Recent Tube

বাবাহীন বাবাদের বোবা হতেই হয়! জিয়াউল হক।



 বাবাহীন বাবাদের বোবা হতেই হয়!
    ****
  তিনি বুঝে গেছেন; তাঁর দিন ঘনিয়ে এসেছে। দীর্ঘদিন কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন। সেই ১৯৬৮/৬৯ এর করাচি হতে শুরু তার সে জটিলতা। করাচি, তুরস্ক, আলজেরিয়া, ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডেও চিকিৎসা করেছিলেন কমবেশি। সে সুবাদে ভালোই ছিলেন। কিন্তু শেষ অব্দি তা চিকিৎসার বাইরে চলে যায় অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই।

  ঢাকা সি এম এইচ হাসপাতালে সর্বশেষ ভর্তি ছিলেন ১৯৮২/৮৩ এর দিকে। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সবই ব্যর্থ। এক দুপুরে এক ডাক্তার ব্রিগেডিয়ার ডাকলেন আমাকে সিএমএইচের বারান্দা থেকে। আমিই যে তার বড় সন্তান, ততদিনে সে জানা পরিচয়টাই আবার নিশ্চিত হয়ে জানতে চাইলেন বাড়িতে কে কে আছেন? সব খুলে বললাম। তিনি তার প্রফেশনাল গন্ডির বাইরে এসে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘ওনাকে এখন বাড়ি নিয়ে যাও, কটা দিন কাছে রাখো। আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাদের দেখবেন।’

  তেইশের তাগড়া যুবক আমি বুঝে নিলাম, মাথার উপরে জমে উঠা মেঘটা আর কাটছে না। আকাশটাই ভেঙ্গে পড়বে। রেটিনার সেলুলয়েডে তখন এক এক করে পাঁচটি অসহায় মুখ ভেঁসে উঠছে। ছোট ছোট ভাইবোনদের সামনে কি বলবো? আম্মার সামনে কিভাবে দাঁড়াবো? অশীতিপর শ্বেতশুভ্রকেশি বৃদ্ধ দাদা’কে কি বলে বুঝ দেব? 
বাবাকে ঢাকা থেকে নিয়ে এলাম কুষ্টিয়ায়। বাবার সান্নিধ্য খুব কম পেয়েছি। তিনি জাহাজে জাহাজে বিশ্ব ঘুরেছেন। আমি ঘরে মাকে জ্বালিয়েছি আনচেকড্! বাবা ছুটিতে এলেও থেকেছেন গম্ভীর। বরাবরই কম কথা বলতেন। দুষ্টুমি করলে আম্মা শাসাতেন; ‘দাঁড়া, তোর আব্বা আসুক আগে’ বলে। ছোটকালে সে কথা কতবার শুনেছি, সে থেকে মনে ‘আব্বার ভয়’ লেগে থাকায় কাছে ঘেঁষেছি খুবই কম।

  ঢাকা থেকে আসার পথে আমার সেই রাশভারী বাবা বাসে, ফেরিতে, গাড়িতে ডিম সেদ্ধ কিনে দিতে চান তার যুবক ছেলেটাকে। কমলা খাবে? প্রশ্ন ছুঁড়ে মারেন। আমার কান্না পায়। চোখ ভিজে আসে। জানালা খুলে বাইরে নির্বাক তাকিয়ে থাকি, ছুটে চলা গাড়ির বাতাসে যদি চোাখের অশ্রæটা শুকিয়ে ফেলানো যায়!

   বাবা তার বিগত জীবনের দীর্ঘ সময়ে আমাকে কাছে না পাওয়াটাকে পুষিয়ে দিতে চান যেন! চীরদিনের গম্ভীর আর রাশভারি বাবা সব বুঝে গেছেন। মনে মনে আসন্ন বিদায়ের প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। অথচ কাউকে বুঝতে দিতে চান না। দুনিয়ার সব বাবারা বোধ হয় এমনই হন!

   এর পরে মাত্র মাসখানেক বেঁচেছিলেন। কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের মেডিসিন কনসালটেন্ট ডা: গনি সাহেবের সাথে পরামর্শ করে একটা কেবিনে রেখে দিলাম। চিকিৎসার জন্য নয়, ‘চিকিৎসা চলছে, ভালো হয়ে যাবেন’ এমন একটা ধারনা মা ও কচি কচি ভাইবোনদের মনে গেঁথে দেবার জন্য। কিন্তুপ্রতিদিন তাঁর অবস্থার অবনিত হতে  হতে সেই কটা দিনও শেষ হয়ে এলো খুব সহসাই। 

   মৃৃত্যুর মাত্র সপ্তাহখানে আগে এক সন্ধায় লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে তিনি একরকম জোর করেই আমাকে কেবিনের বাইরে নিয়ে এলেন ক্লান্ত ও দূর্বল শরির নিয়েই। মাথায় হাত রাখলেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছোট্ট চিরুনিটা দিয়ে ঐ আঁধারের মধ্যেই আমার মাথা আঁচড়ে দিতে দিতে বেশ কিছু পরামর্শ দিলেন, কিছু ওসিয়াতও করলেন। আমার চোখে তখন সুনামি! সম্ভবত আব্বার চোখেও। ভাগ্যিস লোডশেডিং ছিল! তা না হলে অবাধ্য এ চোখজোড়া লুকোতাম কিভাবে!!

    নদী ভাঙ্গনে নি:স্ব হওয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় সন্তানদের আর কিছু থাক বা না থাক, স্মৃতিক্ষমতা থাকে, থাকতেই হয়। সেই অসিয়তগুলো আজও মনে আছে। সামর্থ না থাকলেও জীবনের সমস্ত শক্তি আর সদ্চ্ছিা দিয়ে বাবার অসিয়ত পালন করার চেষ্টা করেছি। একমাত্র আল্লাহই তার সাক্ষী। আল্লাহ আরও সাক্ষী; বাবার সেই নির্দেশনা পালন করতে গিয়ে এই বৈরি পৃথিবী ও সমাজ আমার জীবনকে কিভাবে জাহান্নাম বানিয়েছে, কিভাবে পুড়িয়েছে না দেখা আগুনে। সব সয়েছি নীরবে, মুখ বুঁজে। ভেবেছি, কেয়ামতের মাঠে বহুদিন পরে আবার যখন দেখা হবে, তখন অন্তত আব্বার সামনে তার অবাধ্য হবার কারণে লজ্জা পেতে হবে না। দিন শেষে শান্তনা কেবল ঐটুকুই। সেটাই বড় সম্বল।

   দিন বসে থাকে না। আব্বার মৃত্যুর পরে দীর্ঘ চার দশক চলে গেছে। তবে আজকাল রাতগুলো যেন থেমে যায়, থেমে যেতে চায়। বাবাহীন বৈরি বিশ্বের কদর্য রুপ ঘুমাতে দেয় না এতিম সন্তানকে। বাবা হারা সন্তান বাবাদের বাবা হয়ে বৃদ্ধ হলেও ‘এতিম’ই থেকে যায়। নির্ঘুম রাতগুলোতে যখন কেউ বলে উঠেন; কি হলো? ঘুমাওনি? / কি রে ঘুমাস নি? তখন জবাব খুঁজি। যুৎসই কোন জবাব নেই। সব কথার, সব প্রশ্নের জবাব হয় না বাবাহীন বাবাদের জন্য। তারা বোবা হন, বোবা হতেই হয় তাদের। বলা হয় না, রাত জেগে জেগে অপেক্ষায় থাকি। ভাবি, আবার কবে দেখা হবে দীর্ঘ চারটি দশক না দেখা মরহুম বাবার সাথে?
-------------- 
লেখক ঃ ইসলামি চিন্তাবিদ ইতিহাস বিশ্লেষক ও গবেষক। 

Post a Comment

0 Comments