Recent Tube

ইতিহাসের অলি গলি ও একজন জিয়াউল হক । আব্দুস সালাম আজাদী।




ইতিহাসের অলি গলি ও একজন জিয়াউল হক ভাই।
------------------------------------------ 

  ইতিহাসের সাগর থেকে মতি মুক্তো কুড়ানো অভ্যাস অনেকের। আব্বাসী যুগের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প আকারে একটা বই আমাকে একবার বড় ভাই ডঃ আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া দিয়েছিলেন মদীনায়। মজার বই ছিলো। নাওয়াদির বা চমক নিয়ে লেখা বইটা আমাকে খুব আনন্দ দিয়েছিলো। তবে এর লেখার উদ্দেশ্য ছিলো অনেকটা আনন্দ দেয়া, ফলে আনন্দের মাধ্যমে ইতিহাস গেলানোর ভাব সেখানে ছিলো।  

   এরপরে আরেকটা বই পড়ি শায়খ আবুল হাসান আননাদাওয়ীর লেখা “ক্বসাস মিনাত তারীখ” বা ইতিহাসের গল্প। এটা তিনি লিখেছেন আরবী ভাষা শিক্ষার দ্রুতি পঠনের পাঠ্য পুস্তকের আদলে। এই বইয়ে বেশ কিছু জিনিষ তাকে লক্ষ্য রাখতে হয়েছে। ছাত্রদের মতি-গতি, তাদের বুঝের লেভেল, ভাষার সৌকার্যের সাথে ভাষার স্ট্রাকচার ও শব্দকোষের প্রতি গভীর নযর। ফলে বইটি সুখপাঠ্য হলেও সার্বজনীন মনে হয়নি। 

   মদীনায় আরেকটা বই খুব উচ্চ মূল্য দিয়ে কিনি। মনে আছে, ছোট বই, তবে দাম ছিলো ১৯৮৯ সনে ৩০ রিয়াল। বইটা লিখেছেন সিরিয়ার সেরা সাহিত্যিক শায়খ আলী আত তানতাওয়ী। নাম ছিলো “ক্বসাস মিনাত তারীখ”।  ইমাম আবুল হাসান আন নাদাওয়ীর সাথে অতিরিক্ত মুহাব্বাতের কারণে একই নামের বই দুইজন লিখেছেন হতে পারে। তানতাওয়ীর এই বইয়ে তিনি ইতিহাস থেকে আনা সুন্দর সুন্দর গল্প দিয়ে সাজিয়েছেন। তিনি সাহিত্যিক ছিলেন। দাঈ ইলাল্লাহ ছিলেন। ফলে তার লেখা গুলো ইসলামের রসে টুইটুম্বর ছিলে এক দিকে, অপরদিকে ছিলো সাহিত্যের অফুরন্ত উৎসরণ। 

  ঐসব বই গুলো সেই সাতাশ বছর আগের কথা। তখনকার দুনিয়াতে মুসলিমরা মোটিভেশনাল লেখা পছন্দ করতো। বাগদাদের স্বপ্ন, কর্ডোভার বনানী চেরা কলকাকলী, কিংবা দিমাশকের মরুদ্যানের স্নিগ্ধ চাহনীর রেশ মানুষ পছন্দ করতো। 

  ১৯৯১ সালের প্রথম গলফ ওয়ারের পর “নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা” আমাদের কেমন যেন একটা নতুন ধাপে পা রাখতে বাধ্য করছে।  এই সময়ে সমস্ত বেদনা ও আনন্দের ঘাঁটিগুলোর সাথে সাম্যক পরিচিত জিয়াউল হক ভাই। তিনি জন্মেছেন বাংলায়, কিছু সময় কাটায়েছেন পাকিস্তানে, যৌবনের প্রফেশানাল জীবন শুরু করেছেন ধনী আরবদের সাথে। আর বিশ্বকে ইবনে খালদুনের চোখে দেখেছেন ইংল্যান্ডে এসে। 

  এইসময় তার ইতিহাস নাড়াচাড়া করাটা একটু আলাদা রকম। তার ইতিহাস চর্চায় নাসীম হিজাযির মন ও ভাঙা জাতির উত্থানের স্বপ্নাশ্রিত জিগির। এই দুয়ের মিশেলে তিনি এক নতুন চমক দিয়েছেন “ইতিহাসের অলি গলি’ তে। 

   সেদিন পোস্টম্যান এসে একটা খাম ধরিয়ে দিলেন। খুলে চারটা বই পেলাম। প্রতিটা বই এ নিউক্যাসেলের বাতাস ও জিয়া ভায়ের হাতের পরশ লাগানো। আমার ও লেখা একটা বই সেখানে, কিন্তু আমার দুই আঙুল ইতিহাসের দিকেই গেলো। 

   ভারতবর্ষ, কর্ডোভা, বাগদাদ, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষতঃ ফিলাস্তিনের নানা উত্থানপতনের সাথে পরিচিত অলি গলিতে তিনি আমাদের নিয়ে গেছেন। আমি বিমুগ্ধ চিত্তে তার লেখা পড়ি। বইটা সাবাড় করে গিন্নিকে বললাম, আমার বই তুমি আর কি পড়বা, এইটা একটু পড়ে নিও। 

   ইতিহাসের অলি গলিতে লেখক আমাদের ইতিহাসের নানা খানা খন্দের পাশে নিয়ে গেছেন। সেখানের নানা গর্তে হা করা সরিসৃপ, বা ভয়ংকর হায়েনাদের উপর তার ক্যামেরাটা ধরে আমাদের নানা শব্দের গাঁথুনি দিয়ে ‘ক্রমাগত ভুলগুলির’ উৎপত্তিস্থল দেখায়ে দিয়েছেন। তিনি খুব সজাগ ভাবে বর্তমানের জেঁকে বসা ইসলাম বিরোধী মুসলমানদের চার পাশে আমাদের নিয়ে ঘুরেছেন। এই সব অলি গলি আমাদের খুব জানা খুব দরকার। 

   এক নাগাড়ে পড়ে একটা বই শেষ করার মত বই পীরিতি এখন আর নেই। নেই তার কারণ ও আছে, সেই হুমায়ুন ও আলমাহমূদের মত যাদুকররা তো হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার ভাই জিয়াউল হক এর নরম অথচ আগ্নিময়, ফুলেল অথচ তেজোদ্দিপ্ত ভাষায় একটা নব বিবাহিতা বধুর আকর্ষণের মত শব্দরা খেলা করে। যাদের সাথে সময় কাটাতে আমার মত বুড়োরও বিয়ের পোষাক পরতে ইচ্ছে হয়, আলহামদুলিল্লাহ।  

  কী অদ্ভুত, তিনি ভালোভাবেই জানেন, আমি তার তুলনায় কোন তলায়, এরপরেও কেন জানি এই বইটা আমার ও আমার জোড় বলি বা জুড়ি ডঃ আজাদের নামে উৎসর্গ করে অনেক উপরে তুলে ধরেছেন। “ফি’লুল হাকীম লা ইয়াখলু মিনাল হিকমাহ” বা প্রজ্ঞাবানের কোন কাজ প্রজ্ঞা থেকে খালি না। তিনি ভালো ভাবেই জানেন ডঃ আজাদ হলে হতে পারে, কিন্তু আমি তার শ্রদ্ধা পাবার মোটেই উপযুক্ত না। কিন্তু আমি বোধকরছি জিয়া ভাই হাতে একটা ছড়ি নিয়ে আমার দিকে উঁচু করে বলছেন, সালাম ভাই, ইতিহাসের অলি গলিতে আপনিও পা রাখেন, তা না হলে ভারতের স্বাধীনতা যেমন পলাশীতে গিয়েছিলো, ঐ রকম কিছু ঘটে যাবে, তখন আফসুস করার জন্যও শব্দ খুঁজে পাবেন না। 

 ধন্যবাদ আমার প্রিয় ভাইকে, শ্রদ্ধা আমার প্রিয় লেখককে।
---------------------------- 
লেখক ঃ  ইসলামি চিন্তাবিদ, দাঈ,গবেষক, ও ইসলামি ইতিহাস বিশ্লেষক। 

Post a Comment

0 Comments