Recent Tube

গুনাহ মাফের উপায়। শাহাদাত হোসাইন খান রহঃ ।










 

গ্রন্থঃ গুনাহ মাফের উপায়
অধ্যায়ঃ দ্বিতীয় অধ্যায় : গুনাহ মাফের উপায়,

 
৩. তাওবাহ্ করা - (ঘ) খাঁটি তাওবার শর্তাবলী ও পদ্ধতি 

তাওবাহ্ খাঁটি হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। সে শর্তসমূহ পূরণ না করে তাওবাহ্ করলে সে তাওবাহ্ খাঁটি তাওবাহ্ হবে না আর তা আল্লাহর নিকট কবূলও হবে না। শর্তাবলীর সংখ্যা সর্বনিমণ ৩টি আর সর্বোচ্চ ৬টি। যদি গুনাহের সম্পর্ক শুধু আল্লাহর (অবাধ্যতার) সঙ্গে থাকে এবং কোন মানুষের অধিকারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকে, তাহলে এ ধরনের তাওবাহ্ ক্ববূলের জন্য ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ)[1]ও সাউদী আরবের সাবেক গ্রান্ড মুফতী শাইখ ‘আবদুল ‘আযীয বিন ‘আবদুল্লাহ বিন বায (রহিমাহুল্লাহ)[2]সহ অনেক আলিমের মতে শর্ত ৩টি। তবে কোন গুনাহ যদি মানুষের অধিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় তাহলে আরও একটি শর্ত বেড়ে তা হয়ে যাবে ৪টি।

তবে সাউদী আরবের আরেক বিখ্যাত ‘আলিম শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমীন (রহিমাহুল্লাহ)-এর মতে তাওবার শর্ত মোট ৫টি। তবে মানুষের অধিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করার জন্য অতিরিক্ত ১টি শর্ত যোগ হবে। তা হলো পাওনাদারকে তার হক বা অধিকার ফিরিয়ে দেয়া। সুতরাং যদি এগুলোর মধ্যে একটি শর্তও বাদ পড়ে, তাহলে সেই তাওবাহ্ খাঁটি তাওবাহ্ হবে না। নিম্নে ঐ সকল শর্ত সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো :

তাওবাহ্ একমাত্র আল্লাহর জন্য হতে হবে এবং আল্লাহর কাছে করতে হবে;

গুনাহর কাজ করার জন্য অনুতপ্ত ও লজ্জিত হতে হবে;

যে গুনাহ হতে তাওবাহ্ করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে;

ভবিষ্যতে এই গুনাহ আর না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে;

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাওবাহ্ করতে হবে;

মানুষের অধিকার তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে।


এসব শর্তাবলী নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :

১. তাওবাহ্ একমাত্র আল্লাহর জন্য হতে হবে এবং আল্লাহর কাছে করতে হবে :

মহান আল্লাহর ভয় বা সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোন সৃষ্টির ভয় বা সন্তুষ্টির উদ্দেশে তাওবাহ্ করলে সেই তাওবাহ্ কখনো কবূল হবে না। কোন মানুষকে দেখানো বা তার নৈকট্য পাওয়ার উদ্দেশে কিংবা কারো চাপে পড়ে তাওবাহ্ করলে বা সুনাম নেওয়ার জন্য তাওবাহ্ করলে অথবা কারো মন রক্ষার জন্য তাওবাহ্ করলে বা কোন স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে তাওবাহ্ করলে, সে তাওবাহ্ খাঁটি তাওবাহ্ হবে না।

তাওবাহ্ দ্বারা উদ্দেশ্য হতে হবে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকাল এবং গুনাহ থেকে মুক্তি। এ ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশে তাওবাহ্ করা যাবে না। বরং অন্য কোন উদ্দেশে তাওবাহ্ করলে গুনাহ মাফ তো হবেই না উল্টো নতুন গুনাহ ‘আমলনামায় যোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উল্লেখ্য যে, খ্রিস্টানদের পাদ্রী কিংবা মুসলিমদের পীর-দরবেশ, বুজুর্গ-মাশায়েখ, হিন্দুদের ব্রাহ্মণ-ঠাকুর-পুরোহিতের কাছে তাওবাহ্ করার কোন সুযোগ নেই। তাওবাহ্ মানে তাদের পড়ানো কোন গদ নয়। তারা কেউই ব্যক্তির পাপ মোচন করতে পারে না। আল্লাহ দুনিয়ার কাউকে এমন ক্ষমতা দেননি।

তাওবাহ্ করতে হবে সরাসরি আল্লাহর কাছে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও কাছে তাওবাহ্ করলে সে তাওবাহ্ কখনই আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছবে না। কবূল হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। বরং তা শির্ক। খ্রিষ্টান পাদ্রীরা পাপ মোচনের দায়-দায়িত্ব নিজেরা নিয়ে নিয়েছে আর হিন্দু মুশরিক পুরোহিতরাও নিজেরা তাদের পদ্ধতি অনুকরণ করেছে। কিন্তু ইসলামে এগুলোর অবকাশ নেই। তবে হ্যাঁ, ‘আলিমগণ অবশ্যই তাওবার নিয়ম-কানুন শিখাতে-পড়াতে ও কালেমার তালকীন দিতে শরীয়ত অনুযায়ী সহযোগিতা ও পরামর্শ দিতে পারেন। মূলত তাওবাহ্ করার বিষয় শুধু মুখে পড়ার বিষয় নয়।


২. গুনাহের কাজ করার জন্য অনুতপ্ত ও লজ্জিত হতে হবে :

গুনাহ করার পর তা থেকে তাওবাহ্ করতে চাইলে তাওবাকারীকে অবশ্যই তার কৃতকর্মের জন্য অন্তর থেকে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হতে হবে। অপরাধকর্মের কারণে লজ্জিত হওয়া খাঁটি তাওবার শর্ত। তাইতো নাবী (সা.) বলেছেন :

النَّدَمُ تَوْبَةٌ

‘‘অনুতপ্ত হওয়াই হল তাওবার মূল বিষয়।’’[3]

কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত না হয়ে, অনুতপ্ত না হয়ে যত তাওবাই করা হোক তা আল্লাহ গ্রহণ করবেন না। ইসলামের নীতিমালায় প্রসিদ্ধ নীতি হলো, ‘পাপকাজ করে লজ্জিত হলে পাপ কমে যায়। আর পুণ্য কাজ করে গর্ববোধ করলে পুণ্য বাতিল হয়ে যায়।’ যে পাপ কাজ করে, সে সাধারণ মানুষ। যে পাপ করে অনুতপ্ত হয়, সে নেককার মানুষ। আর যে পাপ করার পর তার বড়াই করে, সে শয়তান। এমন অনেক পাপ আছে, যা অনেক নির্বোধ মানুষের কাছে গর্বের বিষয়। ফলে পাপী সেই পাপ করে বন্ধু-বান্ধব ও জনগণের সামনে প্রকাশ করে গর্ব অনুভব করে। এর ফলে গুনাহ মাফ হওয়ার সহজ সম্ভাবনাটুকু নষ্ট হয়ে যায়। তখন তার পাপ কাজের অনেক সাক্ষী তৈরি হয়ে যায়। ফলে পাপ থেকে মাফ পাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ সম্পর্কে নাবী (সা.) বলেছেন :

كُلُّ أُمَّتِى مُعَافَاةٌ إِلَّا الْمُجَاهِرِينَ وَإِنَّ مِنَ الْإِجْهَارِ أَنْ يَعْمَلَ الْعَبْدُ بِاللَّيْلِ عَمَلًا ثُمَّ يُصْبِحُ قَدْ سَتَرَه رَبُّه فَيَقُولُ يَا فُلَانُ قَدْ عَمِلْتُ الْبَارِحَةَ كَذَا وَكَذَا وَقَدْ بَاتَ يَسْتُرُه رَبُّه فَيَبِيتُ يَسْتُرُه رَبُّه وَيُصْبِحُ يَكْشِفُ سِتْرَ اللهِ عَنْهُ

‘‘আমার প্রত্যেক উম্মাতের পাপ মাফ করে দেয়া হবে, তবে যে প্রকাশ্যে পাপ করে (অথবা পাপ করে বলে বেড়ায়) তার পাপ মাফ করা হবে না। আর পাপ প্রকাশ করার এক ধরন এও যে, একজন লোক রাত্রে কোন পাপ করে ফেলে, অতঃপর আল্লাহ তা গোপন করে নেন। (অর্থাৎ কেউ তা জানতে পারে না।) কিন্তু সকাল বেলায় উঠে সে লোকের কাছে বলে বেড়ায়, ‘হে অমুক! গত রাতে আমি এই এই (পাপ) কাজ করেছি।’ রাতের বেলায় আল্লাহ তার পাপকে গোপন রেখে দেন; কিন্তু সে সকাল বেলায় আল্লাহর সে গোপনীয়তাকে নিজে নিজেই ফাঁস করে ফেলে।’’[4]

তাই গুনাহ হয়ে গেলে তা গোপন রাখতে হবে এবং গোপনে লজ্জিত হয়ে আল্লাহর কাছে মাফ চাইতে হবে। তাহলেই আশা করা যায় পাপীর তাওবাহ্ কবূল হবে।


৩. যে গুনাহ হতে তাওবাহ্ করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে :

গুনাহগার ব্যক্তি যে গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করতে চাচ্ছেন তাওবার শুরুতেই তাকে ঐ গুনাহ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে ফেলতে হবে। অর্থাৎ ঐ গুনাহ বর্জন করতে হবে। তাওবার শর্তসমূহের মধ্যে এই শর্তটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। কোন ফরয কাজ না করার গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করতে চাইলে আগে ঐ কাজটি করে তাওবাহ্ করতে হবে। যেমন কেউ যাকাত দিত না। এখন যদি যে যাকাত না দেয়ার পাপ থেকে তাওবাহ্ করতে চায় তাহলে তাকে সবার আগে পূর্বের যত বছরের যাকাত দেয়নি তা হিসাব করে আদায় করতে হবে। কারণ যাকাত আল্লাহর হক এবং গরীবের হক। তাওবার দ্বারা আল্লাহর হক থেকে মুক্তি পেলেও গরীবের হক থেকে তো সে মুক্তি পাচ্ছে না। তাই সাউদী আরবের বিখ্যাত ফাতাওয়া বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘‘ইসলাম কিউ এ’’-তে পুরনো বছরগুলোর যাকাত সাধ্য অনুযায়ী হিসাব করে আদায় করাকে ওয়াজিব বলা হয়েছে। যদি সাধ্য থাকে আর সে তা আদায় করে তাহলে তার তাওবাহ্ কবূল হবে।[5]

একইভাবে কেউ যদি পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়ার গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করতে চায় তাহলে তাকে সবার আগে পিতা-মাতার সেবায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। কেউ যদি আত্মীয়তার সম্পর্ক না রাখার গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করতে চায় তাহলে তাকে সবার আগে যে সকল আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল তাদের সাথে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপন করে তাওবাহ্ করতে হবে। যারা মদ্যপান বা ধূমপান করে তাদেরকে মদ্যপান বা ধূমপান ছেড়ে দিয়ে তাওবাহ্ করতে হবে।

আবার একইভাবে হারাম কোন কাজ করে ফেলার গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করতে চাইলে সবার আগে খুব দ্রুত সেই হারাম কাজটি করা বর্জন করতে হবে। তারপর তাওবাহ্ করতে হবে। যেমন কেউ যদি সুদের পাপ থেকে তাওবাহ্ করতে চায় তাহলে তাকে সবার আগে সুদ গ্রহণ বন্ধ করতে হবে এবং তা থেকে দূরে সরে যেতে হবে। আর সুদের যে অর্থ-সম্পদ তার কাছে আছে তা হিসাব করে হালাল অর্থ থেকে পৃথক করে সাওয়াবের উদ্দেশ্য ছাড়া সমাজকল্যাণমূলক কাছে ব্যয় করতে হবে। কেউ তাওবাহ্ করতে চায় অথচ ফরয ‘ইবাদাত বর্জন করেই যাচ্ছে বা হারাম কাজ করেই যাচ্ছে তাহলে তার তাওবাহ্ কখনোই কবূল হবে না। বরং তার তাওবাহ্ হয়ে যাবে আল্লাহর সাথে ঠাট্টা করার শামিল। ময়লা থেকে পা ধুয়ে সেই পা কোন ময়লাহীন শুকনো স্থানে রাখতে হবে। নয়তো ময়লায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় পা ধুলে অথবা ধোয়া পা ময়লাতেই রাখলে পা ধোয়া নিরর্থক হবে।

কুয়ার মধ্যে পড়ে যাওয়া বিড়ালের ঘটনা থেকে গুনাহ থেকে কিভাবে তাওবাহ্ করতে হয় তার একটি বাস্তব উদাহরণ পাওয়া যায়। নীচের গল্পটি পড়ে দেখুন:

এক ব্যক্তি এক মুফতী সাহেবকে ফতোয়া জিজ্ঞেস করলো যে, যে পানি থেকে গন্ধ আসে, সে পানিতে উযূ-গোসল করলে পবিত্রতা অর্জিত হবে কিনা? মুফতী সাহেব বললেন, ‘৪০ বালতি পানি তুলে ফেললে পানি পবিত্র হয়ে যাবে।’ মুফতী সাহেবের ফতোয়া শুনে বাড়ির মালিক অতি কষ্টে কুয়া থেকে ৪০ বালতি পানি তুলে ফেললেন, কিন্তু তাতেও পানির দুর্গন্ধ গেল না।

ঐ ব্যক্তি মুফতী সাহেবকে আবার জিজ্ঞেস করলো, আমি তো কুয়া থেকে ৪০ বালতি পানি তুলে ফেলে দিয়েছি, এখন কি কুয়ার পানি পবিত্র হয়েছে? মুফতী সাহেব তাকে আবারও ৪০ বালতি পানি তুলে ফেলার নির্দেশ দিলেন। ৪০ বালতি পানি তুলে ফেলা হলো। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন নেই। আরো ৪০ বালতি পানি তুলে ফেলতে আদেশ করার পরও যখন পানির দুর্গন্ধ গেল না, তখন বাড়িওয়ালা মুফতী সাহেবের প্রতি রাগান্বিত হলেন। এবার মুফতী সাহেব সরেজমিনে তদন্তে নামলেন।

সরেজমিনে গিয়ে কুয়ার নিচে তাকিয়ে দেখলেন, সাদা সাদা কী যেন একটা জিনিস ভাসছে। তিনি বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতেই বাড়িওয়ালা বললেন, ‘ওই সেই বিড়ালটা, যেটা পড়ে মারা গেছে।’ মুফতী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওটা তুলে ফেলেননি কেন?’ বাড়িওয়ালা বলল, ‘হুযুর! আপনি তো ওটা তুলে ফেলতে বলেন নি।’ মুফতী সাহেব বললেন, ‘সেটাও কি বলতে হয়? এ কথা কি আপনার বুদ্ধিতে ধরে না যে, পানি থেকে বিড়ালের পচা-গলা দেহ না তুলে বালতির পর বালতি পানি তুলে ফেললেও কুয়ার পানি পবিত্র ও দুর্গন্ধহীন হবে না।’

এই গল্প কাল্পনিক হলেও এর মাধ্যমে স্পষ্টভাবেই বোঝা গেল যে, কুয়ার মধ্যে বিড়ালের পচা-গলা দেহ রেখে কুয়ার পানিকে দুর্গন্ধমুক্ত ও পবিত্র করার চেষ্টা করা আর পাপরত অবস্থায় তাওবাহ্ ও ইস্তিগফার করা প্রায় একই কথা। পাপে রত অবস্থায় তাওবাহ্ ও ইস্তিগফার করার কী মূল্য হতে পারে? মদ খেতে খেতে ‘তাওবা-তাওবা’ বললে, ব্যভিচারে লিপ্ত থাকা অবস্থায় ‘আস্তাগফিরুল্লাহ-আস্তাগফিরুল্লাহ’ পড়লে কী লাভ হতে পারে? তাই আগে পাপ বর্জন করতে হবে, তারপর তাওবাহ্ করতে হবে। তবেই সেই তাওবাহ্ কবূল হবে। নয়তো তা হবে পন্ডশ্রম। তবে ইস্তিগফার সবসময়ই করতে থাকতে হবে।


৪. ভবিষ্যতে এই গুনাহ আর না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে :

খাঁটি তাওবাহ্ করার জন্য কৃত গুনাহর জন্য লজ্জিত হয়ে গুনাহ বর্জন করলেই হবে না। ভবিষ্যতে আর এই গুনাহ না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে। যদি তাওবাহ্ করার সময় মনে মনে নিয়ত থাকে যে সুযোগ পেলে আবার ঐ গুনাহর কাজ করবো তাহলে সেই তাওবার কোন গুরুত্ব আল্লাহর কাছে নেই। সেই তাওবাহ্ কোন তাওবাই নয়। যেমন কোন ব্যক্তি অঢেল অর্থ-সম্পত্তির মালিক। এমতাবস্থায় সে মদন্ডনারী নিয়ে যেনা-ব্যভিচার করার জন্য প্রস্ত্ততি নিয়ে বিদেশ গেলো। হঠাৎ কোন এক কারণে তার অর্থ-সম্পদ শেষ হয়ে সে নিঃস্ব হয়ে পড়লো। তখন সে তাওবাহ্ করতে লাগলো। অথচ তার মনে আকাঙক্ষা আছে যে, সে যদি আবার অর্থ-সম্পদের মালিক হতে পারে তাহলে সে আবার যেনা করবে। মদ পান করবে। তাহলে তার এই তাওবাহ্ আল্লাহর নিকট কবূল হবে না। তার তাওবাহ্ হচ্ছে অপারগের তাওবাহ্। কোন পাপ কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে তা থেকে তাওবাহ্ করলে তা তাওবাহ্ হয় না। তবে যৌবন বয়সে করা পাপের তাওবাহ্ বৃদ্ধকালে করলে আশা করা যায় আল্লাহ কবূল করবেন। কারণ সে হয়তো যৌবনকালে বুঝতে পারেনি। বৃদ্ধকালে নিজের অপরাধের কথা বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে তাওবাহ্ করলে সেই তাওবাও আল্লাহ কবূল করবেন, ইনশা-আল্লা-হ।

তবে কখনো কখনো পাপ পুনরায় না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও যদি আবার তা করে ফেলে, তাহলে বলা যাবে না যে, পাপীর আগের তাওবাহ্ কবূল হয়নি, তা বাতিল হয়ে গেছে। কারও আগের তাওবাহ্ কবূল হওয়ার পরও সে আবার পাপে লিপ্ত হতে পারে। তখন সে আবার তাওবাহ্ করবে। ভবিষ্যতে পাপ না করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও যদি অনিচ্ছা সত্ত্বে বারবার সে পাপে লিপ্ত হয়ে যায় তাহলে সে বারবারই তাওবাহ্ করবে।

তবে মনে রাখতে হবে পাপী ব্যক্তি কোন অবস্থায় সেই পাপে লিপ্ত হয়েছে তা কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা জানেন। তাই আল্লাহকে ফাঁকি দিয়ে তাওবাহ্ করা যায় না। সাধারণভাবে কেউ যদি অনিচ্ছকৃত বা না জেনে গুনাহ করে আল্লাহর কাছে মাফ চায়, আবার গুনাহ করে মাফ চায় আল্লাহ ক্ষমা করবেন। সে কথাই নাবী (সা.) হাদীসে কুদসীতে বর্ণনা করেন। তিনি (সা.) বলেন :

أَذْنَبَ عَبْدٌ ذَنْبًا فَقَالَ اللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِى ذَنْبِى. فَقَالَ تَبَارَكَ وَتَعَالٰى أَذْنَبَ عَبْدِى ذَنْبًا فَعَلِمَ أَنَّ لَه رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِالذَّنْبِ. ثُمَّ عَادَ فَأَذْنَبَ فَقَالَ أَىْ رَبِّ اغْفِرْ لِى ذَنْبِى. فَقَالَ تَبَارَكَ وَتَعَالٰى عَبْدِى أَذْنَبَ ذَنْبًا فَعَلِمَ أَنَّ لَه رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِالذَّنْبِ. ثُمَّ عَادَ فَأَذْنَبَ فَقَالَ أَىْ رَبِّ اغْفِرْ لِى ذَنْبِى. فَقَالَ تَبَارَكَ وَتَعَالٰى أَذْنَبَ عَبْدِى ذَنْبًا فَعَلِمَ أَنَّ لَه رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِالذَّنْبِ وَاعْمَلْ مَا شِئْتَ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكَ

‘‘কোন বান্দা একটি পাপ করে বলল, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার পাপ ক্ষমা কর।’ তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমার বান্দা একটি পাপ করেছে, অতঃপর সে জেনেছে যে, তার একজন রব আছেন, যিনি পাপ ক্ষমা করেন অথবা তা দিয়ে পাকড়াও করেন।’ অতঃপর সে আবার পাপ করল এবং বলল, ‘হে আমার রব! তুমি আমার পাপ ক্ষমা কর।’ তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমার বান্দা একটি পাপ করেছে, অতঃপর সে জেনেছে যে, তার একজন রব আছেন, যিনি পাপ ক্ষমা করেন অথবা তা দিয়ে পাকড়াও করেন।’ আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করলাম। সুতরাং সে যা ইচ্ছা করুক।’’[6]

‘সে যা ইচ্ছা করুক’ কথার অর্থ হল, সে যখন এরূপ করে; অর্থাৎ পাপ করে সাথে সাথে তাওবাহ্ করে এবং আমি তাকে মাফ করে দেই, তখন সে যা ইচ্ছা করুক, তার কোন চিন্তা নেই। যেহেতু তাওবাহ্ পূর্বকৃত পাপ মোচন করে দেয়। অবশ্য একই পাপ জেনেশুনে বারবার করলে অথবা তাওবার সময় পাপ বর্জনের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা না করলে সে ক্ষমার যোগ্য নাও হতে পারে। মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَنْ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلٰى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ

‘‘আর যারা কোন অশ্লীল কাজ করলে অথবা নিজেদের প্রতি যুল্ম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ ছাড়া কে গুনাহ ক্ষমা করবে? আর তারা যা করেছে, জেনে শুনে তারা তার পুনরাবৃত্তি করে না।’’[7]

নাবী (সা.) বলেছেন :

ارْحَمُوا تُرْحَمُوا وَاغْفِرُوا يَغْفِرْ اللهُ لَكُمْ وَيْلٌ لِأَقْمَاعِ الْقَوْلِ وَيْلٌ لِلْمُصِرِّينَ الَّذِينَ يُصِرُّونَ عَلٰى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ

‘‘তোমরা দয়া কর, তোমাদের প্রতি দয়া করা হবে। তোমরা ক্ষমা কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা কথা শুনেও শুনে না। দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা জেনে শুনে তাদের কৃত অপরাধের উপর অটল থাকে।’’[8]

তাই তাওবাহ্ করার সময় অবশ্যই ভবিষ্যতে আর সেই গুনাহ না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে। তাওবাহ্ করার পর আবার কোন কারণে পাপ হয়ে গেলে পুনরায় তাওবাহ্ করতে হবে। কোন অবস্থাতেই গুনাহর উপর অটল থাকা যাবে না। কারণ কেউ জানে না সে কখন মৃত্যুবরণ করবে, আদৌ সে তাওবার সুযোগ পাবে কিনা।


৫. নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাওবাহ্ করতে হবে :

তাওবাহ্ করার নির্ধারিত সময় আছে। আর তাওবার নির্ধারিত সময় দুই ধরনের :

এক. প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাওবার সর্বশেষ সময় হচ্ছে তার মৃত্যু। তাই মৃত্যু আসার আগেই তাওবাহ্ করতে হবে।

দুই. সকল মানুষের জন্য তাওবাহ্ করার সর্বশেষ সময় হচ্ছে ক্বিয়ামাতের আলামত হিসেবে পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত। তাই সাধারণভাবে পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়ার আগেই তাওবাহ্ করতে হবে।

মূলত পাপ করার পরক্ষণেই তাওবাহ্ করা উচিত। অনেকে শেষ জীবনে দাড়ি-চুল পাকলে পরে তাওবাহ্ করবেন বলে অপেক্ষায় থাকে, অবহেলা করে। কিন্তু হঠাৎ মৃত্যু এসে যাওয়ায় সে আর তাওবার সুযোগ পায় না।

মহান আল্লাহ বলেছেন :

إِنَّمَا التَّوْبَةُ عَلَى اللهِ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِنْ قَرِيبٍ فَأُولٰئِكَ يَتُوبُ اللهُ عَلَيْهِمْ وَكَانَ اللهُ عَلِيمًا حَكِيمًا - وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتّٰى إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآنَ وَلَا الَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمْ كُفَّارٌ أُولٰئِكَ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا

‘‘নিশ্চয় তাদের তাওবাহ্ কবূল করা আল্লাহর দায়িত্ব যারা অজ্ঞতাবশতঃ মন্দ কাজ করে। তারপর অনতিবিলম্বে তারা তাওবাহ্ করে। অতঃপর আল্লাহ এদের তাওবাহ্ কবূল করবেন আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, অতিপ্রজ্ঞাময়। আর তাওবাহ্ নেই তাদের, যারা অন্যায় কাজসমূহ করতে থাকে, অবশেষে যখন তাদের কারো মৃত্যু এসে যায়, তখন বলে, আমি এখন তাওবাহ্ করলাম; আর তাওবাহ্ তাদের জন্য নয়, যারা কাফির অবস্থায় মারা যায়; আমরা এদের জন্যই তৈরী করেছি যন্ত্রণাদায়ক ‘আযাব।’’[9]

আর নাবী (সা.) বলেছেন :إِنَّ اللهَ يَقْبَلُ تَوْبَةَ الْعَبْدِ مَا لَمْ يُغَرْغِرْ

‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা বান্দার তাওবাহ্ সে পর্যন্ত কবূল করবেন, যে পর্যন্ত তার প্রাণ কণ্ঠাগত না হয় (অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে ঘ্যার ঘ্যার করা শুরু করে)।’’[10]

মহান আল্লাহর ‘আযাব দেখার পরে করা তাওবাও কোন উপকারে আসবে না। মৃত্যুর সময় ফির‘আওনের ঈমান তার কোন উপকার করেনি। সুতরাং কেউ আল্লাহর ‘আযাব গ্রাস করার মুহূর্তে তাওবাহ্ করলে তা তার কোন উপকারে আসবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :

فَلَمَّا رَأَوْا بَأْسَنَا قَالُوا آمَنَّا بِاللَّهِ وَحْدَه وَكَفَرْنَا بِمَا كُنَّا بِه مُشْرِكِينَ -فَلَمْ يَكُ يَنْفَعُهُمْ إِيمَانُهُمْ لَمَّا رَأَوْا بَأْسَنَا سُنَّتَ اللهِ الَّتِىْ قَدْ خَلَتْ فِىْ عِبَادِه وَخَسِرَ هُنَالِكَ الْكَافِرُونَ

‘‘তারপর তারা যখন আমার ‘আযাব দেখল তখন বলল, ‘আমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলাম, আর যাদেরকে আমরা তার সাথে শরীক করতাম তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করলাম’। সুতরাং তারা যখন আমার ‘আযাব দেখল তখন তাদের ঈমান তাদের কোন উপকার করল না। এটা আল্লাহর বিধান, তাঁর বান্দাদের মধ্যে চলে আসছে। আর তখনই ঐ ক্ষেত্রে কাফিররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’’[11]

একইভাবে ক্বিয়ামাতের পূর্বে তাওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। যখন কেউ তাওবাহ্ করতে চাইলেও তখন তার তাওবাহ্ প্রতিপালকের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। মহান আল্লাহ বলেছেন :

هَلْ يَنْظُرُونَ إِلَّا أَنْ تَأْتِيَهُمُ الْمَلَائِكَةُ أَوْ يَأْتِيَ رَبُّكَ أَوْ يَأْتِيَ بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ يَوْمَ يَأْتِي بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ لَا يَنْفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِنْ قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا قُلِ انْتَظِرُوا إِنَّا مُنْتَظِرُونَ

‘‘তারা কি এরই অপেক্ষা করছে যে, তাদের নিকট ফেরেশতাগণ হাযির হবেন, কিংবা তোমার রব উপস্থিত হবেন অথবা তোমার রব-এর আয়াতসমূহের কিছু সংখ্যক আয়াত প্রকাশ পাবে? যেদিন তোমার রবের আয়াতসমূহের কিছু সংখ্যক আয়াত প্রকাশ পাবে, সেদিন কোন ব্যক্তিরই তার ঈমান উপকারে আসবে না যে পূর্বে ঈমান আনেনি, কিংবা সে তার ঈমানের মাধ্যমে কোন কল্যাণ অর্জন করেনি। বল, ‘তোমরা অপেক্ষা কর, নিশ্চয় আমরাও অপেক্ষা করছি’।’’[12]

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

لَا تَنْقَطِعُ الْهِجْرَةُ حَتّٰى تَنْقَطِعَ التَّوْبَةُ وَلَا تَنْقَطِعُ التَّوْبَةُ حَتّٰى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا

‘‘তাওবার সুযোগ কেটে না যাওয়া পর্যন্ত হিজরত বন্ধ হবে না। আর পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত তাওবার সুযোগ কেটে যায় না।’’[13]

অন্যত্র নাবী (সা.) বলেছেন :

مَنْ تَابَ قَبْلَ أَنْ تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا تَابَ اللهُ عَلَيْهِ

‘‘যে ব্যক্তি পশ্চিম দিকে থেকে সূর্যোদয় হওয়ার পূর্বে তাওবাহ্ করবে, আল্লাহ তার তাওবাহ্ গ্রহণ করবেন।’’[14]

তাই মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হওয়ার বা পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়ার পূর্বেই গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করতে হবে। আগামীকাল নয়, আজই এখনই তাওবাহ্ করতে হবে।


৬. মানুষের অধিকার তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে :

যদি কোন গুনাহর সম্পর্ক কোন মানুষের অধিকারের সাথে হয়, তাহলে যার অধিকার নষ্ট হয়েছে, তার অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে অথবা ক্ষমা চেয়ে তার সাথে মিটমাট করে নিতে হবে। যদি অবৈধ পন্থায় কারো মাল বা অন্য কিছু গ্রহণ-হরণ করে থাকে, তাহলে তা মালিককে ফিরিয়ে দিতে হবে। আর যদি কারো উপর মিথ্যা অপবাদ দেয় অথবা অনুরূপ কোনো দোষ করে থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে শাস্তি নিতে নিজেকে পেশ করতে হবে অথবা তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। যার প্রতি যুল্ম করা হয়েছে, তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে গিয়ে বলতে হবে, ভাই/বোন! আমি আপনার উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছি বা আপনার গীবত করে আপনার সম্মান নষ্ট করেছি বা যুলুম করেছি। এখন আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে তাওবাহ্ করছি, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। এভাবে যত মানুষের সাথে সম্পৃক্ত গুনাহ করেছে তত মানুষের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। যদি সেই ব্যক্তি মারা গিয়ে থাকে তাহলে তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে, অর্থ-সম্পদ হরণ করে থাকলে তা ঐ ব্যক্তির উত্তরাধিকারের নিকট পৌঁছে দিবে, তার পক্ষ থেকে দান-সদাক্বাহ্ করবে এবং নিজে বেশি বেশি করে সৎ কাজ/সাওয়াবের কাজ করে সাওয়াব বাড়িয়ে নেবে। কেননা ঐ যার অধিকার নষ্ট করেছে সে ব্যক্তি যদি জাহান্নামী হয় তাহলে সে ক্বিয়ামাতের মাঠে এই ব্যক্তির কাছে তার অধিকার ফেরত চাইতে পারে। তখন তাকে সাওয়াব দিয়ে প্রতিদান দিতে হবে।

নাবী (সা.) বলেছেন :

مَنْ كَانَتْ لَه مَظْلَمَةٌ لِأَخِيهِ مِنْ عِرْضِه أَوْ شَيْءٍ فَلْيَتَحَلَّلْهُ مِنْهُ الْيَوْمَ قَبْلَ أَنْ لَا يَكُونَ دِينَارٌ وَلَا دِرْهَمٌ إِنْ كَانَ لَه عَمَلٌ صَالِحٌ أُخِذَ مِنْهُ بِقَدْرِ مَظْلَمَتِه وَإِنْ لَمْ تَكُنْ لَه حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ سَيِّئَاتِ صَاحِبِه فَحُمِلَ عَلَيْهِ

‘‘যদি কোন ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের প্রতি তার সম্ভ্রম বা অন্য কিছুতে কোন যুলুম ও অন্যায় করে থাকে, তাহলে সেদিন আসার পূর্বেই সে যেন আজই তার নিকট হতে (ক্ষমা চাওয়া অথবা প্রতিশোধ/পরিশোধ দেয়ার মাধ্যমে) নিজেকে মুক্ত করে নেয়; যে দিন (ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য) না দীনার হবে না দিরহাম, টাকা-পয়সা, মাল-ধন (সেদিন) যালেমের নেক ‘আমল থাকলে তার যুল্ম অনুপাতে নেকী তার নিকট থেকে কেটে নিয়ে (মাযলুমকে দেয়া) হবে। পক্ষান্তরে যদি যদি তার নেকি না থাকে (অথবা নিঃশেষ হয়ে যায়) তাহলে তার বাদীর (মাযলূমের) গুনাহ নিয়ে তার ঘাড়ে চাপানো হবে।’’[15]

আর কেউ যদি কোন বান্দার হক নষ্ট করে কিন্তু যার হক নষ্ট করেছে শত চেষ্টা করেও তাওবাহ্ করার সময় তাকে খুঁজে না পায় বা তার কাছে পৌঁছতে না পারে তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ তা‘আলা গুনাহকারীকে মাফ করবেন। ইন-শা-আল্লাহ।

উল্লেখ্য যে, আল্লাহর হক নষ্ট করার গুনাহ থেকে তাওবাহ্ করার জন্য প্রথম ৫টি শর্ত যথেষ্ট। তবে আল্লাহর হকের মধ্যে কিছু হক আছে যা তাওবার মাধ্যমে মাফ হয় না সেগুলো কাযা আদায় করে হক পূরণ করতে হয়। যেমন, সলাত, সিয়াম ইত্যাদি।

উপরে উল্লিখিত সকল সকল শর্ত পালন করে যে পাপী তাওবাহ্ করবে, তার তাওবাহ্ হবে খাঁটি তাওবাহ্। এই তাওবাই আল্লাহ চান এবং তিনি এই তাওবাই গ্রহণ করেন।

বিশুদ্ধ তাওবাহ্ হল ব্যভিচারের অপরাধে অপরাধী মা‘ইয বিন মালিক-এর মত তাওবা। যার ব্যাপারে নাবী (সা.) বলেছিলেন :

لَقَدْ تَابَ تَوْبَةً لَوْ قُسِمَتْ بَيْنَ أُمَّةٍ لَوَسِعَتْهُمْ

‘‘সে এমন তাওবাহ্ করেছে যে, যদি তা একটি জাতির মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হত, তাহলে সকলের জন্য তা যথেষ্ট হত।’’[16]

বিশুদ্ধ তাওবার উদাহরণ স্বরূপ ব্যভিচারের অপরাধে অপরাধী জুহায়নাহ্ গোত্রের নারীটির তাওবার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

لَقَدْ تَابَتْ تَوْبَةً لَوْ قُسِمَتْ بَيْنَ سَبْعِينَ مِنْ أهْلِ المَدِينَةِ لَوَسِعَتْهُمْ

‘‘এই মহিলাটি এমন বিশুদ্ধ তাওবাহ্ করেছে যদি তা মদীনার ৭০ জন লোকের মধ্যে বণ্টন করা হত তাহলে তা তাদের জন্য যথেষ্ট হত।’’[17]

বিশুদ্ধ তাওবাহ্ হল, যার পরে গুপ্ত ও প্রকাশ্যভাবে ‘আমলে কোন প্রকার পাপের আচরণ থাকবে না। যে তাওবাহ্ তাওবাকারীকে বিলম্বে ও অবিলম্বে সাফল্য দান করে। বিশুদ্ধ তাওবাহ্ হল তাই, যার পরে তাওবাকারী বিগত অপরাধ-জীবনের জন্য কান্না করে, পুনরায় সেই অপরাধ যেন ঘটে না যায় তার জন্য ভীত-আতঙ্কিত ও সতর্ক থাকে, অসৎসঙ্গীদের সংসর্গ বর্জন করে এবং সৎসঙ্গীদের সাহচর্য অবলম্বন করে।

[1]. জন্ম : ৬৩১ হি./১২৩৩ ঈ. - মৃত্যু : ৬৭৬ হি./১২৭৭ ঈ.। [2]. জন্ম : ১৩৩০ হি./১৯১০ ঈ. - মৃত্যু : ১৪২০ হি./১৯৯৯ ঈ.। [3]. সুনান ইবনু মাজাহ : ৪২৫২, সহীহ ইবনু হিব্বান : ৬১৪, সহীহুত্ তারগীব : ৩১৪৬-৩১৪৭, হাদীসটি সহীহ। [4]. সহীহুল বুখারী : ৬০৬৯; সহীহ মুসলিম : ৭৬৭৬। [5]. https ://islamqa.info/ar/26119 [6]. সহীহুল বুখারী : ৭৫০৭; সহীহ মুসলিম : ৭১৬২। [7] সূরা আ-লি ‘ইমরা-ন ০৩ : ১৩৫। [8]. মুসনাদ আহমাদ : ৭০৪১; আল আদাব আল মুফরাদ : ৩৮০; শু‘আবুল ঈমান : ৭২৩৬; আস্ সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ : ৪৮২। [9] সূরা আন্ নিসা ০৪ : ১৭-১৮। [10]. মুসনাদ আহমাদ : ৬১৬০; জামি‘ আত্ তিরমিযী : ৩৫৩৭; হাদীসটি হাসান, সহীহুত তিরমিযী : ২৮০২। [11] সূরা আল মু’মিন/গাফির ৪০ : ৮৪-৮৫। [12] সূরা আল আন্‘আম ০৬ : ১৫৮। [13]. সুনান আবূ দাঊদ : ২৪৮১, হাদীসটি সহীহ। [14]. সহীহ মুসলিম : ৭০৩৬। [15]. সহীহুল বুখারী : ২৪৪৯; জামি‘ আত্ তিরমিযী : ২৪১৯। [16]. সহীহ মুসলিম : ৪৫২৭। [17]. সহীহ মুসলিম : ৪৫২৯। http://www.hadithbd.com/books/link/?id=9104

গ্রন্থঃ গুনাহ মাফের উপায়
অধ্যায়ঃ দ্বিতীয় অধ্যায় : গুনাহ মাফের উপায়

 
৩. তাওবাহ্ করা - (চ) খাঁটি তাওবার জন্য ব্যাকুলতা ও কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা 

পৃথিবীর ইতিহাসে যেমন অমার্জিত পাপীদের কথা লেখা আছে তেমনি লেখা আছে পাপহীন নাবী-রাসূলদের কথা। এর মাঝে লেখা আছে আরও কিছু মানুষের কথা যারা অনেক মারাত্মক পাপ করেও আল্লাহর নিকট তাওবাহ্ কবূল হয়েছে। সেসব ঘটনার কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো :


* একশ’ মানুষের খুনির তাওবাহ্ :

বানী ইসরাঈলের এ লোক ১০০টি খুন করেছিল। তারপর সেই খুনি খাঁটি তাওবাহ্ করেছিল। তাই আল্লাহ তার এত বড় ও জঘন্য অপরাধও ক্ষমা করে দিয়েছেন। ঘটনাটি নিমণরূপ :

عن أبي سَعيد سَعْدِ بنِ مالكِ بنِ سِنَانٍ الخدريِّ ؓ : أنّ نَبِيَّ الله ﷺ ، قَالَ :كَانَ فِيمَنْ كَانَ قَبْلَكمْ رَجُلٌ قَتَلَ تِسْعَةً وتِسْعينَ نَفْسًا ، فَسَأَلَ عَنْ أعْلَمِ أَهْلِ الْأَرضِ ، فَدُلَّ عَلٰى رَاهِبٍ ، فَأَتَاهُ . فقال : إنَّه قَتَلَ تِسعَةً وتِسْعِينَ نَفْساً فَهَلْ لَه مِنْ تَوبَةٍ ؟ فَقَالَ : لَا ، فَقَتَلهُ فَكَمَّلَ بِه مئَةً ، ثُمَّ سَأَلَ عَنْ أَعْلَمِ أَهْلِ الْأَرضِ ، فَدُلَّ عَلٰى رَجُلٍ عَالِمٍ . فقَالَ : إِنَّه قَتَلَ مِئَةَ نَفْسٍ فَهَلْ لَه مِنْ تَوْبَةٍ؟ فَقَالَ : نَعَمْ ، ومَنْ يَحُولُ بَيْنَه وبَيْنَ التَّوْبَةِ؟ انْطَلِقْ إِلٰى أَرْضِ كَذَا وكَذَا فإِنَّ بِهَا أُناساً يَعْبُدُونَ الله تَعَالٰى فاعْبُدِ الله مَعَهُمْ ، ولَا تَرْجِعْ إِلٰى أَرْضِكَ فَإِنَّهَا أرضُ سُوءٍ ، فانْطَلَقَ حَتّٰى إِذَا نَصَفَ الطَّرِيقَ أَتَاهُ الْمَوْتُ ، فاخْتَصَمَتْ فِيهِ مَلَائِكَةُ الرَّحْمَةِ ومَلَائِكَةُ العَذَابِ . فَقَالتْ مَلَائِكَةُ الرَّحْمَةِ : جَاءَ تَائِبًا ، مُقْبِلًا بِقَلبِه إِلَى اللهِ تَعَالٰى ، وَقَالَتْ مَلَائِكَةُ العَذَابِ : إنَّهلَمْ يَعْمَلْ خَيرًا قَطُّ ، فَأَتَاهُمْ مَلَكٌ في صورَةِ آدَمِىٍّ فَجَعَلُوهُ بَيْنَهُمْ- أيْ حَكَمًا - فقالَ : قِيسُوا مَا بَينَ الأرضَينِ فَإلٰى أيّتهما كَانَ أدنٰى فَهُوَ لَه . فَقَاسُوا فَوَجَدُوهُ أدْنى إِلى الْأَرْضِ الَتِىْ أرَادَ ، فَقَبَضَتْهُ مَلَائِكَةُ الرَّحمةِ مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ

وَفِىْ رِوَايَة في الصَّحِيْح :فَكَانَ إلى القَريَةِ الصَّالِحَةِ أقْرَبَ بِشِبْرٍ فَجُعِلَ مِنْ أهلِهَا

وَفِىْ رِوَايَة في الصَّحِيْح :فَأَوحَى الله تَعَالٰى إِلٰى هٰذِه أَنْ تَبَاعَدِي ، وإِلٰى هٰذِه أَنْ تَقَرَّبِي ، وقَالَ : قِيسُوا مَا بيْنَهُما ، فَوَجَدُوهُ إِلٰى هٰذِهِ أَقْرَبَ بِشِبْرٍ فَغُفِرَ لَه . وَفِىْ رِوَايَة : فَنَأى بصَدْرِه نَحْوَهَا

আবূ সা‘ঈদ আল (সা‘দ ইবনু মালিক ইবনু সিনান) খুদরী থেকে বর্ণিত যে, নাবী (সা.) বলেছেন : ‘‘তোমাদের পূর্বে (বানী ইসরাইলের যুগে) একটি লোক ছিল যে ৯৯ জন মানুষকে হত্যা করেছিল। অতঃপর লোকেদেরকে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জ্ঞানী সম্পর্কে জানতে চাইলো। তাকে একজন খ্রিষ্টান সন্ন্যাসীর কথা বলা হল। সে তার কাছে এসে বলল, ‘সে ৯৯ জন মানুষকে হত্যা করেছে। এখন কি তার তাওবার কোন সুযোগ আছে?’ সে বলল, ‘না’। সুতরাং সে (রাগান্বিত হয়ে) তাকেও হত্যা করে একশত পূরণ করল। পুনরায় সে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জ্ঞানী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। এবারও তাকে এক জ্ঞানীর খোঁজ দেয়া হল। সে তার নিকট এসে বলল যে, ‘সে একশত মানুষ খুন করেছে। সুতরাং তার কি তাওবার কোন সুযোগ আছে?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ আছে! তার ও তাওবার মধ্যে কে বাধা সৃষ্টি করবে? তুমি অমুক স্থানে চলে যাও। সেখানে কিছু এমন লোক আছে যারা আল্লাহ তা‘আলার ‘ইবাদাত করে। তুমিও তাদের সাথে আল্লাহর ‘ইবাদাত কর। আর তোমার নিজ আবাসস্থলে ফিরে যেও না। কেননা, ও স্থান পাপের স্থান।’

অতঃপর ঐ ব্যক্তি ঐ স্থানের দিকে যেতে আরম্ভ করল। যখন সে মধ্য রাস্তায় পৌঁছল, তখন তার মৃত্যু এসে গেল। (তার দেহ থেকে আত্মা বের করার জন্য) রহমত ও আযাবের উভয় প্রকার ফেরেশতা উপস্থিত হলেন। ফেরেশতাদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক আরম্ভ হল। রহমতের ফেরেশতাগণ বললেন, ‘এই ব্যক্তি তাওবাহ্ করতে এসেছিল এবং পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর দিকে তার আগমন ঘটেছে।’ আর আযাবের ফেরেশতাগণ বললেন, ‘এ লোক এখনো ভালো কাজ করেনি (এই জন্য সে শাস্তির উপযুক্ত)।’ এমতাবস্থায় একজন ফেরেশতা মানুষের রূপ ধারণ করে উপস্থিত হলেন। ফেরেশতাগণ তাঁকে সালিস মানলেন। তিনি ফায়সালা দিলেন যে, ‘তোমরা দুই স্থানের দূরত্ব মেপে দেখ। (অর্থাৎ এ লোক যে স্থান থেকে এসেছে সেখান থেকে এই স্থানের দূরত্ব এবং যে দেশে যাচ্ছিল তার দূরত্ব) এই দুই স্থানের মধ্যে সে যার দিকে বেশী নিকটবর্তী হবে, সে তারই অন্তর্ভুক্ত হবে।’ অতএব তাঁরা দূরত্ব মাপলেন এবং যে স্থানে সে যাওয়ার ইচ্ছা করেছিল, সেই (ভালো) স্থানকে বেশী নিকটবর্তী পেলেন। সুতরাং রহমতের ফেরেশতাগণ তার জান কবয করলেন।’’[1]

অন্য একটি বর্ণনায় এরূপ আছে যে, ‘‘পরিমাপে ঐ ব্যক্তিকে সৎকর্মশীল লোকেদের স্থানের দিকে এক বিঘত বেশী নিকটবর্তী পাওয়া গেল। সুতরাং তাকে ঐ সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের স্থানের অধিবাসী বলে গণ্য করা হল।’’[2]

অন্য আরেকটি বর্ণনায় এইরূপ এসেছে যে, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা ঐ স্থানকে (যেখান থেকে সে আসছিল তাকে) আদেশ করলেন যে, তুমি দূরে সরে যাও এবং এই সৎকর্মশীলদের স্থানকে আদেশ করলেন যে, তুমি নিকটবর্তী হয়ে যাও। অতঃপর বললেন, ‘তোমরা এ দু’য়ের দূরত্ব মাপ।’ সুতরাং তাকে সৎকর্মশীলদের স্থানের দিকে এক বিঘত বেশী নিকটবর্তী পেলেন। যার ফলে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হল।’’[3] আরও একটি বর্ণনায় আছে, ‘‘সে ব্যক্তি নিজের বুকের উপর ভর করে ভালো স্থানের দিকে একটু সরে গিয়েছিল।’’[4]


* গামিদী গোত্রের ব্যভিচারিণী মহিলার তাওবাহ্ :

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে গামিদী গোত্রের এক মহিলা যেনার কারণে গর্ভবতী হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে তাওবাহ্ করে গুনাহ থেকে পবিত্র হতে চেয়েছিল। খাঁটি তাওবার সে ঘটনাও হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা করেছিল। ঘটনাটি নিম্নরূপ :

قَالَ فَجَاءَتِ الْغَامِدِيَّةُ فَقَالَتْ يَا رَسُولَ اللهِ إِنِّىْ قَدْ زَنَيْتُ فَطَهِّرْنِى. وَإِنَّه رَدَّهَا فَلَمَّا كَانَ الْغَدُ قَالَتْ يَا رَسُولَ اللهِ لِمَ تَرُدُّنِىْ لَعَلَّكَ أَنْ تَرُدَّنِى كَمَا رَدَدْتَ مَاعِزًا فَوَاللهِ إِنِّىْ لَحُبْلٰى. قَالَ إِمَّا لَا فَاذْهَبِى حَتّٰى تَلِدِى ». فَلَمَّا وَلَدَتْ أَتَتْهُ بِالصَّبِىِّ فِى خِرْقَةٍ قَالَتْ هٰذَا قَدْ وَلَدْتُه”. قَالَ اذْهَبِى فَأَرْضِعِيهِ حَتّٰى تَفْطِمِيهِ». فَلَمَّا فَطَمَتْهُ أَتَتْهُ بِالصَّبِىِّ فِى يَدِه كِسْرَةُ خُبْزٍ فَقَالَتْ هٰذَا يَا نَبِىَّ اللهِ قَدْ فَطَمْتُه وَقَدْ أَكَلَ الطَّعَامَ. فَدَفَعَ الصَّبِىِّ إِلٰى رَجُلٍ مِنَ الْمُسْلِمِينَ ثُمَّ أَمَرَ بِهَا فَحُفِرَ لَهَا إِلٰى صَدْرِهَا وَأَمَرَ النَّاسَ فَرَجَمُوهَا فَيُقْبِلُ خَالِدُ بْنُ الْوَلِيدِ بِحَجَرٍ فَرَمٰى رَأْسَهَا فَتَنَضَّحَ الدَّمُ عَلٰى وَجْهِ خَالِدٍ فَسَبَّهَا فَسَمِعَ نَبِىُّ اللهِ ﷺ سَبَّه إِيَّاهَا فَقَالَ مَهْلًا يَا خَالِدُ فَوَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِه لَقَدْ تَابَتْ تَوْبَةً لَوْ تَابَهَا صَاحِبُ مَكْسٍ لَغُفِرَ لَه. ثُمَّ أَمَرَ بِهَا فَصُلِّيَ عَلَيْهَا وَدُفِنَتْ

একদিন গামিদী গোত্রের এক মহিলা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট আগমন করলো এবং বলল, হে আল্লার রাসূল! আমি ব্যভিচার করেছি। সুতরাং আপনি আমাকে পবিত্র করুন। তখন তিনি তাঁকে ফিরিয়ে দিলেন। পরবর্তী দিন আবার ঐ মহিলা আগমন করলো এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কেন আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আপনি কি আমাকে ঐভাবে ফিরিয়ে দিতে চান, যেমন ভাবে আপনি মা‘ইযকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন? আল্লাহর শপথ, নিশ্চয় আমি গর্ভবতী। তখন তিনি বললেন, যদি (ফিরে যেতে না চাও), তবে (আপাততঃ এখনকার মত) চলে যাও এবং সন্তান প্রসবকাল সময় পর্যন্ত অপেক্ষা কর।

বর্ণনাকারী বলেন, এরপর যখন সে সন্তান প্রসব করল তখন সে সন্তানকে এক টুকরা কাপড়ের মধ্যে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আগমন করলেন এবং বললেন, এই সন্তান আমি প্রসব করেছি। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : যাও তাকে (সন্তানকে) দুধ পান করাও গিয়ে। দুধপান করানোর সময় শেষ হলে পরে এসো। এরপর যখন তার দুধপান করানোর সময় শেষ হল তখন ঐ মহিলা শিশু সন্তানটিকে নিয়ে তার কাছে আগমন করলো এমন অবস্থায় যে, শিশুটির হাতে এক টুকরা রুটি ছিল। এরপর বললো, হে আল্লাহর নাবী! (এইতো সেই শিশু) তাকে আমি দুধপান করানোর কাজ শেষ করেছি। সে এখন খাদ্য খায়। তখন শিশু সন্তানটিকে তিনি কোন একজন মুসলিমকে প্রদান করলেন। এরপর তার ব্যাপারে (ব্যভিচারের শাস্তি প্রদানের) আদেশ দিলেন। তার বুক পর্যন্ত গর্ত খনন করা হল এরপর জনগণকে (তার প্রতি পাথর নিক্ষেপের) নির্দেশ দিলেন। তারা তখন তাকে পাথর মারতে শুরু করল। খালিদ ইবনু ওয়ালীদ একটি পাথর নিয়ে অগ্রসর হলেন এবং মহিলার মাথায় নিক্ষেপ করলেন, তাতে তার মুখমণ্ডলে রক্ত ছিটকে পড়লো। তখন তিনি মহিলাকে গালি দিলেন। নাবী (সা.) গালি শুনতে পেলেন। তিনি বললেন, সাবধান! হে খালিদ! সেই মহান আল্লাহর শপথ, যার হাতে আমার জীবন, জেনে রেখো! নিশ্চয় সে এমন তাওবাহ্ করেছে, যদি কোন যুলুমবাজ (চাঁদাবাজ) ব্যক্তিও এমন তাওবাহ্ করতো তবে তারও ক্ষমা হয়ে যেতো। এরপর তার জানাযার সলাত আদায়ের নির্দেশ দিলেন। অতঃপর তার জানাযায় সলাত আদায় করা হলো। এরপর তাকে দাফন করা হলো।[5]

জুহায়নাহ্ গোত্রের এক ব্যভিচারীণী মহিলার তাওবার ক্ষেত্রেও গামিদী গোত্রের মহিলার ঘটনার মত ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। ঘটনাটি নিমণরূপ :

عَنْ أبي نُجَيد عِمْرَانَ بنِ الحُصَيْنِ الخُزَاعِىِّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا : أنَّ امْرَأةً مِنْ جُهَيْنَةَ أتَتْ رَسُوْلَ الله ﷺۤ وَهِيَ حُبْلٰى مِنَ الزِّنٰى ، فَقَالَتْ : يَا رَسُولَ الله ، أصَبْتُ حَدّاً فَأَقِمْهُ عَلَيَّ ، فَدَعَا نَبيُّ الله ﷺ وَليَّها ، فقالَ : أَحْسِنْ إِلَيْهَا ، فإذا وَضَعَتْ فَأْتِني فَفَعَلَ فَأَمَرَ بهَا نبيُّ الله ﷺ ، فَشُدَّتْ عَلَيْهَا ثِيَابُهَا، ثُمَّ أَمَرَ بِهَا فَرُجِمَتْ، ثُمَّ صَلّٰى عَلَيْهَا. فقالَ لَه عُمَرُ : تُصَلِّىْ عَلَيْهَا يَا رَسُول الله وَقَدْ زَنَتْ ؟ قَالَ : لَقَدْ تَابَتْ تَوْبَةً لَوْ قُسِمَتْ بَيْنَ سَبْعِينَ مِنْ أهْلِ المَدِينَةِ لَوَسِعَتْهُمْ، وَهَلْ وَجَدْتَ أَفضَلَ مِنْ أنْ جَادَتْ بنفْسِهَا لله - عَزَّ وَجَلَّ - ؟!

আবূ নুজাইদ ‘ইমরান ইবনুল হুসাইন আল খুযা‘ঈ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, জুহায়নাহ্ গোত্রের এক নারী আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর নিকট হাজির হল। সে যিনার কারণে গর্ভবতী ছিল। সে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি দন্ডনীয় অপরাধ করে ফেলেছি তাই আপনি আমাকে শাস্তি দিন!’ আল্লাহর নাবী (সা.) তার আত্মীয়কে ডেকে বললেন, ‘‘তুমি একে নিজের কাছে যত্ন সহকারে রাখ এবং সন্তান প্রসবের পর একে আমার নিকট নিয়ে এসো।’’ সুতরাং সে তাই করল (অর্থাৎ প্রসবের পর তাকে রাসূল (সা.)-এর কাছে নিয়ে এল)।

আল্লাহর নাবী (সা.) তার কাপড় তার (শরীরের) উপর মজবুত করে বেঁধে দেয়ার আদেশ দিলেন। অতঃপর তাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলার আদেশ দিলেন। অতঃপর তিনি তার জানাযার সলাত আদায় করলেন। ‘উমার তাঁকে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এই মহিলার জানাযার সলাত আদায় করলেন, অথচ সে ব্যভিচার করেছিল?’ তিনি বললেন, ‘‘(‘উমার! তুমি জান না যে,) এই মহিলাটি এমন বিশুদ্ধ তাওবাহ্ করেছে, যদি তা মদীনার ৭০ জন লোকের মধ্যে বণ্টন করা হত তাহলে তা তাদের সকলের জন্য যথেষ্ট হত। এর চেয়ে কি তুমি কোন উত্তম কাজ পেয়েছ যে, সে আল্লাহর জন্য নিজের প্রাণকে কুরবান করে দিল?’’[6]

* তাবূক যুদ্ধে না যাওয়া তিন সাহাবীর তাওবাহ্ :

সাময়িকের জন্য ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনজন প্রখ্যাত সাহাবী তাবূকের যুদ্ধে যাননি। তাদের এই না যাওয়ার অপরাধ থেকে তারা কীভাবে তাওবাহ্ করেছেন তারই বর্ণনা পাওয়া যাবে নীচের দীর্ঘ হাদীসটিতে।

কা‘ব ইবনু মালিক-এর পুত্র ‘আবদুল্লাহ[7] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি (আমার পিতা) কা‘ব ইবনু মালেক-কে ঐ ঘটনা বর্ণনা করতে শুনেছি,

যখন তিনি তাবূকের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পিছনে থেকে যান। তিনি বলেন, ‘আমি তাবূক যুদ্ধ ছাড়া যে যুদ্ধই রাসূলুল্লাহ (সা.) করেছেন তাতে কখনোই তাঁর পিছনে থাকিনি। (অবশ্য বদরের যুদ্ধ থেকে আমি পিছনে রয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বদরের যুদ্ধে যে অংশগ্রহণ করেনি, তাকে ভৎর্সনা করা হয়নি।) আসল ব্যাপার ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.) ও মুসলিমগণ কুরাইশের কাফেলার পশ্চাদ্ধাবনে বের হয়েছিলেন। (শুরুতে যুদ্ধের নিয়ত ছিল না।) পরিশেষে আল্লাহ তা‘আলা তাঁদেরকে ও তাঁদের শত্রুকে (পূর্বঘোষিত) ওয়াদা ছাড়াই একত্রিত করেছিলেন।

আমি আক্বাবার রাতে (মিনায়) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে উপস্থিত ছিলাম, যখন আমরা ইসলামের উপর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম। আক্বাবার রাত অপেক্ষা আমার নিকটে বদরের উপস্থিতি বেশী প্রিয় ছিল না। যদিও বদর (অভিযান) লোক মাঝে ওর চাইতে বেশী প্রসিদ্ধ। (কা‘ব বলেন) আর আমার তাবূকের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পিছনে থাকার ঘটনা এরূপ যে, এই যুদ্ধ হতে পিছনে থাকার সময় আমি যতটা সমর্থ ও সচ্ছল ছিলাম অন্য কোন সময় ছিলাম না। আল্লাহর ক্বসম! এর পূর্বে আমার নিকট কখনো দু’টি সওয়ারী (বাহন) একত্রিত হয়নি। কিন্তু এই (যুদ্ধের) সময়ে একই সঙ্গে দু’টি সওয়ারী আমার নিকট মজুদ ছিল।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিয়ম ছিল, যখন তিনি কোন যুদ্ধে বের হওয়ার ইচ্ছা করতেন, তখন ‘তাওরিয়া’ করতেন (অর্থাৎ সফরের গন্তব্যস্থলের নাম গোপন রেখে সাধারণ অন্য স্থানের নাম নিতেন, যাতে শত্রুরা টের না পায়)। এই যুদ্ধ এভাবে চলে এল। রাসূলুল্লাহ (সা.) ভীষণ গরমে এই যুদ্ধে বের হলেন এবং দূরবর্তী সফর ও দীর্ঘ মরুভূমির সম্মুখীন হলেন। আর বহু সংখ্যক শত্রুরও সম্মুখীন হলেন। এই জন্য তিনি মুসলিমদের সামনে বিষয়টি স্পষ্ট করে দিলেন; যাতে তাঁরা সেই অনুযায়ী যথোচিত প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেন। ফলে তিনি সেই দিকও বলে দিলেন, যেদিকে যাবার ইচ্ছা করেছেন।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে অনেক মুসলিম ছিলেন এবং তাদের কাছে কোন হাজিরা বহি ছিল না, যাতে তাদের নামসমূহ লেখা হবে। এই জন্য যে ব্যক্তি (যুদ্ধে) অনুপস্থিত থাকত সে এই ধারণাই করত যে, আল্লাহর অহী অবতীর্ণ ছাড়া তার অনুপস্থিতির কথা গুপ্ত থাকবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এই যুদ্ধ ফল পাকার মৌসুমে করেছিলেন এবং সে সময় (গাছের) ছায়াও উৎকৃষ্ট (ও প্রিয়) ছিল, আর আমার টানও ছিল সেই ফল ও ছায়ার দিকে।

সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সা.) ও মুসলিমরা (তাবূকের যুদ্ধের জন্য) প্রস্ত্ততি নিলেন। আর (আমার এই অবস্থা ছিল যে,) আমি সকালে আসতাম, যেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে আমিও (যুদ্ধের) প্রস্ত্ততি নেই। কিন্তু কোন ফয়সালা না করেই আমি (বাড়ী) ফিরে আসতাম এবং মনে মনে বলতাম যে, আমি যখনই ইচ্ছা করব, যুদ্ধে শামিল হয়ে যাব। কেননা, আমি এর ক্ষমতা রাখি। আমার এই গড়িমসি অবস্থা অব্যাহত রইল এবং লোকেরা জিহাদের আয়োজনে প্রবৃত্ত থাকলেন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) ও মুসলিমরা একদিন সকালে তাবুকের জিহাদে বেরিয়ে পড়লেন এবং আমি প্রস্ত্ততির ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে পারলাম না। আমি আবার সকালে এলাম এবং বিনা সিদ্ধান্তেই (বাড়ী) ফিরে গেলাম। সুতরাং আমার এই অবস্থা অব্যাহত থেকে গেল। ওদিকে মুসলিম সেনারা দ্রুতগতিতে আগে বাড়তে থাকল এবং যুদ্ধের ব্যাপারও ক্রমশঃ এগুতে লাগল। আমি ইচ্ছা করলাম যে, আমিও সফরে রওয়ানা হয়ে তাদের সঙ্গ পেয়ে যাই। হায়! যদি আমি তাই করতাম (তাহলে কতই না ভালো হত)! কিন্তু এটা আমার ভাগ্যে হয়ে উঠল না। এদিকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চলে যাওয়ার পর যখনই আমি লোকের মাঝে আসতাম, তখন এ জন্যই দুঃখিত ও চিমিত্মত হতাম যে, এখন (মদীনায়) আমার সামনে কোন আদর্শ আছে তো কেবলমাত্র মুনাফিক্বব কিংবা এত দুর্বল ব্যক্তিরা যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমাহ যোগ্য বা অপারগ বলে গণ্য করেছেন।

সম্পূর্ণ রাস্তা রাসূল (সা.) আমাকে স্মরণ করলেন না। তাবূক পৌঁছে যখন তিনি লোকের মাঝে বসেছিলেন, তখন আমাকে স্মরণ করলেন এবং বললেন, ‘‘কা‘ব ইবনু মালেকের কী হয়েছে?’’ বানু সালেমাহ (গোত্রের) একটি লোক বলে উঠল, ‘‘হে আল্লাহর রাসূল! তার দুই চাদর এবং দুই পার্শ্ব দর্শন (অর্থাৎ ধন ও তার অহঙ্কার) তাকে আঁটকে দিয়েছে।’’ (এ কথা শুনে) মু‘আয ইবনু জাবাল বললেন, ‘‘বাজে কথা বললে তুমি। আল্লাহর ক্বসম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা তার ব্যাপারে ভালো ছাড়া অন্য কিছু জানি না।’’ রাসূলুল্লাহ (সা.) নীরব থাকলেন।

এসব কথাবার্তা চলছিল এমতাবস্থায় তিনি একটি লোককে সাদা পোশাক পরে (মরুভূমির) মরীচিকা ভেদ করে আসতে দেখলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : ‘‘তুমি যেন আবূ খাইসামাহ হও।’’ (দেখা গেল) সত্যিকারে তিনি আবূ খাইসামাহ আনসারীই ছিলেন। আর তিনি সেই ব্যক্তি ছিলেন, যিনি একবার আড়াই কিলো খেজুর সদাকাহ করেছিলেন বলে মুনাফিক্ববরা (তা অল্প মনে করে) তাঁকে বিদ্রম্নপ করেছিল।’

কা‘ব বলেন, ‘অতঃপর যখন আমি সংবাদ পেলাম যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাবূক থেকে ফেরার সফর শুরু করে দিয়েছেন, তখন আমার মনে কঠিন দুশ্চিন্তা এসে উপস্থিত হল এবং মিথ্যা অজুহাত পেশ করার চিন্তা করতে লাগলাম এবং মনে মনে বলতে লাগলাম যে, আগামীকাল যখন রাসূল (সা.) ফিরবেন, সে সময় আমি তাঁর রোষাণল থেকে বাঁচব কী উপায়ে? আর এ ব্যাপারে আমি পরিবারের প্রত্যেক বুদ্ধিমান মানুষের সহযোগিতা চাইতে লাগলাম। অতঃপর যখন বলা হল যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আগমন একদম নিকটবর্তী, তখন আমার অন্তর থেকে বাতিল (পরিকল্পনা) দূর হয়ে গেল। এমনকি আমি বুঝতে পারলাম যে, মিথ্যা বলে আমি কখনই বাঁচতে পারব না। সুতরাং আমি সত্য বলার দৃঢ় সংকল্প করে নিলাম।

এদিকে রাসূলুল্লাহ (সা.) সকালে (মদীনায়) পদার্পণ করলেন। তাঁর অভ্যাস ছিল, যখন তিনি সফর থেকে (বাড়ি) ফিরতেন, তখন সর্বপ্রথম তিনি মাসজিদে দু’ রাক্‘আত সলাত আদায় করতেন। তারপর (সফরের বিশেষ বিশেষ খবর শোনাবার জন্য) লোকেদের জন্য বসতেন। সুতরাং এই সফর থেকে ফিরেও যখন পূর্বের মতো কাজ করলেন, তখন মুনাফিক্বরা এসে তাঁর নিকট ওযর-আপত্তি পেশ করতে লাগল এবং ক্বসম খেতে আরম্ভ করল। এরা সংখ্যায় আশি জনের কিছু বেশী ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের বাহ্যিক ওযর গ্রহণ করে নিলেন, তাদের বায়‘আত নিলেন, তাদের জন্য (আল্লাহর কাছে) ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং তাদের গোপনীয় অবস্থা আল্লাহকে সঁপে দিলেন। অবশেষে আমিও তাঁর নিকট হাজির হলাম।

অতঃপর যখন আমি তাঁকে সালাম দিলাম, তখন তিনি রাগান্বিত ব্যক্তির হাসির মত মুচকি হাসলেন। অতঃপর তিনি বললেন, ‘‘সামনে এসো!’’ আমি তাঁর সামনে এসে বসে পড়লাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তুমি কেন জিহাদ থেকে পিছনে রয়ে গেলে? তুমি কি বাহন ক্রয় করনি?’’ আমি বললাম, ‘‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর ক্বসম! আমি যদি আপনি ছাড়া দুনিয়ার অন্য কোন লোকের কাছে বসতাম, তাহলে নিশ্চিতভাবে কোন মিথ্যা ওযর পেশ করে তার অসন্তুষ্টি থেকে বেঁচে যেতাম। বাকচাতুর্য (বা তর্ক-বিতর্ক করার) অভিজ্ঞতা আমার যথেষ্ট রয়েছে। কিন্তু আল্লাহর ক্বসম! আমি জানি যে, যদি আজ আপনার সামনে মিথ্যা বলি, যাতে আপনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন, তাহলে অতি সত্বর আল্লাহ তা‘আলা (অহী দ্বারা সংবাদ দিয়ে) আপনাকে আমার উপর অসন্তুষ্ট করে দেবেন।

পক্ষান্তরে আমি যদি আপনাকে সত্য কথা বলি, তাহলে আপনি আমার উপর অসন্তুষ্ট হবেন। কিন্তু আমি আল্লাহর নিকট এর সুফলের আশা রাখি। (সেহেতু আমি সত্য কথা বলছি যে,) আল্লাহর ক্বসম! (আপনার সাথে জিহাদে যাওয়ার ব্যাপারে) আমার কোন অসুবিধা ছিল না। আল্লাহর ক্বসম! আপনার সাথ ছেড়ে পিছনে থাকার সময় আমি যতটা সমর্থ ও সচ্ছল ছিলাম ততটা কখনো ছিলাম না।’’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : ‘‘এ লোকটি নিশ্চিতভাবে সত্য কথা বলেছে। বেশ, তুমি এখান থেকে চলে যাও, যে পর্যন্ত তোমার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা কোন ফায়সালা না করবেন।’’

আমার পিছনে পিছনে বানু সালামাহ্ (গোত্রের) কিছু লোক এল এবং আমাকে বলল যে, ‘‘আল্লাহর ক্বসম! আমরা অবগত নই যে, তুমি এর পূর্বে কোন পাপ করেছ। অন্যান্য পিছনে থেকে যাওয়া লোকেদের ওজর পেশ করার মত তুমিও কোন ওজর পেশ করলে না কেন? তোমার পাপ মোচনের জন্য এটাই যথেষ্ট ছিল যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) তোমার জন্য (আল্লাহর নিকট) ক্ষমা প্রার্থনা করতেন।’’ কা‘ব বলেন, ‘আল্লাহর ক্বসম! লোকেরা আমাকে আমার সত্য কথা বলার জন্য তিরস্কার করতে থাকল। পরিশেষে আমার ইচ্ছা হল যে, আমি দ্বিতীয়বার রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে গিয়ে প্রথম কথা অস্বীকার করি (এবং কোন মিথ্যা ওজর পেশ করে দেই।) আবার আমি তাদেরকে বললাম, ‘‘আমার এ ঘটনা কি অন্য কারো সাথে ঘটেছে?’’ তাঁরা বললেন, ‘‘হ্যাঁ। তোমার মত আরো দু’জন সমস্যায় পড়েছে। (রাসূল (সা.)-এর নিকটে) তারাও সেই কথা বলেছে, যা তুমি বলেছ এবং তাদেরকে সেই কথাই বলা হয়েছে, যা তোমাকে বলা হয়েছে।’’

আমি তাদেরকে বললাম, ‘‘তারা দু’জন কে কে?’’ তারা বলল, ‘‘মুরারাহ ইবনু রাবী‘ আমরী ও হিলাল ইবনু উমাইয়্যাহ্ ওয়াক্বিফী।’’ এই দু’জন যাঁদের কথা তারা আমার কাছে বর্ণনা করল, তাঁরা সৎলোক ছিলেন এবং বদর যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন; তাঁদের মধ্যে আমার জন্য আদর্শ ছিল। যখন তারা সে দু’জন ব্যক্তির কথা বলল, তখন আমি আমার পূর্বেকার অবস্থার (সত্যের) উপর অনড় থেকে গেলাম (এবং আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা দূরীভূত হল। যাতে আমি তাদের ভৎর্সনার কারণে পতিত হয়েছিলাম)। (এরপর) রাসূলুল্লাহ (সা.) লোকেদেরকে পিছনে অবস্থানকারীদের মধ্যে আমাদের তিনজনের সাথে কথাবার্তা বলতে নিষেধ করে দিলেন।’

কা‘ব বলেন, ‘লোকেরা আমাদের থেকে পৃথক হয়ে গেল।’ অথবা বললেন, ‘লোকেরা আমাদের জন্য পরিবর্তন হয়ে গেল। পরিশেষে পৃথিবী আমার জন্য আমার অন্তরে অপরিচিত মনে হতে লাগল। যেন এটা সেই পৃথিবী নয়, যা আমার পরিচিত ছিল। এভাবে আমরা ৫০টি রাত কাটালাম। আমার দুই সাথীরা তো নরম হয়ে ঘরের মধ্যে কান্নাকাটি আরম্ভ করে দিলেন। কিন্তু আমি গোত্রের মধ্যে সবচেয়ে যুবক ও বলিষ্ঠ ছিলাম। ফলে আমি ঘর থেকে বের হয়ে মুসলিমদের সাথে সলাতে হাজির হতাম এবং বাজারসমূহে ঘোরাফেরা করতাম। কিন্তু কেউ আমার সঙ্গে কথা বলত না।

আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকটে হাজির হতাম এবং তিনি যখন সলাতের পর বসতেন, তখন তাঁকে সালাম দিতাম, আর আমি মনে মনে বলতাম যে, তিনি আমার সালামের জওয়াবে ঠোঁট নাড়াচ্ছেন কিনা? তারপর আমি তাঁর নিকটেই সলাত পড়তাম এবং আড়চোখে তাঁকে দেখতাম। (দেখতাম,) যখন আমি সলাতে মনোযোগী হচ্ছি, তখন তিনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন এবং যখন আমি তাঁর দিকে দৃষ্টি ফিরাচ্ছি, তখন তিনি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন!

অবশেষে যখন আমার সাথে মুসলিমদের বিমুখতা দীর্ঘ হয়ে গেল, তখন একদিন আমি আবূ ক্বাতাদাহ -এর বাগানে দেয়াল ডিঙ্গিয়ে (তাতে প্রবেশ করলাম।) সে (আবূ ক্বাতাদাহ) আমার চাচাতো ভাই এবং আমার সর্বাধিক প্রিয় লোক ছিল। আমি তাকে সালাম দিলাম। কিন্তু আল্লাহর ক্বসম! সে আমাকে সালামের জওয়াব দিল না। আমি তাকে বললাম, ‘‘হে আবূ ক্বাতাদাহ! আমি তোমাকে আল্লাহর ক্বসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি জান যে, আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা.)কে ভালোবাসি?’’ সে নিরুত্তর থাকল। আমি দ্বিতীয়বার ক্বসম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। এবারেও সে চুপ থাকল। আমি তৃতীয়বার ক্বসম দিয়ে প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলে সে বলল, ‘‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই বেশী জানেন।’’ এ কথা শুনে আমার চক্ষুদ্বয় থেকে অশ্রু বইতে লাগল এবং যেভাবে গিয়েছিলাম, আমি সেই ভাবেই দেয়াল ডিঙ্গিয়ে ফিরে এলাম।

এরই মধ্যে একদিন মদীনার বাজারে হাঁটছিলাম। এমন সময় শাম দেশের কৃষকদের মধ্যে একজন কৃষককে- যে মদীনায় খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করতে এসেছিল- বলতে শুনলাম, কে আমাকে কা‘ব ইবনু মালেককে দেখিয়ে দেবে? লোকেরা আমার দিকে ইঙ্গিত করতে লাগল। ফলে সে ব্যক্তি আমার নিকটে এসে আমাকে ‘গাসসান’-এর বাদশার একখানি পত্র দিল। আমি লিখা-পড়া জানতাম, তাই আমি পত্রখানি পড়লাম। পত্রে লিখা ছিল :

‘অতঃপর আমরা এই সংবাদ পেয়েছি যে, আপনার সঙ্গী (মুহাম্মাদ) আপনার প্রতি দুর্ব্যবহার করেছে। আল্লাহ আপনাকে লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত অবস্থায় থাকার জন্য সৃষ্টি করেননি। আপনি আমাদের কাছে চলে আসুন; আমরা আপনার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করব।’

পত্র পড়ে আমি বললাম, ‘‘এটাও অন্য এক বালা (পরীক্ষা)।’’ সুতরাং আমি ওটাকে চুলোয় ফেলে জ্বালিয়ে দিলাম। অতঃপর যখন ৫০ দিনের মধ্যে ৪০ দিন গত হয়ে গেল এবং অহী আসা বন্ধ ছিল। এই অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একজন দূত আমার নিকট এসে বলল, ‘‘রাসূলুল্লাহ (সা.) তোমাকে তোমার স্ত্রী থেকে পৃথক থাকার আদেশ দিচ্ছেন!’’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘আমি কি তাকে তালাক দেব, না কী করব?’’ সে বলল, ‘‘তালাক নয় বরং তার নিকট থেকে আলাদা থাকবে, মোটেই ওর নিকটবর্তী হবে না।’’ আমার দুই সাথীর নিকটেও এই বার্তা পৌঁছে দিলেন। আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, ‘‘তুমি পিত্রালয়ে চলে যাও এবং সেখানে অবস্থান কর-যে পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যাপারে কোন ফায়সালা না করেন।’’

(আমার সাথীদ্বয়ের মধ্যে একজন সাথী) হিলাল ইবনু উমাইয়ার স্ত্রী রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বলল, ‘‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! হিলাল ইবনু উমাইয়াহ খুবই বৃদ্ধ মানুষ, তার কোন খাদেমও নেই, সেহেতু আমি যদি তার খিদমত করি, তবে আপনি কি এটা অপছন্দ করবেন?’’ তিনি বললেন, ‘‘না, (অর্থাৎ তুমি তার খিদমত করতে পার।) কিন্তু সে যেন (মিলন উদ্দেশে) তোমার নিকটবর্তী না হয়।’’ (হিলালের স্ত্রী বলল, ‘‘আল্লাহর ক্বসম! (দুঃখের কারণে এ ব্যাপারে) তার কোন সক্রিয়তা নেই। আল্লাহর ক্বসম! যখন থেকে এ ব্যাপার ঘটেছে তখন থেকে আজ পর্যন্ত সে সর্বদা কাঁদছে।’’

(কা‘ব বলেন,) ‘আমাকে আমার পরিবারের কিছু লোক বলল যে, ‘‘তুমিও যদি নিজ স্ত্রীর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট অনুমতি চাইতে, (তাহলে তা তোমার জন্য ভালো হত।) তিনি হিলাল ইবনু উমাইয়ার স্ত্রীকে তো তার খিদমত করার অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন।’’ আমি বললাম, ‘‘এ ব্যাপারে আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট অনুমতি চাইব না। জানি না, যখন আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকটে অনুমতি চাইব, তখন তিনি কী বলবেন। কারণ, আমি তো যুবক মানুষ।’’

এভাবে আরও দশদিন কেটে গেল। যখন থেকে লোকেদেরকে আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে নিষেধ করা হয়েছে, তখন থেকে এ পর্যন্ত আমাদের পঞ্চাশ রাত পূর্ণ হয়ে গেল। আমি পঞ্চাশতম রাতে আমাদের এক ঘরের ছাদের উপর ফজরের সলাত পড়লাম। সলাত পড়ার পর আমি এমন অবস্থায় বসে আছি যার বর্ণনা আল্লাহ তা‘আলা আমাদের ব্যাপারে দিয়েছেন- আমার জীবন আমার জন্য দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল এবং পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও আমার প্রতি সংকীর্ণ হয়ে উঠেছিল- এমন সময় আমি এক চিৎকারকারীর আওয়ায শুনতে পেলাম, সে সাল‘আ পাহাড়ের উপর চড়ে উচ্চৈঃস্বরে বলছে, ‘‘হে কা‘ব ইবনু মালিক! তুমি সুসংবাদ নাও!’’ আমি তখন (খুশীতে শুকরিয়ার) সাজদায় পড়ে গেলাম এবং বুঝতে পারলাম যে, (আল্লাহর পক্ষ থেকে) মুক্তি এসেছে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) ফজরের সলাত পড়ার পর লোকেদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের তাওবাহ্ কবূল করে নিয়েছেন। সুতরাং লোকেরা আমাদেরকে সুসংবাদ দেয়ার জন্য আসতে আরম্ভ করল। এক ব্যক্তি আমার দিকে অতি দ্রুত গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে এল। সে ছিল আসলাম (গোত্রের) এক ব্যক্তি। আমার দিকে সে দৌঁড়ে এল এবং পাহাড়ের উপর চড়ে (আওয়াজ দিল)। তার আওয়াজ ঘোড়ার চেয়েও দ্রুতগামী ছিল। সুতরাং যখন সে আমার কাছে এল, যার সুসংবাদের আওয়াজ আমি শুনেছিলাম, তখন আমি তার সুসংবাদ দানের বিনিময়ে আমার দেহ থেকে দু’খানি বস্ত্র খুলে তাকে পরিয়ে দিলাম।

আল্লাহর ক্বসম! সে সময় আমার কাছে এ দু’টি ছাড়া আর কিছু ছিল না। আর আমি নিজে দু’খানি কাপড় অস্থায়ীভাবে ধার নিয়ে পরিধান করলাম এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশে রওনা হলাম। পথে লোকেরা দলে দলে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমাকে মুবারকবাদ জানাতে লাগল এবং বলতে লাগল, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা তোমার তাওবাহ্ কবূল করেছেন, তাই তোমাকে ধন্যবাদ।’’ অতঃপর আমি মাসজিদে প্রবেশ করলাম। (দেখলাম,) রাসূলুল্লাহ (সা.) বসে আছেন এবং তাঁর চারপাশে লোকজন আছে। ত্বালহা ইবনু ‘উবাইদুল্লাহ উঠে ছুটে এসে আমার সঙ্গে মুসাফাহা করলেন এবং আমাকে মুবারকবাদ দিলেন। আল্লাহর ক্বসম! মুহাজিরদের মধ্যে তিনি ছাড়া আর কেউ উঠলেন না।’

সুতরাং কা‘ব ত্বালহা (রাঃ)-এর এই ব্যবহার কখনো ভুলতেন না। কা‘ব বলেন, ‘যখন আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে সালাম জানালাম, তখন তিনি তাঁর খুশীময় উজ্জ্বল চেহারা নিয়ে আমাকে বললেন, ‘‘তোমার মা তোমাকে যখন প্রসব করেছে, তখন থেকে তোমার জীবনের বিগত সর্বাধিক শুভদিনের সুসংবাদ তুমি গ্রহণ কর!’’ আমি বললাম, ‘‘হে আল্লাহর রাসূল! এই শুভসংবাদ আপনার পক্ষ থেকে, না কি আল্লাহর পক্ষ থেকে?’’ তিনি বললেন, ‘‘না, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে।’’

রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন খুশি হতেন, তখন তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে যেত, মনে হত যেন তা একফালি চাঁদ এবং এতে আমরা তাঁর এ (খুশী হওয়ার) কথা বুঝতে পারতাম। অতঃপর যখন আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে বসলাম, তখন আমি বললাম, ‘‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার তাওবাহ্ কবূল হওয়ার দরুণ আমি আমার সমস্ত মাল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের রাস্তায় সাদাক্বাহ্ করে দিচ্ছি।’’ তিনি বললেন, ‘‘তুমি কিছু মাল নিজের জন্য রাখ, তোমার জন্য তা উত্তম হবে।’’ আমি বললাম, ‘‘যাই হোক! আমি আমার খায়বারের যুদ্ধে (প্রাপ্ত) অংশ রেখে দিচ্ছি।’’

আর আমি এ কথাও বললাম যে, ‘‘হে আল্লাহর রাসূল! নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা আমাকে সত্যবাদিতার কারণে (এই বিপদ থেকে) উদ্ধার করলেন। আর এটাও আমার তাওবার দাবী যে, যতদিন আমি বেঁচে থাকব, সর্বদা সত্য কথাই বলব।’’ সুতরাং আল্লাহর ক্বসম! যখন থেকে আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সত্য কথা বলার প্রতিজ্ঞা করলাম, তখন থেকে আজকের দিন পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা কোন মুসলিমকে সত্য কথা বলার প্রতিদান স্বরূপ এর চেয়ে উৎকৃষ্ট কোন পুরস্কার দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। আল্লাহর ক্বসম! আমি যেদিন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এ কথা বলেছি, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি মিথ্যা কথা বলার ইচ্ছা করিনি। আর আশা করি যে, বাকী জীবনেও আল্লাহ তা‘আলা আমাকে এ থেকে নিরাপদ রাখবেন।’

কা‘ব বলেন : ‘আল্লাহ তা‘আলা (আমাদের ব্যাপারে আয়াত) অবতীর্ণ করেছেন,

لَقَدْ تَابَ اللهُ عَلَى النَّبِيِّ وَالْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ الَّذِينَ اتَّبَعُوهُ فِي سَاعَةِ الْعُسْرَةِ مِنْ بَعْدِ مَا كَادَ يَزِيغُ قُلُوبُ فَرِيقٍ مِنْهُمْ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ إِنَّه بِهِمْ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ 117 وَعَلَى الثَّلَاثَةِ الَّذِينَ خُلِّفُوا حَتّٰى إِذَا ضَاقَتْ عَلَيْهِمُ الْأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ وَضَاقَتْ عَلَيْهِمْ أَنْفُسُهُمْ وَظَنُّوا أَنْ لَا مَلْجَأَ مِنَ اللهِ إِلَّا إِلَيْهِ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ لِيَتُوبُوا إِنَّ اللهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ 118- يٰۤاَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ 119

‘‘আল্লাহ ক্ষমা করলেন নাবীকে এবং মুহাজির ও আনসারদেরকে যারা সংকট মুহূর্তে নাবীর অনুগামী হয়েছিল, এমন কি যখন তাদের মধ্যকার এক দলের অন্তর বাঁকা হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তারপর আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করলেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাদের প্রতি বড় স্নেহশীল, পরম করুণাময়। আর ঐ তিন ব্যক্তিকেও ক্ষমা করলেন, যাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্থগিত রাখা হয়েছিল; পরিশেষে পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের প্রতি সংকীর্ণ হয়ে উঠেছিল এবং তাদের জীবন তাদের জন্য দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল আর তারা উপলব্ধি করেছিল যে, আল্লাহ ছাড়া আল্লাহর পাকড়াও হতে বাঁচার অন্য কোন আশ্রয়স্থল নেই। পরে তিনি তাদের প্রতি অনুগ্রহপরায়ণ হলেন, যাতে তারা তাওবাহ্ করে। নিশ্চয় আল্লাহই হচ্ছেন তাওবাহ্ গ্রহণকারী, পরম করুণাময়। [1]. সহীহুল বুখারী : ৩৪৭০ ও সহীহ মুসলিম : ৭১৮৪। [2]. সহীহ মুসলিম : ৭১৮৫। [3]. সহীহুল বুখারী : ৩৪৭০। [4]. সহীহুল বুখারী : ৩৪৭০। [5]. সহীহ মুসলিম : ৪৫২৮। [6]. সহীহ মুসলিম : ৪৫২৯। [7]. এই ‘আবদুল্লাহ কা‘ব -এর ছেলেদের মধ্যে তাঁর পরিচালক ছিলেন, যখন তিনি অন্ধ হয়ে যান। [8] সূরা আত্ তাওবাহ্ ০৯ : ১১৭-১১৯। [9] সূরা আত্ তাওবাহ্ ০৯ : ৯৫-৯৬। [10]. সহীহ মুসলিম : ৭১৯২। 

Post a Comment

0 Comments