Recent Tube

টুকটাক সংলাপ-৪; জিয়াউল হক।


              টুকটাক সংলাপ-৪;

---------------------------------------------------------

   চৈত্রের খরতাপে পুড়ে যাওয়া পুকুরের তলা দেখছেন নিশ্চয়ই! পুকুরের তলা পুড়ে যাওয়া মানে তাপের এতোটা উত্তাপ, তথা, অনাবৃষ্টি ও সেই সাথে রোদ্রের এতোটা তাপ যে দিনে দিনে পুকুরের সকল পানিটুকু বাস্প হয়ে উবে গেছে। এক ফোটা পানিও আর অবশিষ্ঠ নেই। এমনকি, মাটি পর্যন্ত শুকিয়ে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।
     এমন চিত্র নদীমাতৃক বাংলাদেশের সর্বত্রই দেখা যায় চৈত্র বেশাখ মাসে। কেবল পুকুরই নয়, আমরা তো নদী, এমনকি, আমার বাড়ির কাছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নীচে পদ্মার তলদেশ পর্যন্ত শুকিয়ে যেতে দেখি। এ চিত্র আমাদের কাছে খুবই পরিচিত, প্রত্যেক বাংলাদেশীর কাছেই এটা পরিচিত দৃশ্য। প্রতিবসরই তা আমরা দেখি। দেখি বটে, কিন্তু ভাবি কি?
এটাকে বহুভাবে ভাবা যায়। আবহাওয়াবীদ একরকম ভাবেন, শষ্য চাষে নিয়োজিত চাষী ভাবেন ভিন্ন আর এক রকম। বাড়ির গৃহিনী তাঁর গৃহস্থালী কাজকর্মের চিন্তায় চিন্তিত হয়ে ভাবেন আর এক রকম। নদী, সেচ প্রকল্প, পানির প্রবাহ নিয়ে সরকারী বা বেসরকারীভাবে যারা নানা কাজে কর্মে নিয়োজিত তারাও ভাবেন। তারা ভাবেন ভিন্ন আর একরকম।
সাংবাদিকরাও ভাবেন, কখন সেখানে গিয়ে ছবি তুলে এনে একটা সংবাদ করবেন, সেটা ভাবেন। ভাবনার এরকম নানারকম ধারা আর ধরনের মধ্যে আমি এক ভিন্নরকম ভাবনার কথা আজ বলবো। সময় ও সুযোগ থাকলে একটু ভেবে দেখতে পারেন বিষয়টি।
পুরো সমাজটাকে পুকুর বা নদীর এরকম তলদেশ হিসেবে কল্পনা করুন। এ সমাজকে এরকম ঐক্যবদ্ধ করে সমাজের নানা ধর্ম বর্ণ, লিঙ্গ, নানা মত ও পথের লোকজনের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহমর্মীতাবোধ। একে অপরের প্রতি ভালোবাসা আর ইতিবাচক দৃষ্টিভংগী। নিজ নিজ মত ও পথের বৈপরিত্য সত্তেও প্রত্যেক মানুষ যখন একে অপরকে তার মৌলিক মানবিক মর্যাদা, অধিকার প্রদান করে, এক অপরে প্রতি ঘোষিত বা অঘোষিত সামাজিক দায়িত্ববোধের ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল হয়ে তা পালন করে স্বতস্ফুর্তভাবে, তখন তাদের মধ্যে একটা ঐক্য গড়ে উঠে; সামাজিক ঐক্য।
এটাই হলো বৃহত্তর মানবিক ঐক্য ও সামাজিক সম্প্রীতি। এক মানুষ অপর এক মানুষের সাথে অন্য কোন সম্পর্কে না হলেও কেবলমাত্র ‘মানুষ’ এবং একই সমাজের সদস্য হিসেবে একই ভুখন্ড, ভাষা, জীবনাচার, বোধ-বিশ্বাস, কৃষ্টি-কালচার, শিক্ষা-সংস্কৃতি এরকম নানা কিছুকে ধারণ করার কারণেও তাদের মধ্যে ঐক্য ও বন্ধন গড়ে উঠার সুযোগ থাকে। এর প্রতিটিকেই কাজে লাগিয়ে সেরকম পরিবেশ তৈরি করে নিতে হয়।
অবশ্য এসবের মধ্যে বৈপরিত্যও থাকে। মানুষের গঠন প্রকৃতিতে (যেমন স্ত্রী বা পুরুষ), বয়সে (যেমন শিশু যুবা বা বৃদ্ধ), গায়ের রং বা বর্ণে (যেমন সাদা বা কালো কিংবা নিগ্রো), শারিরিক গঠনে (লম্বা বা খাটো), ভাষায়, বোধে বা বিশ্বাসে, নানাভাবে তাদের মধ্যে বৈপরিত্য থাকে।
     
     ইসলাম আমাদের জানান দিয়েছে, মানুষের মাধে বিদ্যমান এই বৈপরিত্যকে পারস্পরিক বিভেদ আর বিভাজনের জন্য নয়, বরং তাদের পারষ্পরিক পরিচিতি আরও সহজ ও গাঢ়ো করার জন্য, নিজেদের জীবন পরিচালনাকে সহজ ও সাবলীল করার জন্যই করা হয়েছে। এই সত্যটাকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধী করতে পারা তখনই সম্ভব যখন আমরা মানুষের স্রষ্টা আল্লাহকে চিনবো, জানবো।
এ জন্য বিদ্যমান বৈপরিত্যকে ইতিবাচক মানসে ধারণ করতে হয়, স্বিকার করতে হয়। প্রতেক্যের মধ্যে বিরাজমান এই ভিন্নতাকেই দেখতে হয় সৃষ্টির আদি রুপ ও আকৃতিতে, ইতিবাচক দৃষ্টিতে। একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা, তাকে মানুষ হিসেবে সম্মান দেয়া। তার আলাদা স্বকিয়তাকে সম্মান করা, বৃহত্তর সামাজিক ঐক্যের পূর্বশর্ত।
     এ ধরনের মানসিকতার অভাব হলে সমাজে মানুষে মানুষে সহমর্মীতা ধ্বসে পড়ে। ধ্বসে পড়ে ঐক্যও। তখন একটি সমাজ একের ভেতরেই শতধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। ঠিক ঐ পুকুরের শুকনো তলার মতো। প্রত্যেকেই তখন নিজেই একটা আলাদা ‘সমাজ’। এমন সমাজ কখনোই টিকে থাকে না, থাকতে পারেও না। সমাজ টিকে না থাকলে বা সমাজের স্থিতিশীলতা টিকে না থাকলে ঐ সমাজের কোন সদস্যই আর শান্তিতে কাল কাটাতে পারে না, তাদের সকলের জীবনই দু:সহ হয়ে উঠে।
এই কারণেই বলি, নিজের ব্যক্তিত্বে রুক্ষতা, অহংকার, দম্ভ আর গর্বের আগুন জ্বেলে রাখবেন না, কারণ সেই উত্তাপে আপনার নিকটজন তো বটেই, আপনার সংস্পর্শে যেই আসুক না কেন, তাদের হৃদয় থেকে মানবিক ঔদার্য, প্রেম, ভালোবাসা আর সহমর্মীতা উধাও হয়ে যাবে। আল কুরআনে আল্লাহ পাকও তাঁর প্রিয় রাসুল সা. এবং তাঁর মাধ্যমে আমাদেরকে সেই শিক্ষাটাই দিয়েছেন (সুরা আলে ইমরান:১৫৯) (নিজেকেও সে কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি এ সুযোগে)।
আমরা সবাই যদি এমন চারিত্রিক বৈশিষ্ঠগুলোকে ধারণ করি, তা হলে আমরা সকলেই একে অপর থেকে আলাদা আলাদা পৃথক সত্তায় পরিণত হয়ে পড়বো।ঐক্য ভেঙ্গে পড়বে। নিজেদের মধ্যে কলহ বিবাদ ও বিভাজন বাড়বে, কারো জীবনেই শান্তির লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এ কারনেই আমাদের সকলেরই চরিত্রে কঠোরতা এবং রুক্ষতাকে বর্জন করে নম্রতা ও সহীষ্ণুতাকে ধারণ করে রাখাটা এতোটা গুরুত্বপূর্ণ।
---------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments