Recent Tube

যে কারণে বার বার ‘পলাশী ’ আসে- জিয়াউল হক।







 

যে কারণে বার বার ‘পলাশী ’ আসে- (ঐতিহাসিক পলাশী দিবস উপলক্ষ্য)

    আলফানসো এবারে পূর্ণ সামরিক পরিকল্পনাতেই এগুলেন। মাত্র পাঁচ বৎসরের মধ্যেই বাণিজ্য কুটিরের ছদ্মাবরণে কোচিনে তৈরি করলেন প্রথম দূর্গ। কেরালার রাজার ক্ষমতা হলো না বাধা দেবার, সে নিজেই তখন পর্তূগিজ বণিকদের হাতের পুতুল ! ১৫১০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় এলাকা গোয়া’য় প্রথম পর্তূগিজ কলোর্নি বানিয়ে ফেলেলেন। এতোদিন কোন না কোন স্থানীয় ভারতীয় রাজার উপরে নির্ভর করতে হতো, কিন্তু এবারে তাদের নিজেদের বসার জায়গা হলো অন্তত। এখান থেকেই তারা যুদ্ধ চালিয়ে গেল উপকূলব্যাপী ছোট ছোট মুসলিম সালতানাতগুলো বিরুদ্ধে।

    কালিকটের জামুরিন হিন্দু রাজা পর্তূগিজ আগমণের সূচনা থেকেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন আশে পাশের সকল মুসলমান বণিক ও যোদ্ধাদের নিয়ে মুসলিম সেনাপতি কুঞ্জ আলি এবং কুট্টি আলি’র সেনাপতিত্বে। সেই রাজাই শেষপর্যন্ত মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে পর্তূগিজদের সাথে সন্ধী করেন!

     এ বিশ্বাসঘাতকতা পুরো মুসলমান সম্প্রদায়কে চরম ঝুঁকির মুখে ফেলে। হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক ও পারষ্পরিক আস্থায় মারাত্মক ধ্বস নামে। যে দু'টি সম্প্রদায় শত শত বৎসর পাশাপাশি বন্ধুর মত বসবাস করে এসেছে, তাদের সেই সম্পর্ক ও সম্প্রীতিতে অবিশ্বাস আসন করে নেয়। 

    স্থানীয় ছোট খাটো হিন্দু রাজারাও (যেমন; Kolathiri, Quilon  এবং Purakkad প্রমূখ) প্রতিপক্ষকে পরাস্থ বা তাদের হাত থেকে নিজেদের রাজ্য রক্ষার জন্য পর্তুগিজদের আহ্বান করেছে, তাদের সহায়তা নিয়েছে। এ সুযোগকে পর্তূগিজরা কাজে লাগিয়েছে পুরোমাত্রায়। কোন ইউরোপীয় দখলদার শক্তি কর্তৃক সাফল্যজনকভাবে ভারতের একটি গোষ্ঠীকে অপর কোন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে কার্যস্বিদ্ধির ধারাও এখান থেকেই শুরু।

    এভাবেই পর্তূগিজরা ১৫০৩ খৃষ্টাব্দে কোচিন, ১৫০৫ কান্নালৌর, ১৫১০ খৃষ্টাব্দে গোয়া এবং ১৫১১ খৃষ্টাব্দে মালাক্কা প্রণালী দখল করে দুরপ্রাচ্যের ইন্দোনেশিয়া থেকে আফ্রিকার মোজাম্বিক পর্যন্ত এক বিশাল নৌ রুটের উপরে নিজেদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

    পায়ের নীচে মাটি শক্ত হয়ে গেলে তারা শত্রু মিত্র কাউকেই ক্ষমা করেনি। মালাবার উপকূলের পরাজিত মুসলমান, এমনকি, হিন্দুদেরও হত্যা করেছে, নারীদের রক্ষিতা বানিয়েছে, শিশু, যুবকদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছে আটলান্টিকের ওপারে ওয়েস্ট ইন্ডিজে। আজও সেখানে হিন্দু-মুসলমান ভারতীয়দের বংশধররা বিদ্যমান। এই দাস ব্যাবসায় বহু হিন্দু ব্রাহ্মণ এবং গোয়ায় ভারতীয় নারীদের গর্ভে পর্তূগিজদের ঔরষে জন্ম নেয়া এ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা জড়িয়ে গেলে তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছোঁয়া পায়। উন্নয়নের জোয়ার আসে স্পেন ও পর্তূগালেও! রাতারাতি সেখানে বিপ্লব ঘটতে দেখে ঘর ছেড়ে ছুটে আসে প্রতিবেশি ফ্রান্সও। শুরু হয় দেশ ও জনপদ দখলের মহোৎসব! 

    নিজেদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দে, তাতার ও ক্রুসেডারদের বর্বরতায় আব্বাসীয় খেলাফত ততোদিনে ইতিহাস। উমাইয়্যাদের তো আন্দালুস থেকে উৎখাত করেছে। মুসলিম উম্মাহর সামনে কোন অভিভাবক নেই এক ওসমানীয় খেলাফত ছাড়া। কিন্তু ওসমানীয় খেলাফত তখন পুর্ব ইউরোপের হাঙ্গেরি, ভিয়েনা, বুলগেরিয়া’সহ আশে পাশের নানা জনপদে অভিযানে ব্যস্ত। আর নিজেদের আভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ তাদেরও ছিল।

   ঠিক এরকম একটা সময়ে আরও একটা ঘটনা ঘটে যায়, ভারতের বাইরে, কিন্তু ঘটনাটা পুরো ভারতের, এমনকি, পুরো মুসলিম বিশ্বের গতিধারাই বদলে দিয়েছে। সেটা হলো 'সাফাউই' বা 'সাফাভি' নামক কট্টর ও উগ্রপন্থী শিয়া গোষ্ঠীর নেতা শাহ আব্বাস পারস্যের ক্ষমতায় আসীন হন। উগ্রপন্থী, কট্টর সুন্নীবিরোধি এই গোষ্ঠী পারস্যের বুকে হাজার হাজার ইসলামিক স্কলার, সুন্নী আলেম, এমনকি, মধ্যপন্থী শিয়া আলেমদেরকেও নির্দ্বিধায় হত্যা করে। ইরানের বুকে দীর্ঘ সাড়ে আটশত বৎসর ধরে চলা ইসলামের গৌরবজনক অবস্থান থেকে বিচ্যুত করে শিয়া ধর্মকে ইরানের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করে (১৫০১)। শুরু হয় এক ভিন্ন অধ্যায়।

    এ সময় ভারতের লোকসংখ্যা ছিল আঠারো কোটি। ওদিকে ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে ইংল্যান্ড তখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বস্তি। স্যাঁতসেঁতে কর্দমাক্ত জলাভুমিতে পচিশ লক্ষ মানুষের মানবেতর জীবন। আলু আর সমুদ্র বা নদীর মাছ পুড়িয়ে খেয়েই কোনমতে জীবন বাঁচায়। শতকরা ৯০জন গ্রামে বাস করে, সারা বসর রোগ আর মহামারীর মহোৎসবে গড় আয়ু মাত্র ৩৫ বসর, শতকরা ৯০জন শিশু প্রথম জন্মবার্ষিকির আগেই মারা যায়। খুন ডাকাতি লুটতরাজ অহরহ ঘটছে। শতকরা প্রায় পচাত্তর ভাগ থেকে আশি ভাগ লোকই দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে। 

    রাণী প্রথম এলিজাবেথ দিশেহারা। তাঁর এক পরামর্শক; বুড়ো দার্শনিক জন ডি (John Dee) পরামর্শ দিলেন বাইরের দেশ দখল করে ‘ব্রিটিশ এম্পায়ার’ প্রতিষ্ঠার। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘ব্রিটিশ এম্পায়ার’ বাক্যটি তিনিই উচ্চারণ করেন। বুড়োকে রাজদরবারের অন্যান্যরা তো বটেই, এমনকি, রাণীও পাগল ঠাউরেছেন। ঠাট্টা করেছেন। বেচারা বুড়ো জন ডি উপহাসের পাত্র হয়ে অনাদরে, অনাহারে একরম বিনা চিকিৎসায় মরেছেন। এ যেন আমাদের কবি ফররুখের মতো অবস্থা। পৃথিবীর সব দূরদর্শী মানুষগুলোকেই বোধ হয় অপরিণামদর্শী দেশবাসী এভাবেই প্রতিদান দেয়! জন ডি যে সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন পুর্তুগাল আর ফ্রান্সের ঘটনা বিবেচনায়, সেটা দেখার মতো জ্ঞানচক্ষু ছিল না ইংলিশ সমাজের অধিকাংশজনেরই।

    পর্তূগালের নাটকীয় উত্থান শুনে এক ইংরেজ ব্যবসায়ী রালফ ফিচ (Ralph Fitch) ভাগ্যের সন্ধানে সেখানে যান, কিন্তু পাত্তা না পেয়ে নিরাশ হন। দেশে গিয়ে কি করবেন? খাবেনই বা কি? তাই দেশ না ফিরে পর্তূগিজরা যে দেশে গিয়ে ভাগ্য ফিরিয়েছে, সেই ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন এবং একসময় এসে দক্ষিণ ভারতে নামেন। সবখানেই পর্তূগিজদের আধিপাত্য, কোন ইংলিশম্যানকে তারা পাত্তা দিতে রাজী নয়। ফলে বাধ্য হয়ে উত্তরে দিকে যাত্রা করলেন।

    রালফ ভারতের জনপদকে খুব কাছ থেকে দেখতে থাকলেন। বর্ণবাদভিত্তিক এ সমাজে এক গোষ্ঠী অপর গোষ্ঠীর দ্বারা নিষ্পেষিত ও জর্জরিত। প্রতিটি গোষ্ঠী তার প্রতিদ্বন্দী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার সুযেগে থাকে। যে কোন মূল্যে তা গ্রহণও করে মনের ঝাল মেটাতে। এখানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের শত্রু, বন্ধুত্বের ভান ধরে থাকে কেবল! 
খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রালফের জন্য, একজন ইংরেজের জন্য। অচিরেই তিনি ভিড়ে যান সম্রাট আকবরের দরবারে (১৫৭৯)। সম্রাটের সাথে বন্ধুত্ব এবং মাত্র বসর দুয়েকের মধ্যেই খোদ রাণী এলিজাবেথের ব্যক্তিগত অনুরোধে আকবর তাকে মোগল দরবারে ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত হিসেবে বরণ করে নেন। শুরু হয় ইতিহাসের এক টার্নিং পয়েন্ট। (সম্ভবত আগামি পর্বে সমাপ্য)
--------------------------------- 
 লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক গবেষক ও ইংল‍্যান্ডের বেসরকারী একটি মানসিক হাসপাতালের সাবেক সহকারী পরিচালক , ইংল‍্যান্ড।

Post a Comment

0 Comments