Recent Tube

একটি ডালিম গাছের ছায়া, একটি মাদ্রাসা ও ভারতবর্ষে আলেমদের অবদান; জিয়াউল হক।



 একটি ডালিম গাছের ছায়া, একটি মাদ্রাসা ও ভারতবর্ষে আলেমদের অবদান;
  ~~~~~~

 সময়কাল ১৮৬৫, সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তি প্রতিকূল সমাজ। ভারতীয় মুসলিম মানস আতংকে অতিষ্ঠ, উৎকন্ঠিত ও দিকভ্রান্ত এবং একসাগর হতাশায় নিমজ্জিত বিদ্রোহ সংঘটনের কারণে ইংরেজদের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো মুসলমানদের উপরে। তারা এর আগে ইসলাম  ও মুসলমানদের প্রতি এর আগে থেকেই বৈরি মনোভাবাপন্ন থাকলেও এবারে একেবারে হিংস্র হয়ে উঠলো। আলেম ওলামা আর ইসলামি জ্ঞান সমৃদ্ধ যে কোনো ব্যক্তিই তাদের রোষাণলের শিকার হলো। 

 এক হিসেবে মতে ১৮৬৭ পর্যন্ত প্রায় চৌদ্দ হাজারেরও বেশি আলেমকে ইংরেজরা ধরে ধরে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। দিল্লীর এমন কোনো গাছ ছিল না, যে গাছে কোনো না কোনো আলেমের মৃতদেহকে ঝুলিয়ে রাখা হয়নি দিনের পর দিন। বহু আলেমকে ধরে রেঙ্গুন কিংবা আন্দামানে নির্বাসন দেয়া হয়েছে। বহু আলেমকে গুম করে ফেলা হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে অনেক আলেম বাড়ি-ঘর, সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজন ব্যবাস বাণিজ্য ফেলে রাতারাতি দুর দুরান্তে পালিয়ে গেছেন। 

 গুম করে ফেলা কিংবা নির্বাসনে পাঠানো কিংবা ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো এইসব আলেমদের পেছনে ফেলে যাওয়া স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের জীবনে রাতারাতি কি দূর্বিষহ অবস্থা, কি অপমানজনক, অনিশ্চিত অবস্থা নেমে এসেছিল, তা আমরা চিন্তাও করতে পারি না। তখনকার এ চরম অবস্থাটা বোঝার জণ্য কেবল সামান্য কিছু তথ্য দিচ্ছি, সে সময় ভারতবর্ষে অবস্থানরত প্রতি তিন জন ইংরেজদের মধ্যে একজনই স্থানীয় ভারতীয় নারীকে স্ত্রী বা রক্ষিতা হিসেবে রেখেছিলেন নিজ নিজ দখলে। (সুত্র: The Last Mughul, William Dalrymple) 

 এদের বেশিরভাগ নারীই ছিল মুসলিম ঘরের, যাদেরকে একরকম জোর করেই ধরে এনে রাখা হয়েছিল, অনেকে আবার স্বামী-সংসার, আত্মীয়-স্বজন সব হারিয়ে, কোন রকম আশ্রয় না পেয়ে, কেবলমাত্র জান বাঁচাতে মনের বিরুদ্ধে হলেও এরকম অপমানকর জীবন বেছে নিয়েছিলেন বা নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

 ভারতীয় নারী, বিশেষ করে, মুসলিম নারীদের এরকম করুণ অবস্থার সুযোগ নিয়ে সে সময় দিল্লির নবাবের দরবারে ব্রিটিশ দূত Sir David Ochterlony তো একই সাথে এক এক করে তেরজন স্ত্রী রেখেছিলেন নিজের কাছে! (সুত্র: The Last Mughul, William Dalrymple, pp-49)
আর সমসাময়িক ভারতে প্রচন্ড ক্ষমতাশালী এই সুশীল সিভিল সার্ভেন্ট মুসলিম সমাজও সেই সাথে দিল্লির নবাবের গালে চপেটাঘাতের জন্য প্রতিদিন বিকেলে তার এই তেরজন স্ত্রীকে যথাযথ মুসলিম নারীর সাজে সাঁজিয়ে, পর্দার সাথেই তেরটা হাতির পিঠে চড়িয়ে দিল্লির লালদূর্গে নিয়ে যেতেন হাওয়া খাওয়াতে, খোদ নবাবের চোখের সামনে দিয়েই! (সুত্র-ঐ)

 আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে উক্ত সুশীল ভদ্রনোক (!) তার তের বিবির প্রতি পরম ভালোবাসায় এ কাজটি করতেন। কিন্তু যারা তার ছোট স্ত্রী মোবারাক বেগমের গর্ভে জন্ম নেয়া দুই কন্যাকে মুসলিম রীতিতে বড় করার বিষয়ে ঘোর বিরোধিতা ও বিয়ের সময় মুসলিম ছেলের সাথে বিয়ে দিতে অস্বীকৃতির পুরো বিষয়টাকে জানেন, তারা জানেন, কি ভয়াবহ রকমের ইসলাম বিদ্বেষ ধারণ করতেন নিজ বুকে এই সিভিল সার্ভেন্ট!
এটা তো ছিল সমাজের একেবারে নীচু স্তরের ঘটনা। কিন্তু তৎকালীন ভারতীয় মুসলিম সমাজের একেবারে উঁচু স্তরেও ধর্মান্তকরণের কাজটা চলছিল ঠিক মতই। 

 এক ইংরেজ জেনারেল Walter Reinhardt Sombre  বিয়ে করেন Farzana Zeb un-Nissa নাম্নীএক মুসলিম নারীকে। কট্টর ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী জেনারেল Walter এর প্রভাবে বেগম জেবুন্নেছা ঠিকই ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে ক্যাথলিক খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ এবং Begum Sumru নাম ধারন করেন। এই দম্পতি মিরাটের কাছে এক বিশাল জমিদারীর (সারদানা জামিদারী) মালিক বনে যান। 

 তৎকালীন ভারতের অন্যতম ধনী ও প্রথম ভারতীয় ক্যাথলিক খৃষ্টান নারী জমিদার হিসেবে Begum Sumru খৃস্টান পাদ্রী ও মিশনারীদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন। এইসব খৃষ্টান পাদ্রীরা মুসলমান নারীদের কাছে খৃষ্ট ধর্ম উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে খৃষ্টান ধম গ্রহণের বৈষয়িক লাভ হিসেবে এই বেগমের ধনাঢ্য ও প্রভাশালী জীবন ও সামাজিক মর্যাদার বিষয়টি কৌশলে উপস্থাপন করতে একটুও দ্বিধা করতো না।

 অবস্থাটা কোন পর্যায়ে গিয়েছিল সেটা বোঝার জন্য আরও কিছু তথ্য দেই, সেগুলো হলো, এক ইংরেজ বুড়ো William Linnaeus Gardner এক মুসলিম নারীকে বিয়ে করেন, ঠিক প্রায় ঐ একই সময়ে তারই যুবক পুত্র James Gardner স্বয়ং নবাব জাফরের চাচাতো বোন, তথা, মোগল রাজকুমারী মুখতারি বেগমকে বিয়ে করে, আর এই দম্পতির গর্ভেই জন্ম নেয় প্রখ্যাত এ্যংলো ইন্ডিয়ান জেনারেল James Jahangir Shikoh Gardner। এভাবে একটা শংকর জাতি অচিরেই তৈরি হয়ে যায় মাত্র কয়েকটি দশকের মধ্যে।

 যা হোক, সে অধ্যায়টি আমার আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। আমরা বরং আমাদের মুল আলোচনায় ফিরে আসি। সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তি কয়েকবৎসরে কোম্পানী সরকারের রোষাণলে পড়ে বিপর্যস্থ হয়ে পড়া মুসলিম সমাজের অনেক নারীই ঐ সময়ে আত্মহত্যা করে নিস্কৃতি খুঁজেছেন জীবন থেকে। এদের সন্তান সন্ততিরা ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমে পড়েছে জীবন বাঁচাতে। 

 ঠিক এরকম একটা সময়ে কোলকাতা থেকে Reginald Heber এবং দিল্লিতে অবস্থানরত Reverend John Jennings ও তার দলবল সহ খৃষ্টান ইংরেজ পাদ্রিরা Society for the Propagation of the Gospels এর ব্যানারে বাপ-মা হারা মুসলমান ছেলেদের ধরে ধরে নিয়ে আশ্রয় ও খাদ্য দেবার নাম করে খৃষ্টধর্মে দীক্ষা দেবার মত ঘৃন্য কাজে নেমে পড়ে।

 এরকম অবস্থা দেখে কিছু মুসলমান ভেতরে ভেতরে মনোকষ্টে ভুগছিলেন, এ থেকে উত্তরণের পথও খুঁজছিলেন উত্তর প্রদেশের এক অখ্যাত গ্রাম্য আলেম; নাম মোল্লা মাহমুদ হাসান। তিনি অন্তত এটুকু বুঝেছিলেন যে, উম্মাহর এই গভীর সংকট রাতারাতি কাটবে না। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো দীর্ঘ মেয়াদি কর্মকান্ড, জ্ঞানচর্চা ও বিস্তার। তার এ উপলব্ধী মত তিনি কাজে নেমেও পড়লেন আর কাল বিলম্ব না করে। গ্রামে একটা ডালিম গাছের ছায়ায় বসিয়ে একজন মুসলমান বালককে কুরআনের প্রাথমিক জ্ঞান দিতে শুরু করলেন। 

 প্রথম দিন ওস্তাদের কাছে বসে কুরআনের প্রাথমকি জ্ঞান নেয়া বালকটির নামও ছিল মাহমুদুল হাসান ( পরবর্তিতে এই ছাত্রটিই শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান নামে ইতিহাসখ্যাত হন)। সে পরের দিন আরও দুই জন সমবয়সী বন্ধুকে ধরে নিয়ে এসে ঐ ডালিম গাছের ছায়ায় বসে তালিম নিয়ে যায়। বিষয়টি গ্রামের কয়েকজন মুরুব্বীর নজরে পড়লে তারাও নিজেদের ছেলেদের নিয়ে এসে ওস্তাদ মাহমুদ হাসানের কাছে বিনে পয়সায় আলিফ বা, তা, সা পড়ার জন্য দিয়ে যান। 

 মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই বেশ ক‘জন ছাত্র জুটে গেলে সবাই পরামর্শ করে ঐ ডালিম গাছের ছায়ায় বসে ১৮৬৬ সালের ৩০ শে মে, বৃহষ্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে একটি মাদ্রাসার কার্যক্রম শুরু করলেন, একুশজন ছাত্র নিয়ে। কোনো সুরম্য ভবন তো দুরের কথা, একটা খড়ের ঘরও ছিল না, কেবলমাত্র একটা ডালিম গাছের ছায়া আর আল্লাহর জমিনটুকু ছাড়া।

 সেই শুরু। এক মোখলেস বান্দাহর অন্তরের বাসনাটুকু আল্লাহপাক কবুল করেছিলেন, খোলা আকাশের নিচে একটা ডালিম গাছের নীচের সেই মাদ্রাসাটি আজ দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা। উত্তর প্রদেশের অখ্যাত একটি গ্রামের সেই মাদ্রাসাটি আজ কেবলমাত্র ভারতবর্ষেই নয় বরং পুরো বিশ্বের এক অনন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত। 

 বিগত দেড়শত বৎসরে এখান থেকে ইলম অর্জন করে আলেম হয়ে বেরিয়ে এসে লক্ষ লক্ষ আলেম পুরো ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে যেমন ছড়িয়ে পড়েছেন তেমনি ছড়িয়ে পড়েছেন মক্কা-মদিনা, মিশর, আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, চীন, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের আনাচে কানাচে। এসব আলেম যেখানেই গেছেন সেখানেই তারা মাদ্রাসা বা ইলমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন, কোটি কোটি ছাত্রকে কুরআন হাদিসের জ্ঞান দিয়েছেন। এভাবেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে কুরআন আর হাদিসের জ্ঞান। কলোনিয়ালজম বা উপনিবেশবাদ ও ক্রসেড মোকাবেলা করেও ইসলাম টিকে গেছে।

 আজ যারা কওমি দেউবন্দী বলে মাদ্রাসার ছাত্র কিংবা হুজুরদের কটাক্ষ করেন, তাদের বোঝা উচিৎ, তাদের মুসলিম পরিচিতিটুকু যে টিকে আছে এত সুগভীর ষড়যন্ত্রের পরেও, এর পেছনে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি, তারা হলেন এই দেউবন্দী বা কওমি মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদেরই। 

 মাদ্রাসার পাঠ্যসুচী যুগোপোযোগী করার প্রয়োজনীয়তাকে কেউ অস্বীকার করে না, কিন্তু সে ছলে কথায় কথায় যারা এইসব মাদ্রাসাকে অবজ্ঞা করেন, তারা অন্তত এদের কাছে এটা শিখতে পারেন, প্রচন্ড বৈরি পরিবেশের মধ্যেও একেবারে রিক্ত হাতে কিভাবে ইসলামকে টিকিয়ে রাখতে ও তা ছড়িয়ে দিতে হয়, সে বিষয়টি, শিখতে পারেন কিভাবে সকল লোভ ও লালসাকে উপক্ষো করে ইসলাম প্রচার করে যেতে হয়। শিখতে পারেন বাগাড়ম্বর দিয়ে নয়, বরং আন্তরিকতা ও ধৈর্যের সাথে নীরবে কাজ করে যাবার মাধ্যমেই কেবল ইসলামবিরোধি শক্তির সকল ষড়যন্ত্রকে রুখে দেয়া যায়। (একটি পুরোনো লেখা)
------------------------- 
লেখক : ইসলামি চিন্তাবিদ প্রবন্ধ লেখক ইতিহাস গবেষক ও দাঈ।

Post a Comment

0 Comments