Recent Tube

ইসলামী পুনর্জাগরণ সমস্যা ও সম্ভাবনা পর্ব--৮ ড. ইউসুফ আল কারজাভী

 
 
    ইসলামী পুনর্জাগরণ   
  সমস্যা সম্ভাবনা। 
                     পর্ব--৮মঃ
-----------------------------------

৬. ইতিহাস, বাস্তবতা ও আল্লাহর সুনান সম্পর্কে সচেতনতার অভাব

     ইসলাম সম্পর্কে সঠিক সচেনতার অভাব ছাড়াও বাস্তবতা, জীবন, ইতিহাস এবং আল্লাহ্ র সৃষ্টির রীতি সম্পর্কেও যথার্থ সচেনতার অভাব রয়েছে। এর অভাবে কিছু লোক অসাধ্য সাধন করতে চায়। যা ঘটতে পারে না তারা তাই কল্পনা করে এবং পরিস্থিতি ও ঘটনা প্রবাহের ভুল বিচার করে বসে যা আল্লাহ্ র রীতি ও শরীয়তী চেতনার পরিপন্থী। তারা অসমসাহসিক পদক্ষেপ নেয়, এমনকি জীবনেরও ঝুঁকি নেয়। এর পক্ষে বিপক্ষে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তারা তা মোটেও বিবেচনা করে না। কারণ তারা মনে করে তাদের লক্ষ্য তো আল্লাহ্ ও তাঁর কালাম সমুন্নত করা। অতএব এসব লোকের পদক্ষেপকে অন্যরা “আত্মঘাতী” বা উম্মাদনাপূর্ণ বলে অভিহিত করলে আশ্চর্যের কিছু নেই।

      বস্তুত এই মুসলমানরা যদি মুহুর্তের জন্যেও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাহর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করতো তাহলে নিশ্চিতভাবে সঠিক পথ-নিদের্শ লাভ করতো। আমরা এখানে স্মরণ করতে পারি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ১৩ বছরের মক্কী জীবন। তিনি শুধু দাওয়াত দিয়ে ক্ষান্ত হননি, ৩৬০টি মূর্তি থাকা সত্ত্বেও কা’বায় নামায ও তাওয়াফ করতে বলেছেন। কেন এরূপ করলেন? তিনি কাফিরদের তুলনায় তাঁর অনুল্লেখযোগ্য শক্তি ও অবস্থানের কথা ভেবে অতি বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি কখনোই কমান্ডো হামলা চালিয়ে পাথরের মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলার চিন্তা করেননি। তাহলে তো আসর উদ্দেশ্যই পণ্ড হয়ে যেতো। ঐ পদক্ষেপে কাফিরদের মন থেকে তো বহু-ইশ্বরবাদের ভুত মুছে ফেলা যেতো না। তিনি সর্বাগ্রে চেয়েছিলেন তাঁর স্বজাতির মনকে মুক্ত করতে-কা’বাকে মূর্তিমুক্ত করতে নয়। এ জন্যে তওহীদেরশিক্ষা দিয়ে প্রথম মুশরিকদের মন পবিত্র করার লক্ষ্যে এমন একদল ঈমানদার তৈরি করেন যারা তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন এবং কঠোর অধ্যবসা ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তারা বাতিলৈর বিরুদ্ধে হকের লড়াই চালিয়ে যেতে সক্ষম। এসব বিশ্বাসীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা নিরলস নির্বিকার চিত্তে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্যে কাজ করে যায়, বিজয়ের উল্লাসে তারা মাদকতায় বিভোর হয়ে যায় না, আবার পরাজয়ে মুষড়ে পড়ে না। অবশ্য কখনো কখনো তারা কাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অনুমতি প্রার্থনা করেছিল। কিন্তু তিনি এখনো সময় আসেনি বলে তা অগ্রাহ্য করেছিলেন এবং আল্লাহ্ র নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধারনের উপদেশ দিয়েছিলেন। একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) আম্মার বিন ইয়াসির (রা) ও তাঁর পিতাকে নিগৃহীত হতে দেখলেন। তিনি তাঁদেরকে সহ্য করার জন্যে উৎসাহিত করলেন এবং তাঁদের জান্নাতের সুসংবাদ দিলেন। স্বাধীনতা ও ধর্মরক্ষার জন্যে আল্লাহ্ র আদেশ না পাওয়া অবধি ঘটনা এভাবে চলতে থাকে। অবশেষে আদেশ এলো। কুরআনের ঘোষণা: “যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে। নিশ্চই আল্লাহ্ তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম; তাদেরকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে শুধু এ কারণে যে, তারা বলে: আমাদের প্রভু হচ্ছেন আল্লাহ্ ।” (২২:৩৯-৪০)

     কিন্তু এই অনুমতি দেয়া হয়েছে কেবল তখনি যখন রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সাহাবীরা নিজেস্ব আবাসভূমি স্থাপন করে নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। তারপরই তাঁদেরকে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়েছৈ। তাঁরা এরপর একর পর এক বিজয় অর্জন করেছেন যতক্ষণ না তাঁরা আল্লাহ্ র হুকুমের মক্কা বিজয় করেছেন। এই মক্কা থেকেই তিনি চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন কাফিরদের অত্যাচারে।শৈষ পর্যন্ত তিনি মক্কার মূর্তি ধ্বংস করলেন এবং তিলাওয়াত করলেন এই আয়াত, “ বলো সত্র সমাগত এবং মিথ্যা বালুপ্ত হয়েছে। মিথ্যা তো বিলুপ্ত বাধ্য।” (১৭:৮১)

     বিস্ময়ের ব্যাপার, জামায়াত আত-তাকফির আল-হিজরা ইতিহাসের এই ধারাকে অস্বীকার করে। এই অবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অবশ্য গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ শুকরী ও আবদুর রহমান আবু আল-খায়েরের মধ্যে মতপার্থক্যও হয়েছিলো। আবু আল-খায়ের তাঁর “স্মৃতিকথায়” লিখেছেন যে, ইসলামের ইতিহিসের প্রতি শেখ শুকরীর অবস্থা ছিল না। তিনি এটাকে “অপ্রমাণিক ঘটনাবলী” বলে মনে করতেন। এটা ছিলো সাথে মতভেদের চতুর্থ বিষয়। তিনি কেবল কুরআন শরীফে বর্ণীত ঘটনাবলীকেই ইতহাসের উপাদান বলে মনে করতেন। তাই তানি ইসলামী খিলাফতের অধ্যায় পাঠ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।

    ধর্মীয় অজুহাতে ইতিহাস সম্পর্কে ও ধরনের সংকীর্ণ ও অযৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে তারা ইসলামের ইতিহাসকেও হারাম ঘোষণা করেছিলেন। ইতিবাচক ও নেতিবাচক, জয় ও পরাজয় তথা সকল বিষয় সমন্বিত একটি জাতির ইতিহাস হচ্ছে সমৃদ্ধ খনির মতো যা থেকে সম্পদ আহরণ করে একটি জাতি তার বর্তমান গড়ে তোলে। যে জাতি ইতিহাসকে উপেক্ষা করে তার অবস্থা স্মৃতিভ্রংশ মানুষের সাথে তুলনীয়, যার কোনো মূল বা দিক-দর্শন নেই। কোনো গ্রুপ বা জনগোষ্ঠী কিভাবে এরূপ একটি অস্বাভাবিক শর্তকে টিকে থাকার ভিত্তি হিসেবে নির্ধারণ করতে পারে? তাছাড়া ইতাহাস হচ্ছে এমন একটি আয়না যাতে আল্লাহ্‌র বিধান প্রতিবিম্বিত হয়েছে। এজন্যে আর কুরআনে গোটা সৃষ্টিলোক সাধারণ ভাবে এবং মানব জীবনে বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। আর এ কারণেই আল কুরআন ইতিহাসের প্রেক্ষিত অনুধাবন এবং এ থেকে শিক্ষা গ্রহণের আহবান জানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে কুরআনের বর্ণনা: “তোমাদের পূর্বে বহু জীবন প্রণালী গত হয়েছে, সুতরাং তোমরা দুনিয়া ভ্রমণ করো এবং দেখ মিথ্যাশ্রয়ীদের কি পরিণাম হয়েছে।” (৩:১৩৭)

      আল্লাহ্ রীতির বৈশিষ্ট্য হলো স্থায়িত্ব, তার কখনো পরিবর্তন হয় না। আল কুরআন বলছে: “তারা আল্লাহ্ র নামে দৃঢ় অঙ্গীকার করে বলতে যে, তাদের কাছে কোনো সতর্ক বাণী এলে তারা অন্য সকল সম্প্রদায় অপেক্ষা সৎপথের অধিকতর অনুসারী হবে। কিন্তু যখন তাদের কাছে সতর্ক বাণী এলো তখন তা কেবল এদের বিমুখতাই বৃদ্ধি করলো, যমীনের বুকে ঔদ্ধত্য প্রকাশ এবং কূট-ষড়যন্ত্রের কারণে। কূট-ষড়যন্ত্র এর উদ্যোক্তাদেরকেই পরিবেষ্টন করে। তবে কি তারা প্রত্যক্ষ করেছে পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রযুক্ত বিধানের? কিন্তু তুমি আল্লাহ্ র বিধানে কখনো কোন পরিবর্তন দেখতে পাবে না এবং আল্লাহর রীতিতে কোন ব্যাতিক্রম দেখবে না। (৩৫: ৪২-৪৩)

     আল।রাহ্ র রীতি যেহেতু অপরিবতর্নীয় ও স্থায়ী তাই যারা দুষ্কর্মে লিপ্ত হয় স্থান-কাল ও জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি আচরণে তিনি একই রীতি প্রয়োগ করেন। এই নীতির একটি শিক্ষনীয় দৃষ্টান্ত আমরা দেথেছি ওহুদের যুদ্ধে। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উপদেশ উপেক্ষা করার দরুন তাদেরকে কঠিন মূল্য দিতে হয়েছিলো। কুরআনুল করীমে একথা উল্লিখিত হয়েছৈ: “কী ব্যাপার! যখন তোমাদের ওপর মুসীবত এল তখন তোমরা বললে এটা কোথা থেকে এলো! অথচ তোমরা তো দ্বিগুণ বিপদ ঘটিয়েছিলে। বলো এটা তোমাদের নিজেদেরই নিকট থকে। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে শক্তিশালী। (৩:১৬৫)

    আরেকটি আয়াতে যে কারণে মুসলমানদের পরাজয় বরণ করতে হয়েছে তার পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়েছে: “আল্লাহ তোমাদের সাথে তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছিলেন যখন তোমরা আল্লাহ্ র অনুমতিক্রমে তাদেরকে বিনাশ করছিলে যে পর্যন্ত না তোমরা সাহস হারালে এবং নির্দেশ সম্বদ্ধে মতভেদ করলে এবং যা তোমরা ভালবাস তা তোমাদেরকর দেখবার পর তোমরা অবাধ্য হলে।” (৩:১৫২)

      কিছু বিছিন্ন ঘটনার দরুণ ইতিহাসে অনেক সন্দেহজনক ঘটনা সংযোজিত হয় সত্য, কিন্তু মূল গটনা প্রবাহ সুরক্ষিত থাকে এবং একাধিক প্রামাণিক সূত্রে তা সমর্থিত হয়। আর সন্দেহপূর্ণ ঘটনাগুলো বিজ্ঞ ব্যাক্তি বিশ্লেষণ করতে পারেন। যাতে সত্য নিরূপণ করা যায়।

    পক্ষান্তরে আমরা শুধু ইসলামের ইতিহাস নয়, সৃষ্টির পর থেকে মানব ইতিহাসের প্রতি আমাদের দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করতে চাই। শুধু ঈমানদারদের ইতিহাস নয়, বরং নাস্তিকদের ইতিহাস থেকেও জ্ঞান আহরণ করা যায়। কেননা আল্লাহ্ র রীতিতে কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই।তা তো তাওহীদ পন্থী ও পৌত্তলিক উভয়ের ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য। বস্তুত জাহিলিয়ার ভ্রান্ত প্রকৃতি অনুধাবন করতে না পারলে আমরা কুরআনুল কারীমকে এবং ইসলামের বদৌলতে আমরা কী কল্যাণ লাভ করেছি তাও উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো না। কুরআনে বলা হয়েছে: “...যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রন্তিতে নিমজ্জিত ছিলো।” (৩:১৬৪) এবং “তোমরা অগ্নি গহবরের কিনারে দাঁড়িয়েছিলে, আল্লাহ তা হতে তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন।” (৩:১০৩)

      উমর ইবনে খাত্তাব (রা)-এর একটি উক্তিতেও এই মর্ম প্রতিফলিত হয়েছে: “জাহিলিয়ার প্রকৃতি অনুধাবনে ব্যর্থতা শুরু হলে একে একে ইসলামের বন্ধনী বিছিন্ন হতে থাকবে।”

    সত্য প্রকাশ যদি পুণ্য হয় তাহলে আমি বলবো ইসলামী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই ইতিহাস সঠিকভাবে অধ্যায়ন ও অনুধাবন করেননি। ইতিহাস পাঠের অর্থ শুধু বিশেষ বিশেষ সময়ের ঘটনাকে জানা নয়, বরং অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে এর মর্ম উপলব্ধি করা, শিক্ষা নেয়া এবং আল্লাহ্ র রীতিগুলো উদ্ভাসিত করা। নিছক পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ধ্বংসাবশেষ অবলোকন করলে কোনো ফায়দা হবে না। শুধূ দেখা আর শোনার মাধ্যমে ইতিহাসের মর্ম উপলব্ধি করা যায় না। এ প্রসঙ্গে কুরআন বলছে: “তারা কি দেশে ভ্রমন করেনি? তাহলে তারা জ্ঞান বুদ্ধিসম্পন্ন হৃদয় ও শ্রুতিশক্তিসম্পন্ন কর্ণের অধিকারী হতে পারতো। আসলে চোখ তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে বক্ষস্থিত হৃদয়।” (২২:৪৬)

     ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং একটির সাথে অপরটির সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। কারণ এগুলো একই অপরিবর্তনীয় নিয়মে প্রবাহিত হয়। তাই পাম্চাত্য শিখিয়েছে: “ইতিহাসের চাকা ঘোরা” আর আরবারা বলে, “আজবকের রাত কালকের রাতের মতোই।”
আল কুরআনুল করীমে দৃষ্টিভঙ্গি ও আচার-আচরণে সাদৃশ্যের কারণ হিসেবে অভিন্ন চিন্তা ও দৃষ্টির উল্লেখ করা হয়েছে:

    “যাদের জ্ঞান নেই তরা বলে, ‘আল্লাহ কেন আমাদের সাথে কথা বলেন না কিংবা কোন নিদর্শন আমাদের কাছে আসে না কেন? এর আগের লোকেরাও এ ধরনের কথা বলতো। তাদের হৃদয় একই রকম। আমি দৃঢ় প্রত্যয়শীলদের জন্য নিদর্শনাবলী স্পষ্টভাবে বিবৃত করেছি।” (২:১১৮)

    কুরায়েশ পৌত্তলিকদের সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেছেন: “এভাবে এদের পূর্ববর্তীদের কাছে যখনি কোনো রাসূল (সা) এসেছেন তারা তাঁকে বলেছে, ‘তুমি তো এক যাদুকর, না হয় এক উম্মাদ!’ তারা কি একে অপরকে এই মন্ত্রাণাই দিয়ে এসেছে? বস্তুত তারা এক সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়।” (৫১:৫২-৫৩)

    তাহলে দেখা যায়, আল্লাহ্ র নবীর প্রতি আগের ও পরের জাতিসমূহের দৃষ্টিভঙ্গির অভিন্নতা তাদের মধ্যে সমঝোতার ফলশ্রুতি নয়, বরং সাদৃশ্য হলো অন্যায় ও স্বচ্ছাচারী আচরণে। সুতরাং তাদের দৃষ্টভঙ্গি অভিন্ন কারণ হলো স্বেচ্ছাচারিতা।

        যারা ইতিহাসের গুরুত্ব এবং আল্লাহর রীতির মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম কেবল তারাই অতীত জাতিসমূহের ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিতে পারে। তারাই প্রকৃত সুখী। তারাই যারা এসব ভুলভ্রান্তি থেকে নিজেরা সতর্ক হয় বটে, কিন্তু অন্যের ভাল দিকগুলোকেও উপেক্ষা করে না। জ্ঞানই ঈমানদারের লক্ষ্য তা সে যেখান থেকেই অর্জন করুক না কেনো। কেননা অন্য যে কোন ব্যাক্তির চেয়ে এটা তারই প্রাপ্য।
৭. দু’টি গুরুত্বপূর্ণ

    সাধারণ মুসলমান, বিশেষত ইসলামী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদেরকে আল্লাহ্‌র দু’টি রীতি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। প্রথম: সৃষ্টি ও বিধানের ক্ষেত্রে সুষ্পষ্ট পর্যায়ক্রমিকতা লক্ষণীয়। অথচ আল্লাহ্ পাক আঁখির পলক পড়ার চেয়ে কম সময়ের মধ্যে বেহেশত ও সৃষ্টিতে সক্ষম! “হও আর তা হয়ে যায়।” (২:১১৭)

   তিনি তাঁর (হিসেবে) ছয় দিনে এগুলো সৃষ্টি করেছেন অথাৎ পর্যায়ক্রমে যা কেবল তিনিই জানেন। কেননা “দিন” সংক্রন্ত আমাদের ধারনা থেকে তা ভিন্ন। সকল প্রাণীর বিকাশের ক্ষেত্রেও পর্যায়ক্রমিকতা লক্ষণীয়। ধীরে ধীরে এগুলো পূর্ণতা লাভ করে। দাওয়াতী কাজেও এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়। পৌত্তলিকতা ও কুসংস্কার থেকে মনকে মুক্ত করার জন্যে প্রথমে সেখানে তওহীদের বীজ প্রোথিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এভাবে ঈমানের ভিত্তি মজবুত হলে ওয়াজিবাত ও মুহাররামাতের প্রক্রিয়া চালু করা হয়। এরপর সালাত, যাকাত, সিয়াম ইত্যাদি প্রবর্তন করা হয়। এজন্যে আমরা মক্কী ও মাদানী আয়াতের মধ্যে পার্থ্ক্য লক্ষ্য করি।

      আয়েশা (রা) শারীয়ার প্রবর্তন এবং কুরআন নাযীলের পর্যায়ক্রম সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন: প্রথমে কুরআনের যেসব আয়াত নাযিল হয়েছে তাতে জান্নাত ও জাহান্নামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। (পরে) যখন মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলো তখন হালাল ও হারামের বিধান নাযীল হলৌ। যদি প্রথমেই “মদ পান করো না” এবং “ব্যভিচার করো না” নাযিল হতো লোকেরা বলতো, ‘আমরা মদপান ও ব্যভিচার কখনোই ছাড়তে পারব না।’ (বুখারী) সুতরাং যারা ইসলামী জীবন ব্যবস্থা তথা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতাষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত তাদেরকে পরিবেশ, পরিস্থিতি, প্রতিবন্ধকতা, উপায়-উপকরণ ও সামর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে পর্যায়ক্রমে দাওয়াতী কাজ চালাতে হবে। এক্ষেত্রে খলীফা উমর ইবনে আবদুল আজীজের দৃষ্টান্ত স্মর্তব্য। তিনি খেলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ জীবন পুনর্গঠন করেছিলেন। কিন্তু পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সহজ ছিলো না। তার পুত্র আবদুল মালিক অত্যন্ত নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। তিনি তাঁর পিতাকে একবার বললেন, “হে পিতা, আপনি কেন হত্যা করেন না? আল্লাহ্ শপথ, সত্যের জন্যে আমরা বা আপনার প্রাণ গেলেও আমি পরোয়া করি না।” কিন্তু উমর জবাব দিলেন, “তাড়াহুড়া করো না আমার পুত্র। আল্লাহ্ পাক কুরআনুল কারীমে দু’বার মদ্যপানেরনিন্দা করেছেন এবং তৃতীয়বারে নিষিদ্ধ করেছেন। আমার ভয় হয়, একবারেই সব চাপিয়ে দিলে এক সাথেই তা প্রত্যাখ্যাত হয় কিনা। এতে ফিতনার সৃষ্টি হতে পারে।” (আল মুয়াফাকাত)

      দ্বিতীয়: দ্বিতীয় রীতিটি হচ্ছে প্রথমটির পরিপূরক। প্রতিটি জিনিসের পূর্ণতা বা পরিণতি লাভের নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে। মূর্ত ও বিমূর্ত উভয় ক্ষেত্রেই এই রীতি প্রযোজ্য। ফসল পাকার আগেই কাটা যায় না। অপরিপক্ক ফলমূল ও শাকসবজি উপকারের পরিবর্তে ক্ষতি করতে পারে। ঠিক তেমনি মহৎ কাজের সুফল অনেক বছর পরেই পরিদৃশ্যমান হয়। পরিণত হতে যতো সময় লাগবে ততোই তা ফলপ্রদ হবে। এক পুরুষের চেষ্টা-সাধনা অন্য পুরুষে ফল দিতে পারে। মক্কা মুকাররমায় প্রথমদিকে কাফিররা আল্লাহর শাস্তির হুশিয়ারীকে অবিবেচকের মতো উপহাস করতো এবং দ্রুত শাস্তি আনার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতি আহবান জানাতো। কিন্তু তারা এটা জানতো না যে, নির্দিষ্ট সময়েই তা আসবে। বিলম্বও নয়, দ্রুতও নয়।

        “তারা তোমাকে শাস্তি ত্বরান্বিত করতে বলে। যদি নির্ধরিত সময় না থাকতো তবে শাস্তি তাদের ওপর আসবে আকস্মিকভাবে, অজ্হতসারে।” (২৯:৫৩)
  “তরা তোমাকে শাস্তি ত্বরান্বিত করতে বলে, অথচ আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি কখনো ভঙ্গ করেন না, তোমাদের গণনার হাজার বছরের সামন।” (২২:৪৭)

      এই পর্যায়ে আল্লাহ্ তায়ালা মহানবীর (সা)-এর প্রতি বিগত নবীদের মতো অধ্যবসায়ী হওয়ার উপদেশ দিলেন: “অতএব তুমি ধৈর্য ধারণ কর যেমন ধৈর্য ধারণ করেছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ।”(৪৬:৩৫) বিগত নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারীদের কঠোর সঙগ্রাম ও ত্যাগ তিতিক্ষার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন:

    “তোমরা কি মনে করো তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, যদিও এখনও তোমাদের কাছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা আসেনি! অর্থ কষ্ট ও দুঃখ-ক্লেশ তাদেরকে স্পর্শ করেছিলো এবং তারা ভীত ও কম্পিত হয়েছিলো। এমনকি রাসূল এবং তাঁর ঈমানদার অনুসারীরা বলে উঠেছিলো, আল্লাহ্‌র সাহায্য কখন আসবে; নিশ্চয় আল্লাহ্‌র সাহায্য নিকটবর্তী। কিন্তু সেই নির্দিষ্ট সময় কেবল আল্লাহ্‌রই জানা আছে। এ জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সাহাবীদের ধৈর্য ধারণ করতে বলতেন এবং নিদির্ষ্ট সময়ের পূর্বে বিজয় প্রত্যাশা থেকে বিরত থাকতে উপদেশ দিতেন। একটি ঘটনা থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। একবার খারায ইবনে আল-আর্ত ইসলামের জন্যে তাঁর দুঃখকষ্ট বরণের কথা বলে আর্লাহ্ র সাহায্য প্রার্থনার আবেদন জানালে রাসূলুল্লাহ (সা) এতোই ক্রুদ্ধ হন যে, তাঁর মুখ লাল হয়ে যায়। তিনি বললেন: “তোমাদের আগে একজন বিশ্বাসীকে লোহা দিয়ে এমনভাবে পিষ্ট করা হয়েছে যে, হাড় ছাড়া তার শরীরের গোশ্‌ত ও শিরা-উপশিরা অবশিষ্ট ছিলো না। আর একজনকে করাত দিয়ে জীবন্ত অবস্থায় দু’ভাগে চিরে ফেলা হয়েছিলো। কিন্তু তাঁরা কেউই ধর্মত্যাগ করেননি। আল্লাহ্‌র শপথ, তিনি এমনভাবে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করবেন যে, একজন ভ্রমনকারী সানা থেকে হাদ্রামাউত পর্যন্ত সফরের সময় এক আল্লাহ্ এবং তার ভেড়ার জন্যে নেকড়ে ছাড়া আর কাউকে ভয় করবে না। কিন্তু তোমরা অধৈর্য।” ( বুখারী)

   ইনশাআল্লাহ, চলবে...।

Post a Comment

0 Comments