Recent Tube

গত ২০ ই রমযান ছিল ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের দিন; শামীম আজাদ।


২০ই রমযান ছিল ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের দিন;

     হযরত মুহাম্মদ (সা:) ১১ জানুয়ারী, ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে , ২০ ই রমযান ৮ হিজরি রক্তপাতহীনভাবে মক্কা নগরী দখল করেন। ইতিহাসে এই ঘটনা মক্কা বিজয় নামে খ্যাত। ঐতিহাসিকদের মতে মক্কা বিজয় ইসলামের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয় যদিও আল কুরআনে হুদাইবিয়ার সন্ধিকেই প্রকাশ্য বিজয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে

إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُّبِينًا
(হে নবী) আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি।
সূরা ফাতাহ-০১

      মূলত প্রকৃতপক্ষে হুদাইবিয়ার সন্ধি এবং মক্কা বিজয় দুটিই মুহাম্মদ (সা:) এর অতুলনীয় দূরদর্শীতার ফল। হুদাইবিয়ার সন্ধির মাধ্যমে যে বিজয়ের সূত্রপাত হয়েছিল তার চূড়ান্ত রূপই ছিল মক্কা বিজয়। এই বিজয়ের ফলে মুসলমানদের পক্ষে আরবের অন্যান্য এলাকা বিজয় করা সহজসাধ্য হয়ে পড়ে। হুদাইবিয়ার সন্ধি মোতাবেক সন্ধির পরবর্তী বছর মুহাম্মদ (সা:) ২০০০ সাহাবা নিয়ে মক্কায় উমরাতুল ক্বাযা পালন করতে আসেন এবং এ সময়ই তিনি মক্কার কুরাইশদের মধ্যে নেতৃত্বের শুন্যতা লক্ষ্য করেন। তাদের শক্তির সঠিক পরিমাপ করতে পেরেছিলেন তিনি এবং এজন্যই অধীর ছিলেন মক্কা বিজয়ের জন্য। এর ১ বছরের মাথায়ই তিনি তা সম্পন্ন করার জন্য মনস্থির করেন।

 হুদাইবিয়ার সন্ধি রদ:

      হুদাইবিয়ার সন্ধির অল্প কিছুদিন পরেই ইসলাম ব্যাপক হারে প্রসারিত হতে শুরু করে যা কুরাইশদের শঙ্কিত করে তোলে। তারা দেখতে পায় এভাবে চলতে থাকলে মক্কা ও তার দক্ষিণাঞ্চরের গোত্রগুলো অচিরেই ইসলাম গ্রহণ করবে। তাই তারা তায়েফের সাকীফ গোত্র এবং হুনায়নের হাওয়াজিন গোত্রদ্বয়েরসাথে জোটবদ্ধ হয়ে মদীনা আক্রমণের পরিকল্পনা করে। কিন্তু ১০ বছরের এই চুক্তির কারণে তারা আক্রমণ করতে পারছিলনা। তাই তারা প্রথমে চুক্তি বাতিলের ষড়যন্ত্র শুরু করে।

       সন্ধির চুক্তিমতে বনু বকর গোত্র কুরাইশদের সাথে এবং বনু খুযাআ গোত্র মদীনার ইসলামী সরকারের সাথে মৈত্রীসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিল। এই দুটি গোত্রের মধ্যে অনেক আগে থেকেই শত্রুতা চলে আসছিলো। এর কারণ অনেকটা এরকম - ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে বনু হাদরামি গোত্রের জনৈক এক ব্যক্তি বসবাসের উদ্দেশ্যে খুযাআ গোত্রের এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় খুযাআ গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করে। এরপর বনু বকরের লোকেরা খুযাআ গোত্রের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আবার খুযাআ গোত্রের লোকেরা বনুবকরের একাংশ বনু দায়েলের সরদার আসওয়াদের তিন সন্তান সালমা, কুলসুম ও যুবাইরকে হারাম শরীফের সীমানার কাছে হত্যা করে। তখন থেকেই বনু দায়েল তথা সমগ্র বনু বকরের সাথে বনু খুযাআর বিরোধ চলে আসছিলো যা ইসরামের আবির্ভাবের ফলে অনেকটা স্তিমিত হয়ে যায়। কিন্তু হুদাইবিয়ার সন্ধির পর আবার বনু বকর সুযোগ খুঁজতে থাকে।

        এরই জের ধরে একদিন বুন দায়েল পরিবারের প্রধান নাওফেল ইবনে মুয়াবিয়া বনু খুযাআ গোত্রের মুনাব্বিহ নামক এক ব্যক্তিকে ওয়াতির নামক জলাশয়ের নিকট ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে। এতে পূর্ব শত্রুতা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এবং দুই গোত্রে তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হয়। কুরাইশরা সন্ধি বাতিলের জন্য একে একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে এবং এই যুদ্ধে বনু বকরকে অস্ত্র সাহায্য দেয়। তারা ভেবেছিলো বিস্তারিত তথ্য মুহাম্মদ (সা:) এর কাছে পৌছাবেনা; তাই তারা রাতের অন্ধকারে বনু বকরের পক্ষে যুদ্ধেও অবতীর্ণ হয়। খুযাআ গোত্রের উপর রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র অবস্থায় আক্রমণ করা হয় এবং নিরুপায় হয়ে তারা হারাম শরীফে আশ্রয় গ্রহণ করে। খুযাআর লোকেরা বলে যে তারা হারাম শরীফে প্রবেশ করেছে যেখানে রক্তপাত নিষিদ্ধ। কিন্তু নাওফেল সবকিছু অমান্য করে এবং কুরাইশ ও বনু বকরকে নিয়ে হারাম শরীফের অভ্যন্তরে ঝাপিয়ে পড়ে খুযাআ গোত্রের প্রচুর লোককে হত্যা করে। এটি ছিল হুদায়বিয়ার চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

       এই ঘটনার পর খুযাআ গোত্রের আমর ইবনে সালিম এবং বনু কা'ব গোত্রের এক ব্যক্তিসহ মোট ৪০ জন উষ্ট্রারোহীকে নিয়ে মুহাম্মদ (সা:) এর কাছে এসে সব ঘটনা বিবৃত করে এবং তার সাহায্যের জন্য আবেদন করে। মুহাম্মদ (সা:) তাদেরকে সাহায্য করা হবে বলে আশ্বাস দেন এবং তখনই মক্কা বিজয়ের ব্যাপারে মনস্থির করেন। খুযাআর লোকেরা তখন মক্কায় ফিরে যায়। এর পরপরই মুহাম্মদ (সা:) এই হত্যাকান্ডের কঠোর প্রতিবাদ জানিয়ে এবং তিনটি শর্তারোপ করে কুরাইশদের কাছে একজন দূত প্রেরণ করেন। কথা ছিলো এই শর্তত্রয়ের যেকোন একটি মেনে নিতে হবে। শর্তত্রয় ছিল:

      খুযাআ গোত্রের নিহতদের রক্তপণ শোধ করতে হবে অথবা কুরাইশদের কর্তৃক বনু বকরের সাথে তাদের মৈত্রীচুক্তি বাতিল ঘোষণা করতে হবে অথবা এ ঘোষণা দিতে হবে যে, হুদাইবিয়ার সন্ধি বাতিল করা হয়েছে এবং কুরাইশরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।

কুরাইশদের পক্ষ হতে কারতা বিন উমর তৃতীয় শর্তটি গ্রহণ করে। পরবর্তীকালে তারা অবশ্য এর জন্য অনুতপ্ত হয়েছিল। যাইহোক, এভাবেই ঐতিহাসিক হুদাইবিয়ার সন্ধি রদ হয়ে যায়।

  সন্ধি নবায়নের প্রচেষ্টা:

      প্রকৃতপক্ষে সন্ধিচুক্তি অগ্রাহ্য করে বনু বকরকে সহযোগিতা করাটা ছিল প্রচন্ড অন্যায় আর চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তটিও যে তদনুরুপ অন্যায় ও নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক হয়েছে কুরাইশ নেতারা তা অচিরেই উপলব্ধি করতে শুরু করে। তাই তারা চুক্তি নবায়নের জন্য শীঘ্রই তাদের অন্যতম নেতা আবু সুফিয়ানকে মদীনায় প্রেরণ করে। আবু সুফিয়ান কাজটি সহজে আদায় করে নেয়ার লক্ষ্যে প্রথমেই তার কণ্যা উম্মে হাবীবার গৃহে যায়। উল্লেখ্য উম্মে হাবীবা ছিল মুহাম্মদ (সা:) এর স্ত্রীদের একজন। কিন্তু হাবীবার গৃহে যেয়ে আবু সুফিয়ান কোন সুবিধা করতে পারেননি; এমনকি উম্মে হাবীবা তাকে বসতেও দেয়নি। কারণ হিসেবে উম্মে হাবীবা বলে যে তার গৃহের বিছানাটি আল্লাহর রাসূল (সা:) এর। পিতা হিসেবে আবু সুফিয়ান শ্রদ্ধেয় হলেও মুহাম্মদ (সা:) এর বিছানায় একজন নাপাক মুশরিক বসুক এটা সে চায়না। আবু সুফিয়ান এতে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বেরিয়ে যায়। মুহাম্মদ (সা:) এর কাছে সে সন্ধি নবায়নের প্রস্তাব পেশ করলে মুহাম্মদ (সা:) কোন উত্তর দেননি। এরপর আবু সুফিয়ান একে একে আবু বকর, উমর এবং সবশেষে আলীর কাছে যায়। আবু বকর ও উমর তাদের অপারগতার কথা প্রকাশ করেন এবং আলী তামাশা করে বলেন যে আবু সুফিয়ান যেন কারো উত্তরের অপেক্ষা না করে মদীনার মসজীদে নববীতে তার প্রস্তাবের কথা ঘোষণা করে চলে যায়। উপায়ন্তর না দেখে আবু সুফিয়ান তা-ই করে এবং মক্কায় ফিরে যায়। সন্ধি নবায়নের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। আর এদিকে মুহাম্মদ (সা:) মক্কা বিজয়ের জন্য অতি গোপনে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন।

  গোপন প্রস্তুতি:

       মক্কা অভিযানের পূর্বে মূতার যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতির কথা প্রকাশিত হয়ে পড়ায় অনেক ক্ষতি হয়েছিল। তাই মুহাম্মদ (সা:) মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি সর্বোচ্চ গোপনীয়তার মাধ্যমে শুরু করেন। তিনি কাউকে বলেননি কোথায় অভিযানে বের হবেন। এমনকি তার ঘনিষ্ঠ সহচর আবু বকর বা তার স্ত্রীদেরকেও কিছু বলেননি। তবে একটি উপায়ে তা প্রায় প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল। হাতিব ইবনে আবী বালতা নামক একজন সাহাবী, যিনি বদর যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, অনুমান করেন যে নবী মক্কা অভিমুখে যাবেন। তিনি অনুমানভিত্তিক এই সংবাদ একটি পত্রের মাধ্যমে কুরাইশদের জানানোর উদ্যোগ নেন এবং একজন মহিলার মাধ্যমে তা মক্কা পাঠিয়ে দেন। কিন্তু ঐ মহিলা মক্কা পৌছানোর পূর্বেই নবী (সা:) এই সংবাদ জেনে যান এবং তিনজন সাহাবীকে সেই পত্রটি উদ্ধারের জন্য প্রেরণ করেন। এই তিনজন হলেন আলী, যুবায়ের এবং মিকদাদ। তারা মক্কা অভিমুখে রওযায়ে খাখ নামক স্থানে উক্ত মহিলার সন্ধান পান। প্রথমে অস্বীকার করলেও হুমকির মুখে সে চিঠিটি দিয়ে দেয়। এটি মদীনায় আনার পর জানা যায় যে তা হাতিবের লিখা। প্রকৃতপক্ষে হাতিব ইসলামের প্রতি বিদ্বেষের বশে নয় বরং নির্বুদ্ধিতার কারণে কেবল কুরাইশদের সহানুভূতি আদায়ের জন্য এই পত্র লিখেছিলেন। তাই তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়।

    মক্কা অভিমুখে যাত্রা ও শিবির স্থাপন:

     সম্পূর্ণ গোপনে মক্কা অভিযান শুরু হয়। বনু সুলাইম, বনু আশজা, বনু মুযায়না, বনু গিফার এবং বনু আসলাম গোত্রের অনেকেই প্রস্তুতি নিয়ে মদীনা থেকে মুহাম্মদ (সা:) এর সাথে বের হয়। এই দলের সাথে খালীদ বিন ওয়ালিদ ছিলেন। আবার অনেকেই পথিমধ্যে মিলিত হয়। এভাবে মুসলমানদের মোট সৈন্যসংখ্যা দাড়ায় ১০,০০০। মুসলিম বাহিনী ৮ম হিজরী সালের ১০ রমযান তারিখে মদীনা থেকে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করে। তখন মুসলমানদের সবাই রোযা রেখেছিল এবং কাদীদ নামক স্থানে কুদাইদ এবং উসফান নামক এলাকার মধ্যবর্তী একটি ঝর্ণার নিকট আসার পর তারা রোযা ভঙ্গ করেন। এরপর ঐ রমযানে আর কেউ রোযা রাখেনি। ১২ দিন চলার পর মুসলিম বাহিনী মার-উজ-জাহরান নামক গিরি-উপত্যকায় পৌছে। এখানেই এশার নামায আদায়ের পর মুসলিম বাহিনী শিবির স্থাপন করে।

عَنْ جَابِرٍ: أَنَّ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ خَرَجَ عَامَ الْفَتْحِ إِلٰى مَكَّةَ فِىْ رَمَضَانَ فَصَامَ حَتّٰى بَلَغَ كُرَاعَ الْغَمِيمِ فَصَامَ النَّاسُ ثُمَّ دَعَا بِقَدَحٍ مِنْ مَاءٍ فَرَفَعَه حَتّٰى نَظَرَ النَّاسُ إِلَيْهِ ثُمَّ شَرِبَ فَقِيلَ لَه بَعْدَ ذٰلِكَ إِنَّ بَعْضَ النَّاسِ قَدْ صَامَ. فَقَالَ: «أُولٰئِكَ الْعُصَاةُ أُولٰئِكَ الْعُصَاةُ». رَوَاهُ مُسْلِمٌ

     জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:

      তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের বছর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমাযান (রমজান) মাসে (মাদীনাহ্ হতে) মক্কা অভিমুখে রওনা হলেন। তিনি (মক্কা মাদীনার মধ্যবর্তী স্থান ‘উসফানের কাছে) ‘‘কুরা-‘আল গমীম’’ পৌঁছা পর্যন্ত সওম রাখলেন। অন্যান্য লোকেরাও সওমে ছিলেন। (এখানে পৌঁছার পর) তিনি পেয়ালায় করে পানি চেয়ে আনলেন। পেয়ালাটিকে (হাতে উঠিয়ে এতো) উঁচুতে তুলে ধরলেন যে, মানুষেরা এর দিকে তাকাল। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পানি পান করলেন। এরপর কিছু লোক আরয করল যে, (এখনো) কিছু লোক সওম রেখেছে (অর্থাৎ- রসূলের অনুসরণে সওম ভাঙেনি)। (এ কথা শুনে) তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ এসব লোক পাক্কা গুনাহগার, এসব লোক পাক্কা গুনাহগার।  
    মুসলিম ১১১৪, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ২০১৯, সহীহ ইবনু হিববান ৩৫৪৯, সহীহ আত্ তারগীব ১০৫৩, মিশকাতুল মাসাবিহঃ ২০২৭

  মক্কায় প্রবেশ:

        একই সময়ে আবু সুফিয়ান ইবনে হারব মুহাম্মদ এবং মক্কার মাঝখানে যাতায়াত অব্যাহত রাখেন এবং মক্কা বিজয় ঠেকাতে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করতে থাকেন। তথ্যসূত্র অনুসারে, তিনি মুহাম্মাদ (সা:) এর চাচা ইবনে আব্বাসের সাহায্য পান, যদিও কিছু পণ্ডিত মনে করেন যে, আব্বাসীয় রাজবংশের শাসনাধীন ইতিহাসবিদগণ তাদের লেখায় আব্বাসের ভূমিকাকে বাড়িয়ে তুলে ধরেছেন এবং আবু সুফিয়ানের ভূমিকাকে ছোটো করে দেখিয়েছেন, যিনি কিনা আব্বাসীয় শত্রুদের পূর্বপুরুষ।

     মক্কা ইব্রাহিমীয় উপত্যকায় অবস্থিত, যা প্রায় ১০০০ ফিট উচু কালো অসমতল পাহাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত। পাহাড়গুলোর খাঁদের মাঝে চল্লিশটি প্রবেশপথ ছিল। এগুলো ছিল উত্তর-পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিম, দক্ষিণ ও উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। মুহাম্মাদ (সা:) মুসলিম সেনাবাহিনীকে চারটি সারিতে বিভক্ত করেন - যেগুলোর প্রত্যেকটি এক এক পথ দিয়ে অগ্রসর হবে। মুহাম্মাদ (সা:) যে সারিতে উপস্থিত ছিলেন তার নেতৃত্ব দেন আবু উবাইদুল্লাহ ইবনে জাররাহ। মদিনার প্রধান প্রবেশ পথের মধ্য দিয়ে আজাখিরের নিকটবর্তী উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে মক্কায় প্রবেশের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। মুহাম্মাদ (সা:) এর  চাচাতো ভাই আল-যুবায়ের দ্বিতীয় সারির নেতৃত্ব দিলেন এবং উক্ত সারিটি দক্ষিণ-পশ্চিম দিক হতে কুদা পাহাড়ের পশ্চিমের একটি পথ দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করে। দক্ষিণ দিক হতে কুদাইর মধ্য দিয়ে প্রবিষ্ট সারিটি মুহাম্মাদ (সা:) এর চাচাতো ভাই আলীর নেতৃত্বাধীন ছিল। সর্বশেষ কলামটি ছিল খালিদ ইবনে ওয়ালিদের নেতৃত্বাধীন, যা খান্দামা ও লাইসের মধ্য দিয়ে উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে প্রবেশের জন্য এগিয়ে যায়।

     তাঁদের রণকৌশলটি ছিল একই সময়ে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য হিসেবে মক্কাকে কেন্দ্র করে চারদিক থেকে অগ্রসর হওয়া। এর ফলে শত্রুপক্ষের শক্তি ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়বে এবং অগ্রসরমান কোন সারির দিকেই তারা আলাদাভাবে মনোযোগ দিতে পারবে না। এই কৌশলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল যদি একটি বা দুটি আক্রমণকারী সারি প্রবল বাধার সম্মুখীনও হয় এবং বাধা ভাঙতে অক্ষম হয়, তবুও অন্য পাশের সারিগুলো থেকে আক্রমণ চালিয়ে যাওয়া যাবে। এ কৌশলে কুরাইশদের পালিয়ে যাওয়াকেও রোধ করা সম্ভব হবে।

মুহাম্মাদ (সা:) কুরাইশরা আক্রমণ না করলে যুদ্ধ হতে বিরত থাকার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মুসলিম সেনাবাহিনী রবিবার ১১ ডিসেম্বর ৬২৯ সালে মক্কায় প্রবেশ করে (১৮ রমজান ৮ হিজরি)। খালিদের সারি ছাড়া বাকি তিনটি সারির প্রবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ ও রক্তপাতবিহীন। ইক্রিমা ও সুফিয়ানের মত কট্টর মুসলিম-বিরোধীগণ কুরাইশ যোদ্ধাদের একটি দলকে একত্রিত করে খালিদের শারীর মুখোমুখি প্রেরণ করে। কুরাইশগণ মুসলিমদের তলোয়ার ও বর্শা দ্বারা আক্রমণ করে, মুসলিমগণ কুরাইশদের আক্রমণ প্রতিরোধ করে। একটি স্বল্পকালীন খণ্ডযুদ্ধের পর ১২ জন কুরাইশ সেনা নিহত হবার পর কুরাইশগণ মুসলিমদেরকে প্রবেশের জন্য জায়গা ছেড়ে দেয়। মুসলিমদের ২ জন সেনা নিহত হয়।

খালিদ ইবনে ওয়ালিদের কৈফিয়ত গ্রহণ

    হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদের সৈন্যবাহিনীর ওপর কতিপয় কুরাইশ গোত্রের লোক তীর বর্ষণ করে; যার ফলে তিনজন মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন। হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ প্রতিহত করতে গেলে তাতে ১৩ জন লোক নিহত হয় আর অন্যরা পালিয়ে যায়।

   ৩ মুসলমানের শাহাদাত এবং ১৩ জন মক্কার লোকের নিহত হওয়ার ঘটনার জন্য প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে জানতে চান। তিনি ঘটনার প্রকৃত বর্ণনা দিলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, ‘আল্লাহর ফয়সালা এ রকমই ছিল’।

  ফলাফল:

      মক্কা বিজয় সূচনার শেষলগ্নে, আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করেন। মুহাম্মাদ (সা:) তাকে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বলেন তিনি স্বীকার করেছেন যে, মক্কার দেবদেবীগণ ক্ষমতাহীন বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, যা হল ইসলামী বিশ্বাসমূলক স্বীকারোক্তির প্রথমাংশ। বিনিময়ে, মুহাম্মাদ (সা:) আবু সুফিয়ানের ঘরকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেন কারণ সে ছিল গোত্রের তৎকালীন সর্দার এবং সকলেই তার আয়ত্তাধীন এলাকায় জমায়েত হয়েছিল, যা তিনি এভাবে বলেন:
"এমনকি যে আবু সুফিয়ানের গৃহে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদে থাকবে, 
যে অস্ত্র সমর্পণ করবে সেও নিরাপদে থাকবে, যে নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকবে সেও নিরাপদে থাকবে।"
পবিত্র কাবাঘরে যারা আশ্রয় গ্রহণ করবে, তারাও নিরাপদ।

    তিনি আরও ঘোষণা করেন:
আল্লাহ তখন থেকেই মক্কাকে একটি পবিত্র আশ্রয়স্থল বানিয়েছেন যখন তিনি স্বর্গ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন এবং পুনুরুত্থান দিবসের আগ পর্যন্ত এটি আল্লাহ প্রদত্ত পবিত্রতার কারণে পবিত্র স্থান হিসেবে বহাল থাকবে। আমার পূর্বে কাওকে এতে এই (দাঙ্গা হাঙ্গামা করার) বৈধতা দেয়া হয়নি। আমার পরে কাওকে বৈধতা দেয়াও হবে না এবং একটি ক্ষুদ্র সময় ছাড়া আমার জন্যও এটি বৈধ ছিল না। এর পশুদেরকে (শিকারযোগ্য) তাড়া করা যাবে না, এর গাছ কাঁটা যাবে না, এর ঘাস বা কোন গাছ উপড়ে ফেলা যাবে না, এবং প্রকাশ্যে ঘোষণা দেওয়া ব্যতিরেকে এর লুকাতা (অধিকাংশ জিনিস) কেউ তুলে নিতে পারবে না ।'

      এরপর, মুহাম্মাদ (সা:) তার সাহাবা (সঙ্গী) দের সাথে নিয়ে কাবা পরিদর্শন করলেন। সকল দেবদেবীর মূর্তি ভেঙ্গে ধ্বংস করে ফেলা হল। এরপর মুহাম্মাদ (সাঃ) কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করলেন:

وَقُلْ جَاء الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا
"বলো, সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হতে বাধ্য।"
সূরা বনী ইসরাইল-৮১

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ دَخَلَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم مَكَّةَ، وَحَوْلَ الْكَعْبَةِ ثَلاَثُمِائَةٍ وَسِتُّونَ نُصُبًا فَجَعَلَ يَطْعَنُهَا بِعُودٍ فِي يَدِهِ وَجَعَلَ يَقُولُ ‏{‏جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ‏}‏ الآيَةَ‏.‏

      আবদুল্লাহ্‌ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন (বিজয়ীর বেশে) মক্কায় প্রবেশ করেন, তখন কা‘বা শরীফের চারপাশে তিনশ’ ষাটটি মূর্তি ছিল। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের হাতের লাঠি দিয়ে মূর্তিগুলোকে আঘাত করতে থাকেন আর বলতে থাকেনঃ “সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে, (আয়াতের শেষ পর্যন্ত)”- (বনী ইসরাঈল/ইসরা : ৮১)।
সহিহ বুখারীঃ ২৪৭৮

   জনগণ মক্কায় সমবেত হল এবং মুহাম্মাদ (সা:) নিম্নোক্ত বক্তব্য দিলেন:

  "আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই। তার কোন সহকারী নেই। তিনি তার অনুগতর কাছে করা অঙ্গীকার পূর্ণ করেছেন, তাকে সাহায্য করেছেন এবং তার সকল প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেছেন। মনে রেখো, কাবা ঘরের অভিভাবকত্ব ও মক্কায় তীর্থযাত্রীদের পানি সরবরাহকারী ছাড়া সকলের বংশ বা সম্পদ সম্পর্কিত জাত্যাভিমানের দাবি বাতিল করা হল। মনে রেখো, যে হত্যা করবে তার রক্তপন হল ১০০ উট। কুরাইশের লোকসকল, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের কাছ থেকে অজ্ঞতার যুগের সকল অহংকার এবং তোমাদের পূর্বপুরুষ-সম্পর্কিত সকল গরিমা রহিত করেছেন, কারণ সকল লোকই আদমের উত্তরসূরি, আর আদম ছিলেন কাদামাটির তৈরি।"

     এরপর মুহাম্মাদ (সা:) জনগণকে উদ্দেশ্য করে বললেন:
"হে কুরাইশগণ, তোমাদেরকে প্রতি আমার কি রকম আচরণ করা উচিৎ বলে মনে কর?"

    এবং তারা বলল, "করুণা, হে আল্লাহর নবী। আমরা আপনার কাছ থেকে ভালো ছাড়া কিছুই আশা করি না।"

        এরপর মুহাম্মাদ (সা:) ঘোষণা করলেন:
"আমি তোমাদের ঠিক তাই বলবো যা নবী ইউসুফ তার ভাইদেরকে বলেছিলেন। আজ তোমাদের প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই; তোমরা যেতে পারো কারণ তোমরা মুক্ত।" মক্কাবাসীর আত্মসমর্পণের পর মুহাম্মাদ (সা:) এর সম্মান বৃদ্ধি পায়। আরব অঞ্চল হতে সকল কূটনৈতিক প্রতিনিধিগণ তাকে স্বীকৃতি দিতে মদিনায় আসেন।

 দশজন লোককে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেয়া হল:
১. ইকরিমা ইবনে আবু জেহেল, 
২. আবদুল্লাহ ইবনে সাদ ইবনে আবি সারহ, 
৩. হাবার ইবনে আসওয়াদ, 
৪. মিক্বাস সুবাবাহ লাইসি, 
৫. হুয়াইরাস বিন নুকাইদ, 
৬. আবদুল্লাহ হিলাল ও হিন্দাসহ মোট চারজন মহিলা যারা হত্যার বা অপরাধের দায়ে দোষী ছিল অথবা যুদ্ধ উস্কে দিয়েছিল অথবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল।

তবে, তাঁদের সকলকে হত্যা করা হয় নি; ইকরিমা ইসলাম গ্রহণ করে বেঁচে যান এবং ভবিষ্যৎ যুদ্ধে মুসলিম পদবিতে যুদ্ধ করেন। দুইজন গায়িকাকে মুহাম্মাদ আইন অমান্যের দায়ে অভিযুক্ত করেন, একজনকে হত্যা করা হয় কিন্তু অপরজন ইসলাম গ্রহণের কারণে মুক্তি পায়। আবদুল্লাহ ইবনে সাদ- উসমান ইবনে আফফানের সুপারিশে নিরাপত্তা পায় এবং প্রাথমিকভাবে সে মুহাম্মদ (সা:) এর  আনুগত্য মেনে নিতে অস্বীকার করে, তবুও মুহাম্মাদ (সা) এর জারিকৃত আদেশকে ভুল বোঝার কারণে প্রত্যক্ষদর্শীরা তাকে হত্যা করেনি।
মক্কা বিজয়ের ঘটনাই পরবর্তীতে হুনাইনের যুদ্ধকে অনুসরণ করে।
--------------------------------- 
লেখকঃ ইসলামিক আর্টিকেল লেখক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments