Recent Tube

ভয়ংকর, বেয়াদব উশৃংখল? আল্লাহর কসম আপনি একজন মিথ্যবাদী। ৷ জিয়াউল হক।



'ভয়ংকর, বেয়াদব উশৃংখল? আল্লাহর কসম আপনি একজন মিথ্যবাদী
    --------------------------------- 
     কুষ্টিয়া। সেপ্টেম্বর ১৯৭৯। 
কোন এক প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরিক্ষায় এসেছে বড্ড বেয়াড়া আর উশৃংখল হিসেবে সর্বমহলে সবিশেষ নাম কুড়ানো এক যুবক। সেখানেই আগত অনেকের মাঝে ক্ষণিকের জন্য তার দেখা হলো অপরিচিত অচেনা সমবয়স্ক এক যুবকের। হাসিমাখা মুখটা খুব মায়াবী, হাল্কা গোঁফ, সারাটা মুখ জুড়েই দাঁড়ি। ক্ষণিকের জন্য দেখা হয়েছে বটে, কোন পরিচয় নয়। 

    সেই দেখাটাই আবারও হলো ১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখ, বৃহস্পতিবার। সেদিনও সেই মায়াবি মুখের ছেলেটার আকর্ণ হাসি, এগিয়ে এসে নিজে থেকেই পরিচয় দিলেন, নামও বললেন।  

     বেয়াদব ছেলেটা তেমন পাত্তা দিল না। ভদ্রতাও দেখালো না, নির্লিপ্ত রইলো। বড় ভাইদের (তাদেরই একজন পরবর্তিতে তিনি জাতীয় রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি) কেউ ক্উ 'ভয়ংকর শিবির' চেনার যে সব লক্ষণ শিখিয়েছিলেন, জীবনে কোনদিনই শিবির না দেখে এই বেয়াড়া আর উশৃংখল ছেলেটা তাকে দেখেই চিনতে পেরেছে; ব্যাটা শিবির না হয়ে পারেই না! প্রথম পরিচয়ে সামান্য সৌজন্যতা না দেখিয়ে নির্লিপ্ত রয়ে যাওয়ার সেটাই ছিল বড় কারন।  

    মাত্র দিন চারেক পর, জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখ, সোমবার, বেলা সম্ভবত সাড়ে এগারোটা বা সেরকমই হবে। এক প্রতিষ্ঠানের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে এই বেয়াড়া যুবকটা, মাঝপথে আবারও দেখা হয়ে গেল 'ভয়ংকর শিবির' সন্দেহ করা সেই যুবকটির সাথে, উপর থেকে সিড়ি বেয়ে নেমে আসছেন। হাল্কা দাঁড়িওয়ালা মুখে তার মন মাতানো সেই হাসিটুকু লেগেই আছে। 

   উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া গেলো না, তিনি সালাম দিয়ে বসলেন। এবারে থামতেই হলো। বেয়াড়া যুবকটা নিজ হাতে ধরা ভারতীয় লেখক মনোজ বসুর লেখা 'সোভিয়েতের দেশে দেশে' বইটা যুবকের থুতনিতে ঠেকিয়ে বলে উঠলো; চাচা, কালকে যদি মুখে ঐ দাঁড়ি দেখি, তা হলে নিশ্চিত জানবেন ঠ্যাং দু'টো অক্ষত নিয়ে ফিরে যেতে পারবেন না।  

    আহা! আজ বিয়াল্লিশ বসর পরেও সে মুখটা তার চোখের সামনে ভাঁসছে যেন! দপ করে একটা মহুর্তের জন্য মুখের হাসিটা কোথায় যেন উবে গেল, কয়েকটা মহুর্ত মাত্র, তার পরে তিনি নিজেকে সামলে নিলেন, এরপরে আবারও সেই ভুবনভোলা হাসি ফুটিয়ে তুলে বললেন; তাই? তা আমার দাঁড়ি আবার কি অপরাধ করলো? দাড়ি গজালে কি করবো?

     কেমন যেন হেঁয়ালি প্রশ্ন। বেয়াড়া যুবকটি তখন তার নিজের পথ ধরেছে, না থেমেই জবাব দিল; সেটা আগামি কাল এখানকার সবাই দেখবে। কেউ যদি পারে, তবে যেন ঠেকাতে আসে। বলতে বলতে সে উঠে গেল উপরে। ঘুরেও তাকালো না সেই যুবকের প্রতিক্রিয়া কি হয়, তা দেখার জন্য।  

       পরদিন সে প্রস্তুত হয়েই এসেছিল। কিন্তু না সেই যুবক আসেনি। সারাদিন এক ধরনের উত্তেজনা নিয়েই কেটেছে বেয়াড়া ছেলেটার, কিন্তু সেই ছেলেটা আসেনি। তার পরদিন এসেছে। ক্লিনশেভড! কোন ঝামেলা করতে হয়নি বেয়াড়া যুবকটিকে। 'ভয়ংকর শিবির' সোজা করা গেছে বিনা ঝামেলায়! এর পরে এটা নিয়ে সে আর কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তার আচরণেও কোন পরিবর্তন হয়নি সেই হাসিমাখা মুখ, দেখা হলেও আগে সালাম দেয়া, এসব দেখে বেয়াড়া ছেলেটা ভেতরে ভেতরে এক ধরনের অস্বস্থিতে পুড়ে মরতো যেন নীরবে গোপনে!  

    বেয়াড়া যুবকটি ক্লাসের একাডেমিক পড়া শোনা তেমন খুব একটা করতো না, লেকচারগুলো মন দিয়ে শুনতো, সময় মতো নোট নিত মাত্র, কিন্তু তার পরেও তার রেজাল্ট হতো আর সবার চেয়ে ভালো। একাডেমিক পড়া না  পড়লেও বই পড়ার ক্ষেত্রে সে ছিল আক্ষরিক অর্থেই 'বইপোকা'।  
যেখানেই যাক না কেন সে, তার হাতে বই একটা থাকবেই। বিকেলে কুষ্টিয়া গড়াই নদীর তীরে বসে থাকলেও তার হাতে কোন এক গল্পের বই, ব্যাডমিন্টনের মাঠেও খেলার ফাঁকে বইয়ের পাতায় তার চোখ। 

    সে সময় কুষ্টিয়া শহরে বই পাওয়াটা অতোটা সহজও ছিল না। মাঝে মধ্যে বইয়ের খরা দেখা দিত। ঠিক এরকমই একটা সময়ে এগিয়ে এলেন সেই যুবক। একদিন হাতে কোন বই না দেখে, কিংবা বইহীন অবস্থায় চুপচাপ বসে থাকতে দেখে দয়াপরবশ হয়ে যথারীতি হাসিমাখা মুখে জানতে চাইলেন, আজ বই নেই কেন হাতে? ততোদিনে তারা 'আপনি' হতে 'তুমি'তে এসে ঠেকেছে। জানালেন তার বাসা অনেক বই আছে, তবে বইগুলো পুরোনো, মলাটহীন। চাইলে সে এনে দিতে পারে। 

      হাতে স্বর্গ পাবার মতো করে এ বদান্যতা লুফে নিল বেয়াড়া যুবকটি। এমনিতেই সে এক ধরনের অস্থস্থিতে ভুগছিল, তার উপরে এ বাদন্যতাকে সে লুফে নিল সম্পর্ককে স্বাভাবিক করে নিতে। কিন্তু তখনও সে তার সেদিনকার আচরণের জন্য ক্ষমা চাইলো না, ভুলও স্বীকার করলো না। দিন দুয়েকের মধ্যে বই এলো। মলাটহীন অনেক পুরোন বই। লেখকের নামটাও নেই, পাতা হারিয়ে গেছে হয়তো। কিন্তু বইয়ের বিষয়বস্তু, লেখার ধরন আর সহজ ও সাবলীল বর্ণনাভঙ্গি সেই সাথে অসাধারণ সব যুক্তি বেয়াড়া যুবকটিকে উন্মাদ (!) করে দিল মাত্র বসর দুয়েকের মধ্যেই! 

     এই বইপড়াকে কেন্দ্র করেই শেষ পর্যন্ত বেয়াড়া যুবকটির সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। একসময় আবার যে যার মতো চলে গেল তারা, বাংলাদেশের দুই প্রান্তে।বেয়াড়া যুবকটি গেলেন ঠাকুরগাঁও জেলার সীমান্তঘেঁষা দূর্গম হরিপুর, আর 'ভয়ংকর শিবির' বন্ধু গেলেন ঢাকার ধানমন্ডি।  

     কয়েক বসর পর, ১৯৯২, ২২ শে মে। ঢাকা এয়ারপোর্টের চেকইনে দেখা হয়ে গেল আবারও। দু'জনেই সেদিন একই বিমানে পাড়ি দিলেন কুয়েতের উদ্দেশ্যে। এর পরে দীর্ঘ একটি যুগেরও বেশি সময়কাল বেয়াড়া যুবকটি 'ভয়ংকর শিবির' এর কাছাকাছি থাকার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছে। থেকেছেও দীর্ঘ একটা যুগ। কাছে থেকে দিনের পর দিন দেখেছে 'ভয়ংকর শিবির'কে। তার ভেতরে না ভয়ের কিছু দেখেছে আজ পর্যন্ত, না উশৃংখলতা কিছু। যেটা দেখেছে তা হলো এ পতিত বৈরি পরিবেশে মানুষ নামের একজন 'ফেরেশতা' যেন!  

     বেয়াড়া ছেলেটা অনুশোচনায় পুড়তে পুড়তে ঘটনার প্রায় দেড় যুগ পর শেষ পর্যন্ত একদিন সেই 'ভয়ংকর শিবির' যুবকটির কাছে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করে ক্ষমা চাইতে গেলে তিনি তা মনেই করতে পারলেন না। তাকে বার বার বার মনে করিয়ে দিতে গেলেও তিনি তা মনে করতেই পারলেন না। আহা কি বিনয়! পাছে সেদিনের ঘটনায় আবার লজ্জা পায় তার বন্ধু, তাই তিনি সেটা স্মরণেই আনলেন না, স্বীকারও করলেন না!

     সেদিন বেয়াড়া ছেলেটা নীরবে, গোপনে চোখের পানি ফেলেছিল মানবতার উন্নত ও মহৎ রুপটাকে নিজের চোখে দেখতে পেয়ে।  
দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বসর পেরিয়ে আজও তারা একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একে অপরকে দোওয়ায় শামিল রাখা বন্ধু। এমন অকৃত্রিম বন্ধুকে যে বক্তা বেয়াদব, উশৃংখল আর বে'আমল বলতে পারে, তার উদ্দেশ্যে সেদিনকার সেই বেয়াড়া যুবকের একটা কথা বলার আছে রোজা মুখে; আল্লাহর কসম আপনি একজন মিথ্যবাদী
--------------------------------- 
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments