Recent Tube

ইসলাম ও জিহাদ ১ম পর্ব শহীদ হাসানুল বান্না

  
                  ইসলাম জিহা 
                              ১ম পর্ব;

জিহাদ একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য : জিহাদ প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে ওয়াজিব। আল্লাহর দৃষ্টিতে জিহাদের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহর দীনের যারা মুজাহিদ এবং যারা তাঁরই সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নিজেদের প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে শাহাদাত বরণ করেন তাঁদের জন্যে রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে অফুরন্তু পুরস্কার। তিনি তাদেরকে এমন সম্মান-সম্ভ্রম ও মর্যাদা দান করেছেন, যা আর কাউকে দান করেননি। শহীদানের পূত-পবিত্র রক্ত আল্লাহর হুজুরে বিজয় ও সাহায্যের নিদর্শন বই আর কিছু নয় এবং আল্লাহর দরবারে তাঁদের উচ্চ মর্যাদা ও সম্মানের এটিই হচ্ছে মৌল মাপকাঠি। জিহাদ ফি সাবিলিল্লায় যারা পিছ পা হয় আল্লাহর কাছে রয়েছে তাদের জন্যে ভয়াবহ পরিণাম এবং তারা অপমানিত ও ঘৃণিত। আল্লাহ কঠোরভাবে নিন্দা করেছেন জিহাদের ভয়ে ভীত কাপুরুষ মুসলমানদেরকে। দুনিয়াতে তাদের জন্যে রয়েছে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অপমান, আর আখেরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। এমনকি সোনার পাহাড়ের বিনিময়েও তারা এ শাস্তি থেকে রেহাই পাবে না। জিহাদ না করা আল্লাহর দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ। কোনো জাতি না করা আল্লাহর দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ। কোনো জাতি বা সম্প্রদায়ের জন্যে জিহাদ পরিত্যাগ করা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার শামিল।

সত্য ও ন্যায়ের জন্যে সংগ্রাম, প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ এবং পারস্পরিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের ওপর ইসলাম সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। দুনিয়ার অন্য কোনো ধর্ম বা মতবাদ এসব বিষয়ের ওপর এত বেশী জোর দেয়নি। এমনতর বিধি-ব্যবস্থা অতীতে বা বর্তমানে কোনো রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন বা ধর্মে অনুসন্ধান করলে পাওয়া যাবে না। আল্লাহর কুরআন ও রাসূল (সা) এর হাদীস জিহাদের শিক্ষায় ভরপুর। ইসলাম আমাদেরকে জিহাদের আহ্বান জানায়, মুজাহিদ জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ করে এবং জিহাদের জন্যে প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ ও অস্ত্র-শস্ত্র সংগ্রহের নির্দেশ দান করে।

বক্ষ্যমান প্রবন্ধে আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) জিহাদ সম্পর্কে যে সমস্ত মূল্যবান হেদায়াত দিয়েছেন তা সংক্ষেপে আলোচনা করবো। এ প্রসঙ্গে উল্লেখিত কুরআনুল কারীমের পবিত্র আয়াত ও হুজুর (সা) এর হাদীসমসূহের বিস্তারিত ব্যাখ্যাদান আমাদের উদ্দেশ্যে নয়। কারণ এ সম্পর্কিত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণী অত্যন্ত সুস্পষ্ট, যুক্তিযুক্ত ও আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ এবং তাতে কোনো ব্যাখ্যার অবকাশ নেই।

আল্লাহর পথে জিহাদ :

সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ তা’আলারই জন্যে, আল্লাহর অশেষ রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক তাঁর প্রিয় নবী, সরদারে মুজাহিদীন, ইমামুল মুত্তাকীন হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা) এবং তাঁর আহলে বায়েত ও সম্মানিত সাহাবীগণের ওপর।
অধ্যায় ০১ : আল কুরআন থেকে জিহাদ প্রসঙ্গে কয়েকটি আয়াত 
এক: “যুদ্ধ তোমাদের জন্যে ফরয করা হলো, যদি তোমরা তা অপছন্দ কর। (বস্তুত) এমন অনেক বিষয়কে তোমরা পছন্দ কর না অথচ তা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর এবং এমন অনেক কিছু তোমরা শ্রেয় মনে কর অথচ আসলেই তা তোমাদের জন্যে ক্ষতিকর। (এর কারণ এই যে) আল্লাহই জানেন এবং তোমরা জান না”। (সূরা আল বাকারা : ২১৬)

দুই: “হে ঈমানদারগণ, কাফেরদের ন্যায় কথাবার্তা বলো না, যাদের নিকটাত্মীয়রা যদি কখনও বিদেশে যায় বা যুদ্ধে শরীক হয় (এবং সেখানে কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়) তখন তারা বলে যে, তারা আমাদের কাছে থাকলে মারা যেত না বা নিহত হতো না। আল্লাহ এ ধরণের কথাবার্তা তাদের মনে দু:খ ও চিন্তার কারণ বানিয়ে দেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর পথে মারা যাও অথবা নিহত হও, তাহলে আল্লাহর যে রহমত ও মাগফেরাত তোমরা পাবে, তা এ ধরনের লোকেরা যা কিছুই সংগ্রহ-সঞ্চয় করেছ তার চেয়ে অনেক উত্তম। আর তোমরা মৃত্যুবরণ করো বা নিহত হও, সকল অবস্থায়ই তোমাদের সবাইকে আল্লাহর নিকট সমবেত হতে হবে”। (সূরা আলে ইমরান : ১৫৬-১৫৮)

এখন চিন্তা করা উচিত প্রথম আয়াতে আল্লাহর রাহে মৃত্যু বা হত্যার মোকাবেলায় তাঁর অপার করুণা ও ক্ষমার কথা বলা হয়েছে কিন্তু দ্বিতীয় আয়াতে তা বলা হয়নি এতে জিহাদের উল্লেখ নেই।

তিন: “যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদেরকে মৃত মনে করো না, প্রকৃতপক্ষে তারা জীবিত। তারা তাদের প্রভুর নিকট রিযিক পাচ্ছে। আল্লাহ তাদেরকে নিজ অনুগ্রহে যা কিছু দান করেছেন তা নিয়ে তারা খুশী ও পরিতৃপ্ত। এবং যেসব ঈমানদার লোক তাদের পেছনে দুনিয়ায় রয়ে গেছে এবং এখনো তাদের সাথে এসে মিলিত হয়নি তাদের জন্যে কোনো ভয় ও চিন্তা নেই”। (সূরা আলে ইমরান : ১৬৮-১৭০)

এ সূরার ১৭১ থেকে ১৭৫ পর্যন্ত আয়াতসমূহে অনুরূপ কথা বলা হয়েছে, কুরআনে হাকীম খুললে তা দেখা যাবে।

চার : “যারা দুনিয়ার জীবনের বিনিময়ে আখেরাতকে খরিত করে, তাদের উচিত আল্লাহর রাহে লড়াই করা। যে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবে, সে তাতে নিহত হোক বা বিজয়ী হোক, তাকে আমরা অবশ্যই বিরাট প্রতিদান দেব।” (সূরা আন নিসা : ৭৪)

এ সূরার ৭১-৭৮ পর্যন্ত আয়াতসমূহে একই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আল কুরআনের সূরা নিসা একবার পড়ে দেখুন। তাতে দেখবেন আল্লাহ তা’আলা মুসলমানদেরকে কিভাবে সদা হুশিয়ার থাকার জন্যে বলেছেন এবং কখনো বা পূর্ণ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে জামায়াতবদ্ধভাবে বা একাকী জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে ডাক দিয়েছেন, আপনি বুঝতে পারবেন আল্লাহ তা’আলা কি ভাষায় জিহাদের কর্তব্য পালনে অবহেলাকারী মুসলমানদেরকে তাদের নিষ্ক্রিয়তা, কাপুরুষতা ও স্বার্থপরতা জন্যে ধমক দিয়েছেন। দুর্বলের সাহায্য ও মজলুমের প্রতিরক্ষার জন্যে আল্লাহ কি করতে চান তাও এসব আয়াত থেকে বুঝা যাবে। সূরা আন নিসার আয়াতসমূহে আল্লাহ নামায-রোযার সাথে জিহাদেও যোগ করেছেন এবং জিহাদ যে ইসলামী জীবন ব্যবস্থারূপী ইমারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি, তাও তিনি বুঝিয়ে বলেছেন। শুধু তাই নয়, দুর্বল মুসলমানদে মনের দোদুল্যমানতা, তাদের সন্দেহ-সংশয় দূর করে আল্লাহ তাদের মনে সাহস ও বীরত্বের সঞ্চার করেছেন। এ সূরার মহান আয়াতগুলো মুসলমানদের মন এমন মৃত্যুঞ্জয়ী মনোভাব সৃষ্টি করে যারা ভিত্তিতে তারা প্রভুর নিকট থেকে নিশ্চিত প্রতিদানের আশায় মৃত্যুর মোকাবেলায় দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যায়। তাদের মনে এ দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে, ত্যাগ-কুরবানী তা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, মহান প্রতিপালক তার উপযুক্ত প্রতিদান থেকে কাউকে বঞ্চিত করবেন না।

পাঁচ: সূরা আনফাল পুরোটাই জিহাদের দাওয়াত ও যুদ্ধের আহ্বানে ভরপুর। এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুসলমানদেরকে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এবং জিহাদের বিস্তারিত বিধি-বিধান সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এজন্যে রাসূলে কারীম (সা) এর সংগী-সাথীরা এ সূরাকে যুদ্ধ-সংগীত হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মরণপণ জিহাদ যখন শুরু হয়ে যেত, অস্ত্রের ঝনঝনায় যখন দশদিন মুখরিত হতো তখন ইসলামের মুজাহিদরা এ সূরার মর্মস্পর্শী ভাষায় তেলাওয়াত করতেন আর আল্লাহর রাহে প্রাণ বিলিয়ে দোয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে যেতেন। উদাহরণ স্বরূপ পড়ুন, “আর তোমরা যতদূর সম্ভব হাতিয়ার প্রস্তুত কর এবং সদাসজ্জিত ঘোড়া তাদের মোকাবেলার জন্যে প্রস্তুত রেখো যেন এর সাহায্যে আল্লাহ বিরোধী ও তোমাদের জানা না-জানা দুশমনের ভীত-শঙ্কিত করতে পারে। আল্লাহ এদের জানেন।–(সূরা আল আনফাল)

আরো ইরশাদ হচ্ছে:

“হে নবী! মুমিনদেরকে শত্রু দমনের উদ্দেশ্যে সশস্ত্র অভিযানে উৎসাহিত করুন। তোমাদের মধ্যে যারা দৃঢ়-চিত্ত ও ধৈর্যশীল হবে, তারা বিশজন হলে দুশমনদের দু’শজনকে পরাজিত করবে এবং একশজন হলে এক হাজার কাফেরকে পরাভূত করবে। কারণ তারা অজ্ঞান”।

ছয়: সূরা আত তাওবাও একটি যুদ্ধের দাওয়াত। এ সূরা পড়লে মনে হয় যেন একটি রণভেরী। এতে যুদ্ধের নিয়ম-কানুনও রয়েছে। লক্ষ্য করুন আল্লাহ কিভাবে চুক্তি ভঙ্গকারী মুশরিকদের প্রতি লা’নত বর্ষণ করেছেন-

“তাদের বিরুদ্ধে লড়ে যাও। আল্লাহ তোমাদের হাতেই তাদের শাস্তি দেবেন এবং তাদেরকে লাঞ্চিত ও অপামানিত করবেন। তাদের মোকাবেলায় তোমাদের সাহায্য দান করবেন এবং মুমিনদের বুক ঠান্ডা করবেন।” (সূরা আত তাওবা)

এবার আহলে কিতাব (ইহুদী ও খ্রীষ্টান)-দের সম্পর্কে আল্লাহ কি বলেছেন তা লক্ষ্য করুন:

“আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী নয় এবং আল্লাহ ও তার রাসূল যেসব বস্তুতে হারাম ঘোষণা করেছেন, সেগুলোকে হারাম মনে করে না আর মেনে নেয় না দীনে হককে, তোমরা সেসব কিতাবধারীদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাক, যতক্ষণ না তারা অধীনতা ও বশ্যতা স্বীকার করে নিজেদের হাতে জিজিয়া দানে স্বীকৃত হবে”। -(সূরা আত তাওবা)

পরের কয়েকটি আয়াতে কারীমায় সামগ্রিক বিপ্লবের নির্দেশ দেখা যায় । এ নির্দেশ আপনার কাছে মনে হবে যেন মেঘমালার গর্জন আর বিজলীর চোখ ঝলসানো চমক। শেষের দিকে রয়েছে এ আয়াতটি-

“বের হয়ে যাও (জিহাদের উদ্দেশ্যে) অস্ত্র-শস্ত্র হালকা হোক বা ভারী হোক এবং আল্লাহর পথে তোমাদের জান-মাল লাগিয়ে দিয়ে জিহাদ কর”। -(সূরা আত তাওবা)

এরপরে দেখুন যারা জিহাদের সময়ে ঘরে বসে থাকে তাদের সম্পর্কে কালামে ইলাহীতে কি বলা হয়েছে-

“রাসূলের যুদ্ধে চলে যাওয়ার পর যারা জিহাদ থেকে বিরত থেকে ঘরে বসে থাকলো এবং আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ ব্যয় করে ও প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে জিহাদ করা অপছন্দ করলো-বললো, তোমরা এ তীব্র গরমে বের হয়ো না, এর খুবই উৎফুল্ল হয়ে পড়েছে। হে নবী, তুমি বলে দাও যে, জাহান্নামের আগুন এর চেয়েও বেশী গরম-যদি তাদের বোধশক্তি কিছু থেকে থাকে”। -(সূরা আত তাওবা)

পরের প্রসঙ্গে রাসূলে (সা) ও তাঁর সাথী মুজাহিদীন-ই-ইসলাম, “কিন্তু রাসূল (সা) ও তাঁর সাথে যারা ছিলেন তাঁরা জান-মাল দিয়ে জিহাদ করেছেন। এবং তা-ই তাদের জন্যে কল্যাণকর এবং এরাই বিজয়ী। আল্লাহ তাদের জন্যে তৈরী করে রেখেছেন বেহশেত –যার নীচ দিয়ে প্রবহমান রয়েছে নহরাজি এবং সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে”।

আরও দেখুন-

“নিশ্চয়ই আল্লাহ খরিদ করে দিয়েছেন মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জান-প্রাণ এ ধন-মালকে, এর বিনিময়ে তাদের জান্নাত দেবেন বলে। মুমিনরা আল্লাহর পথে আল্লাহরই সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করে। আর এ যুদ্ধে তারা যেমন আল্লাহরই দুশমনদের হত্যা করবে, তেমনি তারা নিজেরাও নিহত হবে শত্রুর হাতে। এটি হচ্ছে আল্লাহর চেয়ে বেশী ওয়াদা, তাওরাত, ইনজিল ও কুরআন। এবং আল্লাহর চেয়ে বেশী ওয়াদা রক্ষাকারী আর কে আছে? অতএব তুমি যা খরিদ করেছ তাতেই সন্তুষ্ট থাক এবং এটাই তোমরা জন্যে শ্রেষ্ঠ বিজয়”। -(সূরা আত তাওবা)

সাত: কুরআন মজীদের একটি সূরারই নামকরণ করা হয়েছে সূরা কিতাল, যার অপর নাম হচ্ছে সূরা মুহাম্মদ। সৈনিক জীবনের প্রাণ হলো দু’টি জিনিস-আনুগত্য ও শৃঙ্খলা। আল্লা তা’আলা পাক কুরআনের দু’টি আয়াতে এ দু’টি জিনিস সন্নিবেশিত করছেন। আনুগত্য প্রসঙ্গে এ সূরাতেই আল্লাহ বলেন:

“যারা ঈমানদার তারা বলে কোনো আয়াত কেন নাযিল হলো না? এরপরে যখন কোনো সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ় আয়াত নাযিল হয় এবং তাতে জিহাদের উল্লেখ থাকে, তখন তুমি দেখাবে যাদের অন্তকরণ রোগগ্রস্ত। তারা মৃত্যুর ভয়ে বিবর্ণ হয়ে তোমরা দিকে তাকাচ্ছে। অতএব তাদের আনুগত্যের পরীক্ষা হয়ে গেল এবং কথাও জানা গেল”।

সূরা আস সফ-এ শৃঙ্খলা প্রসংগে দেখুন-

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন যারা সারিবদ্ধভাবে সীসা নির্মিত দেয়ালের ন্যায় মজবুতভাবে আল্লাহর পথে শত্রু দমনে সশস্ত্র অভিযান করে, যুদ্ধ করে”।

আট: সূরা ফাতাহ-এ একটি যুদ্ধের বর্ণনা রয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে আল্লাহ মুমিনদের উপর সন্তুষ্ট হলেন যখন তারা একটি গাছের নীচে তোমার [মুহাম্মদ (সা)] হাতে বাইয়াত গ্রহণ করছিল। তারা জেনে নিয়েছিল যা তাদের অন্তরে ছিল। অতপর তিনি তাদের ওপর শাস্তি ও স্বস্তি নাযিল করেন। অচিরেই তারা বিজয়ী হয় এবং গণিমতের মাল তাদের হস্তগত হয় এবং আল্লাহ জবরদস্ত ও প্রজ্ঞার অধিকারী।

কুরআনে হাকীমের এ সমস্ত আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে আজকের যুগের মুসলমানদের চিন্তা করা উচিত তারা জিহাদের সওয়াব থেকে কত দূরে আছে।

এ প্রসঙ্গে হাদীসে রাসূল থেকে কিছু আলোচনা করা যায়। 
অধ্যায় ০২ : জিহাদ প্রসঙ্গে হাদীসে রাসূল (সা) 
এক: হযরত আবূ হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, জিহাদ সম্পর্কিত একটি দীর্ঘ হাদীসের শেষাংশে প্রিয় নবী করীম (সা) বলেন, “সেই আল্লাহর শপথ যাঁর হাতে আমার জীবন, আমর মন তো চায় আল্লাহর পথে আমি শহীদ হই, আবর জীবিত হই, আবার শহীদ হই, আবার জীবিত হই এবং আবার শহীদ হই”।

-(বুখারী, মুসলিম)

দুই: হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন-যাঁর হাতে আমার জীবন সে সর্বশক্তিমানের শপথ। যে ব্যক্তিই আল্লাহর পথে জখম হয়, আল্লাহ তাকে ভালবাভাবেই জানেন। কিয়ামতের দিন সে রক্তের রং ও মিশকের সুগন্ধি নিয়ে আগমন করবে।

তিন: হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমার চাচা আনাস বিন নযর বদরের যুদ্ধে শরীক হতে পারেননি। রাসূলুল্লাহ (সা) এর দরবারে তিনি আরজ করেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা) মুশরিকদের বিরুদ্ধে আপনার প্রথম যুদ্ধে আমি অনুপস্থিত ছিলাম। আল্লাহর শপথ, যদি আমাকে মুশরিকদের বিরুদ্ধে আসন্ন জিহাদে শরীক হওয়ার সুযোগ দেন, তাহলে আপনি দেখতে পাবেন, আমি কি করি। সুতরাং যখন ওহুদের যুদ্ধে মুসলমানেরা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, তখন তিনি হঠাৎ চিৎকার করে বললেন, হে আল্লাহ! আমার সাথীরা যাকিছু করেছেন, আমি সে জন্যে তোমার কাছে মাফ চাইছি এবং মুশরিকগণ যা কিছু করছে আমি তা থেকে পবিত্র। অতপর তিনি সামনে এগিয়ে যেতেই সাদ বিন মায়াজকে দেখলেন এবং চিৎকার করে ওঠলেন, হে সাদ বিন মায়াজ। জান্নাত। জান্নাত। আমার প্রভুর শপথ। আমি তার খোশবু পাচ্ছি। ওহুদের দিক থেকেই আসছে। হযরত সাদ আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, তিনি না করলেন তা আমি পারালাম না। হযরত আনাস বলেন, পরে আমরা তাঁর শরীরে তলোয়ার, তীর ও বল্লমের আশিটি আঘাত দেখেছি। আমরা তাকে শহীদ অবস্থায় পেয়েছি। মুশরিকেরা তার অঙ্গ-প্রতঙ্গ কেটে ফেলেছিল, এজন্যে কেউ তাঁকে চিনতে পারেনি। তাঁর বোন আঙ্গুল দেখে তাকে চিনেছেন। হযরত আনাস বলেন- আমরা মনে করতাম এঁদের মত লোকদের জন্যেই “এরূপ কত মুমিন রয়েছেন যাঁরা আল্লাহর সাথে ওয়াদা পূরণ করেছেন” এ আয়াতটি নাযিল করেছেন।

চার: হযরত উষ্মে হারেসা বিনতে সারাকা থেকে বর্ণিত, “তিনি হুজুর (সা) এর দরবারে এসে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি কি হারেসা সম্পর্কে কিছু বলবেন না? জঙ্গে বদরের পূর্বে একটি অজ্ঞাত তীর এসে তাঁর শরীরে বিঁধে যায় এবং তিনি শহীদ হন। যদি তিন জান্নাতবাসী হয়ে থাকেন তাহলে আমি সবর করবো, অন্যথায় প্রাণ ভরে কাঁদব। হুজুর (সা) জবাব দিলেন, হারেসার মা! বেহেশতে তো অনেক বেহেশতবাসীই রয়েছেন তোমরা ছেলে তো সেরা ফেরদাউসে রয়েছেন।” (বুখারী)

চিন্তা করে দেখুন জান্নাতের চিন্তা কিভাবে তাঁদেরকে প্রাণ প্রিয় পুত্রের শোক পর্যন্ত ভুলিয়ে দেয়।

পাঁচ: হযরত আবদুল্লাহ বিন আবি আওফা (রা) থেকে বর্ণিত, “আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, জেনে রেখো বেহেশত তরবারির ছায়াতলে”। (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ)

ছয়: হযরত জায়দ বিন কালিদ জুহানী থেকে বর্নিত, “রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, যে ব্যক্তি কাউকে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর জন্যে তৈরী করেছে, সে যেন নিজেই জিহাদ করলো এবং যে আল্লাহর পথে বের হয়েছে এমন কোনো গাজীর পরিবারের সাথে ভাল ব্যবহার করেছে সে যেন স্বয়ং জিহাদে শরীক হলো”।

-(বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ ও তিরমিযী)

সাত: “হযরত আবু হুরাইয়া (রা) থেকে বর্ণিত, “হুজুরে পাক (সা) এরশাদ করেছেন,যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সহকারে জিহাদে কোনো ঘোড়া দান করে, কিয়ামতের দিন উক্ত ঘোড়ার খাদ্য, পানীয় এবং গোবরও তাঁর মিজানে থাকবে”-(বুখারী)
আট: হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, অপর একটি দীর্ঘ হাদীসের শেষাংশে রাসূলে কারীম (সা) বলেন, “আল্লাহর রাহে মুজাহিদের উদাহরণ সেই ব্যক্তির ন্যায়, যে রোযাও রাখে, রাতে নামাযও পড়ে এবং কালামে পাক তেলাওয়াত করে। কিন্তু রোযার সে কাতর হয় না, নামাযেও তার শৈথিল্য আসে না। ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহর পথে জিহাদকারীর অবস্থাও অনুরূপ থাকে”।
_(বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী, ইবনে মাজা ও তিরমিযী)

নয়: হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত, “রাসূল (সা) বলেন, আমি কি তোমাদেরকে ভাল লোক আর কে মন্দ লোক তা জানিয়ে দেব না? সে ব্যক্তি ভাল লোকদের মধ্যে অন্যতম, যে ব্যক্তি ঘোড়া বা উটে সওয়াব হয়ে বা পায়ে হেটে সকল অবস্থাতেই মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর রাহে কর্মতৎপর থাকে। অপরদিকে সে ব্যক্তি মন্দ লোকদের অন্যতম, যে আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করে অথচ তা থেকে কোনো নসিহত কবুল করে না”। -(নাসায়ী)

দশ: হযরত হযরত ইবেন আব্বাস (রা) বলেন, “আমি আল্লাহর রাসূল (সা) কে বলতে শুনেছি, দু’প্রকারের চক্ষুকে আগুন স্পর্শ করে না, প্রথম সে চক্ষু যা আল্লাহর ভয়ে কাঁদে, দ্বিতীয়টি হলো সে চক্ষু যা শত্রুর প্রতীক্ষায় আল্লাহর পথে পাহারাদারী করে রাত কাটিয়েছে।“-তিরমিযী)

এগার: হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, “নবী করীম (সা) বলেছেন, সারা দুনিয়ার মানুষ আমার হয়ে যাওয়ার চেয়ে আল্লাহর রাস্তায় মৃত্যুবরণ করা আমার কাছে অধিক প্রিয়”। -(নাসায়ী)

বার: হযরত রাশেদ বিন সা’দ জনৈক সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন, কোনো এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা) কবরে সকল মুমিনের পরীক্ষা হবে, কিন্তু শহীদের হবে না, এর কারণ কি? হুজুর (সা) জবাবে বলেন, তার মাথার ওপর তলোয়ার চমকানোই তার পরীক্ষার জন্যে যথেষ্ট”। -(নাসায়ী)

তের: হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, মওতের ছোঁয়া একজন শহীদের কাছে তেমন, যেমনটি তোমাদেরকে কেউ চিমটি কাটলে অনুভব কর”।
-(তিরমিযী, নাসায়ী, দারেমী)

চৌদ্দ: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত আছে, “রাসূলে করীম (সা) বলেন, আমাদের মহান আল্লাহ যে ব্যক্তির ওপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট, যে আল্লাহর রাহে জিহাদ করে এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীরা পরাজয় বরণ করলেও জিন দায়িত্ব উপলদ্ধি করে ফিরে দাঁড়ায় এবং আমৃত্যু লড়াই করে। তখন আল্লাহ ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা আমার এ বান্দার দিকে লক্ষ্য কর, আমার পুরস্কারের আশায় এবং শাস্তির ভয়ে সে পুনরায় জিহাদে লিপ্ত হয়েছে শেষ পর্যন্ত নিজের জান দিয়েছে। তোমরা সাক্ষী থাক, আমি তাকে মাফ করে দিলাম”। -(আবু দাউদ)

পনর: আবু দাউদ শরীফে হযরত আবুল খায়ের বিন সাবেত বিন কয়েস বিন সাষ্মাস তাঁর পিতা থেকে এবং তিনি তাঁর দাদা থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে দেখা যায় আহলে কিতাবের বিরুদ্ধে জিহাদে নিহত হলে, নিহত মুসলমান দু’জন শহীদের সাওয়াব পাবে।
এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় আহলে কিতাবদের সাথে জিহাদ করা অবশ্য কর্তব্য। জিহাদ কেবল মুশরিকদের বিরুদ্ধে নয় বরং যারাই ইসলামের দুশমন তাদের সকলের বিরুদ্ধেই জিহাদ করতে হবে। আর আহলে কিতাবদের বিরুদ্ধে জিহাদ করলে আল্লাহর নিকট তাঁর জন্যে দ্বিগুণ পুরুস্কার থাকবে।

ঘোল: হযরত সহল বিন হানিফ থেকে বর্ণিত আছে। “রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি খালেস অন্তকরণে আল্লাহর কাছে শাহাদাতের বাসনা করে, সে ব্যক্তি বিছানায় মারা গেলেও আল্লাহ তাকে শহীদের মর্যাদা দেবেন”। -(মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনে মাযাহ)

সতর: হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, “একজন সাহাবী কোনো এক স্থান অতিক্রম করছিলেন, সেখানে একটি নহর ছিল। তিনি নহরটি পছন্দ করলেন এবং মনে মনে চিন্তা করলেন, এ জায়গায় একাকবী বসে ইবাদাত করলে কতই না ভাল হতো। তিনি তাঁর ইচ্ছা নবী করীম (সা) এর কাছে ব্যক্ত করলেন। হুজুর (সা) বললেন, তা করবে না। তোমাদের পক্ষে ঘরে বসে সত্তর বছর নামাযে কাটানোর চেয়ে আল্লাহর পথে বের হওয়া অধিক উত্তম। তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দিন এবং বেহেশতে স্থান দান করুন। আল্লাহর পথে জিহাদ করা। যে ব্যক্তি কিছুক্ষণ সময়ের জন্যে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছে, তার জন্যে জান্নাত অবধারিত। -(তিরমিযী)

ঊনিশ: হযরত মিকদাদ বিন মাদকারব থেকে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহর নিকট শহীদের ছয়টি বৈশিষ্ট্য। প্রথম আক্রমণেই তাকে মাগফেরাত করা হয়, দুনিয়ায় থাকাকালীন অবস্থাতেই তাকে বেহেশতের ঠিকানা জানিয়ে দেয় হয়, কবর আযাব থেকে তার নাজাত হয়,কিয়ামতের ভয়াবহ আতংক থেকে সে নিরাপদ থাকবে, তাকে ইয়াকুত খচিত একটি সম্মানিত টুপি পরিধান করানো হবে, যা সারা দুনিয়া এবং দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু রয়েছে তার চেয়েও মূল্যবান হবে, মৃগ-নয়না হুরেরা তার স্ত্রী হবে এবং সে সত্তর জন আত্মীয়ের জন্যে শাফায়াত করবে”। -(তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)

বিশ: হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত আছে। “রাসূল (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি জিহাদের চিন্তা ব্যতিরেকে আল্লাহর সাথে দেখা করবে তার সে সাক্ষাত ত্রুটিপূর্ণ হবে”। -(তিরমিযী, ইবেন মাজাহ)

একুশ: হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত, “রাসূলে কারীম (সা) বলেন, যে ব্যক্তি খুলুছিয়াতের সাথে শাহাদাত কামনা করে, শহীদ না হলেও তাকে শহীদের মর্যাদা দেয়া হবে”। -(মুসলিম)

বাইশ: হযরত ওসমান বিন আফফান (রা) থেকে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাহে একরাতও কোনো ঘাঁটি পাহারা দেয়, তার জন্যে তার হাজার রাতের নামাযেরে সমান (সওয়াব) হবে”। -(ইবনে মাজাহ)

তেইশ: হযরত আবু দারদা (রা) থেকে বর্ণিত, “নবী করীম (সা) বলেছেন, একটি নৌযুদ্ধ দশটি স্থল যুদ্ধের সমান এবং যে নদীতে পড়ে গেল, সে যেন আল্লাহর রাহে খুনে সিক্ত হয়ে গোসল করে ওঠলো”। -(ইবনে মাজাহ)

চব্বিশ: হযরত জাবির বিন আবদুল্লাহ (রা) বলেন, “জঙ্গে ওহুদের দিন আবদুল্লাহ বিন আমর বিন হিশাম শহীদ হলে পর তাঁর ছেলে জাবিরকে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন যে, আল্লাহ জাবিরের পিতার সাথে একেবারে মুখোমুখী কথা বলেছেন। এ হাদীসের শেষাংসে বলা হয়েছে আবদুল্লাহ বিন আমরের প্রার্থনা অনুযায়ী আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করেন, “যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছেন তাদের তোমরা মৃত মনে করো না”।

পঁচিশ : হযরত আনাস (রা) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, “নবী করীম (সা) বলেছেন, আল্লাহর পথে কোনো জিহাদকারীকে বিদায় দেয়ার উদ্দেশ্যে সকাল বিকাল, কিছুদূর অগ্রসর হওয়া এবং তাকে সওয়ারীর পিঠে আরোহণে সাহায্য করা, আমার কাছে দুনিয়া ও তার মধ্যে যা কিছু রয়েছে, তার সবকিছু থেকে প্রিয়”। -(ইবনে মাজাহ)

চলবে............।

Post a Comment

0 Comments