
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments