Recent Tube

যে কারণে বার বার ‘পলাশী ’ আসে-; জিয়াউল হক।





 


 
   যে কারণে বার বার ‘পলাশী ’ আসে-;
                      শেষ-পর্ব;
   

   রালফ পানপেয়ালার বন্ধু আকবরকে পরামর্শ দিচ্ছেন কিভাবে তার রাজ্যকে নিরুপদ্রব রাখা যায়, আকবর বিনিময়ে তড়িঘড়ি গঠিত ইংলিশ কোম্পানি ‘ Elizabeth's Levant Company  ’কে (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পূর্বসূরী) ভারতে বিশেষ সুবিধায় বাণিজ্য, দিল্লিতে গির্জা প্রতিষ্ঠা, রাজপরিবারে খৃষ্টধর্ম শিক্ষা দেয়াসহ সবরকম সুবিধা দিয়েছেন (১৫৮৬-৮৮)।

    ওদিকে সুন্নী মুসলমানদের হাতছাড়া হওয়া শিয়া ইরানে ইংরেজ দুই সহোদর; রবার্ট শালি আর উইলিয়াম শার্লি পর্যটকের ছদ্মবেশে এসে চাকুরি নিলেন শাহের অধিনে। ছোট ভাই রবার্ট শার্লিকে ইরানি সেনাবাহিনী আধুনিকায়নের দায়িত্ব দেয়া হলো (১৫৮৮)। মাত্র পাঁচ বসরেই ইরানের সেনাবাহিনী তাদের শক্তি পরখ শুরু করলো উসামানীয় খেলাফতের বিরুদ্ধে।

   বসর দুয়েকের মধ্যেই (১৫৯১) ভারতে ‘হায়দ্রাবাদ’ নামক পুরোমাত্রায় শিয়া শহর প্রতিষ্ঠিত হলো সুলতান কুলি কুতুব কর্তৃক। ততদিনে দক্ষিণ উপকূলে পর্তূগিজদের প্রতিদ্বন্দী ফরাসি এবং ইংরেজ বণিকরাও হাজির। আর বিজাপুরের সুলতান আদিল খাঁন ও আহমেদনগরের শাসক নিজাম শাহ মিলে পর্তুগিজদের দূর্গ Chalyam মাটির সাথে মিশিয়েছেন (১৫৬৪)। ঐতিহাসিক শ্রীধারা মেননের মতে; ‘সেটাই ছিল ভারতে পর্তূগিজদের পতনের শুরু।’ 

    তবে কারণটা ভিন্ন। নেহেরুর ভাষায়; ‘সে (ভারত) সব সময়ই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, কখনও সফল হয়েছে, কখনোবা ব্যর্থ। এমনকি, যখন সে ব্যর্থ হয়েছে, তখনও তার ব্যর্থতাকে স্মরণে রেখে সুযোগের অপেক্ষায় থেকে নিজেদের সেভাবেই তৈরি করেছে। তার কৌশল দুই ধরনের; লড়াই করে আগ্রাসী শক্তিকে তাড়িয়ে দেয়া, আর যাদের পরাজিত করা সম্ভব হবে না, তাদেরকে ভেতর থেকেই হজম করে ফেলা।’

    ভারত পর্তূগিজদের হজম করে ফেলেছে। আল বুকার্ক আর ভাস্কো ডা গামা অগণিত ভারতীয়কে হত্যা করে তাদের স্ত্রী কন্যাদের বিয়ে করতে হুকুম দিয়েছিলেন নিজ সৈন্যদের। এভাবেই ভারতীয় সংস্কৃতির ছোবলে পর্তূগিজ শাসন হজম হয়ে যায়। ইংরেজরা ঢালাওভাবে ভারতীয় সাংস্কৃতি গ্রহণের ভূলটা করেনি। উল্টো তাদের জন্য সবচেয়ে বড়ো আতংক; ইসলামি  সাংস্কৃতিকে কলুষিত করেছে, করিয়েছে ভারতীয় হিন্দু ও কট্টর শিয়াদের দিয়ে। সম্রাট  আকবরকে তারা এ কাজে লাগিয়েছে। 

    হায়দ্রাবাদ ভারতের বুকে উগ্র শিয়া মতবাদের তীর্থস্থান হয়ে উঠলো। সাফাউই ইরান হতে সৈনিক, প্রশাসক, আলেম এসে ভারতে আসন গাড়লো। বিগত একটি শতাব্দি ক্রমাগতভাবে নির্যাতনের মুখে সুন্নী অনেক আলেম-ওলামা সুফীবাদের দিকে ঝুঁকে সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি হতে সরে যাওয়ায় শুন্যস্থান পূরণ করলেন তারা এবং আরও বেশি কঠোর হলেন সুন্নী আলেমদের প্রতি। এ সময়ে ভারতের বুকে সুফিবাদের বিস্তার ঘটার কারণও এটাই।

    আকবরের মা হামিদা বানু, তার অভিভাবক বৈরাম খাঁ, আবুল ফজল, তার ভাই ফৈজি শিয়া মতাদর্শী, আবুল ফজল শিয়া হয়েও ছিলেন পাঁড় নাস্তিক। তাদের বাবা শেখ মুবারাকও শিয়া। রিক্ত হাতে আসা এ পরিবার রাষ্ট্রীয় সুবিধা পেতে আকবরের দরবারে পরামর্শদাতা সেজে বসলেন। খুঁটির জোর দুটো; এক; কুরআন-হাদিসের জ্ঞান থাকায় বিকৃত ফতওয়া দেবার যোগ্যতা এবং দুই; প্রতিবেশি সাফাউই শাহের নেকনজর।

   আকবরের আগে ভারতবর্ষে ক্রমাগত নয়টি মুসলিম রাজবংশ শাসন করলেও কেউই চল্লিশ বৎসরের বেশি টেকেনি। তাই আকবরের মনে রাজ্য হারাবার ভয় থাকায় তিনি সহজ পথ ধরলেন। Alexander Walker এর ভাষায় ‘আকবর অন্যান্য মহান ধর্মের সাথে ইসলাম ধর্মকে মিলিয়ে একটা সার্বজনীন সহনশীল ধর্ম উদ্ভাবনে সচেষ্ট হন, এটা আকবরকে তার অমুসলিম প্রজাদের কাছে প্রিয়পাত্র করে তোলে’।

    রাজপুতরা নিজ কন্যা, বোন, আত্মীয়াকে আকবরের স্ত্রী হিসেবে রাজপ্রসাদে তুলে দিলে হিন্দু ধর্ম, সংস্কৃতি ও জীবানাচারের অবাধ অনুপ্রবেশে মোগল সাম্রাজ্যসহ পুরো মুসলিম সমাজ অস্তিত্তসংকটে পড়ে। মুসলিম শাসকরা জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হারিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোগবাদী ও বিলাসী শাসকে পরিণত হয়। প্রমাণ জাহাঙ্গির আর তার রাণীর শখের বশে মাছের নাকে হীরার নোলক পরানো, শাহজাহানের ৩ কোটি ২০লক্ষ রুপীতে (আধুনিক ২০ বিলিয়ন রুপী) তাজমহল, ১১৫০ কেজি সোনা, ২২৪ টি হীরা দিয়ে ময়ুর সিংহাসন, ১২ বিলিয়ন ডলারের কোহিনূর মুকুট তৈরি! 

   অথচ পচিশকোটি (১৭৫৬) ভারতবাসীর মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা, শিক্ষার আধুনিকায়ন ও বিজ্ঞানচর্চার কোন ব্যবস্থা হয়নি। জুন মাসের প্রচন্ড রোদে পা পুড়ে যাওয়া থেকে বাঁচতে এক জোড়া পুরোনো জুতো চুরির অপরাধে চোরের পা গোড়ালী হতে কেটে ফেলেন! আকবরে ন্যায়বিচারের নমূনা !! 

    বিগত আড়াইশত বসরে তৈরি হওয়া চরম বঞ্চনা, অপমান, শোষণ আর জুলুমে পরিপূর্ণ এরকম সমাজে যখন ইংরেজরা কিছু খুদ কুঁড়ো ছিটিয়েছে, দু’পয়সা কামানোর সুযোগ দিয়েছে, সেই সুযোগ নিতে সামান্য মুদি দোকানদার কান্তমুদি ছুটে গিয়েছে নিজ নবাব আলিবর্দীর বিরুদ্ধে হেস্টিংসকে সাহায্য করতে। বিনিময়ে মাত্র এক দশকেই কান্তমুদি ‘কান্তজমিদার’। একই পথে  মীর জাফর থেকে ঘষেটি বেগম, রাজদূর্লভ প্রমূখ হেঁটেছে। নিজেদেরকে বঞ্চিত ভেবে প্রাপ্ত সুযোগ নিয়েছে। 

   সুযোগ নিয়েছে ইংরেজরাও। ভারতবাসীর আত্মকোন্দলের সুযোগে দীর্ঘ ১৯০ বসরে নিয়ে গেছে ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার! চলতি অর্থবসর (২০২১-২২) বাংলাদেশের প্রস্তাবিত বাজেট ৭২ বিলিয়ন ডলার; এ যাবতকালের সর্ববৃহৎ। চুরি হয়ে যাওয়া ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলারে বাংলাদেশ দীর্ঘ ৫৯৮ বসর একটা পয়সা না কামিয়েও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারতো!

   অবস্থার কি পরিবর্তন হয়েছে? আজও কি নিজেরা আত্মকলহে নিমগ্ন নেই? আজও কি অর্থনৈতিক বৈষম্য, জুলুম নির্যাতন আর অবিচার সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান নেই? আজও কি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার চুরি হয়ে যাচ্ছে না? আজও কি আমরা এক গোষ্ঠীকে অপর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছি না? আমরা কি নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিচ্ছি না? অবলীলায় জুলুম করছি না? জুলুম করে নির্লজ্জের মতো ক্ষমতার বড়াই দেখাচ্ছি না? আজকের বঞ্চিত নির্যাতিত আর নিপীড়িতরাই নিশ্চিত একদিন ঘষেটি বেগম, মীর জাফর হবে প্রতিশোধ নিতে। অপেক্ষা কেবল উপযুক্ত সময় ও সুযোগের!

   অর্থাৎ আরও একটা পলাশীর সকল পথই খোলা রয়েছে আজও। পলাশীর পূনরাগমণ ঠেকানোর পথ একটাই; ইনসাফ ও ন্যায় বিচার, মানবিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা এবং জাতিয় ঐক্যের সাথে সাথে ‘সবার আগে আমার দেশের স্বার্থ, তারপরে অন্য কিছু’ এই চেতনা ধারণ ও লালন করার মধ্যেই।
--------------------------------- 
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক গবেষক ও ইংল‍্যান্ডের বেসরকারী একটি মানসিক হাসপাতালের সাবেক সহকারী পরিচালক  ইংল‍্যান্ড।

Post a Comment

0 Comments