কুরআনিক থট প্রসেস-
পর্ব-১৩;
---------------------------------
ভাষা হলো জ্ঞানের অন্যতম প্রধান বাহন। ভাষাকে ভিত্তি করেই জ্ঞান তার প্রকাশ ঘটায়। মানুষ তার মনে যা ভাবে তা প্রকাশ করার একমাত্র মাধ্যমই হলো ভাষা। তাই চিন্তাধারা বা থটপ্রসেসের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো; ভাষা।
ভাষা সরাসরি চিন্তা বা ধারনা তৈরি করে না, তবে ব্যক্তিমানসে তৈরি হওয়া চিন্তা (Thought) ও ধারনাকে (Perception) সে আকার দেয়, প্রকাশ করে। শ্রবণযোগ্য বা অনুধাবন যোগ্য হিসেবে অপরের কাছে তুলে ধরে।
মানুষের মনে যে চিন্তা বা ধারনার উপস্থিতি রয়েছে বা যা তারা প্রকাশ করছে প্রতিনিয়তই, সেটাকে সকলের সামনে তুলে ধরার মাধ্যমও এই ভাষা’ই। উপলব্ধী ও হৃদয়ংগমের মাধ্যমও এই ভাষা। তাই ভাষা সার্বিকভাবে থট প্রসেসের সাথে অবিচ্ছেদ্দভাবে জড়িত একটি উপাদান।
একজন ব্যক্তির জন্য এই ভাষার ব্যবহার জানা ও তাকে সর্বোচ্চ মানে ব্যবহার করতে পারাটাও এক বিরাট যোগ্যতা। এই যোগ্যতাও আল্লাহ পাক মানুষকে দিয়েছেন। তিনি ভাষার সৃষ্টি করার পাশাপাশি সেই ভাষায় তার উপলব্ধী, ভাবনা, আবেগ ও অনুভুতিকে ভাষায় বর্ণনা করার ক্ষমতা ও যোগ্যতাও দেয়া হযেছে, সে বিষয়েও বলা হয়েছে; ‘করুণাময় আল্লাহ। শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তাকে শিখিয়েছেন বর্ণনা। (সুরা আর-রহমান ১-৪)’
তা হলে আমরা দেখতে পাচ্ছি কথা বলার ক্ষমতা বাকশক্তি, সেই সাথে শ্রবণশক্তি বা কথা শোনার ক্ষমতা ও যোগ্যতা, একই সাথে দৃষ্টিশক্তি বা দেখার ক্ষমতা ও তা অনুধাবন করার ক্ষমতা, স্পর্শ করার শক্তি, ঘ্রাণ নেবার ক্ষমতা এবং ভাষার ব্যবহার জানা এসবই হলো কগনিশনের সঙ্গার মধ্যে যে ইন্দ্রিয় বা সেন্স (senses) এর কথা বলা হয়েছে, তার আওতাভূক্ত।
এগুলো সবই ইন্টেলেক্ট (Intellect) বা আকল তৈরিতে সাহায্যকারী ও অনিবার্য উপাদান হিসেবে কাজ করে। এইসব ইন্দ্রিয়গুলোকে যথাযথভাবে কাজে না লাগিয়ে আকল তৈরি করা যায় না, বা আকল তৈরি হয় না।
কুরআনুল কারিমেও আমরা স্বয়ং আল্লাহর বাণী হতেই এর প্রমাণ পাই, যেমন দেখুন; আর তাদের অন্তর্ভুক্ত হইও না, যারা বলে যে, আমরা শুনেছি, অথচ তারা শোনে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা'আলার নিকট সমস্ত প্রাণীর তুলনায় তারাই মূক ও বধির, যারা উপলদ্ধি করে না। (সুরা আনফাল : ২১-২২)
অন্যত্র শোনা, উপলব্ধী করার মাধ্যমে বুদ্ধি খাটানো বা আকল তৈরির কথা বলা হয়েছে; তারা আরও বলবেঃ যদি আমরা শুনতাম অথবা বুদ্ধি খাটাতাম, তবে আমরা জাহান্নামবাসীদের মধ্যে থাকতাম না। (সুরা মুলক : ১০)
অন্য এক স্থানে বলা হয়েছে; আর আমি সৃষ্টি করেছি দোযখের জন্য বহু জ্বিন ও মানুষ। তাদের অন্তর রয়েছে, তার দ্বারা বিবেচনা করে না, তাদের চোখ রয়েছে, তার দ্বারা দেখে না, আর তাদের কান রয়েছে, তার দ্বারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত; বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই হল গাফেল, শৈথিল্যপরায়ন। (সুরা আরাফ : ১৭৯) আবার সাদামাটা ভাষায় এভাবে বলা হয়েছে; যে ব্যক্তি ইহকালে অন্ধ ছিল সে পরকালেও অন্ধ এবং অধিকতর পথভ্রান্ত (সুরা বনী-ইসরাঈল :৭২)।
আমরা ইতোপূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, থট প্রসেসের (Thought Process) অন্যতম একটা উপাদান হলো; উপস্থাপনা (Propositions)। আল কুরআন তার নিজস্ব পরিভাষায় এটাকে ‘বয়ান’ হিসেবে অভিহিত করেছে (সুরা আর রাহমান, আয়াত ১-৪ দ্রষ্টব্য)।
আরবি ভাষায় বয়ান শব্দের খুব সহজ ও সর্বজনগ্রাহ্য অর্থও এটাই; বর্ণনা করা, বলা, ব্যাখা করা, পরিবেশন করা, উপস্থাপনা, ইত্যাদি। মোদ্দা কথা হলো, সৃষ্টির সকল কিছুর ইমেজ ও কনসেপ্ট; তথা, ধারনাকে নিজের মানসপটে ধারন করে সে সব তথ্য উপাত্ত ও চিত্রকে বিশ্লেষণ করার মতো মানসিক প্রক্রিয়া, তথা, ইনফরমেশন প্রসেসিং সিস্টেম ও দক্ষতা (Information Processing Skill) তার পাশাপাশি তা প্রকাশ করার এক অতি প্রয়োজনীয় উপযুক্ত ও কার্যকর উপাদান হলো ভাষাজ্ঞান বা ল্যাংগুয়েজ স্কিল (Communication Skill / Language Skill)।
আবার দেখুন, ভাষা জানলেই চলে না, সেই ভাষা প্রয়োগের জ্ঞান, তথা, ভাষাজ্ঞানও মানুষের জন্য অন্তত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। ভাষা ছাড়া মানুষ তার মানবিক প্রকৃতিতে পূর্ণতা পেতে পারে না। ভাষা না জানলে, তার ব্যবহার না জানলে তার লার্নিং স্কিল (Learning Skill) কোন কাজই করে না, তার ভেতরে সেটা গড়েও উঠে না। তেমন কোন সুযোগও নেই। কারণ মানুষ এমন একটা প্রাণী, যার আকল বা ইন্টেলেক্ট (Intellect) রয়েছে, যাকে শেখানো যায়।
ঠিক এ বাস্তবতারই প্রমাণ আমরা পচ্ছি সুরা বাকারা’র ৩৫ নম্বর আয়াতে যেখানে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন হযরত আদম আ: কে উদ্দেশ্য করে বললেন; এবং আমি আদমকে হুকুম করলাম যে, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করতে থাক এবং ওখানে যা চাও, যেখান থেকে চাও, পরিতৃপ্তিসহ খেতে থাক, কিন্তু এ গাছের নিকটবর্তী হয়ো না। অন্যথায় তোমরা যালিমদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়বে।’
এ আয়াতে আদম আ: ও তাঁর স্ত্রী বিবি হাওয়ার সামনে আল্লাহ তাঁর নির্দেশকে পরামর্শ, সতর্কতা, করণীয় আকারে তুলে ধরছেন, একই সাথে সে করণীয়, সেই সতর্কতার ব্যাতয় ঘটলে কি পরিণতি হবে তাও স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছেন।
অর্থাৎ বিষয়টা আদম আ: এর সামনে এমনভাবে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে যখন তিনি ও তাঁর স্ত্রী বিবি হাওয়া জান্নাতে স্বাধীনভাবে চলা ফেরা, উঠা বসা ও খাওয়া দাওয়া করা, নিজের বা নিজেদের বোধ ও উপলব্ধীর উপরে ভিত্তি করে পছন্দ অপছন্দানুযায়ী স্বিদ্ধান্ত নেওয়া বা না নেওয়ার পূর্ণ সুযোগ ও ক্ষমতা তাদের রয়েছে।
আর এই সুযোগ ও ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে হলে তাদের প্রয়োজন ছিল জ্ঞান ও উপলব্ধী, আকল বা ইন্টেলেক্ট, যুক্তি ইত্যাদি সমৃদ্ধ একটি পূর্ণাঙ্গ ও পরিণত থট প্রসেস বা চিন্তা মানস।
আল কুরআনের যে কয়েকটি আয়াতের উল্লেখ করেছি আমরা ইতোপূর্বে (সুরা বাকারার ৩০ হতে ৩৬ নম্বর পর্যন্ত যে সাতটি আয়াতের উদ্ধৃতি ইতোপূর্বে দেয়া হয়েছে, সেগুলো দ্রষ্টব্য) সেগুলো আমাদের সামনে এ কথা প্রমাণ করে যে, আদম আ: ও বিবি হাওয়াকে এমন একটি পূর্ণাঙ্গ চিন্তাধারা বা থট প্রসেস দেয়া হয়েছিল। সেই থট প্রসেসে (Thought Process) স্বাধীনভাবে চিন্তা করে করণীয়, আদেশ নির্দেশ, উপদেশ বা পরামর্শ মানা বা না মানার ব্যাপারে স্বিদ্ধান্ত নেবার, যুক্তি তৈরি ও বিচারের একক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তাঁরা। এবং সে বাস্তবতার প্রমাণ আমরা পাই পরবর্তি ৩৬ নম্বর আয়াতে।
---------------------------------
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থপ্রনেতা গীতিকার ইতিহাস বিশ্লেষক গবেষক ও দাঈ।
0 Comments