Recent Tube

যে যুবক শৃংখল ভাংতে চায়, এ লেখা তার জন্য- জিয়াউল হক।




যে যুবক শৃংখল ভাংতে চায়, এ লেখা তার জন্য-
---------------------------------- 

  গ্রিক দর্শনে জ্ঞানের ভিত্তি হলো দুটো; থিওরি (Theory) ও লজিক (Logic), ত্বত্ত ও যুক্তি।। সক্রেটিস থেকে শুরু করে এ্যরিস্টেটল কিংবা প্লেটো, কেউই এ বিশ্বাসের বাইরে ছিলেন না। এর বাইরে জ্ঞানের আর কোনো ভিত্তি আছে বলে তারা বলেন নি। 

  গ্রিক মাইথোলোজির সচেতন পাঠক একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন, সেখানে যে কোনো ত্বত্তই হাজির করা হোক না কেন, তার সপক্ষে অত্যন্ত শক্তিশালী যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করা হয়েছে। ভাষা আর ভাবের ব্যঞ্জন সৃষ্টি করে তা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টাও লক্ষণীয়। তবে সেগুলো যাচাই বাছাই করার কোনো পথ নেই, নির্দেশনাও নেই।

  তাই এ দর্শনে যে বিষয়টি পুরোপুরি অনুপস্থিত তা হলো, উপস্থাপিত কোনো যুক্তি বা ত্বত্তকেই পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ বা বিশ্লেষণ করার বিষয়টি। প্রাচীন গ্রিক দর্শনে এক্সপেরিমেন্টের (Experiment) কোনো বালাই ছিল না। সেরকম কোনো তাগাদাও এ দর্শনে দেয়া হয় নি। 
একটা বাস্তব ঘটনা হতে আমরা এর প্রকৃষ্ঠ উদাহারণ পাই। 

   এরিস্টেটল তার লেখায় নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরকে পুরুষের তুলনায় দূর্বল বলেছেন। তার এ ত্বত্তের পক্ষে তিনি যুক্তি হিসেবে বলেছেন; নারীর দাঁতের সংখ্যা আঠাশটি। তার নিজের স্ত্রী  Pythias ছিলেন একজন বাইওলোজিস্ট, জীববিজ্ঞানী, গ্রিক সমাজের অত্যন্ত বিদূষী কন্যা। এরিস্টেটল ইচ্ছা করলেই তার স্ত্রীর ক'টি দাঁত রয়েছে সেটা পরীক্ষা করে দেখতে পারতেন। কিন্তু সে গরজবোধ তার ভেতরে উদ্রেক হয় নি। তিনি তা করেনও নি। 

  এর অনিবার্য ফল হিসেবে গ্রিক মাইথোলোজিতে এমন সব উদ্ভট বিশ্বাস ঠাঁই করে নিতে পেরেছে যা স্বাভাবিক বোধ ও বিশ্বাসের পরিপন্থী, যদিও সে দর্শনে চিন্তার একটা প্রচন্ড গতীময়তা বিদ্যমান। এ কারণেই গ্রিক দর্শন সার্বজনীন বৈশ্বিক দর্শন হয়ে উঠতে পারেনি।
 
  এর বিপরিতে ইসলামি দর্শনে জ্ঞানের ভিত্তি হলো তিনটি। ত্বত্ত, যুক্তি ও নীরিক্ষণ (Theory, Logic and Experiment)। স্বয়ংআল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সুস্পষ্ট নির্দেশ হলো; কোনো শিক্ষা, ত্বত্ত বা খবর যথাযথ যাচাই বাছাই না করে অন্ধের মত যেন বিশ্বাস না করি আমরা। আমাদের সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, আমাদের চোখ, কান ও শ্রবণশক্তি এসবকিছুর উপযুক্ত জবাবদীহি করতে হবে, অতএব আমরা যেন এসবের উপযুক্ত স্বৎব্যবহার করি। ( দেখুন; আল কুরআন ১৭:৩৬, ৪৯:৬, ৪:৫৮ এবং ১৩৫, ২:১১১)

  এর ফলে ইসলামি শিক্ষায় বা ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থায় যাছাই বাছাই, পরীক্ষা নীরিক্ষা করাটা অপরিহার্য একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আল কুরআন পাবার আগে যে আরবরা জ্ঞান তো দুরের কথা, একটা বই এরই দেখা পায় নি, সেই আরবরাই মাত্র চারটি বা পাঁচটি দশকের মধ্যে গ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ও দর্শনকে পিছে ফেলে পুরো বিশ্বকে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের আলোয় রাঙ্গিয়ে তুললো! গ্রিকো-ল্যাটিন বা হেলেনিক এবং একই সাথে পারসিক ও ইন্দো চৈনিক সভ্যতা, তথা পুরো বিশ্ব সভ্যতাকেই ভেঙ্গে চুরে এক নতুন বিশ্বব্যবস্থায় দাঁড় করালো যেন চোখের পলকে!

    কেবলমাত্র আরবদের কথাই বা বলি কেন? ৬৩৫ খৃষ্টাব্দে কাদ্বেসিয়ার যুদ্ধের মাধ্যমে সরাসরি ইসলামের সান্নিধ্যে আসার আগে পারস্য সভ্যতা বিশ্বে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বা চার হাজার বৎসর সগৌরবে অত্যন্ত জৌলুসের সাথেই কাটিয়েছে, কিন্তু সে সভ্যতায় একজন ইবনে সিনা বা জাবির কিংবা খাওয়ারিজমি কিংবা ইবনে রুশদ বা ইবনে হায়সামের জন্ম দিতে পারেনি। অথচ ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার সান্নিধ্যে আসার পরে মাত্র কয়েকটি দশকের মধ্যেই এই ইরানি সমাজ, তথা মুসলিম ইরানি সমাজ রত্নগর্ভা হয়ে উঠলো!

   একই অবস্থা হয়েছিল স্পেন-এ। ৭১১ খৃস্টাব্দ থেকে শুরু হয়ে ৭৫২ খৃষ্টাব্দে এসে সমাপ্ত হওয়া পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় স্পেন পরিচিতি পায় আন্দালুসিয়া হিসেবে। আর এই পরিচিতি কেবল রাজনৈতিক পরিচিতিই ছিল না, ছিল বিশ্বব্যাপী আলোর মশালবাহক হিসেবেও। জ্ঞান-বিজ্ঞান আর সমাজ বিপ্লবের ক্ষেত্রে এক বৈশ্বিক রেনেঁসার জন্ম দেয় বাস্তবিক অর্থেই। 

  সেই রেনেসোঁর চলমান প্রক্রিয়ায় আজকের আধুনিক সভ্যতা। আমরা মুসলমানরা নিজেদের গাফিলতির কারণেই এ রেনেসার চালকের আসন থেকে দূরে ছিটকে পড়েছি। পড়েছি এ কারণে যে, আমরা নিজেদের অজান্তেই আধুনিকতার নামে, প্রগতিশীলতার নামে সেই পুরোনো গ্রিক ধাঁচের শিক্ষাব্যবস্থার অনুবর্তি হয়ে পড়েছি।
 
   ফল কি হয়েছে? ফল এই হয়েছে যে, বিগত এক হাজার বৎসরের মধ্যে পুরো মুসলিম জনপদের কোথাও আর একজন ইবনে সিনা ইবনে রুশদ কিংবা জাবির বা ইবনে হায়সামের জন্ম হয় নি, সেই জনপদ এখনও আছে, আছে সেই ইসলামও। কিন্তু কোথায় একটা বন্ধাত্ব যেন স্থায়ী আসন গেড়েছে! এর কারণ আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। একটু ভেবে দেখুন, পেয়ে যাবেন। 

  খুব একটা ভাবতে হবে না। দেখবেন আমাদের ছেলে মেয়েরা আজ অন্ধ হয়ে ওস্তাদের, শিক্ষকের বলা কথাগুলো অহির বাণীর মত চুড়ান্ত সত্য হিসেবে গ্রহণ করা শিখেছে। তাদের ভেতর থেকে শিক্ষার নামে, জ্ঞান বিজ্ঞানের নামে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তগুলো যাচাই বাছাই, বিশ্লেষণ করার মন মানসিকতা, ইচ্ছা ও সাহস দূরিভূত হয়েছে ।
 
  ওস্তাদের কথার বিপরিতে সত্য ও বাস্তব হলেও কিছু একটা বলার মত সাহস ও বুকের পাটা তাদের  নেই।  ফলে তাদের মন ও মগজে এক ধরনের আবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। শতাব্দী প্রাচীন এ আবদ্ধতা ভাংতেই হবে, তা না হলে মুক্তির কোনো আশাই নেই।
---------------------------- 
লেখক ঃ ইসলামি চিন্তাবিদ গ্রন্থ প্রণেতা প্রবন্ধ লেখক গবেষক ইতিহাস বিশ্লেষক ও দাঈ।

Post a Comment

0 Comments