Recent Tube

ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহঃ এর 'তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ'র ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণঃ মুহাম্মদ তানজিল ইসলাম।



 ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহঃ এর 'তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ'র ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণঃ
----------------------------------------------------


 আগেও বলেছি যে, ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহঃ কর্তৃক রচিত 'ইসলামী আকীদা' একটি উপকারী গ্রন্থ। কিন্তু মানব রচিত কোনো গ্রন্থ ভুলভ্রান্তি, বৈপরীত্য ও অসঙ্গতি থেকে মুক্ত নয় (সূরা নিসাঃ ৪/৮২)। আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহঃ স্যারের তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ'র ব্যাখ্যা যেমন অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ, তাওহীদুল উলুহিয়্যাতের ব্যাখ্যারও একই অবস্থা। যেমন তিনি বলেন, "ইলাহ শব্দের অর্থ মাবুদ বা ইবাদত-কৃত বা উপাস্য। আরবীতে সকল পূজিত, উপাসনাকৃত বা অলৌকিক ভাবে ভক্তিকৃত দ্রব্য, ব্যক্তি বা বস্তুকে ইলাহ বলা হয়।" (খুদবাতুল ইসলাম, পৃঃ ৪২) তিনি আরো বলেন, মহান আল্লাহ ছাড়া কেউ কোনো ভাবে কোনো মুমিনের 'ইলাহ' বা উপাস্য হতে পারে না। (ইসলামী আকীদা, পৃঃ ৯৯)। অর্থাৎ তার মতে, ইলাহ মানে উপাস্য, এর বেশি কিছু নয়। এভাবে তিনি উলূহিয়্যাহর অর্থকে সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ করে ফেলেন। 

 পর্যালোচনাঃ

  ইলাহ'র অর্থ শুধুমাত্র উপাস্য নয় বরং একাধিক অর্থ রয়েছে। তবে ইলাহ'র একাধিক অর্থ থাকলেও প্রধান অর্থ দুইটি। (১) উপাস্য অর্থাৎ যার উপাসনা, আরাধণা, পূঁজা-অর্চনা করা হয়। (২) সর্বোচ্চ, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত বিধানদাতা, হুকুমকর্তা, আইনদাতা অর্থাৎ যার নির্দেশ, বিধান, আইনকে অন্যান্য সকল বিধান ও আইনের উপর প্রাধান্য দেয়া হয়, যার আইনকেই চূড়ান্ত আইন বলে মেনে নেওয়া হয়। স্যার শুধু প্রথম অর্থ গ্রহণ করেছেন কিন্তু দ্বিতীয় অর্থ বর্জন করেছেন এবং নবীদের মিশনকে কেবল নামাজ রোজা ইত্যাদির মতো কিছু ইবাদতের মাঝে সীমাবদ্ধ করে ফেলেন। অথচ আল্লাহর ইবাদত করা বলতে কেবল তাঁর জন্য নামাজ, রোজা উদ্দেশ্য নয়। বরং জগতের সবকিছুতে তাকে একমাত্র প্রতিপালক, একমাত্র উপাস্য, লা শরীক সত্তা ইত্যাদি রূপে বিশ্বাস করা এবং একই ভাবে আল্লাহ তা'য়ালাকে একমাত্র বিধানদাতা হিসাবে বিশ্বাস করা ও মেনে চলা। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, 
أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَٰهَهُ هَوَاهُ.
আপনি কি তাকে লক্ষ্য করেছন, যে তার প্রবৃত্তিকে নিজের ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? (সূরা জাসিয়াঃ৪৫/২৩)
أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَٰهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنْتَ تَكُونُ عَلَيْهِ وَكِيلًا
আপনি কি তাকে দেখেননি, যে তার প্রবৃত্তিকে নিজের ইলাহরূপে গ্রহণ করেছে? তবুও কি আপনি তার যিম্মাদার হবেন? (সূরা ফুরকানঃ ২৫/৪৩) হাওয়া অর্থ হলো নফস, প্রবৃত্তি, কামনা-বাসনা বা মনে আকাঙ্খা। নফস মানুষকে সাধারণত মন্দ কাজের নির্দেশ দিয়ে থাকে। কুরআনের ভাষায়-
إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ
নিশ্চয় নাফ্স মন্দ কজের নির্দেশ দিয়ে থাকে। (সূরা ইউসুফঃ১২/৫৩)

   প্রবৃত্তি বা মনের আকাঙ্খাকে ইলাহ বানানোর তৎপর্য হলো, নিজের মনের বা নফসের গোলামী করা, নফস যা হুকুম করে সে অনুযায়ী চলা অর্থাৎ নফসের হুকুম মানা। কোন ব্যক্তি নফসের হুকুম বা আইনকে (আল্লাহর আইনের উপর প্রাধান্য দিয়ে) মানলে আল্লাহর ভাষায়, প্রকৃতপক্ষে সে নফসকে 'ইলাহ' বানায়। অতএব যদি কেউ আল্লাহর আইন পরিত্যাগ করে কোন রাজা, বাদশা, রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীর হুকুম বা আইনকে প্রাধান্য দিয়ে মেনে নেয় তাহলে সে আল্লাহর পরিবর্তে ঐ রাজা, বাদশা, রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীকেই ইলাহ বানায়। কুরআনের অকাট্য দলিল দ্বারা তাই প্রমাণ হয়। এমনি ভাবে কেউ যদি আল্লাহর হুকুম, আইন ও বিধানের তোয়াক্কা না করে, অপর কোন মানুষের হুকুম মান্য করে, সে হুকুম রাষ্ট্রের হোক বা দলের বা নেতার বা পীরের, যারই হোক যার হুকুম মানবে প্রকৃতপক্ষে সে-ই 'ইলাহ' হবে। তাকে মুখে 'ইলাহ' বলে স্বীকার করুক বা না করুক।

   হযরত মূসা (আ) ফিরআউনের নিকট لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ. এর দাওয়াত নিয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে ফিরআউন ক্ষিপ্ত হয়ে জাতীয় পরিষদের নিকট যে কথা বললো আল্লাহ সে কথা কুরআনে উল্লেখ করেছেন-
وَقَالَ فِرْعَوْنُ يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ مَا عَلِمْتُ لَكُمْ مِنْ إِلَٰهٍ غَيْرِي.
ফির‘আউন বলল, ‘হে পরিষদবর্গ, আমি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ আছে বলে আমি জানি না। (সূরা কাসাসঃ২৮/৩৮)
অতঃপর হযরত মূসা (আ) কে হুমকি দিয়ে-
قَالَ لَئِنِ اتَّخَذْتَ إِلَٰهًا غَيْرِي لَأَجْعَلَنَّكَ مِنَ الْمَسْجُونِينَ
ফির‘আউন বলল, ‘যদি তুমি আমাকে ছাড়া কাউকে ইলাহরূপে গ্রহণ কর, তাহলে অবশ্যই আমি তোমাকে জেলে বন্ধী করব’। (সূরা শুআরাঃ২৬/২৯)

   ফিরআউন নিজেকে দ্বিতীয় অর্থে অর্থাৎ চূড়ান্ত আইনদাতা হিসাবে 'ইলাহ'র দাবী করেছে, তার পূঁজা বা উপাসনা করার জন্য নয়। উপাসনা বা পূঁজা করার ব্যাপারে ফিরআউন নিজেও মন্দিরের মূর্তিকেই 'ইলাহ' মনে করতো। কুরআনের ভাষায়, 
وَقَالَ الْمَلَأُ مِنْ قَوْمِ فِرْعَوْنَ أَتَذَرُ مُوسَىٰ وَقَوْمَهُ لِيُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَيَذَرَكَ وَآلِهَتَكَ
আর ফির‘আউনের কওমের সভাসদগণ বলল, ‘আপনি কি মূসা ও তার কওমকে ছেড়ে দেবেন যাতে তারা (আপনার আইন না মেনে) জমিনে ফাসাদ করে এবং আপনাকে ও আপনার ইলাহ তথা উপাস্যগুলোকে বর্জন করে?’ (সূরা আ'রাফঃ৭/১২৭)

  মক্কার মুশরিকদের বিষয়ে আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ ۚ وَلَوْلَا كَلِمَةُ الْفَصْلِ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ ۗ وَإِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ.
তাদের কি (আল্লাহর উলুহিয়্যাতের ক্ষেত্রে) এমন কিছু শরীক বানিয়ে নিয়েছে, যারা তাদের জন্য দ্বীনের বিধান দিয়েছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? আর ফয়সালার ঘোষণা না থাকলে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েই যেত। আর নিশ্চয় যালিমদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। (সূরা শুরাঃ৪২/২১)

   উপরোক্ত আলোচনা ও আয়াতগুলো থেকে এটা পরিষ্কার যে, কোন মুসলিম لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ. এর মাধ্যমে আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ মানার ঘোষণা দিয়েছেন বা দিবেন, তিনি যেমন আল্লাহ ছাড়া কারো পূঁজা উপাসনা করতে পারেন না, তেমনিভাবে আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে অন্য কোন মানুষের বা মানব রচিত আইনের আনুগত্য ও অনুসরণ করতে পারেন না। আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ
وَهُوَ اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ لَهُ الْحَمْدُ فِي الْأُولَىٰ وَالْآخِرَةِ ۖ وَلَهُ الْحُكْمُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
আর তিনিই আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। দুনিয়া ও আখিরাতে সমস্ত প্রশংসা তাঁরই; বিধানও (মানতে হবে) তাঁরই। আর তাঁর কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে। (সূরা কাসাসঃ ২৮/৭০)

   সুতরাং আল্লাহ তা'য়ালাকে একমাত্র উপাস্য বলে বিশ্বাস করার সাথে সাথে আল্লাহকে আইনদাতা হিসাবে মেনে নেওয়া ঈমানের শর্ত এবং আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করা তওহীদের অংশ। এছাড়া কোনো ব্যক্তি মুমিন বলে গণ্য হতে পারে না। শায়খ ইবনে উসাইমীন (রাহ) বলেছেনঃ আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করা একদিক থেকে তা তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহর সাথে সম্পৃক্ত, অপরদিকে তা তাওহীদুল উলুহিয়্যাহর সাথে সম্পৃক্ত। আল্লাহকে একমাত্র আইনদাতা হিসাবে না মানলে তাওহীদুর রুবুবিয়্যাতে শিরক করা হয়। অপরদিকে আল্লাহ্‌র আইনকে না মেনে অন্য কারো আইনে বিচার-ফয়সালা করলে তাতে তাওহীদুল উলুহিয়াতে শিরক করা হয়। অনুরূপভাবে, আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কোন আইনের বিচার-ফয়সালা মনে-প্রাণে মেনে নেয়াও তাওহীদুল উলুহিয়াতে শিরক করা হয়। সুতরাং এ থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে, আইনদাতা হিসেবে আল্লাহকে মেনে নেয়া এবং আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করা তাওহীদের অংশ। (মাজমু ফাতাওয়া ও রাসাইলে ইবন উসাইমীন ২/১৪০-১৪৪ ও ৬/১৫৮-১৬২)
----------------------------- 
লেখক: ইসলামি চিন্তাবিদ প্রবন্ধ লেখক কলামিস্ট দাঈ ও অনলাইন এক্টিভিস্ট। 

Post a Comment

0 Comments