Recent Tube

কুরআনিক থট প্রসেস: আল কুরআনের চিন্তামানস (৫), জিয়াউল হক।





কুরআনিক থট প্রসেস: আল কুরআনের চিন্তামানস - (৫)
--------------------------------- 


   আল্লাহর নির্দেশে মুসা আ: কোন এক যাত্রায় খিজির আ: এর সহযাত্রী হতে চাইলেন। ধৈর্য ধারণ করা ও নিজ থেকে তাঁর কোন কাজকর্মের কৈফিয়ত না চাওয়ার শর্তে খিজির আ: তাঁকে সহযাত্রি হিসেবে নিলে (সুরা কা’হফ : ৬৬ -৭০)। যাত্রাপথে নদী পারাপারকারী নৌকা ডুবিয়ে দেয়ার ঘটনা (আয়াত:৭১) ঘটে। মানুষের স্বাভাবিক দৃষ্টিতে কাজটা ছিল অপরাধ। অন্যের ক্ষতিসাধনের অধিকার কারো নেই। স্বাভাবিক এই ধারনাবোধ হতে মুসা (আ.) তার প্রতিবাদ করেছেন।

    খিজির (আ.) তাঁকে শর্তের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি চুপ করে যান। কিছুদূর যেতেই তাঁরা সাগরপারে খেলাতে ব্যস্ত একদল বালককে দেখলেন। খিজির (আ.) সেখান থেকে একটি ছেলেকে ধরে এনে হত্যা করলে আল্লাহর নবী মুসা (আ.) বিষ্মিত হয়ে বলে ওঠেন; ‘এ কি! একটি নিষ্পাপ শিশুকে আপনি হত্যা করলেন? এটা তো মহা অন্যায়, বিরাট গুনাহের কাজ।’ 

     খিজির (আ.) বললেন; ‘আমি তো আগেই বলেছিলাম, আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না।’ এবারেও মুসা (আ.) ক্ষমা চাইলেন এবং বলেন, ‘এরপর যদি আমি কোনো প্রশ্ন করি, তাহলে আপনি আমাকে আর সঙ্গে রাখবেন না।’ তিনি নিজেই একটা সীমানা নির্ধারণ করে দিলেন, যা লঙ্ঘন করলে খিজির আ: আর তাঁকে সাথে সহযাত্রী হিসেবে রাখতে বাধ্য নন।

     অতঃপর তাঁরা চলতে চলতে একটি গ্রামে পৌছে গ্রামবাসীদের কাছে খাবার চাইলে গ্রামবাসীরা মুসাফিরদের আতিথেয়তায় সম্মত হলো না। খিজির আ: ঐ গ্রামে অত্যন্ত জরাজীর্ণ ও পতনোন্মুখ একটা দেয়াল দেখে স্বপ্রণোদিত হয়ে সেটাকে সংস্কার করলেন যেন তা স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। বিনিময়ে কোনরকম পারিশ্রমিক নিতে না দেখে কিংবা গ্রামবাসীদের কাছ থেকে খাবার চাইতে না দেখে মুসা (আ.) বললেন; ‘আপনি ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে এর পারিশ্রমিক নিতে পারতেন। কেননা এরা আমাদের খাবার দেয়নি।’ এভাবে স্বনির্ধারিত সীমা অতিক্রম করায় খিজির (আ.) বললেন; ‘এখানেই আমাদের যৌথ যাত্রা শেষ। তবে যাবার আগে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি যেন বুঝতে পারেন, কেন কাজগুলো করেছি।’ 

     খিজির আ: ঘটনাগুলোর ব্যাখা দিলেন। প্রথমটি নৌকা ছিদ্র করার ঘটনা। নৌকাটা ছিল কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তির, যা দিয়ে তারা সাগরে মাছ ধরে বা যাত্রী পারাপারে ভাড়ায় খাটিয়ে জীবন চালাতো। সেটিই ফুটো করেছি কারন সেখানকার জালিম বাদশাহ ঐ সমটাতেই বল প্রয়োগে মানুষের নৌকা ছিনিয়ে নিচ্ছিল। খুঁতযুক্ত, ভাঙ্গাচোরা নৌকা সে নিত না। তাই ছিদ্র করে দিয়েছি, যাতে তারা জীবিকা নির্বাহ করতে পারে (আয়াত :৭৯]
দ্বিতীয় ঘটনাটি খেলাধুলারত ছেলেটির বাবা-মা ঈমানদার মানুষ, ছেলেটি বড় হয়ে কাফির হবে, যা তাদের জন্য দু:খ কষ্ট ও আজাবের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই তিনি চাইলেন যে মহান আল্লাহ তার বাবা মাকে এই ছেলের বদলে এমন উত্তম সন্তান দান করুন, যে হবে সৎকর্মশীল ও নির্মল চরিত্রের অধিকারী (আয়াত ৮০-৮১)।

    তৃতিয়টি ছিল জরাজীর্ণ দেয়ালটি সংস্কার করে তা ধ্বসে পড়া হতে রক্ষা করে যথাস্থানে খাড়া করিয়ে দেয়া। প্রাচিরটির মালিক ছিল নগরীর দু’জন এতিম বালক, আর দেয়ালটির নিচে তাদের নেককার বাবার রেখে যাওয়া গুপ্তধন লুকায়িত ছিল। আল্লাহপাক চেয়েছেন যে, এতিম বালক দু’টি সাবালক হওয়া পর্যন্ত দেয়ালটি দাঁড়িয়ে থাকুক এবং এতিম ছেলেগুলো তাদের প্রাপ্য গুপ্তধন হস্তগত করুক (আয়াত ৮২)।

    পুরো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একজন মানুষ হিসেবে মুসা আ: এর প্রশ্ন উত্থাপন আর খিজির আ: এর জবাবগুলো খুব গভীর বিশ্লেষণের দাবী রাখে। জীবিকার একমাত্র সম্বল নৌকা ফুটো করাটা মালিকদের জন্য আপাতদৃষ্টিতে এক বিরাট বিপদ ছিল, কারণ এর উপরেই তাদের আয় উপার্জন নির্ভর করছিল। তেমনই যে ছেলেটিকে হত্যা করা হয়েছিল, সেটি তার বাবা মায়ের জন্য সন্তান হারানোর মতো হৃদয়বিদারক ঘটনা ছিল।

     আর অত্যন্ত বৈরি সামাজিক মনস্তত্ত সমৃদ্ধ এলাকাবাসী নিজেদের সমাজের দু’জন অসহায় এতিম সন্তানের যতœ নেবার নৈতিক দায়িত্ব কিংবা নিজ জনপদে আগত ক্ষুধার্থ মুসাফিরদের আপ্যায়নের সামাজিক দায়িত্ব পালনেও অনিচ্ছুক, সেই জনপদেও বিনা পারিশ্রমিকে নিজ উদ্যোগে সমাজকর্ম করার পেছনে যে মনস্তত্ত রয়েছে, সেটিকেই আমাদের সামনে তুলে ধরতে আল্লাহ পাক তাঁর নবীকে আর দশজনের মতো সমাজের একজন সাধারণ সদস্য বানিয়ে খিজির আ: এর কাছে প্রেরণ করে কিছু ঘটান ঘটালেন। কুরআন সুস্পষ্ট জানাচ্ছে, খিজির আ: আল্লাহর নির্দেশেই এগুলো করেছেন (আয়াত: ৮২)। 

     মুসা আ: একজন নবী হিসেবে নয়, সমকালীন সমাজের একজন সাধারণ সদস্য হিসেবে ঘটনাগুলোকে দেখলেন, এভাবেই তাকে শিক্ষা দিলেন, সমাজে আশে পাশে অনেক ঘটনা আল্লাহ পাক ঘটান যার কোন দৃশ্যমান ব্যাখা আমাদের জানা থাকে না, অথচ সেগুলোর পেছনে সুদূরপ্রসারী বৃহত্তর কল্যাণ লুকায়িত থাকে। 

    উক্ত ঘটনার প্রায় দুই হাজার বসর পরে এসে সেগুলো সবিস্তারে কুরআনের পাতায় আমাদের জন্য তুলে দেয়ার পেছনে উদ্দেশ্যটা হলো, আমরা যেন বিপদে আপদে ধৈর্য ধরতে পারি। যেন বুঝতে পারি; ধৈর্য ও সবরের মধ্যে কল্যাণ লুকায়িত রয়েছে। ধৈর্যশীলদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা: এঁর পক্ষ হতে উত্তম প্রতিদানের প্রতিশ্রæতিগুলো কোন হেলাফেলা খেয়ালি বিষয় নয়।

     আল কুরআন তার পাঠক ও অনুবর্তিদের মনে যে চিন্তামানস তৈরি করতে চায়, সেখানে ধৈর্য বা সবর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা বৈশিষ্ঠ। বস্তুত সর্বোচ্চ মানের সবর হলো কুরআনিক থট প্রসেস বা কুরআনিক চিন্তামানসের এক অনূপম প্রকাশ। (সংক্ষেপকৃত)
-----------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ, গ্রন্থপ্রনেতা, গীতিকার, ইতিহাস বিশ্লেষক, গবেষক, ইংল‍্যান্ডের বেসরকারী মানসিক হাসপাতালের সাবেক সহকারী পরিচালক ও প্রবন্ধ লেখক, ইংল‍্যান্ড।

Post a Comment

0 Comments