Recent Tube

কুরআন ও হাদীসের আলোকে ঐতিহাসিক বদর দিবসের তাৎপর্য ও শিক্ষা। শামীম আজাদ।



কুরআন ও হাদীসের আলোকে ঐতিহাসিক বদর দিবসের তাৎপর্য ও শিক্ষা;
------------------------------------- 

  ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে যাঁর আগমন, ৬১০ খ্রিস্টাব্দে তিনিই নবুয়তপ্রাপ্ত হন। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে যিনি মায়াভরা-বুকভরা ব্যথা নিয়ে মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাহলে ৬২৪ খ্রিস্টাব্দ বা ২য় হিজরি কেনো বিখ্যাত? 
এতদিন যাঁর এক হাতে ছিলো পবিত্র আল কুরআন, অপর শূন্য হাতটিতে এ সালের ১৭ রমজান শুক্রবার তুলে নিলেন উন্মুক্ত তরবারি। কে তিনি ?  উম্মতের শাফায়াতকারী,  রাহমাতুল্লিল আল-আমিন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। কেনো তরবারি হাতে নিলেন ? ইকামাতে দ্বীন প্রতিষ্ঠাকল্পে এবং হক-বাতিল নামক দু'টি শব্দের মর্ম উম্মতের মাঝে সাবলীলভাবে বুঝিয়ে দিতে। সামরিক এ মহা অভিযানের কেন্দ্রবিন্দু কোথায় ছিলো ? সোনার মদীনা মুনাওয়ারা থেকে সোজাপথে ৮০ মাইল পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে; ব্যক্তি, এলাকা বা কূপের নামে নামকরণ করা ঐতিহাসিক বদর প্রান্তরে।

      প্রধান সেনাপতির সাথে প্রধানত ছিলো খোদায়ী নুসরত বা আসমানী সাহায্য, ভিন্নধর্মী সেনাবাহিনী ৩১৩ জন। সমগ্র সেনাদলে ঘোড়া ছিলো মাত্র দু'টি, ৭০টি উট, ৮টি তরবারি-তাও কিছু তরবারি ছিলো ভাঙ্গা, ৬টি তীর ধনুক, একটি আওয়াজ 'আল্লাহু আকবার' এসব নিয়েই যিনি ও তাঁর সাথীরা বদর প্রান্তরে এসেছিলেন পরিবর্তন করতে পুরো পৃথিবীর তকদীর। এই তাওহীদী নেশার কারণেই প্রচ- গরমে, রমজানুল মোবারকের ১৭তম দিনে মুখে রোজা, স্বল্পসংখ্যক সৈন্য, অথচ শত্রুপক্ষের ঈমানবিহীন ১০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী, একশ অশ্বারোহী, ৭০০ উষ্ট্রারোহী, দু'শতাধিক পদাতিক, অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত গোটা বাহিনী, কোটি কোটি টাকার সম্পদ-তাতে ভয় কী! মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সৈন্য বাহিনী জান দিতে ভয় করে না, শিরকেটে যাক কিংবা অক্ষত থাকুক তার কোনো পরোয়া করেনা, বরং সিদ্দিকে আকবর (রাঃ) ও ওমর ফারুক (রাঃ) সে সময়ে রাসূল সাঃকে অভয় দিয়ে বলেই ফেলেছেন-হে হাদীয়ে যামান! আমাদের জান-মাল-সন্তান, আপনার ওপর কোরবান। সুবহান আল্লাহ।

   বদরযুদ্ধের পটভূমি : বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কার কাফির কুরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে জন্মভূমি মক্কা, খানায়ে কাবা, বাড়িঘর, আত্মীয়-স্বজন প্রভৃতির মায়া কাটিয়ে সাহাবাগণসহ একটু শান্তিতে বসবাস করার আশায় মদীনায় আগমন করেছিলেন। কিন্তু এখানে এসে তিনি শান্তিতে বসবাস করতে পেরেছেন? হ্যাঁ, মক্কা থেকে একটু ভালো পরিবেশ সৃষ্টি হলেও ভিতরে ভিতরে ইহুদী, খ্রিস্টান ও পৌত্তলিক ধর্মাবলম্বীদের মনের তীব্র জ্বালা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা গোপনে গোপনে নবীকে নিঃশেষ করার জন্যে মক্কার কোরাইশ সর্দারদের সাথে বৈঠক করত সুকৌশলে। 'নবীজীর সাথে ইহুদীদের শত্রুতার প্রধান কারণ ছিলো সুদ নিয়ে। কারণ ইহুদীগণ ছিলো সবাই বিরাট ধনী ও সুদখোর। তারা অন্য কোনো কাজ কর্ম করতো না। কেবল টাকা ধার দিত আর বসে বসে সুদের দ্বারাই পরম সুখে কাল যাপন করতো। আর হযরত রাসুলূল্লাহ (সাঃ) ছিলেন সুদের ঘোর বিরোধী। কারণ স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে সুদকে হারাম বলে ঘোষণা করেছেন। 
الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا ۗ وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا ۚ فَمَنْ جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّهِ فَانْتَهَىٰ فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ ۖ وَمَنْ عَادَ فَأُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
যারা সুদ খায়, তারা কিয়ামতে দন্ডায়মান হবে, যেভাবে দন্ডায়মান হয় ঐ ব্যক্তি, যাকে শয়তান আসর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলেছেঃ ক্রয়-বিক্রয় ও তো সুদ নেয়ারই মত! অথচ আল্লা’হ তা’আলা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতঃপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, পূর্বে যা হয়ে গেছে, তা তার। তার ব্যাপার আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। আর যারা পুনরায় সুদ নেয়, তারাই দোযখে যাবে। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে।
সূরা আল বাকারাঃ ২৭৫

يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ ۗ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ
আল্লাহ তা’আলা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খয়রাতকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ পছন্দ করেন না কোন অবিশ্বাসী পাপীকে।
সূরা আল বাকারাঃ ২৭৬
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যে সমস্ত বকেয়া আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক।
সূরা আল বাকারাঃ ২৭৮

فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوا فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ ۖ وَإِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوسُ أَمْوَالِكُمْ لَا تَظْلِمُونَ وَلَا تُظْلَمُونَ
অতঃপর যদি তোমরা পরিত্যাগ না কর, তবে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও। কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমরা নিজের মূলধন পেয়ে যাবে। তোমরা কারও প্রতি অত্যাচার করো না এবং কেউ তোমাদের প্রতি অত্যাচার করবে না।
সূরাঃ আল বাকারাঃ ২৭৯

   আল্লাহ তা’আলার এই হুকুমের ফলে শুধু সুদ গ্রহণ করাই নয়, বরং সুদ প্রদান করাও হারাম বলে ঘোষিত হয়েছে। তাই মদীনার মুসলমানগণ সুদ প্রদানের শর্তে টাকা ধার করা সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছিলেন। যার ফলে সুদখোর ইহুদীগণ বিরাট আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। অতঃপর তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জোট পাকিয়েছিল।' 
(সীরাতে মুস্তফা) 

   পরবর্তীতে মক্কা থেকে কুরাইশগণ দলবদ্ধভাবে একাধিক্রমে কয়েকবার মদীনার উপকণ্ঠে এসে দস্যুবেশে হামলা করে লুটপাট করে নিয়ে গেলো। এটিই ছিলো মক্কা-মদীনায় যুদ্ধের ভূমিকা বা বদর যুদ্ধের প্রাথমিক সূত্রপাত।

    বদরের যুদ্ধকালীন সময় : বিভিন্ন ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর একদিন মুহাম্মদ (সাঃ) জানতে পারলেন যে, আবু সুফিয়ান ইবনে হারবের নেতৃত্বে কুরাইশদের একটি বিরাট কাফেলা সিরিয়ার দিক থেকে এগিয়ে আসছে। সে কাফিলায় কুরাইশদের সম্পদ এবং বাণিজ্যিক সম্ভার রয়েছে। আবু সুফিয়ান এক পর্যায়ে জানতে পারলেন যে, মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর সাথীগণ যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছেন। হিজাযের কাছাকাছি এসে আবু সুফিয়ান ব্যাপারটা অাঁচ করতে পারলো এবং দামদাম ইবনে আমর গিফারীকে তৎক্ষণাৎ মজুরীর বিনিময়ে মক্কা পাঠিয়ে দিল। কুরাইশদের ধন-সম্পদ রক্ষা করার জন্যে অস্ত্রে সজ্জিত লোক পাঠাতে ও মুহাম্মদ (সাঃ) এর দলবলকে আক্রমণ করার জন্যে লোক পাঠাতে বলল। দামদাম খুব দ্রুত সংবাদ নিয়ে মক্কায় পৌঁছে গেল। 
(সীরাতে ইবনে হিশাম)

     মক্কার কুরাইশ সরদাররা সংবাদ শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল, তারা দাঁত কিড়মিড় করে বলেছিল, মুহাম্মদ এবং তাঁর সাহাবাদের মক্কার বাণিজ্য কাফেলার প্রতি চোখ তুলে তাকানোর সাহস কি করে হলো? সর্দার আবু জাহেলের নেতৃত্বে মক্কার সৈন্যবাহিনী অতঃপর পথে বেরিয়ে পড়লো।

    পরিস্থিতির আলোকে বিশ্বনবী (সাঃ) মজলিশে শুরার বৈঠক আহ্বান করলেন। বৈঠকে সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। সেনা অধিনায়ক এবং সাধারণ সৈন্যদের মতামত নেয়া হয়। কিছু সংখ্যক মুসলমান রক্তাক্ত সংঘর্ষের কথা শুনে কাঁপতে শুরু করলো। নেতাদের মতামত চাওয়া হলো। সকলেই চমৎকার মনোভাব প্রকাশ করলো। ইয়া রাসূল আল্লাহ, আমরা আপনার সঙ্গে আছি। মুহাজিরগণ ও আনসারগণ অভয় দিয়ে নবীকে বললেন, সেই আল্লাহর শপথ, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন। আপনি যদি আমাদের সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে চান, তবে আমরাও ঝাঁপিয়ে পড়বো। সুবহানাল্লাহ। আমাদের একজন লোকও পেছনে পড়ে থাকবে না। আগামীকাল আপনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করলেও আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমাদের মনে কোনো প্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। আমরা রণনিপুণ। এমনও হতে পারে আল্লাহ তা'আলা আমাদের মাধ্যমে এমন বীরত্বের প্রকাশ ঘটাবেন, যা দেখে আপনার চক্ষু শীতল হয়ে যাবে। সুবহান আল্লাহ। আর রাহীকুল মাখতুম, ২১৬ পৃঃ স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত গ্রন্থ।

     অতঃপর রাসুল (সাঃ) ও তার সাহাবারা সম্পূর্ণভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে হেমান নামক পাহাড় ডান দিকে রেখে বদর প্রান্তরের কাছাকাছি এসে তাঁবু স্থাপন করলেন। এখানে অবতরণের পর হুজুর (সাঃ) তাঁর  সাথী হযরত আবু বকর (রাঃ)কে সঙ্গে নিয়ে সংবাদ সংগ্রহে বের হলেন। মক্কার সৈন্যদের তাঁবু দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এমন সময় আরবের একজন বৃদ্ধের দেখা পেলেন। নবীজী (সাঃ) নিজের পরিচয় গোপন রেখে তাঁকে কোরাইশ ও মোহাম্মদের সাহাবী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। কিন্তু বুড়ো বেঁকে বসলেন। সে বলল, নিজের ও দলের পরিচয় দিন অন্যথায় আমি কিছু বলবনা। নবীজী (সাঃ) বললেন, আপনার কাছে আগে আমরা যা জানতে চেয়েছি তা বলুন পরে আমরা আমাদের পরিচয় দিবো। বৃদ্ধ বললেন, মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর সাথীরা যদি আমাকে সত্য বলে থাকে তাহলে তারা অমুক জায়গায় থাকার কথা এবং মক্কার কোরাইশ সাংবাদিকরা যদি সত্য বলে থাকে তাহলে তারা অমুক জায়গায় থাকার কথা। ঠিক তার কথামত সে জায়গায়ই প্রত্যেকে অবস্থান করেছিল। অতঃপর মক্কার কোরাইশ বাহিনী সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নেয়া শুরু করলেন সাহাবায়ে কেরাম। পরের দিন সাহাবী রিপোর্টাররা কয়েকজন ব্যক্তিকে ধরে এনে নবীজীর কাছে উপস্থাপন করলেন, নবীজী বললেন, আবু জাহেলের লোক কত? তারা বলল জানি না। দৈনিক তারা কয়টি উট জবাই করে? তারা বলল ৯টি আবার কোন্ দিন ১০টি। তখন নবীজী (সাঃ) বললেন, তাদের সংখ্যা ৯০০ থেকে ১০০০ এর মধ্যে হবে। সুবহান আল্লাহ। আর রাহীকুল মাখতুম, ২১৭ পৃঃ।

    জামে তিরমিযী, আবওয়াবুল জিহাদ ১ম খ-, পৃঃ ২০১ রাসূল (সাঃ) এরপর সেনা বিন্যাস করেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে রওয়ানা হয়ে যান। সেখানে নবীজী (সাঃ) হাতে ইশারা করে দেখিয়ে বলেছিলেন যে, আগামীকাল ইনশাআল্লাহ এই জায়গা হবে অমুকের বধ্যভূমি। অতঃপর সাহাবারা নিরুদ্বেগ প্রশান্তির সাথে রাত কাটালেন ফলে আল্লাহ তায়ালা সে রাতেই রহমতের বৃষ্টি দিয়ে জানিয়ে দিলেন, মাওলার রহমত তোমার সাথে আছে। সূরা আনফাল, ১১নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিলেন-
إِذْ يُغَشِّيكُمُ النُّعَاسَ أَمَنَةً مِنْهُ وَيُنَزِّلُ عَلَيْكُمْ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً لِيُطَهِّرَكُمْ بِهِ وَيُذْهِبَ عَنْكُمْ رِجْزَ الشَّيْطَانِ وَلِيَرْبِطَ عَلَىٰ قُلُوبِكُمْ وَيُثَبِّتَ بِهِ الْأَقْدَامَ
'অর্থাৎ স্মরণ কর, তিনি তার পক্ষ থেকে তোমাদেরকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেন এবং আকাশ থেকে তোমাদের উপর বারি বর্ষণ করেন; তা দ্বারা তিনি তোমাদের পবিত্র করবেন, তোমাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা অপসারণ করবেন, তোমাদের হৃদয় দৃঢ় করবেন এবং তোমাদের পা স্থির করবেন।'

    খোঁজ নিয়ে জানা গেল সে সময়ে শত্রুদের মাঝে পারস্পরিক মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। একদল যুদ্ধ করবে আরেকদল যুদ্ধ না করে ফিরে যাবে কিন্তু আবু জাহেলের কুটনৈতিক বুদ্ধির কাছে তারা হার মানলো। উভয় বাহিনী যখন মুখোমুখি হতে শুরু করল। প্রিয় নবী আল্লাহর কাছে দরখাস্ত করলেন,

  'হে আল্লাহ কুরাইশরা পরিপূর্ণ অহঙ্কারের সাথে তোমার বিরোধীতায় এবং তোমার রাসূলকে মিথ্যা প্রমাণ করতে এগিয়ে এসেছে। হে আল্লাহ আজ তোমার প্রতিশ্রুত সাহায্য বড় বেশি প্রয়োজন। হে আল্লাহ আজ তুমি ওদের ছিন্ন ভিন্ন করে দাও।'

      কাতার সোজা করার পর নবীজী (সাঃ) সাহাবীদের বললেন, তার পক্ষ থেকে নির্দেশনা পেয়ে কেউ যেন যুদ্ধ না করে। তিনি বললেন, সহীহ বুখারী, ২য় খ- ৫৬৮পৃঃ তে হাদীস এসেছে, পৌত্তলিকরা যখন দলবদ্ধভাবে তোমাদের কাছে আসবে তখন তাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করবে, লক্ষ্য রাখবে যেন তীরের অপচয় না হয়।

   সুনান আবু দাউদ, ২য় খ-, পৃঃ-১৩ তে হাদীস এসেছে) "ওরা তোমাদেরকে ঘিরে না ফেলা পর্যন্ত তরবারি চালনা করবেনা।" অতঃপর নবীজী (সাঃ) আবুবকর (রাঃ) কে সঙ্গে নিয়ে অবস্থান কেন্দ্রে চলে গেলেন।

    অন্যদিকে পৌত্তলিকদের হেডমাস্টার ও সভাপতি আবু জেহেল আল্লাহর কাছে ফয়সালার জন্য দোয়া করলো। সে বললো, 
হে আল্লাহ আমাদের মধ্যে যে দল আত্মীয়তার সম্পর্ক অধিক ছিন্ন করেছে এবং ভুল কাজ করেছে, আজ তুমি তাদেরকে ধ্বংস করে দাও এবং তুমি আমাদের সাহায্য কর। পরবর্তী সময়ে আবু জেহেলের এ কথার প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লাহ তায়ালা সূরা আনফালের ১৯নং আয়াতে বলেন-
إِنْ تَسْتَفْتِحُوا فَقَدْ جَاءَكُمُ الْفَتْحُ ۖ وَإِنْ تَنْتَهُوا فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ ۖ وَإِنْ تَعُودُوا نَعُدْ وَلَنْ تُغْنِيَ عَنْكُمْ فِئَتُكُمْ شَيْئًا وَلَوْ كَثُرَتْ وَأَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ
"তোমরা মীমাংসা চেয়েছিলে তা তোমাদের কাছে এসেছে। যদি তোমরা বিরত হও সেটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। যদি তোমরা পুনরায় তা করো; তবে আমিও পুনরায় শাস্তি দেব এবং তোমাদের দল সংখ্যায় অধিক হলেও তোমাদের কোন কাজে আসবেনা এবং আল্লাহ তা'আলা মুমিনদের সঙ্গে রয়েছেন।"
সূরা আনফালঃ ১৯

    অতঃপর মুসলিম বাহিনীর সর্বকনিষ্ঠ মুজাহিদ উবাইদা (রাঃ) উতবা ইবনে রাবীয়ার বিরুদ্ধে. হামযা (রাঃ) শাইবার বিরুদ্ধে, আলী (রাঃ) ওয়ালীদ ইবনে উতবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এবং প্রত্যেককে খতম করে দিলেন। সীরাতে ইবনে হিশাম, ৩৪৩ পৃঃ।

     উভয় পক্ষে প্রচ- যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাসুল (সাঃ) আল্লাহর দরবারে এই দোয়া করলেন, হে আল্লাহ যদি আজ মুসলমানদের এই দল নিশ্চিহৃ হয়ে যায়; তবে দুনিয়ায় এবাদত করার মতো কেউই থাকবে না। হে আল্লাহ তুমি কি এটা চাও যে, আজকের পরে কখনোই তোমার এবাদত করা না হোক? হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) বলেন, ইয়া রাসুল আল্লাহ (সাঃ) হাত নামান, থামুন, আপনার দোয়ার কারণে আল্লাহর আরশ কাপঁতেছে। এদিকে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের প্রতি আদেশ পাঠালেন যা সূরা আনফালের ১২নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
إِذْ يُوحِي رَبُّكَ إِلَى الْمَلَائِكَةِ أَنِّي مَعَكُمْ فَثَبِّتُوا الَّذِينَ آمَنُوا ۚ سَأُلْقِي فِي قُلُوبِ الَّذِينَ كَفَرُوا الرُّعْبَ فَاضْرِبُوا فَوْقَ الْأَعْنَاقِ وَاضْرِبُوا مِنْهُمْ كُلَّ بَنَانٍ
"স্মরণ করো, তোমাদের প্রতিপালক ফেরেশতাদের প্রতি প্রত্যাদেশ করেন যে, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। সুতরাং তোমরা মোমেনদেরকে অবিচলিত রাখো; যারা কুফরী করে আমি তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে দেব। হে ফেরেশতাগণ, তোমরা শত্রুদের গর্দানের উপরিভাগে আঘাত করো; আরো আঘাত হানো প্রত্যেক গিরায় গিরায়।"

    এদিকে আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় নবীর প্রতি এ মর্মে অহী পাঠালেন, যা সূরা আনফালের ৯ নং আয়াতে বর্ননা করা হয়েছে।
إِذْ تَسْتَغِيثُونَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّي مُمِدُّكُمْ بِأَلْفٍ مِنَ الْمَلَائِكَةِ مُرْدِفِينَ
"আমি তোমাদেরকে সাহায্য করবো একহাজার ফেরেশতা দ্বারা, যারা একের পর এক আসবে"। 

      রাসুল পাক (সাঃ) কাছে এ সময় হযরত জিব্রাঈল (আঃ) আসলেন। তিনি চকিতে মাথা তুলে বললেন, আবু বকর খুশি হও। জিব্রাঈল এসেছেন, ধুলোবালির মধ্য এসেছেন। ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে, নবীজী (সাঃ) বলেন, আবু বকর খুশি হও, তোমাদের কাছে আল্লাহর সাহায্য এসে পৌঁছেছে। জিব্রাঈল ঘোড়ার লাগাম ধরে ঘোড়ার আগে আগে আসছেন। ধুলোবালি উড়ছে।

     নবীজী (সাঃ) এরপর কামরা থেকে বর্ম পরিহিত অবস্থায় বের হলেন এবং উদ্দীপনাময় ভঙ্গিতে সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্যে সাহাবীদেরকে বলেছিলেন যে, আর তিনি এক মুঠো ধূলি কাফেরদের প্রতি নিক্ষেপের সময় বললেন, 'শাহাতিল উজুহ' অর্থাৎ ওদের চেহারা আচ্ছন্ন হোক। এই নিক্ষিপ্ত ধুলি প্রত্যেক কাফেরের চোখ, মুখ, নাক ও গলায় প্রবেশ করলো। একজনও বাদ গেলনা। যা বর্তমান সময়ের মারনাস্ত্র, ক্ষেপনাস্ত্র, চালকবিহীন ড্রোন থেকেও হাজার হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী ছিলো। এ সর্ম্পকে আল্লাহ তায়ালা সূরা আনফালের ১৭ নং আয়াতে বলেন।
فَلَمْ تَقْتُلُوهُمْ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ قَتَلَهُمْ ۚ وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ رَمَىٰ ۚ وَلِيُبْلِيَ الْمُؤْمِنِينَ مِنْهُ بَلَاءً حَسَنًا ۚ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
  সুতরাং তোমরা তাদেরকে হত্যা করনি, বরং আল্লাহই তাদেরকে হত্যা করেছেন। আর তুমি মাটির মুষ্ঠি নিক্ষেপ করনি, যখন তা নিক্ষেপ করেছিলে, বরং তা নিক্ষেপ করেছিলেন আল্লাহ স্বয়ং যেন ঈমানদারদের প্রতি এহসান করতে পারেন যথার্থভাবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ শ্রবণকারী; পরিজ্ঞাত।
সূরা আনফালঃ ১৭

  (বর্তমান মুসলিম দেশগুলো যখন যুদ্ধবিমান, মিসাইল তৈরী করে কাফেরদের জন্য সেগুলোতে 8/17 লিখেন এর প্রধান উৎসই হলো 8 নাম্বার সূরা আনফালের 17 নাম্বার আয়াত)

    তখন নবীজী সকলকে অগ্রগামী হয়ে যুদ্ধ করার জন্যে তাগিদ দিলেন এবং বললেন, যারা এই যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করবে তারা জান্নাতি । সাহাবায়ে কেরাম এ কথা শুনে আরো খুশি হয়ে গেলেন। রাসূল (সাঃ) যখন এই জবাবী হামলার নির্দেশ দেন তখন শত্রুদের হামলার তীব্রতা কমে আসে।

     মুসলীম শরীফের ২য় খ- পৃ: ১৩৯," নবীজী (সাঃ) এর উৎসাহে সাহাবীরা বিপুল বিক্রমে লড়াই করেন । এ সময়ে ফেরেশতারা মুসলমানদের সাহায্য করেন।" যখন অভিশপ্ত ইবলিস কুরাইশদের কাছে সুরাকা ইবনে মালেকের আকৃতি ধারন করে যুদ্ধে সাহায্য করার কথা বলেছিল কিন্ত যুদ্ধের ময়দান থেকে পালায়নের সময় মক্কার মোশরেকরা বলতে লাগল, সুরাকা তুমি কোথায় যাচ্ছ? তুমি কি বল নি আমাদের সাহায্য করবে? সুরাইকা বলল, আমি এমন কিছু দেখতে পাচ্ছি যা তোমরা দেখতে পাওনা। আল্লাহকে আমার ভয় হচ্ছে, তিনি কঠোর শাস্তিদাতা। এরপর ইবলিশ সমুদ্রে গিয়ে আত্নগোপন করলো। আররাহীকুল মাখতুম ২২৫ পৃঃ

    শয়তানের পালায়ন করার কারণ সর্ম্পকে সে যা বলল আল্লাহ তায়ালা সূরা আনফালের ৪৮ নং আয়াতে তা বিশ্ববাসীকে শুনিয়ে দিলেন।
وَإِذْ زَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ وَقَالَ لَا غَالِبَ لَكُمُ الْيَوْمَ مِنَ النَّاسِ وَإِنِّي جَارٌ لَكُمْ ۖ فَلَمَّا تَرَاءَتِ الْفِئَتَانِ نَكَصَ عَلَىٰ عَقِبَيْهِ وَقَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِنْكُمْ إِنِّي أَرَىٰ مَا لَا تَرَوْنَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ ۚ وَاللَّهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ
আর যখন সুদৃশ্য করে দিল শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যকলাপকে এবং বলল যে, আজকের দিনে কোন মানুষই তোমাদের উপর বিজয়ী হতে পারবে না আর আমি হলাম তোমাদের সমর্থক, অতঃপর যখন সামনাসামনী হল উভয় বাহিনী তখন সে অতি দ্রুত পায়ে পেছনে দিকে পালিয়ে গেল এবং বলল, আমি তোমাদের সাথে না-আমি দেখছি, যা তোমরা দেখছ না; আমি ভয় করি আল্লাহকে। আর আল্লাহর আযাব অত্যন্ত কঠিন।
(সূরা আল-আনফালঃ ৪৮)

    বদর যুদ্ধে ফেরেশতাগণ অংশগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু কিভাবে শত্রু নিধন করতে হয় তা তাদের জানা ছিলনা। আল্লাহ্ তায়ালা সূরা আনফালের ১২নং আয়াতে তাঁদেরকে শত্রুর উপর আঘাত হানার কৌশল শিক্ষা দিয়ে এরশাদ করেন। 
إِذْ يُوحِي رَبُّكَ إِلَى الْمَلَائِكَةِ أَنِّي مَعَكُمْ فَثَبِّتُوا الَّذِينَ آمَنُوا ۚ سَأُلْقِي فِي قُلُوبِ الَّذِينَ كَفَرُوا الرُّعْبَ فَاضْرِبُوا فَوْقَ الْأَعْنَاقِ وَاضْرِبُوا مِنْهُمْ كُلَّ بَنَانٍ
যখন নির্দেশ দান করেন ফেরেশতাদিগকে তোমাদের পরওয়ারদেগার যে, আমি সাথে রয়েছি তোমাদের, সুতরাং তোমরা মুসলমানদের চিত্তসমূহকে ধীরস্থির করে রাখ। আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেব। কাজেই (হে ফেরেশতাগণ,) তোমরা শত্রুদের গর্দানের উপরিভাগে আঘাত করো; আরো আঘাত হানো প্রত্যেক গিরায় গিরায়। 
সূরা আল-আনফালঃ ১২

   ফেরেশতাগণ কর্তৃক শত্রু নিধনের আলামত ছিল গলায় কালো দাগ। সাহাবায়ে কেরাম বলেন, আমরা তরবারি দ্বারা আঘাত করার পূর্বেই কাফেরদের মস্তক দ্বিখ-িত হয়ে পড়তো। এভাবে ৭০ জনের মধ্যে ৬৪ জন ছিল ফেরেশতাদের আঘাতে নিহত হয়েছে । আমাদের হাতে মাত্র ৬ জন নিহত হয়েছে। (তাফসীরে রুহল বয়ান)।

   অপরদিকে বিশ্ব নবী (সাঃ) এর মুজেযা যুদ্ধের ময়দানে প্রকাশ পেলে সাহাবায়ে কেরাম আরো তেজদীপ্ত হয়ে উঠেন । যুদ্ধে ওকাশা (রাঃ) নামক এক সাহাবীর তরবারি ভেঙ্গে যায়। নবীজী (সাঃ) তাকে খেজুরের একটি শুকনো ডাল দিয়ে বললেন, তুমি এটা দিয়ে যুদ্ধ করো। আল্লাহর কুদরতে খেজুরের ডাল ইস্পাতের তলোয়ারে পরিণত হয়ে গেলো। সুবহানাআল্লাহ এই তলোয়ারের নাম রাখা হয় আউন বা আল্লাহর সাহায্য। যা দিয়ে ওকাশা (রাঃ) জীবনভর যুদ্ধ করেছেন।

    অন্যদিকে যুদ্ধের ময়দানে মুয়ায ইবনে আমর (রাঃ) এর একটি হাত আবু জেহেলের পুত্র ইকরামার আঘাতে দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। তিনি হাতের খন্ডিত অংশ নিয়ে নবীপাকের কাছে উপস্থিত হলেন এবং নবীজী (সাঃ) সেই খন্ডিত হাত সংযুক্ত করে তাতে থুথু মোবারক লাগিয়ে জোড়া দিয়ে দিলেন। সাথে সাথে আল্লাহর মেহেরবাণীতে তার হাতখানা জোড়া লেগে গেল। তিনি উক্ত হাত নিয়ে সুস্থ অবস্থায় হযরত ওসমান রা: এর খেলাফাতকাল পর্যন্ত বেঁচেছিলেন।

    কিছুক্ষণের মধ্যেই অমুসলিমদের বাহিনীতে ব্যর্থতা ও হতাশার সুস্পষ্ট লক্ষণ ফুটে উঠলো। মুসলমানদের প্রবল আক্রমণের মুখে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লো। কাফের কোরাইশরা পশ্চাদপসারণ করতে লাগলো এবং তাদের মনে হতাশা ছেয়ে গেল। মুসলমানরা কাউকে হত্যা করেছিলেন, কাউকে যখম করেছিলেন, কাউকে ধরে নিয়ে আসছিলেন। ফলে কাফেররা সুস্পষ্ট পরাজয় বরণ করলো। তবুও আবু জেহেল লাত, মানাত, উযযার কসম খেয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল ওৎবা, শায়বা, অলীদ নিহত হয়েছে দেখে তোমরা হিম্মত হারিওনা। অতঃপর মুসলমানরা লক্ষ্য করলেন যে, আবু জেহেল একটি ঘোড়ার পিঠে রয়েছে এবং তার মৃত্যু পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছিল। সহীহ বুখারীর ১ম খ- পৃ. ৪৪৪ এ আবু জেহেলের হত্যাকারীর বর্ননা প্রদান করা হয়েছে। মায়াজ ও মুয়াওয়াজ নামক দুই আনসার কিশোর আবু জেহেলকে হত্যার মূল নায়ক ছিল। অতঃপর নবীজী (সাঃ) তাদের দুইভাইকে আবু জেহেলের যুদ্ধলব্ধ সম্পত্তি ভাগ করে দিয়েছেন। এরপর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. আবু জেহেলের মাথা কেটে নবীজীর কাছে এনে বললেন ইয়া রাসুল আল্লাহ (সাঃ) এই হচ্ছে মক্কার কোরাইশ সরদার মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শত্রু আবু জেহেলের মাথা। নবীজী তা দেখে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন।

      পরে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) কোরাইশ নেতৃবৃন্দের লাশ কুয়ার মধ্যে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দিলেন। তিনি কুয়ার পাশে দাঁড়িয়ে একে একে কুয়ায় নিক্ষিপ্ত সকলের নাম নিয়ে ধ্বনি করে বললেন, -
حدثنا علي بن عبد الله، حدثنا يعقوب بن إبراهيم، حدثني أبي، عن صالح، حدثني نافع، أن ابن عمر ـ رضى الله عنهما ـ أخبره قال اطلع النبي صلى الله عليه وسلم على أهل القليب فقال ‏"‏ وجدتم ما وعد ربكم حقا ‏"‏‏.‏ فقيل له تدعو أمواتا فقال ‏"‏ ما أنتم بأسمع منهم ولكن لا يجيبون ‏"‏‏.‏

 ইব্‌নু ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

তিনি বলেন, নবী  (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (বদরে নিহত) গর্তবাসীদের [১] দিকে ঝুঁকে দেখে বললেনঃ “তোমাদের সাথে রব যে ওয়াদা করেছিলেন, তা তোমরা বাস্তবে পেয়েছ তো?” - (সূরা আল-আ’রাফ (৭) : ৪৪)। তখন তাঁকে বলা হল, আপনি মৃতদের ডেকে কথা বলছেন? (ওরা কি শুনতে পায়?) তিনি বললেনঃ “তোমরা তাদের চেয়ে অধিক শুনতে পাও না, তবে তারা জবাব দিতে পারছে  না”। [২]

  ফুটনোটঃ
[১] 'القَليب'  পুরাতন গর্ত বা খাদ যে গর্তের মুখ বন্দ করা হয়নী । বদর যুদ্ধে নিহত মুশরীক দলনেতা আবূ জাহল গঙদের একটি গর্তে নিক্কেপ করা হয়েছিল, 'قَليب' বদরের গর্ত বা খাদ বলা হয় ।

[২] কবরবাসীকে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা নবী  (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও কোন কিছু শুনানোর ক্ষমতা রাখেন না তবে মহান আল্লাহ্‌ তাওফীক দিলে সম্ভব। বর্ণিত অবস্থা তারই দৃষ্টান্ত। 
সহিহ বুখারী, হাদিস নং ১৩৭০

  হে কুয়ার অধিবাসী, হে উৎবা, হে শায়বা, আল্লাহ্ তোমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা যথাযথভাবে পেয়েছো? আমি তো আমার রবের প্রতিশ্রুতি বাস্তবরূপে পেয়েছি" বুখারী, মুসলিম, মেশকাত।

  ফলাফল ও যুদ্ধে পরবর্তী ঘটনা : মুসলমানদের বিজয় পরিপূর্ণ হওয়ার পর প্রিয় নবী (সাঃ) মদীনাবাসীদের তাড়াতাড়ি সুসংবাদ দেওয়ার জন্য দুইজনকে দ্রুত মদীনায় প্রেরণ করলেন। তারা হলেন, আব্দুল্লাহ্ ইবনে রওয়াহা ও যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ)। মদীনায় ঐ সময় বিজয়ের খবর পৌঁছলো যখন নবীজীর মেয়ে হযরত ওসমান (রাঃ) এর সহধর্মিণী হযরত রোকাইয়া (রাঃ) এর কবরের মাঠি সমান করা হচ্ছিল। রোকাইয়া অসুস্থ ছিলেন, যার কারণে নবীজী (সাঃ) প্রিয় সন্তানের মায়া ত্যাগ করে মহান আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য তার পাশে হযরত ওসমান (রাঃ) কে রেখে বদর যুদ্ধে গিয়েছিলেন।

    যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর নবীজী (সা:) তিনদিন বদর ময়দানে অবস্থান করেছিলেন এবং যুদ্ধলব্ধ গণীমতের মাল ও সাহাবীদের নিয়ে মদিনায় রওয়ানা দিলেন। অতঃপর কাফেলা যখন মদীনার রওয়াহা নামক স্থানে পৌছলো, তখন মদীনা বাসীরা নবীকে স্বাগত জানাতে শুরু করলেন। হুুজুর (সাঃ) মদীনায় সাহাবীদের নিয়ে বিজয়ের বেশে প্রবেশ করলেন। যার ফলে বহু অমুসলিম মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করেছিল। নবীজী (সাঃ) মদীনার সকল মুসলমানদের লক্ষ্য করে বললেন, হে মুসলমানগন, আল্লাহর প্রশংসা ও শোকর আদায় কর। আল্লাহর মেহেরবাণীতে আমরা সম্পূর্ণরূপে জয়ী হয়েছি। মক্কার কুরাইশরা পরাজিত হয়ে পলায়ন করেছে । তাদের ৭০ জনকে বন্দী করে এনেছি। শত্রুদের বহু ধন-সম্পদ আমাদের হস্তগত হয়েছে। অন্যদিকে মুসলমানদের মধ্য থেকে ১৪ জন শাহাদাত বরণ করেছেন। 
বদর যুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী ১৪ জন সাহাবীর নাম

১) উমায়ের ইবনে আবি ওক্কাস (রাঃ) عمير أبن أبي وقاص

২) যুশ শিমালাইন বিন আব্দে আমর (রাঃ)ذو الشمالين بن عبد عمرو

৩) সাফওয়ান বিন ওয়াহব (রাঃ) صفوان بن وهب

৪) মাহজা ইবনে সালেহ (রাঃ) مهجع بن صالح

৫) আকীল ইবনু বুকাইর (রাঃ) عاقل بن البكير

৬) উবাইদা ইবনুল হারিছ (রাঃ) عبيدة بن الحارث

৭) সা‘দ ইবনে খাইছামা (রাঃ) سعد بن خيثمة

৮) মুবাশশির ইবনুল মুনযির (রাঃ) مبشر ابن المنذر.

৯) হারেছা বিন সুরাকা (রাঃ) حارثة بن سراقة

১০) রাফে ইবনে মুআল্লা (রাঃ) رافع بن المعلاء

১১) উমাইর ইবনুল হুমাম(রাঃ) عمير ابن الحمام.

১২) ইয়াজীদ ইবনুল হারিছ (রাঃ) يزيد بن الحارث

১৩) মুআওয়িয ইবনুল হারিছ (রাঃ) معوذ بن الحارث

১৪) আওফ ইবনুল হারিছ (রাঃ)عوف بن الحارث

  ইন্নালিল্লাহি ওইন্নাইলাইহি রাজিউন। অতঃপর তিনি সঠিকভাবে সকলের মাঝে গণীমতের মাল সমবন্টন করে দিলেন।

   পরিশেষে বদরের যুদ্ধ থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত যে, সুদকে বর্জন করে ব্যবসা করে আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রেখে, ধৈর্য ধারণ করার মাধ্যমে এবং নেতার আনুগত্যের দ্বারা আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীনের সাহায্য লাভ করা যায়। শুধু নিজে সুদ বর্জন নয় রাষ্ট্রীয়ভাবে এটাকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম করতে হবে।

যার উজ্জল দৃষ্টান্ত হলো বদরের ঐতিহাসিক যুদ্ধ।

Post a Comment

0 Comments