২০২৩ সালের কুরুক্ষেত্র !
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের নাম শোনেননি পাক ভারতে এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। একটি যুদ্ধ- বিবদমান দু’টি পক্ষ যারা কিনা রক্ত সম্পর্কে নিকটাত্মীয় এবং যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ন্যায় ও অন্যায়ের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে তারা ভারতবর্ষ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যেসব কাহিনীর জন্ম দিয়েছিল তার সঙ্কলিত রূপ মহাভারত নামক মহাকাব্যে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে তা মানবজাতির জন্য কিয়ামত পর্যন্ত শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। প্রেম, ভালোবাসা, বিনোদন, ক্রীড়া, কৌতুক, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম-কর্ম, সমাজ-সংসারের বাস্তব রূপ ছাড়াও কল্পনা এবং মনোবিজ্ঞানের এমন সব উপাখ্যান আজ থেকে আড়াই হাজার বছর পূর্বে রচিত একটি গ্রন্থে এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে যা আধুনিককালের মানুষকে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেয়।
মহাভারতের বর্ণিত সর্বশেষ প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধটি যে ময়দানে সংঘটিত হয়েছিল সেটির নাম কুরুক্ষেত্র। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটি কেবল নিছক সাহিত্যকর্ম নয় তা দুনিয়ার তাবৎ ইতিহাসবেত্তা একবাক্যে স্বীকার করেছেন। অর্থাৎ কুরুক্ষেত্রের ময়দানে যুদ্ধ হয়েছিল এবং সেই যুদ্ধের ফলে সমগ্র ভারতবর্ষের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তা কাটিয়ে উঠতে কয়েক শত বছর লেগেছিল। বাংলার ইতিহাসের প্রথম রাজা জগদত্ত কুরুক্ষেত্রে গিয়েছিলেন কৌরবদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করতে এবং স্ববংশে পরাজিত ও নিহত হয়ে বাংলাকে এমন বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন যার কারণে জগদত্তের পতন ও পরাজয়-পরবর্তী কয়েক শ’ বছরের মধ্যে কোনো রাজা বা রাজবংশের নাম-গন্ধ পর্যন্ত ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না।
বাংলার প্রথম রাজার যুদ্ধে পরাজিত হবার ইতিহাস এবং অন্যায় ও অন্যান্য পক্ষ হিসেবে চিহ্নিত কৌরব বংশের পক্ষে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্তের মধ্যেই আমাদের জাতিগত ভ্রান্তি- পরাজিত হবার প্রবল আগ্রহ এবং উড়ে গিয়ে উইপোকার মতো মরে যাওয়ার বাসনার মতো আত্মঘাতী মনোবৃত্তি বাঙালি যে কোনোকালে ছাড়তে পারেনি তা ইতিহাসের সন্ধিক্ষণগুলোতে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। রাজা জগদত্তের আমল থেকে আজ অবধি আপনি যদি রাজ্য-রাজা-রাজধানীর ইতিহাস পর্যালোচনা করেন তবে দেখতে পাবেন যে, ক্ষমতা মানুষকে কীভাবে অন্ধ বানিয়ে দেয়, কীভাবে তাদের মনুষত্ব কেড়ে নেয়, কীভাবে তাদের বেহায়া-বেশরম-বেপর্দা এবং বিরক্তিকর প্রাণীতে পরিণত করে ফেলে।
আমরা যদি ২০২৩ সালের বাংলাদেশের রাজনীতি পর্যালোচনা করি তবে দেখতে পাবো যে, একটি পক্ষ মিথ্যাচারকে তাদের অলঙ্কার বানিয়ে ফেলেছে। তাদের মনে বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে যে, মিথ্যা না বললে তাদের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে না। মিথ্যার পোশাক না পরলে তাদের আব্রæ রক্ষা হয় না এবং মিথ্যার রং মিথ্যার ঢং ও মিথ্যার গন্ধ শরীরের সঙ্গে যুক্ত না করলে তাদের হয়তো হারাম পশুদের মতো মনে হয়। এ জন্য তারা পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করে মিথ্যাচার করে। তারা মিথ্যার বেসাতি সাজিয়ে মিথ্যা ও ভাঁওতাবাজির বাণিজ্যে সফলতা লাভের জন্য মিথ্যার টনিক বানিয়ে হররোজ পান না করলে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পায় না। মিথ্যা নাটক- মিথ্যা পুস্তক- মিথ্যা শপথ এবং মিথ্যার মুকুট মাথায় পরে তারা মিথ্যার মঞ্চে উলঙ্গ নৃত্য করে জীবনের সফলতার মাইলফলক স্থাপন করতে চায়।
কুরুক্ষেত্রের কৌরবদের মতো হাল ফ্যাশনের ক্ষমতাধররা প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি এবং জুয়া-জোচ্চুরির মাধ্যমে ক্ষমতা লাভ, ক্ষমতা ভোগ এবং প্রতিপক্ষের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ব্রহ্মাস্ত্রের খোঁজে দুনিয়া তোলপাড় করছে। কৌরব সেনাপতি কর্ণ ব্রহ্মাস্ত্র হাসিলের জন্য যেভাবে অস্ত্রগুরু দ্রোনাচার্যের সঙ্গে প্রতারণা করে অভিশপ্ত হয়েছিল এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নির্মমভাবে মারা পড়েছিল ঠিক একইভাবে হাল আমলের কৌরবরা তাদের সব কুকর্ম দ্বারা এমনভাবে ঘেরাও হয়ে পড়েছে যে, পৃথিবীর কোনো অব্যর্থ ব্রহ্মাস্ত্র দ্বারা তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
মহাভারতে বর্ণিত ভিলেনরা নীতি নৈতিকতায় এবং বীরত্বে তাদের প্রতিপক্ষ পান্ডবদের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। পঞ্চ পান্ডবের বীরত্ব সাধারণ মানুষের সমর্থন এবং সারা ভারতের সামন্ত রাজাদের সমর্থনের পাশাপাশি দেবতাদের আশীর্বাদ তথা প্রকৃতির আনুকূল্যে কুরুক্ষেত্রের ময়দানটি দুর্যোধনদের জন্য মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছিল। কুরুক্ষেত্রের ময়দানে পতনের পূর্বে দুর্যোধনদের তাণ্ডব বন্ধ করার জন্য স্বয়ং দেবতারা মর্তে নেমে এসেছিলেন। কিন্তু কোনো দ্বৈববাণী কিংবা দেবতাদের দূতিয়ালী কৌরবদের অহমিকা রোধ করে ন্যায়ের পথে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। ফলে একটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দুটো মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রথমটি ছিল উভয়পক্ষের সেনাপতিরা একই গুরুর শিষ্য ছিলেন। অর্থাৎ অস্ত্র গুরু দ্রোনাচার্যের নিকট কৌরব ও পান্ডব রাজপুত্ররা শৈশব-কৈশোর ও যৌবনে অস্ত্র চালনা শিখেছিলেন। দ্বিতীয়ত, তারা ছিলেন একই অঞ্চলের বাসিন্দা এবং রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয়। যুদ্ধের একটি সাধারণ নিয়ম হলো- যুদ্ধরত প্রতিপক্ষ বিশেষ করে আক্রমণকারীরা যদি ভিনদেশী হয় তবে যুদ্ধের ময়দানে দুই ধরনের দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। ক্ষমতায় থাকা রাজা-বাদশাহরা যদি যোগ্য ও জনপ্রিয় হন তবে সারা দেশের জনগণ তাদের পক্ষে থাকে। ফলে আক্রমণকারীরা কোনোকালেই সুবিধা করতে পারে না। অন্য দিকে, ক্ষমতাধররা যদি কৌরবদের মতো চরিত্রহীন, নিপীড়ক এবং জনবিচ্ছিন্ন হন তবে জনগণ বিদেশী আক্রমণকারীদের স্বাগত জানায় এবং প্রায় সব ক্ষেত্রে আক্রমণকারীদের হাতে নিপীড়কদের পতন হয়।
যুদ্ধের ময়দানটি যদি কুরুক্ষেত্রের মতো হয়- অর্থাৎ যেখানে ভিনদেশী কোনো আক্রমণকারী থাকে না এবং যেখানে যুদ্ধরত উভয়পক্ষ একই ভূখণ্ডের বাসিন্দা সেখানে সাধারণ জনগণ বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং সবাই অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং প্রতিপক্ষের শেষ প্রাণীটিকে কবরে না পাঠানো পর্যন্ত অথবা নিজে মৃত্যুর কোলে ঢলে না পড়া পর্যন্ত যুদ্ধ থামে না।
মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের উল্লেখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যদি ২০২৩ সালের জুলাই মাসের বাংলাদেশের রাজনীতি পর্যালোচনা করি তবে দেখতে পাবো যে, পুরো দেশ দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক পক্ষে রয়েছে ক্ষমতার মধু মেওয়া ভোগকারী বিশাল এক গোষ্ঠী, যারা গত ১৫ বছর ধরে সব রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগের পাশাপাশি রাজনীতির কালো পথে সেসব সুবিধা দুনিয়াব্যাপী নিন্দা কুড়ায় সেগুলোও গলধকরণ করেছে জলহস্তির মতো। ঘুষ-দুর্নীতি, নিয়োগ-বদলি, লুটপাট-রাহাজানি, দখল-চাঁদাবাজির মতো আর্থিক অপরাধ করে তারা দেশ-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে এবং সারা দুনিয়াতে তাদের মন্দকর্মের দুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে পৃথিবীর সভ্য লোকেরা নিজেদের দেশ জাতিকে সেই দুর্গন্ধের কবর থেকে রক্ষা করার জন্য গলদঘর্ম পরিশ্রম করছে।
ক্ষমতার কালো মানিকের দল অবৈধ আয় রোজগারের তেল চর্বিতে অবগাহন করতে করতে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য ভুলে গেছে। তাদের ক্ষুণ্ণিবৃত্তির প্রাথমিক পর্ব শেষ হওয়ার পর পাশবিক লালসা তাদের ভয়ঙ্কর প্রাণীতে পরিণত করে ফেলেছে। প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানো, সবাইকে সন্দেহ করা, নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠতর এবং বাকিদেরকে নিকৃষ্টতর ভাবা, প্রতিপক্ষের ওপর পাশবিক জুলুম অত্যাচার চালানোকে এক ধরনের বিনোদন কর্মে পরিণত করা এবং অন্যের নিকট গচ্ছিত মূল্যবান ও আকর্ষণীয় বস্তু জোর জবরদস্তি করে অপহরণ করা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ফলে রাজনীতির ময়দানে যত ব্যাকরণ রয়েছে সব উলোট পালট হয়ে পুরো ময়দানকে কুরুক্ষেত্রের ময়দানের মতো ভয়ঙ্কর বানিয়ে ফেলেছে। এ অবস্থায় ২০২৩ সালের শেষের দিকে আমাদের গাঙ্গেয় ব-দ্বীপটির অবস্থা কী হবে তা নিয়ে সাধারণ জনগণ, প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহ এবং বিশ্ব মোড়লরা পর্যন্ত চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছে।
Daily Nayadiganta
By Golam Maula Rony
--------------------------------------------------
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
0 Comments