Recent Tube

মূর্খতায় গর্বিত শিক্ষার প্রাঙ্গণ। জাহিদ হায়দার কবি

মূর্খতায় গর্বিত শিক্ষার প্রাঙ্গণ, ;

 বিজয় দিবসে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষকেরা বিকৃত জাতীয় পতাকা প্রদর্শন করায় ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। বিজয় দিবসে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষকেরা বিকৃত জাতীয় পতাকা প্রদর্শন করায় ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়।
বেগম রোকেয়া ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক বিজয় দিবস উদ্‌যাপন উপলক্ষে যা করেছেন, নিচের এক থেকে ছয় পর্যন্ত বিষয়গুলোর সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক থাকতে পারে। 

১. কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগ থেকে পাস করা একজন ছাত্র আমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘কাঁদিবার’ বানানে ‘ক’-এর ওপরে চন্দ্রবিন্দু লাগে কি না। 

২. সাল ২০০৫। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের একজন ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘রুশোর দ্য সোশ্যাল কন্টাক্ট’ এবং মেকিয়াভেলির ‘দ্য প্রিন্স’ পড়েছেন কি না। ছাত্রীটি বললেন, ‘স্যার তো পড়তে বলেননি।’ 

 ৩. সাল ১৯৯৫। কবি সমুদ্র গুপ্ত একজন চাকরিপ্রার্থীর সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন। প্রার্থীকে সমুদ্র দা বললেন, ‘আমরা তো বাংলা বলছি, আপনি কথার মধ্যে অনেক ইংরেজি শব্দ বলছেন কেন?’ তরুণের উত্তর ছিল, ‘এসে যায়।’ সমুদ্র দা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি তো বিএ পাস। এমএ পড়ছেন। বিএ মানে কী?’ তরুণ হেসে উত্তর দেন, ‘ব্যাচেলর অব আর্টস।’ সমুদ্র জানতে চান, ‘বাংলা কী?’ তরুণ ঘাড় নাচিয়ে উত্তর দেন, ‘অবিবাহিত কলা।’ ঘাড় নাড়ার কারণে তাঁর টাই দুলে উঠেছিল। 

৪. সাল ১৯৯৭। চাকরিপ্রার্থী এক তরুণের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম। বিএ পাস করা তরুণের নাম শামসুল ইসলাম নিউটন। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, ‘বিজ্ঞানী নিউটন সম্পর্কে কিছু বলুন।’ তরুণ (তাঁরও টাই পরা ছিল) হেসে বললেন, ‘নিউটন এখন নিউইয়র্কে থাকেন।’ তাঁকে বললাম, ‘আপনি এখন আসুন।’ দরজার কাছে গিয়ে তরুণ ফিরে এলেন, ‘সরি স্যার, দুবছর আগে তিনি মারা গেছেন।’

৫. সাল ২০০৯। আমার ছোট ভাইয়ের ছেলে, ছাত্র সপ্তম শ্রেণির, আমার কাছে এসেছিল ইংরেজি শিখতে। তাকে তার ইংরেজি বই থেকে একটি শব্দের বাংলা কী জিজ্ঞেস করলে সে মোবাইল খুলে অর্থ বলল। ১৫ মিনিট পর আমি তাকে ওই শব্দটির অর্থ আবার জিজ্ঞেস করলাম। সে আবার মোবাইলে হাত দিল। বললাম, ‘মোবাইল খুলছ কেন, মাথায় নেই?’ শিশু বলল, ‘ক্লাসে আমার ম্যাম তো মোবাইল খুলেই ইংরেজি শব্দের অর্থ বলেন।’ ভাইয়ের ছেলের হাতে অভিধান দিয়ে শব্দটির বাংলা কী দেখতে বললাম। সে জানে না, কীভাবে অভিধান দেখতে হয়।

১৯৬৫ সালে আমি সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। বাংলা ও ইংরেজির শিক্ষক আমাদের শিখিয়েছিলেন, কীভাবে অভিধান দেখতে হয়। (মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী স্কুল পর্বে এই অতি জরুরি শিক্ষা কার্যক্রমটি শুরু করুন।)

৬. সাল ২০১৬। আমার একজন আত্মীয় গাজীপুরের একটি কলেজের বাংলার অধ্যাপক। তাঁর বাসায় গিয়ে দেখলাম, তিনি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার বাংলা খাতা দেখছেন। শতকরা ৭০ ভাগ ছাত্রছাত্রী রবীন্দ্রনাথ নামের বানান লিখেছে: ‘রবিন্দ্রনাথ’। এবং আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নাম লিখেছে: ‘কাজি নরজুল ইছলাম’।

সম্প্রতি এক জরিপ থেকে জানা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় জ্ঞানচর্চার অবস্থানে বাংলাদেশ ভুটানেরও নিচে।

বাংলাদেশের অস্তিত্বের শিকড়ের সঙ্গে জড়িত তিনটি দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি: শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৬ মার্চ: স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর: বিজয় দিবস।

দেখা গেছে, টিভির সাংবাদিকেরা যদি ১০ জন তরুণ–তরুণীকে ওই তিনটি দিবস ‘কী, কেন’ জিজ্ঞেস করেন, উত্তরদাতাদের মধ্যে ৮ জন সঠিক বিষয় জানে না এবং লজ্জাহীনভাবে হাসে। ভুল উত্তর বলা তরুণ–তরুণীদের অপরাধ নয়। অপরাধ আমাদের, বিশেষ করে তাঁদের, যাঁরা শিক্ষক।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন মহান শিক্ষক, মনে হচ্ছে, কখনো বাংলাদেশের পতাকা দেখেননি। তাঁরা বিজয় দিবস পালনের নামে আমাদের যে পতাকা দেখালেন, তা থেকে আমরা নতুন জ্ঞান অর্জন করলাম। আমাদের পতাকার সূর্য গোল নয়। চার কোনা। শিক্ষকদের মধ্যে কজন মূর্খতার আনন্দে হাসছেন এবং পতাকা ঝুলে পড়েছে তাঁদের পায়ের নিচে।

পতাকায় চার কোনা সূর্য দেখার পর একজন শিক্ষকের মাথায়ও এই চিন্তা এল না যে এতে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া পতাকা ও ‘বিজয় দিবস’ মাত্রাহীনভাবে অপমানিত হবে।

রবীন্দ্রনাথ বুঝেই মানুষের কাছে বলেননি, বলেছেন ঈশ্বরের কাছে ‘তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি’।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে কজন মহান শিক্ষক ‘বিজয় দিবস’ উদ্‌যাপন উপলক্ষে যে ব্যানারটি নিয়ে হাঁটছেন, ওই ব্যানারের ছবি দেখে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। বিজয় দিবসের ব্যানারে ছবি হবে শহীদ মিনারের এবং তার ওপর লিখতে হবে ‘বিজয় দিবস’। আশা করা যায়, এই শিক্ষক শিরোমণিকুল আগামী একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে ব্যানার তৈরি করবেন, তাতে ছবি হবে জাতীয় স্মৃতিসৌধের।

ব্যানারটির ভুল চোখে পড়ার পর তা সংশোধন করতে খুব বেশি হলে ৩০ মিনিট সময় লাগত। বোঝা গেছে, মাননীয় উপাচার্য এবং তাঁর সঙ্গের কোনো শিক্ষক জানেন না, বিজয় দিবসের ব্যানারে কোন ছবি ব্যবহার করতে হবে। সত্য যে, আমরা হয়তো অক্ষর চিনি, কিন্তু জাতিগতভাবে শিক্ষিত নই।

বেগম রোকেয়া ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদালয়ের যে শিক্ষকেরা ‘বিজয় দিবস’ উদ্‌যাপনের নামে যে গুরুতর অন্যায় করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি তাঁদের কৈফিয়ত নেবেন?

ওই শিক্ষকেরা কি প্রকাশ্যে জাতির কাছে ক্ষমা চাইবেন?

 -জাহিদ হায়দার কবি
 দৈনিক প্রথম আলো ৷

Post a Comment

0 Comments