Recent Tube

ইসলামী সভ্যতায় নারী’ সম্পাদনায়ঃ মাওলানা মাকসুসুর রহমান।



 ইসলামী সভ্যতায় নারী’
--------------------------------- 
 সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে শূন্য থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং সে সম্পর্কে আমাদেরকে জ্ঞান দান করেছেন। দরূদ ও সালাম মানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর প্রতি। 
বাংলাদেশের সে সকল বোনদের প্রতি আমার সালাম এবং শুভেচ্ছা, যারা আগামীর সুন্দর একটি পৃথিবী বিনির্মাণ এবং সুন্দর একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আজ একত্রিত হয়ে এ মহান উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। 

 আমরা যদি আমাদের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই, হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সমগ্র মানবতার কাছে শান্তির বাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে সকল ক্ষেত্র নিয়ে সংগ্রাম করেছেন, তার মধ্যে তিনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ তিনটি হলো–
১. নারী
২. জ্ঞান ও মূল্যবোধ
৩. আখলাক

 রাসূল (সাঃ) এর এ তিনটি বড় বড় ক্ষেত্রের বিপ্লব পরস্পর সম্পর্কহীন নয়, বরং ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং একটি অপরটির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি নারীদের ব্যাপারে যে সকল কাজ করেছেন, তার মধ্যে একটি হলো নারীদেরকে তিনি মানুষের মর্যাদায় আসীন করেছেন এবং আল্লাহর খলিফা হিসেবে তাদেরকে সমান মর্যাদা দিয়েছেন। নারীদেরকে মূল্য দেওয়ার আগে তিনি তাদেরকে জীবন দান করেছেন। জাহেলী যুগে নারীদেরকে জীবন্ত কবর দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিলো, যা উচ্ছেদ করে তিনি তাদেরকে নতুন জীবন দান করেছেন এবং মানবীয় মর্যাদায় উপনীত করে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে সুন্দর আসনে সমাসীন করেছেন। আমরা জানি, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর ইসলাম প্রচারের পূর্বে আরব সমাজ এমন একটি সমাজ ছিলো, যেখানে না ছিলো আদালত, না ছিলো মানবিক মর্যাদা, না ছিলো কোনো জ্ঞান, না ছিলো কোনো মিজান। ফলশ্রুতিতে তারা ছিলো একটি মুখাপেক্ষী জাতি। তাদের সকল কুসংস্কারের স্থানে ওহী কেন্দ্রিক জ্ঞান এবং হিকমাকে স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন রাসূল (সাঃ)। এ সময়ে তার সাহাবীগণ তার আনীত বিধানকে শেখার জন্য, জ্ঞান অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। আর এ জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পুরুষ সাহাবীগণ নন, নারী সাহাবীগণও সচেষ্ট ছিলেন এবং সে জ্ঞানকে পরবর্তী প্রজন্ম বা অন্যদের নিকট পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের প্রচেষ্টা ইতিহাসে স্মরণীয়।

  সাহাবীগণের জ্ঞানার্জনের মূল কেন্দ্র ছিলো মসজিদে নববী। নববী যুগে প্রত্যেক ওয়াক্ত নামাজের জামাতে শুধুমাত্র পুরুষগণ নন, নারীগণও অংশগ্রহণ করতেন এবং এ সুযোগ তাদের জন্য ছিলো। এ কারণেই মসজিদে নববীতে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তার সাহাবীদের উদ্দেশ্যে যে সকল কথা বলতেন, তা থেকে নারী সাহাবীগণও সমানভাবে উপকৃত হওয়ার সুযোগ লাভ করেছিলেন। সে মজলিসগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ বা উপস্থিতি মোটেই কম ছিলো না, বরং তা ছিলো পুরুষ সাহাবীদের প্রায় সমপরিমাণ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, রাসূল (সাঃ) এর ওফাতের পর মুসলমানগণ রাসূল (সাঃ) এর সময় প্রচলিত এ বিষয়টির ধারাবাহিকতা জারি রাখতে পারেননি বা জারি রাখতে চাইলেও সে সুযোগ লাভ করতে সক্ষম হননি। ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায়, মসজিদ যেন শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে! এভাবে প্রায় প্রতিটি সমাজ থেকে বৃদ্ধা, যুবতী নির্বিশেষে সকল নারী, এমনকি মেয়ে শিশুরাও আস্তে আস্তে মসজিদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে আমি একটি উদাহরণ দিয়ে থাকি, বনী ইসরাইলরা নারীদেরকে মসজিদে ঢুকতে দিতো না, নারীদের জন্য মসজিদ নিষিদ্ধ ছিলো। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বনী ইসরাইলের এ প্রথাকে পরিবর্তন করে দেন হযরত মরিয়ম (আঃ) এর মাধ্যমে। তার মা তাকে মসজিদের জন্য ওয়াকফ বা উৎসর্গ করে দেন, এমনকি তিনি মসজিদেই লালিত-পালিত হন। হযরত মরিয়ম (আঃ) এর মাধ্যমে সূচিত নারী এবং মসজিদের মধ্যকার এ সম্পর্ক আমাদের জন্য রেখে যাওয়া একটি অসাধারণ উত্তরাধিকার! এ উত্তরাধিকার আমাদেরকে ধারণ করতে হবে এবং লালন করতে হবে, এমনকি আমাদের পরবর্তী বংশধরদের জন্য এ ধারাকে জারি রাখতে হবে।

  নববী যুগে জ্ঞান বলতে কেবল ওহীভিত্তিক জ্ঞানকে বোঝাতো না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শুধুমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া ওহীভিত্তিক জ্ঞানকেই গুরুত্ব দেননি, একই সাথে আকলী বা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের প্রতিও জোর দিয়েছিলেন এবং সকল জ্ঞানকে একত্রিত করে একটি জ্ঞানের বিপ্লব সংঘটিত করেছিলেন। দ্বীনি জ্ঞান এবং অদ্বীনি জ্ঞান– এ রকম কোনো বিভাজন আমাদের ইসলামী সভ্যতার জ্ঞানের ইতিহাসে নেই। তাফসীর, ফিকহ, কালাম যেমন ইসলামী জ্ঞান, মেডিসিন, আইন, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতিও তেমনি ইসলামী জ্ঞান, এমনকি মানবিক তথা ইনসানি জ্ঞান। উসমানী খেলাফতের একজন বিখ্যাত আলেম তাশখরুপযাদে তার “মিফতাহুস সা’দা” গ্রন্থে জ্ঞানকে ২টি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। যথাঃ
১) ইলমুল আদইয়ান বা দ্বীনি জ্ঞান
২) ইলমুল আবদান বা শরীর সম্পর্কীয় জ্ঞান
আমরা ইলমুল আদইয়ান তথা দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করবো, যেন পরবর্তী জীবন তথা আখিরাতে মহান আল্লাহর অনুগ্রহে জান্নাত লাভ করতে পারি।

  অপরদিকে ইলমুল আবদান তথা শরীর সম্পর্কীয় জ্ঞান হলো মেডিসিন সংক্রান্ত জ্ঞান।
এ জ্ঞান আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখবে। এ জ্ঞান খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ শরীর অসুস্থ হলে মানুষ না জ্ঞান অর্জন করতে পারবে, আর না ইবাদত করতে পারবে। ফলশ্রুতিতে ইলমুল আদইয়ান তথা দ্বীনি জ্ঞান অর্জনও সম্ভব হবে না, অর্থাৎ সে আখিরাতের জন্য এই দুনিয়ার জীবনে সে কিছুই অর্জন করতে পারবে না। 
এ কারণে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) জ্ঞানের মধ্যে কোনো ধরনের বিভাজন না করে জ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। এমনকি অর্থ দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ করে নিজের স্ত্রীদেরকে লেখা-পড়া শেখানোর ব্যবস্থা করেছেন।

   রাসূল (সাঃ) এর তৃতীয় যে বড় বিপ্লব, সেটি হলো আখলাক এবং মূল্যবোধের ক্ষেত্রে বিপ্লব। তিনি বলেছেন,
إنما بعثت لأتمم مكارم الأخلاق
“আমি উত্তম আখলাককে পূর্ণতা দান করার জন্য প্রেরিত হয়েছি।”

  এটি আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-কে প্রেরণের উদ্দেশ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি হাদিস। এটি রাসূল (সাঃ) এর রিসালাতের উদ্দেশ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তার রিসালাতের অন্যতম একটি অংশ আখলাক ও মূল্যবোধ শিক্ষা দেওয়া।

  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ প্রসঙ্গে বলেছেন,
وإنك لعلى خلق عظيم
“নিঃসন্দেহে আপনি একটি বড় আখলাকের উপর প্রতিষ্ঠিত।”

  হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে রাসূল (সাঃ) এর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন,
 خلقه القرآن
“কোরআনই তার চরিত্র।”

  এ কারণে রাসূল (সাঃ) মূল্যবোধ এবং আখলাকের দৃষ্টিকোণ থেকে সমগ্র বিশ্ব মানবতার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি এবং ধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নারী এবং মূল্যবোধের মধ্যকার সম্পর্কের যে প্রমাণ রাসূল (সাঃ) দিয়েছিলেন; একজন স্ত্রী হিসেবে, বোন হিসেবে, মা হিসেবে সর্বোপরি মানুষ হিসেবে নারীদেরকে তিনি যে মর্যাদা দিয়েছেন, তা আমরা হযরত খাদিজা (রাঃ) এর উপর ভিত্তি করে খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারি।

  হযরত খাদিজা (রাঃ) এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি ছিলেন রাসূল (সাঃ) এর আনীত বিধানকে সর্বপ্রথম গ্রহণকারী। রাসূল (সাঃ) এর সকল ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তিনি ছিলেন সার্বক্ষণিক সাথী, একসাথে সকল সমস্যা সমাধান করেছেন। তিনি ছিলেন রাসূল (সাঃ) এর সন্তানদের মা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে রাসূল (সাঃ) ও খাদিজা (রাঃ) এর সম্পর্ক একটি বিশেষ সম্পর্ক, যাকে কখনো অন্য কিছুর সাথে মেশানো যায় না।

  আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ওহী পাওয়ার পর সর্বপ্রথম যখন খাদিজা (রাঃ) এর কাছে এসে এ ব্যাপারে অবহিত করেন, তখন তাদের মধ্যকার যে কথপোকথন, তা আমাদের নতুন করে স্মরণ করা উচিৎ। হেরা গুহায় রাসূল (সাঃ) এর প্রতি জিবরাইল (আঃ) এর মাধ্যমে ‘اقرأ باسم ربك الذي خلق’ আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর তিনি খুব ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যান। এ অবস্থায় সেখান থেকে দৌড়ে এসে সর্বপ্রথম খাদিজা (রাঃ) এর কাছে এ ঘটনা বর্ণনা করেন। রাসূল (সাঃ)-কে সর্বপ্রথম বিশ্বাসকারী, ঈমান আনয়নকারী এবং এ পথে যাত্রাকারী ব্যক্তি একজন নারী এবং তিনি হলেন হযরত খাদিজা (রাঃ)। উক্ত অবস্থায় তিনি রাসূল (সাঃ)-কে যে কথাগুলো বলেছিলেন, তা এখনো বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে ইশতেহার হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন, “আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কখনোই আপনাকে লাঞ্চিত করবেন না; কারণ আপনি আপনার আত্মীয়ের অধিকার রক্ষা করেন, দরিদ্রদের সাহায্য করেন, ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ করার জন্য সহযোগিতা করেন, দুর্বল ও অসহায়দের পাশে দাঁড়ান। এ সকল গুণাবলীর কারণে আল্লাহ কখনোই আপনাকে লাঞ্চিত এবং অপমানিত করবেন না।”
এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো রাসূল (সাঃ) ওহী পাওয়ার পর অন্য কোনো মানুষের সাথে পরামর্শ না করে যার সাথে পরামর্শ করেছেন, তিনি একজন নারী। এটি আমাদের জন্য অর্থবহ। রাসূল (সাঃ) এর সবচেয়ে কাছের বন্ধু হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত ওসমান (রাঃ), নবুওয়াত লাভ করার পূর্বে এবং পরে তাকে রক্ষাকারী চাচা আবু তালিব, এমনকি অন্যান্য বন্ধু ও চাচা যারা ছিলেন, তাদের কারো কাছেই তিনি যাননি; সর্বপ্রথম তার ঘরে তার স্ত্রী হযরত খাদিজা (রাঃ) এর কাছে গিয়ে এ বিষয়ে পরামর্শ করেন। তিনি খাদিজা (রাঃ) এর মাধ্যমে নারীদের যে মূল্য দিয়েছেন, এ ঘটনা সে মূল্যের একটি প্রতীক। এ ঘটনার পর হযরত খাদিজা (রাঃ) যখন রাসূল (সাঃ)-কে ওয়ারাকা ইবনে নওফেল এর কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন, তখন রাসূল (সাঃ) কোনো ধরনের আপত্তি না করে ঘটনার ব্যাখ্যা জানার জন্য হযরত খাদিজা (রাঃ) এর সাথে ওয়ারাকা ইবনে নওফেল এর কাছে যান। 

  রাসূল (সাঃ) এর নবুয়াতের শুরু থেকে স্ত্রীকে জানানো, তাকে জিজ্ঞাসা করা এবং তার পরামর্শ নেওয়ার যে ব্যাপার, তা শুধু খাদিজা (রাঃ) এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না, তিনি তার অন্যান্য স্ত্রীদের সাথেও একইভাবে পরামর্শ করেছেন, এমনকি নারী সাহাবীদের সাথেও বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করেছেন। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, রাসূল (সাঃ) এর ওফাতের অল্প সময় পর এ রকম একটি জাল হাদিস সৃষ্টি করা হয়, “নারীদের সাথে পরামর্শ করো, পরবর্তীতে তারা যা বলবে তার বিপরীত করো।” এ জাল হাদিস সৃষ্টির মাধ্যমে নারীদেরকে একটি অসম্মানজনক অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালানো হয়।

  আমরা যদি রাসূল (সাঃ) এর সিরাত দেখি, তবে দারুল আরকামে নারীদেরকে দেখতে পাই, মদীনায় নারীদেরকে দেখতে পাই, যুদ্ধক্ষেত্রে নারীদেরকে দেখতে পাই। এভাবে বলতে গেলে ইসলামের ইতিহাসের শুরু থেকেই নারীদের অনেক বড় ভূমিকা দেখতে পাই। হাবশায় হিজরতের সময় নারীরা ছিলেন, আকাবার বায়াতের সময় নারীরা ছিলেন। হিজরতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সাহায্যকারী ছিলেন নারীরাই। এভাবে ইসলামের ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়েই নারীরা রয়েছেন এবং নারীদের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। এটি আমাদের দেখিয়ে দেয়, ইসলাম তার সূচনালগ্ন থেকে শুধুমাত্র পুরুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ বা পুরুষদের দ্বারা পরিচালিত কোনো আন্দোলন ছিলো না, এ আন্দোলনে পুরুষদের মতো নারীদেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো। নারী-পুরুষ এবং বিশেষ করে যুবক-যুবতীদের মাধ্যমে একটি অস্তিত্বের আন্দোলন, মানবতাকে রক্ষা করার আন্দোলন শুরু করেন রাসূল (সাঃ)। যেমন– আল্লাহর রাসূলের মাক্কী জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মহিলা ছিলেন, যারা হযরত খাদিজা (রাঃ) এর সাথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের অন্যতম উদাহরণ হযরত সুমাইয়া (রাঃ)। তিনি ছিলেন সত্যবাদিতা, আত্মসমর্পণ এবং ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক। তিনি ইসলামের প্রথম শহীদ। হিজরতের সময়ের দায়িত্ব হযরত আসমা (রাঃ) একাই দায়িত্ব পালন করেছেন। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর সবচেয়ে প্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর সাথে তার সম্পর্ক ছিলো বাবা ও সন্তানের মধ্যকার সম্পর্কের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। এ সম্পর্ক এতটাই অসাধারণ ছিলো যে, তিনি অনেক ছোট হওয়া সত্ত্বেও রাসূল (সাঃ) এর উপর যে নির্যাতন হয়েছিল, সেগুলো অনুভব করেছিলেন। নামাজরত অবস্থায় রাসূল (সাঃ) যখন এর উপর নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দেওয়া হয়, তিনি তখন সেসব হাত দিয়ে পরিষ্কার করেন। রাসূল (সাঃ) এর স্ত্রী যখন মৃত্যুবরণ করেন, তখন তার ঘরের সব কাজ করেন হযরত ফাতেমা (রাঃ)। রাসূল (সাঃ) উহুদের ময়দানে যখন আহত হন, তখন তাকে সেবা-শুশ্রূষা করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন হযরত ফাতেমা (রাঃ)। এসব হলো বাবা এবং সন্তানের মধ্যকার সম্পর্কের একটি অসাধারণ উপমা। এ সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) হযরত ফাতেমা (রাঃ)-কে ‘উম্মু আবীহা’ অর্থাৎ তার পিতার মাতা উপাধিতে ভূষিত করেন। হযরত ফাতেমা (রাঃ) যখনই রাসূল (সাঃ) এর কাছে এসেছেন, তিনি যে অবস্থায় থাকেন না কেন, মেয়ের আগমনে উঠে দাঁড়াতেন, তার হাত ধরতেন, কপালে চুমু দিয়ে তাকে পাশে বসাতেন। এত ভালোবাসার পরেও আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাকে এ কথা বলতে দ্বিধা করেননি, “হে ফাতেমা! তুমি যদি হকের পথে না চলো, হকের পথ থেকে বিচ্যুত হও, তাহলে আমি আল্লাহর রাসূলের কোনো ক্ষমতা নেই তোমাকে রক্ষা করার বা আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারবো না।”

  তিনি রাসূল (সাঃ) এর একজন সন্তান; কিন্তু আটা পিষতে গিয়ে ও রুটি বানানোর সময় তার হাতেও বিভিন্ন সময় জখম হতো। দুনিয়াবী কোনো স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে তিনি তার বাবার পাশে থেকে সংগ্রাম করে গেছেন। নববী যুগের একজন শ্রেষ্ঠ নারী হিসেবে ইসলামের ইতিহাসে তার কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। 

   মদীনার সভ্যতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে নারী এবং পুরুষ উভয়ের প্রচেষ্টায়। মদীনাকে রাসূল (সাঃ) নিরাপত্তার এবং অন্য সকল দৃষ্টিকোণ থেকে এমনভাবে গড়ে তোলেন যেন এটি নারীদের জন্য একটি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। এ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রজ্ঞাসম্পন্ন, জ্ঞানসম্পন্ন এবং মূল্যবোধসম্পন্ন নারীরা গড়ে ওঠেন এবং তারা শুধুমাত্র অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং তারা নিজেরাও জ্ঞান ও মূল্যবোধ সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। রাসূল (সাঃ) এর নেতৃত্বে সে সময় আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী শ্রেণি গড়ে ওঠে। আর এ নারীদের মাঝে সবচেয়ে অগ্রগামী ছিলেন হযরত আয়েশা (রাঃ)। তিনি ছিলেন জ্ঞানের জন্য উৎসর্গকৃত একটি প্রাণ এবং সকল মুমিনের জ্ঞানের মা। রাসূল (সাঃ) ও আয়েশা (রাঃ) এর মধ্যকার যে সম্পর্ক, তা অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষক এবং ছাত্রের সম্পর্কের মতো ছিলো। আয়েশা (রাঃ) কম বয়স, অনেক বেশি গতিশীল এবং প্রচন্ড মেধার অধিকারী হওয়ার কারণে রাসূল (সাঃ) এর সাথে সব সময় কোরআনের বিভিন্ন আয়াত, তার বলা বিভিন্ন কথা বা হাদিস নিয়ে আলোচনা করতেন। রাসূল (সাঃ) এর সুন্নত ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার সাথে কথা বলতেন, পর্যালোচনা করতেন, পর্যবেক্ষণ করতেন এবং গবেষণা করতেন। মদীনার প্রথম কঠিন সময়ের মধ্যেও রাসূল (সাঃ) তার স্ত্রীদের জন্য সময় বের করতেন, বিশেষ করে হযরত আয়েশা (রাঃ) এর জন্য সময় বের করে তাকে ফিকহ, তাফসিরসহ বিভিন্ন জ্ঞান নিজে শিক্ষা দিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো হযরত আয়েশা (রাঃ) এর যে আগ্রহ, তা অন্য কোনো নারীর মধ্যে ছিলো না। তিনি সব সময় খুব আগ্রহ ভরে রাসূল (সাঃ) এর কাছে যেতেন, তাকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করতেন। এক অর্থে জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি ছিলেন পাগলপারা। তার জন্য নির্ধারিত এক কক্ষ বিশিষ্ট ঘরটি জ্ঞানের একটি কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং এতিম ও অসহায়দের জন্য একটি আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। তাছাড়া এটি ছিলো মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী নাযিলের একটি জায়গা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ কক্ষটি আয়তনের দিক থেকে ছোট হলেও পৃথিবীর অন্যতম বরকতময় এবং পবিত্র এক স্থানে পরিণত হয়। হযরত আয়েশা (রাঃ) তার প্রজ্ঞা, সাহসিকতা, দূরদৃষ্টি ও বিশেষত তার জ্ঞানের মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাসে স্থান দখল করে নিয়েছেন। রাসূল (সাঃ) এর ওফাতের ৪৭ বছর পর হযরত আয়েশা (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন। এই ৪৭ বছরে তিনি কত দারস দিয়েছেন, কত ফতোয়া দিয়েছেন, কত শিক্ষার্থী প্রস্তুত করেছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এমনকি তিনি উম্মাহর বড় বড় সংকট নিরসনে কখনো কখনো সেনাপতির ভূমিকা পালন করেছেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) আমাদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ একটি উপমা। তবে তিনি একাই নন, তার মতো আরো অনেক উপমা আমাদের সভ্যতায় রয়েছে। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “আমার সাহাবীগণ আকাশের তারকার মতো,” আর এ তারকা শুধুমাত্র পুরুষ সাহাবীগণ নন, নারী সাহাবীগণও। 
উম্মু মিহজান (রাঃ) নামক একজন অসহায় নারী সাহাবী ছিলেন। রাসূল (সাঃ) মদীনা হিজরত করে আসার পর তিনি তার কাছে এসে বলেছিন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনাকে দেওয়ার মতো কিছুই আমার কাছে নেই। আপনি এই নবুওয়াত নিয়ে এসে আমাদেরকে সকল ধরনের মূর্তি থেকে পুত-পবিত্র করেছেন, আমাদেরকে মুক্ত করেছেন। আপনি যদি আমাকে অনুমতি দেন, মসজিদে নববীর একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে আমি মসজিদে নববীতে থাকতে চাই।” এ প্রস্তাব দেওয়ার পর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাকে বলেননি, “তুমি নারী, তুমি মসজিদে অবস্থান করতে পারবে না,” বরঞ্চ তিনি অনেক খুশি হয়েছিলেন। উম্মু মিহজান (রাঃ) যত দিন জীবিত ছিলেন, তত দিন মসজিদে নববী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে গিয়েছেন, এমনকি বিভিন্ন পবিত্র রজনীতে তিনি মসজিদে নববীতে সুগন্ধীর ব্যবস্থা করেছিলেন এবং আলোকসজ্জা করেছিলেন। তিনি মসজিদে নববীর জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর পেছনে জামাতে নামাজও আদায় করেছিলেন। উম্মু মিহজান (রাঃ) এর জীবনী আমার জন্য অনেক বেশি প্রেরণার, আমাকে উদ্বেলিত করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অপরিসীম। এ অসহায় নারী আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর অনুমতিক্রমে মসজিদের জন্য উৎসর্গকৃত একজন নারীতে পরিণত হন। এমনকি তিনি রাসূল (সাঃ) এর পক্ষ থেকে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত একজন সাহাবী হিসেবে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। 

    আরেকজন হলেন উম্মে সুলাইম (রাঃ)। রাসূল (সাঃ) যখন মদীনায় হিজরত করে আসেন, তখন তিনি তার কাছে গিয়ে বলেন, “আমি একজন বিধবা নারী। আপনাকে দেওয়ার মতো আমার বৈষয়িক কোনো কিছুই নেই। আমার একটিমাত্র সন্তান আনাস বিন মালেক, তাকে আমি উপহার হিসেবে দিচ্ছি। সে বড় হয়ে আপনার খেদমত করবে, আপনি যদি গ্রহণ করেন।”

   আরেকজন হযরত রুমাইসা (রাঃ)। উহুদের ময়দানে যখন রাসূল (সাঃ) আহত হয়ে পড়ে ছিলেন, তখন তিনি এক হাতে তলোয়ার নিয়ে রাসূল (সাঃ)-কে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করছিলেন, আবার অন্যদিকে সাহাবীদেরকে বার বার ডেকে বলছিলেন, “তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়ো না, তোমরা আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-কে রক্ষা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধের ময়দানে আসো।”

   আরেকজন হযরত বারিরা (রাঃ)। একজন নারীর যে ব্যক্তিত্ব, তিনি ছিলেন সে ব্যক্তিত্বের মূর্ত প্রতীক।

   এভাবে অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে। মূল কথা হলো নারী এবং জ্ঞান ও মূল্যবোধের মধ্যকার সম্পর্ক ইসলামী সভ্যতায় উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। এ সময়ে নারীগণ কেবল حمالة خشب তথা কাঠ বহনকারী নারী হিসেবে ভূমিকা পালন করেননি, একইসাথে জ্ঞানকে বহন করেছেন, মাগফেরাতকে বহন করেছেন, ধৈর্যকে বহন করেছেন, ভালোবাসাকে বহন করেছেন। এ বিপ্লবসমূহ আল্লাহর রাসূলের সময় শেষ হয়ে গিয়েছে, নাকি এসব আমাদের জন্য আদর্শ এবং বিপ্লবসমূহকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব? 

   আমরা যদি আজকের এ দুনিয়াকে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী দুনিয়ায় রূপান্তর করতে চাই; আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর যুগ, সেই সোনালী সমাজে পরিণত করতে চাই, তাহলে রাসূল (সাঃ) কর্তৃক সংঘটিত সে বিপ্লবগুলোকে বর্তমানে বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এ বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব এখন আমাদেরই। 

    দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক ত্যাগের, অনেক মূল্যের বিনিময়ে হওয়া এ বিপ্লবসমূহ মুসলমানগন পরবর্তীতে জারি রাখতে পারেনি এবং বর্তমানেও তারা তা করতে অক্ষম। 

   দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকের নারীরা সকল ইজম এর কেন্দ্রবিন্দু এবং নারীদেরকে একটি পণ্য হিসেবে বিজ্ঞাপন, সোশ্যাল মিডিয়াসহ সকল জায়গায় উপস্থাপন করা হয়। রাসূল (সাঃ) জাহেলী যুগে যে নারী জাতিকে মুক্ত করে যে জ্ঞান ও মারেফাতের বাহকে রূপান্তরিত করেছিলেন, সে নারী জাতিকে আজ দ্রুত ধ্বংসশীল এবং শুধুমাত্র কাঠ বহনকারী একটি পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য সমগ্র দুনিয়া প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। “নারীদের সাথে পরামর্শ করো, পরবর্তীতে তারা যা বলবে তার বিপরীত করো।”– এটি রাসূল (সাঃ) এর উদ্দেশ্য নয়, বরং সে সকল সংকীর্ণমনা মানুষদের উদ্দেশ্য, যারা এগুলোকে দ্বীন বলে আমাদের সামনে প্রচার করে। এটি তাদের অসৎ উদ্দেশ্য। আমাদের মনে রাখা উচিৎ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শুধুমাত্র তিনি ছাড়া অন্য কিছুর সামনে মাথা নত করাকে হারাম করেছেন। অথচ হতাশাজনক ব্যাপার হলো এমন অনেক রেওয়ায়েত ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে, নারীরা যদি আল্লাহর পরে কাউকে সিজদা করে, তাহলে তাদের স্বামীকে সিজদা করবে। এ ধরনের ভ্রান্ত এবং জাল রেওয়ায়েত কখনোই রাসূল (সাঃ) এর কথা হতে পারে না। 

   আমরা যদি আমাদের যুগকে, আমাদের দেশকে, আমাদের কালকে ইসলামের সেই সোনালী যুগে পরিণত করতে চাই, তবে আমাদের নারীদেরকে পুনরায় জ্ঞান ও মূল্যবোধের বাহকে পরিণত করতে হবে এবং জ্ঞান ও মূল্যবোধের সাথে সংযুক্ত ও সম্পৃক্ত করতে হবে। আমরা যদি ইসলামী সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাহলে এ পৃথিবী বিনির্মাণকারী, সমাজ বিনির্মাণকারী, পরিবার বিনির্মাণকারী, জ্ঞান এবং বিজ্ঞানে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী নারীদের গড়ে তোলা এবং তাদের জন্য পথ উন্মোচন করার কোনো বিকল্প আজ আমাদের সামনে নেই । তুর্কি ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, “এক পাখা বিশিষ্ট পাখি কখনোই উড়তে পারে না।” এজন্য আমরা যদি নারী ও পুরুষ উভয়কে জ্ঞান এবং হিকমা ও মূল্যবোধ এর মাধ্যমে লালিত করতে পারি, তাদেরকে গঠন করতে পারি, তবেই আমাদের পরিবার একটি সুখী পরিবার হবে। কিন্তু যদি নারীদেরকে শুধুমাত্র পরিবারের বিভিন্ন রান্নাবান্না ও এ সকল কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখি, তাহলে আমরা এক পাখা বিশিষ্ট পাখিই হবো। আর এক পাখা বিশিষ্ট পাখি কখনোই উড়তে পারে না। 

   আজ যদি আমরা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো মুসলিম উম্মাহকে কান্না, রক্ত, দরিদ্রতা ঘিরে ফেলেছে। এর চেয়েও দুঃখজনক ব্যাপার হলো এ সকল সমস্যার সমাধান করার জন্যই আবার যুদ্ধ করা হচ্ছে, রক্তপাত করা হচ্ছে। এমনকি ‘আল্লাহু আকবার’ বলে এক মুসলিম আরেক মুসলিমের মাথা কাটতেও দ্বিধাবোধ করছে না। আজ যেখানে আমাদের মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি থাকা দরকার ছিলো, একজনের প্রতি আরেকজনের সহানুভূতি থাকা দরকার ছিলো, সেখানে আমাদের মধ্যে বাসা বেঁধেছ শত্রুতা এবং একজন আরেকজনকে সহ্য না করতে পারার রোগ। ইসলামের শান্তি আজ অস্থিতিশীলতা এবং সংঘাতে রূপ নিয়েছে। আজ আরাকান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, কুদুস, আফ্রিকা, তুরস্ক এবং সিরিয়াতে যা হচ্ছে, তা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো ক্রমেই মেনে নেওয়া যায় না। আজ আমাদের অবস্থা খুব ভয়াবহ। এই ভয়াবহতার নিগড় থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর সেই মূলনীতির আলোকে আমাদের জীবনকে পরিচালিত করতে হবে। মূলনীতিটি হলো ‘মুসলমানগণ একটি শরীরের মতো। শরীরের কোথাও যদি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তাহলে সমগ্র শরীর ব্যথা অনুভব করবে’। আমাদের প্রত্যককে আজ মুসলিম উম্মাহর যে কোনো সংকটে, যে কোনো ব্যথায় ব্যথিত হতে হবে। এজন্য আমরা বিশেষ করে নারী হিসেবে, সামগ্রিকভাবে মানুষ হিসেবে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে নারীদের মধ্যে কেউ যদি কোনো সমস্যার মুখোমুখি হয়, তাহলে তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করে তার পাশে থাকবো, তার সমস্যা সমাধান করার জন্য প্রচেষ্টা চালাবো এবং এটিই আমাদের দায়িত্ব হওয়া উচিৎ। 

  প্রিয় বোনেরা, আজ সমগ্র বিশ্ব মারহামাত বিহীন কঠিন পরিস্থিতিতে উপনীত। নারীরা আজ অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত। আজকের শিশুরা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। সমগ্র মানবতা আজ ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন। আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে যদি এ জুলুম-নির্যাতনকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালাতে পারি, তাহলে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইসলামের সোনালী যুগে যেভাবে আমাদের সাহায্য করেছিলেন, এখনো আমরা অবশ্যই সে সাহায্য পাবো বলে প্রত্যাশা করি। আজ আমরা যদি এ পৃথিবীকে বিনির্মাণ করতে পারি; জ্ঞান এবং হিকমার মাধ্যমে, মূল্যবোধের মাধ্যমে পৃথিবীবাসীকে আখলাক উপহার দিতে পারি, তাহলে শুধু মুসলমানগণ নন, সমগ্র মানবতা একটি বসবাসযোগ্য দুনিয়া উপহার পাবে। আজকের এ রহমত বিহীন পৃথিবী সহযোগিতা, সহমর্মিতার মুখাপেক্ষী; কোথাও এ বিষয়সমূহের অস্তিত্ব নেই। আজ যদি বিশ্ববাসী এসব পেতে চায়, তাহলে হৃদয়ে রহমত ও ভালোবাসাকে লালনকারী এবং মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর ‘আর রাহীম’ গুণের তাজাল্লি তথা প্রতিফলিত রূপ ‘নারী’দের মাধ্যমেই তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তারাই পারে এ পৃথিবীকে আবার পুনরায় রহমত উপহার দিতে। আল্লাহর কাছে আমাদের দোয়া, তিনি যেন আমাদেরকে সে সকল নারীদের অন্তর্ভুক্ত করেন, যে সকল নারী তাদের হৃদয়ে রহমত এবং মারহামাতের বাণীকে লালন করে, জ্ঞান ও মূল্যবোধকে লালন করে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে সে সকল নারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন এবং তাদের মতো হওয়ার তাওফীক দান করুন।

-ড.খদিজা গরমেজ
অনুবাদ:বুরহান উদ্দিন

Post a Comment

0 Comments